নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাংবাদিকতা নিয়ে পড়ালেখা করছি। পাশাপাশি অনলাইন জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করছি দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে। ব্লগে ফেরার ইচ্ছা বহুদিনের। একদিন হয়তো হুট করে আবারও রেগুলার হয়ে যাবো।

তাজুল ইসলাম মুন্না

একসময় ব্লগ দিয়ে দুনিয়া বদলানোর স্বপ্ন দেখতাম। এখন সাংবাদিকতায় সেই স্বপ্ন দেখি। ফেসবুক প্রোফাইলঃ https://www.facebook.com/ItsTajul

তাজুল ইসলাম মুন্না › বিস্তারিত পোস্টঃ

"সহযাত্রী" - ছুটির দিনে'র আরেকটি অসাধারণ গল্প

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১২:১৬

ছুটির দিনে'র সর্বশেষ সংখ্যা "পাঠকের অণুগল্প"-তে এই গল্পটি সেরা গল্প বলে নির্বাচিত হয়েছে। গল্পটি এককথায় অসাধারণ লেগেছে আমার কাছে। প্রথম অংশটুকু পড়ে হাসলেও পরের অংশটুকু পড়ে নিজেই লজ্জিত হয়েছি হাসার কারণে। লেখকের লেখার হাত অসাধারণ...



-----------------------------------------------------------------



বাসে উঠে আমার সিটের কাছে গিয়েই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। শুধু খারাপ না, ভয়াবহ খারাপ। আমার সিটে এক মহিলা বসে আছেন। রোজার ঈদে বাড়ি যাচ্ছি। এমনিতেই বাসের চাহিদা এ সময় বেড়ে যায়, আসল ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া হয়, তাও সিট পাওয়া যায় না। আমি এক সপ্তাহ আগে টিকিট বুকিং দিয়েছি। শুধু জানালার কাছে সিট পাওয়ার জন্য ৩০০ টাকার ভাড়া ৬০০। সঙ্গে ঈদ সেলামি বাবদ ১০০ টাকা কাউন্টারমাস্টারকে দিতে হয়েছে। এত কষ্টের সিটটা যদি অন্য কেউ দখল করে বসে থাকে, তবে মেজাজ খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেউ এসে দাঁড়িয়েছে, আঁচ করতেই মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘এই সিট কি তোমার? বসে পড়ো।’

মনে মনে বললাম, আমার নয় তো কি আপনার?

কিন্তু মুখে খুব বিনয়ের সঙ্গে বললাম,

‘আপনি বোধ হয় ভুল করে আমার সিটে বসেছেন। এটা আপনার, আর ওটা আমার সিট।’

‘তাতে কি! কোনো অসুবিধা নেই। আমার সিটে তুমি বসলে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি আর দশজনের মতো সিট নিয়ে কামড়াকামড়ি করি না। আরে বাবা, সিট তো বড় কথা না, তোমার পৌঁছানোই হলো গিয়ে আসল। নাও...নাও...বসে পড়ো।’

মারছে! মহিলা তো একটা কথার উত্তরে পাঁচ শটা কথা বললেন। বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বসে পড়লাম। আগামী ছয় ঘণ্টার যাত্রায় তিনি আমার জীবন ভাজা ভাজা করে ফেলবেন। ভদ্রমহিলা দুই সিটের দেড়খানা দখল করে বসে আছেন, কোনোমতে চেপেচুপে বসে পড়লাম।

এর মধ্যে অনবরত ওই মহিলা কথা বলে চলেছেন। কিছুক্ষণ গরম নিয়ে অভিযোগ, তারপর তিনি ড্রাইভারের গুষ্টি উদ্ধার করে নিজের ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে এসে পড়লেন। তাঁর দুই মেয়ে, জামাইসহ লন্ডনে থাকেন। বড় জামাই জন্মের কিপটা, ছোট জামাই মেয়ের চেয়ে ১০ বছরের বড়। তাঁর স্বামী মারা গেছে আজ ১১ বছর। একমাত্র ছেলে অস্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া করে। পাঁচ বছর পর গ্রামে যাচ্ছেন...

আমার ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। এ সময় সাত-আট বছরের একটি ছেলে পত্রিকা বিক্রি করতে উঠল। তার কাছ থেকে একটি পত্রিকা কিনে পড়া শুরু করলাম। এখানেও বিপত্তি। মহিলা ঘাড়ের ওপর এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী লিখেছে খবরের কাগজে?’

