নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি আমারি মত.................।

তাজ - সৈয়দাবাদী ।

শিক্ষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, এম পিও ভুক্ত কলেজ

তাজ - সৈয়দাবাদী । › বিস্তারিত পোস্টঃ

দেশের বাইরে দেশ :

১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:২৯

মুহম্মদ জাফর ইকবাল

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক | 05-06-2015


1

দেশের বাইরে দেশ : মুহম্মদ জাফর ইকবাল পৃথিবীর অন্য সব মানুষের মতোই আমারও বেড়াতে খুব ভালো লাগে। যত সময় যাচ্ছে নানা কাজে ততই ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছি আর আমার ঘুরে বেড়ানোর জগৎটি ততই ছোট হয়ে যাচ্ছে ভেবে একটু মন খারাপ হয়।

প্রথম প্রথম যখন নানা ধরনের অলিম্পিয়াড শুরু করা হয়েছিল তখন সেগুলো দাঁড় করানোর জন্য সব জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। ট্রেনের একটা বগিতে কিংবা একটা মাইক্রোবাসে সবাই মিলে গাদাগাদি করে বসে এ দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর মতো আনন্দ আর কোথায় পাওয়া যাবে! সাধারণত যাদের সঙ্গে যাই, তারা প্রায় সবাই কম বয়সী তরুণ, কোথায় থাকব, কী খাব- সেগুলো নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাতে হয় না, তাদের ঘাড়ে সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে আমি ঘুরে বেড়ানোর আনন্দটা উপভোগ করি।



কিন্তু যখন দেশের বাইরে যেতে হয় তখন হঠাৎ করে ঘুরে বেড়ানোর বিষয়টি আনন্দের বদলে কেমন জানি বিভীষিকার মতো হয়ে ওঠে। বিদেশে যেতে হলে ভিসা নিতে হয়, বাংলাদেশের মানুষকে ভিসা নিতে হলে যে অসম্মানের ভেতর দিয়ে যেতে হয় সে রকমটি মনে হয় আর কোনো দেশের মানুষকে সহ্য করতে হয় না। এই অসম্মানগুলো যে শুধু সাদা চামড়ার বিদেশি মানুষেরা করে তা নয়, এমবাসি বা হাইকমিশনের বাংলাদেশি দারোয়ান, কর্মচারী বা নিরাপত্তাকর্মীরাও দুর্ব্যবহার করা শিখে যায়। আমি মোটামুটিভাবে নিশ্চিত, এ দেশের মানুষ যারাই বিদেশে যাওয়ার জন্য কোনো না কোনো দেশের ভিসা নিতে গেছে, তাদের সবারই কোনো না কোনোভাবে অসম্মানিত বোধ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। এই গরমের ছুটিতে আমার নেদারল্যান্ডস যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল, প্লেনে ওঠার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে পাসপোর্ট-ভিসা পেয়েছি। ভিসা প্রক্রিয়া করার মানুষজন আমাকে চিনে তাঁদের নিয়ম ভেঙে কয়েক ঘণ্টা আগে আমার হাতে পাসপোর্ট তুলে দিতে রাজি হয়েছিলেন বলে আসলে শেষ পর্যন্ত প্লেনে উঠতে পেরেছিলাম। সবার এ রকম সৌভাগ্য হয় না- আমাদের ছাত্র অনন্ত ঠিক আমার মতোই ভিসা নিতে গিয়েছিল, সে ভিসা পায়নি বলে জঙ্গিরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করার সুযোগ পেয়েছিল। বাকি জীবন আমি যখনই কোনো দেশের ভিসা নিতে যাব আমার এ ঘটনার কথা মনে পড়বে এবং আমি এক ধরনের ক্ষোভ অনুভব করব।



দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারটি আমার জন্য অনেক সহজ হয়েছে, ই-টিকিট হওয়ার কারণে আজকাল শুধু পাসপোর্ট নিয়ে রওনা দেওয়া যায়। কয়েক বছর আগে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার সময় আবিষ্কার করেছিলাম সে দেশের ভিসাটিও ডিজিটাল, অর্থাৎ পাসপোর্টে ছাপ মারতে হয় না। আমি জীবনে প্রথমবার যখন দেশের বাইরে যাওয়ার সময় প্লেনে উঠেছিলাম তখন দেশের অর্থনীতির অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। কেউ বিশ্বাস করবে কি না জানি না। তখন মাত্র ১০ ডলার হাতে নিয়ে রওনা দিতে হতো। এখন কেউ যদি 'মালদার পার্টি' হয় সে সাত হাজার ডলার নিয়ে রওনা দিতে পারে! যা-ই হোক, এ রকম নানা ধরনের সুবিধা থাকার পরও আমি সব সময়ই দুরুদুরু বক্ষে যাত্রা শুরু করি।



