![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার “স্পর্শের পাপ” এ যারা চোখ বুলিয়েছিলেন বোধকরি তাদের সবারই আমার সেই সবিতার কথা কমবেশি মনে আছে। আজ আমি সবিতার গল্প বলতে আসিনি। আজ বলতে এসেছি , সবিতার মেজদা এবং আমার বাল্যবন্ধু পবিত্র’র গল্প। সবিতার তিনটে ভাই আছে। বড়টার নাম সৌমিত্র, মেজটা পবিত্র আর সবচে ছোট যে, তার নাম আদিত্য। সবিতার এই বড়দা মানে সৌমিত্রদা আমাকে দুই চোখে দেখতে পারতেন না। তার সামনে পড়লেই আমার কানমলা খাওয়া অবধারিত ছিল। অঞ্জন দত্তের সেই “রঞ্জনা আমি আর আসবনা” গানের কথা আপনাদের মনে আছে কি? “বুঝব কীকরে আমি ওতোমার ঐ মেজদাদা শুধু যে তোমার দাদা নয়/// আরও কত দাদাগিরি কব্জির কারিগরি করে তার দিন কেটে যায়”। ছোটবেলায় আমার মনে হত অঞ্জন দত্ত যেন এই গানটা সৌমিত্রদাকে ভেবেই লিখেছিলেন। শুধু মেজদাদার জায়গায় বড়দাদা হবে আর কি!
আগেই বলেছি আজকের গল্পের নায়ক পবিত্র কুমার চক্রবর্তী। যাকে আমরা স্কুলে পকুচ(পবিত্র কুমার চক্রবর্তী) বলে ডাকতাম। পবিত্র আমাদের ফুটবল টীমের গোলকিপার ছিল। আর ক্রিকেট টীমের ছিল উইকেট কিপার। ও ছিল ওর জায়গায় অসাধারণ। বিজ্ঞ বিশ্লেষকের মত করে ও বলত, “ গোল কিপিং হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে অবহেলিত কাজ। তুই দশটা নিশ্চিত গোল ঠেকাবি। পাবলিক কইব, ঐডা করা তোর কাম, দায়িত্ব। আর একটা গোল খাইলেই পাবলিক কইব- সব দোষ গোলকিপারের। ভাল কাম করলে হাততালি তো পাবিইনা, আবার ঘাপলা করলে পাবলিকের থুথু খাবি।” আজও মনে আছে আমি আমার সেই দলছুট কৈশোরে মন্ত্রমুগ্ধের মত পবিত্র’র ওই কথাগুলা শুনতাম। কথা দিয়ে মানুষকে সম্মোহিত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল ওর।
পবিত্র তার পরিবারে খুবই অজনপ্রিয় ছিল। মা-বাবা, ভাই-বোন কেউ ওকে ভাল চোখে দেখত না। বাড়ীতে সে ছিল ভিলেন, কিন্তু বাড়ির বাইরে বন্ধু মহলে ছিল হিরো। পবিত্র প্রচুর সিগারেট খেত (মাঝে মাঝে গাঁজাও)। জীবনেও কোনদিন ক্লাসের বই ভুল করেও খুলে দেখত না। পাড়ার-স্কুলের-কলেজের সমবয়সী সিনিয়র জুনিয়র এমন কোন মেয়ে ছিল না যাকে সে প্রপোজ করে নাই। খিস্তি ছাড়া একটা পুরো বাক্য সে বলতে পারতো না। আমাকে একদিন স্কুলে এসে পবিত্র জিজ্ঞেস করল, “ওই *** ভাই! তুই নাকি আমার বইনের লগে লাইন মারস? বড়দা টের পাইলে কিন্তু তোর *** মারবো কইলাম”
আমার স্কুল-কলেজ দুটোই পবিত্র’র সাথে। পবিত্র’র সাথে ভাব থাকার কারণে আমার বন্ধু-শত্রু দুটোই বেড়ে গিয়েছিল। অনেকে আবার আড়ালে বলত, পবিত্র’র সাথে নাকি আমি ভাব রাখি, তার বোনকে হাতে রাখার জন্য। যাই হোক, ইন্টারমিডিয়েট পাশ করবার পর আমার আর পবিত্র’র দুটি পথ দুই দিকে বেঁকে গেল। পবিত্র একগুঁয়েমি করে একটি অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হল। আমার চেয়ে অনেক ভাল রেজাল্ট থাকা সত্ত্বেও সে কোন সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনকি ভর্তি পরীক্ষা পর্যন্ত দেয়নি।
দিন চলে যেতে থাকে তার নিয়মে। কমতে থাকে আমাদের যোগাযোগ। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আমাদের দূরত্ব। ঈদে- পূজায় ছুটি গেলে দেখা হয়। একটু আধটু ঘুরাফেরা হয়। কিন্তু বেশ বুঝতে পারি, আগের সেই আবেগ আর নেই। আগের সেই উন্মাদনা কোথায় যেন খেই হারিয়ে ফেলেছে।
জানতে পারি, পবিত্র দ্রুত বদলাতে থাকে।ওর গাঁজা খাওয়া বেড়ে যায়। সাথে সম্ভবত আরও কিছু। ভাত খাওয়ার বদলে ও অখাদ্য খাওয়া শুরু করে। ওর খিটখিটে শরীরটা দিনদিন কঙ্কালসারে রুপান্তরিত হয়। ওকে নিষেধ করবার কেউ নেই। ও কারো কথা শোনেও না। কেউ কিছু উপদেশ দিতে গেলেই সেই চিরাচরিত খিস্তি। একবার যে সেই খিস্তি শুনেছে সে আর কোনদিন ওর ছায়াও মারাতে চাইবে না।