‘কী আর লিখবে, দেশে খবর তো ওই একটাই—সরকার আর বিরোধী দলের কামড়াকামড়ি। সব পানসে।’

আমি মুখে একটা তেলতেলে হাসি ধরে রাখলাম, যেন তাঁর কথাই ঠিক। এরপর উঠল এক অন্ধভিক্ষুক। সুর করে গজল গাইতে গাইতে মানুষের কাছে ভিক্ষা করতে লাগল। মহিলা তাকে কড়কড়া দুটি ৫০ টাকার নোট দিলেন। একে একে উঠতে লাগল চকলেট-চুইংগাম বিক্রেতা, বাচ্চাদের আদর্শলিপি বইওয়ালা আর রুমাল, পানি, জুস ও শসা বিক্রেতা। আমার পাশের যাত্রীটি প্রত্যেকের কাছ থেকে কিছু না কিছু কিনলেন এবং সেগুলো তাঁর ইয়া বড় ভ্যানিটি ব্যাগে রাখতে লাগলেন। তিনি কেনা পানির বোতল থেকে পানি দিয়ে দুটি অ্যাভোমিন ট্যাবলেট খেলেন।

‘তুমি খাবে একটা?’

‘জি না। আমার বাসে বমি হয় না।’

‘আমারও হয় না। তবে কিনা আগেভাগেই সতর্ক হলাম। কী নাম তোমার?’

‘আহসান।’

‘বাহ্, চমৎকার নাম। ঢাকায় কী করো?’

‘লেখাপড়া?’

‘কোথায়?’

‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে।’

‘কোন সাবজেক্টে?’

‘বায়োকেমিস্ট্রি।’

‘ও আচ্ছা। তা যাকগে, কোথায় নামবে?’

‘মিরপুর।’

‘আমি ভাঙ্গা নামব। প্রথমে বড় বোনের বাড়ি, পরে বাপের বাড়ি। তুমি ভাঙ্গা থানায় নেমে আমার বাবা আকবর শেখের নাম বললে সবাই দেখিয়ে দেবে। অবশ্যই তুমি ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে আসবে। ঠিক আছে, হাসান।’

‘হাসান না, আহসান।’

‘ওই হলো গে, একই কথা। তুমি আমার ছেলের মতো। ছেলেটা কত দিন দেশে আসে না। ওর ফাইনাল সেমিস্টার শেষ হলেই দেশে চলে আসবে। হোসেন, তোমার আব্বা-আম্মাকে আমার সালাম দেবে।’

আবারও মহিলা নামে ভুল করলেন। শুধরে দিতে ইচ্ছে হলো না। পাক্কা ৫০ মিনিট পর বাস ঢাকা থেকে পাবনার উদ্দেশে রওনা দিল। গদি মোড়া চেয়ারে হেলান দিলাম। হায় রে, চলন্ত বাসের জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে কত কিছু দেখব, কত কিছু ভাবব! ছোট বোনটা কীভাবে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরবে, বাবাকে যতবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে গেছি, ততবারই থাক থাক, থাক বলে বুকে টেনে নেন। মা ব্যস্ত হয়ে উঠবেন তাঁর রান্না করা খাবার পুনরায় গরম করতে, সেই সঙ্গে চোখের পানি ফেলবেন আর আঁচল দিয়ে মুছবেন। কিন্তু কিসের কী? সব পরিকল্পনা ভণ্ডুল! আমার পাশে বসা মূর্তিমান যন্ত্রণা সবকিছু নষ্ট করে দিল।

ড্রাইভার বাস চালাচ্ছেন অতি দ্রুত। যেন গাড়ি না, একটা পঙ্খিরাজ ঘোড়া। উড়াল দিচ্ছে সাদা মেঘের ভেলার ভেতর। একের পর এক গাড়ি ওভারটেক করছে। ভালোই লাগছে। নিজের মধ্যেও কেমন যেন এক ধরনের গতি অনুভব করছি।

মহিলার কথায় সংবিৎ ফিরে পেলাম। আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বিকৃত করে বললেন,

‘কেমন যেন লাগছে তাহসান।’