আমাদের দেশের বিদেশ যাওয়ার যাত্রীদের বেশির ভাগই হচ্ছে প্রবাসী শ্রমিক। কাজেই যখনই আমরা প্লেনে উঠতে যাই, সব সময়ই আমরা তাদের দেখা পাই। একটি সময় ছিল যখন তাদের অনেকেই ইমিগ্রেশনের কার্ডটিও ঠিক করে পূরণ করতে পারত না। আমি যতবার গেছি অসংখ্য শ্রমিকের কার্ড পূরণ করে দিয়েছি, আজকাল সেটি করতে হয় না। এই প্রবাসী শ্রমিকদের দেখে আমি সব সময়ই একটু কষ্ট অনুভব করি। আপনজনদের দেশে রেখে তারা একা একা বিদেশে পাড়ি দেয়। সাধারণ একজন শ্রমিক হিসেবে নির্বান্ধব সেই দেশগুলোতে তাদের নিশ্চয়ই খুব নিরানন্দ একটি জীবন কাটাতে হয়।



এই গরমের ছুটিতে আমার ও আমার স্ত্রীর নেদারল্যান্ডস যাওয়ার কথা। যখনই আমার কোথাও প্লেনে যেতে হয় আমি এক ধরনের দুর্ভাবনায় থাকি যে কিছু একটা ঝামেলার কারণে আমার ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে! তাই সব সময়ই অনেক আগেভাগে এয়ারপোর্টে গিয়ে বসে থাকি। এবারও গেছি এবং গিয়ে দেখেছি আমার আগেই অসংখ্য যাত্রী লাইনে এসে দাঁড়িয়েছে। একনজর দেখেই বোঝা যায়, তাদের প্রায় সবাই প্রবাসী শ্রমিক। এই শ্রমিকরা যখন একটু একটু করে লাইন ধরে অগ্রসর হচ্ছে তখন এয়ারলাইনসের একজন কর্মকর্তা আমাকে ও আমার স্ত্রীকে লাইন থেকে বের করে নিয়ে ফার্স্টক্লাস ও বিজনেস ক্লাস প্যাসেঞ্জারদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। যখন সবাই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে তখন তাদের সবাইকে ডিঙিয়ে আগে চলে যাওয়ার বিষয়টি আমাদের খুব বিব্রত করে; কিন্তু এ ধরনের ঘটনা আমার জন্য নতুন নয় এবং অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এখানে আপত্তি করে লাভ হয় না এবং চেষ্টা করলে পরিবেশটা আরো বিব্রতকর হয়ে যায়।



তবে সত্যিকার বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হলাম যখন আমরা প্লেনে উঠছি তখন। বড় প্লেনে পেছন থেকে যাত্রী বোঝাই করে আনা হয়, সেটি করার জন্য সিট নম্বর ধরে যাত্রীদের ডাকা হয়। প্রবাসী শ্রমিকদের অনেকে সেটা ধরতে পারে না এবং কেউ কেউ তাদের ডাকার আগেই প্লেনে ওঠার চেষ্টা করে। এটি এমন কিছু গুরুতর বিষয় নয় এবং এক-দুজন তাদের ডাকার আগেই প্লেনে উঠে গেলে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। এমিরেটসের সেই ফ্লাইটে মনে হলো, এতে তাদের মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল এবং তাদের কর্মকর্তা একজন যাত্রীকে যাচ্ছেতাইভাবে বকাবকি শুরু করে দিলেন। অপ্রস্তুত কম বয়সী সেই শ্রমিক মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, 'সরি।' আর যায় কোথায়, এমিরেটসের সেই কর্মকর্তা একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, বললেন, 'আপনি যে সরি বলেছেন, সরি বানান করতে পারবেন?'