ঠিক এই সময়টাতে পবিত্র প্রেমে পড়ে। প্রেমে সে আগেও অনেকবার পড়েছে, কিন্তু এই প্রথম সে অন্যপক্ষের সাড়া পায়। মেয়েটার নাম খুব সম্ভবতঃ “মিলি” টাইপ কিছু হবে। সহজ সরল গ্রাম্য মেয়ে। মুসলিম পরিবারে জন্ম। পবিত্র মেয়েটাকে ওর সম্মোহনী বক্তৃতা দিয়ে আকৃষ্ট করে। ওরা খুব তাড়াহুড়ো করে বিয়েও করে ফেলে। এবং সঙ্গতঃ কারনেই এ বিয়ে ছিল দুই পরিবারেরই সম্মতি ছাড়া। ওদের মধ্যে চুক্তি ছিল শুধুমাত্র বিয়ে করবার জন্য পবিত্র একটি মুসলিম নাম ব্যাবহার করবে এবং পরবর্তীতে যে যার ধর্ম পালন করবে।
ওদের সেই স্বপ্নের বাসরে খুব দ্রুত নিয়তির অবতার এসে কড়া নাড়ে। মেয়েটার বাবা তার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এবং পুলিশের সাহায্য নিয়ে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যায়। এবং গোটা তিনেক মামলা (অপহরন ও নারী নির্যাতন মামলাসহ) দিয়ে পবিত্রকে সাত মাসের জন্য চৌদ্দ শিকেয় পুরে রাখা হয়। ইতিমধ্যে মেয়েটাকে জোরপূর্বক অন্যত্র বিয়েও দেয়া হয়। বিয়ের দুই দিনের মাথায় মেয়েটা গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে।
আজ থেকে বছর তিনেক আগে পবিত্র জেল থেকে ছাড়া পায়। এবং সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। আমি ঈদের ছুটিতে বাড়ীতে যাই। প্রায় আট বছর পরে ওদের বাড়ীতে ঢুকি আমি। ততদিনে সবিতা অন্য ঘরে। সবিতার বড়দা বিয়ে করে বাচ্চা কাচ্চার মানুষ হয়ে সেই মেজদাদার খোলস থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমার আর কিসের সংকোচ ও বাড়ীতে ঢুকতে? তবুও আমি পা টিপে টিপে সন্ধ্যার পর আবছা অন্ধকারে পবিত্র’র ঘরের দিকে এগিয়ে যাই। ওর ঘরের কাছাকাছি পৌঁছাতেই সারা ঘরময় সেই অখাদ্যের দুর্গন্ধ অনুভব করি।
ওর ঘরটা খোলাই ছিল। ও একটা বিছানাহীন চৌকির ওপর সটান শুয়ে আছে। আমি খুব সন্ত্রস্থ বুক আর কাঁপা গলায় ওকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছিস? আমার আগমন টের পেয়ে সে ভয়ানক খিস্তি আরম্ভ করে দেয়। “পাগল দেখতে আইচস? আমি পাগল হইলে তুইও শালা পাগল। তোর গুষ্টিসমেত পাগল। আমি হিঁদু পাগল। আর তুই মোসলমান পাগল” এই সব। আরও অনেক কিছু, যার ধারাবিবরণী বাংলা ভাষায় লেখা সম্ভব না। ওর চিৎকার শুনে সৌমিত্রদা ছুটে আসে। এসেই ওকে অমানসিকভাবে মারতে শুরু করে। আমি সৌমিত্রদাকে পেছন থেকে ধরে প্রাণপণ চেষ্টা করলাম তাকে ঠেকাতে। কিন্তু সৌমিত্রদার শক্তি আর ব্যক্তিত্বের কাছে আমি বরাবরের মত এবারও হার মানলাম। সে সমানে চর, থাপ্পড়, কিল, লাথি, ঘুষি চালাতে লাগল। বাজারে চোর ধরা পরলেও এভাবে কেউ পেটায় না। শুরুতে মৌখিক খিস্তি এবং হাত পা ছুঁড়ে পবিত্র নিজেও প্রতিরোধের সমস্ত চেষ্টা করল। অবশেষে একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে বিছানায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে দিল। এবং বারবার “বড়দা আর মারিস না” “মরে গেলাম” বলে কাতরাতে লাগল। সৌমিত্রদা মনেহয় ততক্ষণে ক্লান্ত হয়েছে। পবিত্র’র দুই হাতে ও দুই পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে এবং তাতে তালা লাগিয়ে সে গজগজ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার আগে বাজখাই গলায় হাঁক দিয়ে গেলো, “সুমন! পাগল দেখার কী আছে? বাড়ি যা, ও এখন ঘুমাইব।”
আমি আমার বুকের বাম পাশে প্রচণ্ড ব্যাথা অনুভব করছি। ওখানে কিছু একটা দিয়ে যেন অবিশ্রাম হাতুড়ী পেটানো হচ্ছে। আমি সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থানে উদ্যত হলাম। কিন্তু একি! আমি যে আমার পা মাটি থেকে টেনে ওঠাতে পারছিনা। যেন আমার পায়েও কেউ পবিত্র’র মত লোহার শিকল আর তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে। তার মানে আমিও কি পাগল? পবিত্র’র ভাষায় সেই তথাকথিত মোসলমান পাগল?
©somewhere in net ltd.
১|
১৫ ই অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ১০:১২
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: ++++++++++
চমৎকার । লিখনি যেমন ভালো লাগলো ,তেমন কষ্ট পেলাম ।
ভালো থাকবেন ।