বলতে বলতে হড়হড় করে বমি করে দিলেন। দুটি অ্যাভোমিনে কাজ হয়নি। বমি করবি কর, জানালা দিয়ে, তা না করে আমার দিকে করার দরকার কী ছিল? প্রস্তুত ছিলাম বলে সরতে পেরেছি। কিন্তু সব রক্ষা হয়নি। বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে প্যান্টের আংশিক ছিটায় ভিজেছে। অর্ধগলিত মাংস, ভাত, রুটি—সবকিছু উঠে এসেছে। পায়ের নিচে বমি থাকার কারণে পা তুলে বসলাম। গা ঘিনঘিন করতে লাগল। মনে হলো আমারও বমি হয়ে যাবে। হেলপার এসে ছালা দিয়ে মুছে দিয়ে গেল।

এতক্ষণে মহিলা শান্ত হলেন। বমি করে নেতিয়ে পড়েছেন। যাক! বাঁচা গেল। এটা মন্দের ভালো। সামনে তাকালাম। গাড়ি এ মুহূর্তে সিরাজগঞ্জের কাছাকাছি। ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার উঠেছে বোধহয়। সাঁই সাঁই করে রাস্তার পাশের গাছগুলো সরে যাচ্ছে। রাস্তার দুই পাশে নিচু খাদ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তন্দ্রার মতো এসে গেল। কতক্ষণ পর জানি না, কান ফাটানো প্রচণ্ড শব্দে চোখ খুলে গেল। এক মুহূর্তের জন্য দেখলাম, বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মালবাহী ট্রাকের ধাক্কায় আমাদের বাস উল্টে যাচ্ছে, রাস্তার ধারে মোটা একটা গাছ আমার দিকেই যেন সজোরে ধেয়ে আসছে। চিৎকার করতে চাইলাম, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বের হলো না।

জ্ঞান ফিরল কতক্ষণ পর, জানি না। বুঝতে পারলাম, ঘাসের ওপর শুয়ে আছি। শরীরের কোথাও কোনো অনুভূতি নেই। ঘোলা ঘোলা চোখে দেখলাম, হাত দশেক দূরে আমাদের বাস বড় একটি কড়ইগাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে। চারদিকে লোকজনের চিৎকার, ছোটাছুটি। আমার মতো অনেকেই রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর পড়ে আছে। দৃষ্টি কিছুতেই পরিষ্কার হচ্ছে না। আমার মাথাটা কে যেন কোলে নিয়ে বসে চিৎকার করছেন। তিনি হচ্ছেন আমার পাশের যাত্রী ওই মহিলা। কান্নার সঙ্গে চিৎকার তিনিই করছেন,...ও ভাই...কেউ একজন একটু পানি দাও, ও রে, আমার ছেলেটা মারা যাচ্ছে...

...আল্লারে কত রক্ত...

...এই ছেলে, ও ভাই, কেউ অ্যাম্বুলেন্স ডাকছে না কেন? গাড়ি থামাও, ও সোনা, আহসান...ও আহসান... বাপ আমার...চোখ খোলো...একটু পানি দাও...

মানিক...কথা বলো, সোনা...

আমার রক্তে তাঁর সাদা শাড়িটা লাল হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমি আমার মায়ের কোলে শুয়ে আছি। মায়ের গায়ের মিষ্টি গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। আমি এই স্নেহময়ী মহিলার কোলে মাথা রেখেই ঘুমাব। আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো, মা। শক্ত করে।



রাশিদুল ইসলাম

উজানগ্রাম, কুষ্টিয়া















সবাই ভাল থাকবেন

-হ্যাপি ব্লগিং

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +৯/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১২:২৬

স্পেলবাইন্ডার বলেছেন: Nice!

২| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১২:৪৭

ঋষিক বলেছেন: কঠিন ,বেশি জোশ হৈছে রাশিদুল ইসলামের লেখা।
ব্লগে প্রকাশের জন্যে পোস্টকারীকে ++++

৩| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১:০০

টেকি মামুন বলেছেন: চরম

৪| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ১:০৬

আবদুল্লাহ আল মনসুর বলেছেন: +++

৫| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ২:৪৯

ব্যাধ বলেছেন: ভেতরটা কেমন জানি মোচঁড় দিলো.........চরম।

৬| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ৯:০৫

রাজসোহান বলেছেন: অসাধারন !

৭| ০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ সকাল ৯:১০

নিমা বলেছেন: চমৎকার গল্প

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.