হকচকিত সেই শ্রমিক অবাক হয়ে সেই কর্মকর্তার দিকে তাকিয়ে রইল। প্রবাসী সেই শ্রমিককে সবার সামনে অপমান করেই ভদ্রলোক থেমে গেলেন না, তাকে টেনে একটা চেয়ারে বসিয়ে নানা রকম অপমানসূচক কথা বলতে বলতে তাকে জানালেন, যে যতক্ষণ পর্যন্ত সরি শব্দটি ইংরেজিতে বানান করতে পারবে না ততক্ষণ তাকে প্লেনে উঠতে দেওয়া হবে না।



অসংখ্য যাত্রীর সামনে এই উৎকট-বীভৎস নাটকটি করা হচ্ছে এবং আমি জানি, আমাকে এই নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। সে জন্য অসংখ্য মানুষের সামনে আমাকে এখন এই নাটকে অংশ নিতে হবে। বাস্তবজীবনের এ ধরনের নাটকে আমি অংশ নিতে চাই না। দিগন্ত টেলিভিশনের একজন সাংবাদিক একবার আমার ইন্টারভিউ নিতে চেয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম যে রাজাকার টাইপ টেলিভিশন চ্যানেলে আমি ইন্টারভিউ দিই না। যদি সে কখনো অন্য চ্যানেলে চাকরি নেয়, আমি তাকে খুঁজে বের করে ইন্টারভিউ দেব। কিছুদিন পর আমি খবর পেলাম আমার সেই বক্তব্য ইউটিউবে দেখানো হচ্ছে এবং সুশীল বুদ্ধিজীবী সমাজ আমার এই 'সংকীর্ণ' দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আমাকে নানাভাবে গালমন্দ করছে। এমিরেটস এয়ারলাইনসের বোর্ডিং গেটে আমি যে নাটকে অংশ নিতে যাচ্ছি সেটাও হয়তো কাল-পরশু ইউটিউবে দেখানো হবে।



আমি ও আমার স্ত্রী যখন যাত্রীদের পিছু পিছু এগিয়ে যাচ্ছি তখন হঠাৎ করে দেখলাম একজন মহিলা যাত্রী দাঁড়িয়ে গিয়ে এমিরেটসের কর্মকর্তাকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করলেন, আমি যে ভাষায় বলতাম তার থেকে আরো অনেক গুছিয়ে এবং আরো অনেক তীক্ষ্ন ভঙ্গিতে। শুধু তা-ই নয়, সেই মহিলা ঘোষণা করলেন, 'আপনাকে এই মুহূর্তে এই যাত্রীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।'



দেশের বাইরে দেশ



এমিরেটসের কর্মকর্তা সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীর হাত ধরে ক্ষমা চাইতে শুরু করলেন। ভদ্রমহিলা গেট দিয়ে চলে যাওয়ার পর এমিরেটসের কর্মকর্তা মুহূর্তে আগের রূপে ফিরে গেলেন। চেয়ারে কাঁচুমাচুভাবে বসে থাকা প্রবাসী শ্রমিককে হুংকার দিয়ে বললেন, 'এই মহিলা ইন্ডিয়ান! ইন্ডিয়ান মহিলা বাংলাদেশের কী জানে? কিছু জানে না!' ইত্যাদি ইত্যাদি (আসলে তিনি মোটেও ইন্ডিয়ান মহিলা ছিলেন না, তিনি বাংলাদেশের এবং প্লেনের ভেতরে তাঁর সঙ্গে পরে কথা হয়েছে)।



যা-ই হোক, আমি যখন শেষ পর্যন্ত কাঁচুমাচুভাবে বসে থাকা প্রবাসী শ্রমিকের কাছে পৌঁছলাম তখন এমিরেটসের সেই কর্মকর্তা আমাকে দেখতে পেলেন, চিনতে পারলেন এবং আমার জন্য কিছু করতে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমি তাঁকে উপেক্ষা করে চেয়ারে অপরাধীর মতো বসে থাকা কম বয়সী প্রবাসী শ্রমিকটির পিঠে হাত রেখে বললাম, 'দেখেন, আপনার মোটেই সরি শব্দটির বানান জানার প্রয়োজন নেই। এই ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছেন আমি তার জন্য ক্ষমা চাই। আপনারা বিদেশে গিয়ে কষ্ট করে টাকা রোজগার করে দেশে পাঠান বলে আমাদের দেশের অবস্থা এত ভালো হয়েছে- আপনি আসেন, প্লেনে ওঠেন' ইত্যাদি ইত্যাদি।



একটু পরেই সেই কর্মকর্তা প্লেনের দরজার কাছাকাছি এসে আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করলেন, আমি তাঁকে বললাম, আমাদের দেশের জিডিপি এখন ১৩০০ ডলার হয়েছে, ব্যাংকের রিজার্ভ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। তার কারণ হচ্ছে এই প্রবাসী শ্রমিকরা তাদের জীবনপাত করে বিদেশে পরিশ্রম করে। যখন দেখি, তাদের কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে অসম্মান করা হয়, সেটি আমাদের খুব ব্যথিত করে। ভদ্রলোক আমার কথাটি শুনলেন কিন্তু বিশ্বাস করলেন কি না বুঝতে পারলাম না- এই তুচ্ছ প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে তাঁর খুব একটা মাথাব্যথা নেই, তিনি আমাকে খুশি করার জন্য ব্যস্ত।



প্লেনে ঢুকে আমি ও আমার স্ত্রী আমাদের সিট খুঁজে বের করে বসেছি, তখন এমিরেটসের সেই কর্মকর্তা সারা প্লেন খুঁজে আমাদের বের করে আবার আমার কাছে তাঁর ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করলেন, আমি আবার তাঁকে বললাম, আমাদের আলাদাভাবে সম্মান দেখানোর কিছু প্রয়োজন নেই। আমরা আমাদের মতো চলতে-ফিরতে পারি। যারা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে তাদের একটু সাহায্য দরকার, তাদের একটুখানি সম্মান দরকার। ভদ্রলোক আমার কথাটি বুঝতে পারলেন কি না আমি বুঝতে পারলাম না।



প্লেনে বসে আমি চারদিকে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেছি প্রায় সবই বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক। প্লেনের কেবিন ক্রু কিংবা এয়ার হোস্টেসের একজনও কিন্তু বাংলায় কথা বলতে পারে না। এই দেশের প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্ট করে উপার্জন করা লাখ লাখ টাকা এই এয়ারলাইনসগুলো নিয়ে নিচ্ছে; কিন্তু তাদের সাহায্য করার জন্য কোনো মাথাব্যথা নেই। বাংলাদেশের অংশটুকু পার হয়ে আমি যেই মুহূর্তে অন্য দেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সেই দেশের ভাষায় কথা বলতে পারে সে রকম কেবিন ক্রু প্লেনে যাত্রীদের সেবা করার জন্য উঠে এসেছে। আমাদের এই প্রবাসী শ্রমিকরা কারো দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করে এই প্লেনে ওঠেনি, তারা শতভাগ মূল্য দিয়ে এই টিকিট কিনেছে, তাহলে তারা পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের যাত্রীদের মতো প্রাপ্য সেবাটুকু পাবে না কেন?



২.



এয়ারপোর্টে প্রবাসী শ্রমিক নিয়ে আমার অভিজ্ঞতাটুকু কিন্তু মোটেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আমরা যারাই বিদেশে কোথাও যাওয়ার জন্য কখনো না কখনো প্লেনে উঠেছি, তারা সবাই কোনো না কোনোরূপে এ ঘটনাগুলো দেখেছি। শুধু যে বিদেশি এয়ারলাইনসের কর্মচারী-কর্মকর্তারা আমাদের দেশের প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার কিংবা অসম্মান করেন তা নয়, আমাদের দেশের মানুষদের হাতেও তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে হেনস্তা হতে হয়। আমি একবার ফিলিপাইন গিয়েছিলাম, ফিলিপাইনেরও অসংখ্য শ্রমিক বাইরে কাজ করে, তাদের দেশের অর্থনীতিকে সাহায্য করে। সেই দেশের মানুষ অকৃতজ্ঞ নয়, তারা তাদের দেশের প্রবাসী শ্রমিকদের সুবিধার জন্য এয়ারপোর্টে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে একটা ব্যবস্থা করে রেখেছে। আমরা আমাদের দেশে কেন সে রকম কিছু করতে পারি না? যারা শরীরের ঘাম পায়ে ফেলে আমাদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা আনছে, যে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রেডিট কার্ডে ভরে আমরা দেশ-বিদেশে ফুর্তি করে বেড়াই, সেই শ্রমিকদের আমরা প্রাপ্য সম্মানটুকু দেব না- সেটা তো হতে পারে না।



আমি যত দূর জানি, আমাদের দেশের ৮০ লাখ থেকে এক কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করে। সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ে- এ রকম ইউরোপের দেশের জনসংখ্যা আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা থেকে কম! অন্যভাবে বলা যায়, আমাদের বাংলাদেশ নামে যে রকম একটা ভূখণ্ড আছে, একটি দেশ আছে, দেশের মাটি আছে তার বাইরেও আমাদের আরো একটি বাংলাদেশ আছে। সেই দেশের মাটি নেই কিন্তু সেই দেশের মানুষ আছে। দেশের বাইরের সেই দেশ কি আমাদের বিশাল একটি সম্পদ নয়? সেই সম্পদকে কেন আমরা এভাবে অবহেলা করি?



আমাদের নিজস্ব একটি এয়ারলাইনস আছে, পত্রপত্রিকা পড়লে মনে হয় এই এয়ারলাইনস তৈরি হয়েছে সোনা চোরাচালান করার জন্য। প্রায় প্রতিদিনই দেখতে পাই দেশের কোনো না কোনো এয়ারপোর্টে সোনার চোরাচালান ধরা পড়ছে। কোনো রকম গবেষণা না করেই বলে দেওয়া যায়, বিশাল এই চোরাচালানের খুব ছোট একটি অংশ ধরা পড়ে। কাজেই আমাদের সবার অগোচরে নিশ্চয়ই বিশাল একটা চোরাচালান হচ্ছে, খবরের কাগজ পড়লেই বোঝা যায়, এটি বিচ্ছিন্ন একজন যাত্রীর কাজ নয়, এটি পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার।



অথচ একেবারে কমন সেন্স দিয়ে বলে দেওয়া যায়, আমাদের নিজস্ব এয়ারলাইনস যদি ঠিক করে যে তারা শুধু আমাদের প্রবাসী শ্রমিকদের আনা-নেওয়া করবে, তাহলেই তাদের আর অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি অর্থনীতিবিদ নই, আমি বিমান বিশেষজ্ঞ নই; কিন্তু আমার এই কমন সেন্সের যুক্তিতে ভুল কোথায়, কেউ কি বুঝিয়ে দেবে?



৩.



কিছুদিন আগে খবরের কাগজে দেখেছি, সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের দেশের একটা চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তির আওতায় আমাদের দেশের মেয়েদের সৌদি আরবে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে পাঠানো হবে। পুরো বিষয়টাকে সরকারের একটা বিশাল সাফল্য হিসেবে দেখানো হলেও খবরটি পড়ে আমার কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেল। অনেক দিন আগে আমি প্লেনে করে কোথাও যাচ্ছিলাম, তখন আমার পাশে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে যাওয়া একটি মেয়ে বসেছিল। কম বয়সী খুবই সাধারণ একটি মেয়ে। একেবারে একা রওনা দিয়েছে, কোথায় যাবে, কী করবে তার কিছুই জানে না। চোখে-মুখে অনিশ্চিত একটা জীবন নিয়ে আতঙ্ক দেখে আমার বুকটা ভেঙে গিয়েছিল। সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের গৃহপরিচারিকা পাঠানোর এ রকম একটা চুক্তি হওয়ার অর্থ এ দেশের অসংখ্য সহজ-সরল মেয়েকে তাদের পরিবার, আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিদেশ-বিভুঁইয়ে নির্জন-নির্বান্ধব একটি নিরানন্দ জীবনে রাষ্ট্রীয়ভাবে পাঠিয়ে দেব। আমি নিজেকে বুঝিয়েছিলাম এই নিষ্ঠুর নিরানন্দ জীবনের পরিবর্তে তারা যে পরিমাণ টাকা উপার্জন করবে সেই টাকা হয়তো তার ও তার আপনজনের জীবনে এক ধরনের সচ্ছলতা আয় সমৃদ্ধি এনে দেবে। শেষ পর্যন্ত যখন টাকার পরিমাণটি জানতে পারলাম তখন আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম, আমার মনে হয়েছিল অল্প কিছু বৈদেশিক মুদ্রার জন্য আমরা আমাদের দেশের অসংখ্য মেয়েকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছি। তাদের কি আমরা আমাদের দেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে কোনো একটি সম্মানজনক জীবিকা উপহার দিতে পারতাম না? বিদেশের মোহে পড়ে আমাদের দেশের মানুষ নিজেদের ওপর কত বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে গত কিছুদিনের ঘটনা দেখে সেটা আমাদের থেকে ভালো আর কে বলতে পারবে?



দেশের বাইরে আমাদের আরো একটি দেশ আছে। সেই দেশের মানুষ শুধু গতরে খাটবে, শুধু অপমান সহ্য করবে, শুধু হতদরিদ্র দেশের মানুষ হিসেবে পরিচিতি পাবে এবং আমরা সেটা নিয়ে খুশি থাকব, সেটা তো হতে পারে না। কেন আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রয়োজনীয় জনবল হিসেবে পাঠাতে পারব না? কেন তারা তাদের স্ত্রীকে পাশে নিয়ে, সন্তানকে কোলে নিয়ে বিদেশে কাজ করতে যেতে পারবে না? শুধু তাদের পাঠানো টাকা দিয়ে আমরা বিলাসিতা করব, কিন্তু তাদের জীবন সুন্দর করার জন্য কিছু করব না- সেটা তো হতে পারে না।



লেখক: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.