নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিন্ক সহ পোষ্টের বাহবা/দায়, মূল লেখকের।
একাত্তরে বাঙালিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা বাস্তবায়নে বুদ্ধিজীবীদের ধারাবাহিকভাবে হত্যা ও গুম করা হয়। অধ্যাপক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, শিল্পী, লেখক, সাহিত্যিকসহ কয়েকশ' বুদ্ধিজীবীকে বাড়ি বা নিজ গৃহ থেকে তুলে নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর। এই হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়ন করে জামায়াতের নেতৃত্বাধীন আলবদর এবং আলশামস বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মোট কতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল তার সঠিক পরিসংখ্যান এখনও অজানা। তবে স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের যের্ তািলকা প্রস্তুত করা হয়, তাতে এই সংখ্যা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ শিক্ষাবিদ ৯৮৯ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, ডাক্তার ৪৯ জন, আইনজীবী ৪২ জন এবং প্রকৌশলী-শিল্পী-সাহিত্যিক ২৬ জন। বাংলাদেশে ১৪ ডিসেম্বরকে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালন করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে ১৯৭২ সাল থেকেই আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭২ সালে দালাল আইন প্রণয়নের পর শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত ও বিচারের দাবি করা হয় ১৭ মার্চ। শহীদুল্লা কায়সার, ডা. আলীম চৌধুরী, জহির রায়হান প্রমুখ শহীদ পরিবার হত্যার তদন্ত দাবি করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করে। এরপর সমাবেশটি মিছিলসহ পুরাতন গণভবনে যায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে। ১৮ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ পরিবারের সদস্যদের বলেছেন, এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সরকার দালাল আইনে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচারও শুরু করে।
১৯৭২ সালের ২৮ মার্চ পুলিশ বিভাগের প্রচারিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, 'বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত ৪২টি মামলা রুজু করা হয়েছে।' পরবর্তীকালে সে সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
ঢাকা উচ্চতর বিজ্ঞান ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ড. এ কে আজাদ হত্যা মামলা দিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কিত প্রথম মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ১৩ জুন এই মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়। ৫ অক্টোবর মামলার রায়ে আলবদর বাহিনীর সদস্য মকবুল, আইয়ুব আলী ও জুবায়েরকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ১ জুলাই বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সার হত্যা মামলার রায় হয়। এতে জামায়াতে ইসলামীর নেতা আবদুল খালেককে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের নিয়োগ করা গভর্নর আবদুল মোত্তালিব মালেকের বিচার শুরু হয় ১৯৭২ সালের ৭ অক্টোবর। তার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত অভিযোগ হিসেবে গভর্নর হাউস থেকে উপ-সামরিক আইন প্রশাসক রাও ফরমান আলির পাঠানো বুদ্ধিজীবী নিধন নির্দেশ সংবলিত একটি টেলিগ্রাম পাওয়া যায়। ২০ নভেম্বর সেই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। তাতে গভর্নর মালেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। গভর্নর মালেকের মন্ত্রিসভার আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী জসিমউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করা ছাড়াও বাংলাদেশ সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। তবে দালাল আইন বাতিল হয়ে যাওয়ার আগে মাত্র কয়েকটি মামলার রায় হতে পেরেছিল। পরে দালাল আইন বাতিল হয়ে যাওয়ায় যাদের বিরুদ্ধে রায় হয়েছিল, তারাও মুক্তি পেয়ে যায়। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ের হওয়া সে সময়ের প্রায় একশ'টি মামলাসহ গোটা বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বুদ্ধিজীবী গিয়াস উদ্দিনের বোন অধ্যাপক ফরিদা বানু প্রচলিত ফৌজদারি আইনের ১২০(খ), ৪৪৮, ৩৬৪ ধারায় মামলা করেন। মামলার আসামি করা হয় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রধান হন্তারক আলবদর বাহিনীর চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামান খানকে। মামলাটি পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডিতে পাঠানো হয়। ১৯৯৮ সালের ১৮ জানুয়ারি সিআইডির তৎকালীন সিনিয়র এএসপি মুন্সী আতিকুর রহমান মামলার তদন্ত পর্যায়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যুদ্ধাপরাধ আইনে মামলা দায়েরের অনুমতি চান। কিন্তু পরে এই মামলার অন্যান্য প্রক্রিয়া থামিয়ে দেওয়া হয়।
এভাবেই বারবার হোঁচট খায় বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিচার। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর আবারও আলোচনায় আসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। এই অভিযোগ গঠনের সময় বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিযোগ আনা হয়। এদের মধ্যে রয়েছে নিজামী, মুজাহিদ, চৌধুরী মঈনুদ্দীন, আশরাফুজ্জামান খান, কাদের মোল্লা ও মীর কাসেম আলী। ট্রাইব্যুনালের রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে 'কিলিং স্কোয়াড' হিসেবে আলবদর বাহিনী কাজ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল আলবদর বাহিনী। আলবদর বাহিনীর হাইকমান্ডের শীর্ষ নেতা ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী, দ্বিতীয় নেতা ছিলেন আলী আহসান মুজাহিদ ও তৃতীয় নেতা ছিলেন মীর কাসেম আলী। তাদের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বে মামলা দায়েরের পাশাপাশি সরাসরি অপরাধ সংগঠনের অভিযোগ আনা হয়। অন্যদিকে কাদের মোল্লা, আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে অপরাধ সংগঠনে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়।
এরই মধ্যে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড-সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি মামলার রায় ট্রাইব্যুনাল থেকে এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে একটি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়েছে। আবদুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মোট ৬টি অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্যে দ্বিতীয় অভিযোগটি ছিল কবি মেহেরুননিসা ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা সম্পর্কিত। অন্যদিকে তৃতীয় অভিযোগটি ছিল সাংবাদিক খন্দকার আবু তালেব হত্যা সম্পর্কিত। এ দুটি অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লাকে ১৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করেন। তবে অন্য অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা সাজা একত্রীকরণ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখা হয়। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ১৭ সেপ্টেম্বরের রায়ে প্রথম দুটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দণ্ড বহাল রাখেন। তবে ৬ নম্বর অভিযোগে দণ্ড বৃদ্ধি করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
আলবদর বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ নেতা মুজাহিদের বিরুদ্ধে মোট ৭টি অভিযোগ গঠন করা হয়। এর মধ্যে ১ ও ৫ নম্বর অভিযোগের সঙ্গে বুদ্ধিজীবী হত্যা ও নির্যাতনের সংযোগ হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ প্রথম অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ নম্বর অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। রায়ে ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করেন, একাত্তরে মুজাহিদ ইসলামী ছাত্রসংঘ (জামায়াতের তৎকালীন ছাত্র সংগঠন) রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আলবদর বাহিনীর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ছিল। মুজাহিদের মামলার রায়ের ৪০১ ও ৪০২ অনুচ্ছেদে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আলবদর বাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বাড়ি থেকে তুলে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আলবদর বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের নির্যাতন করা হয়। পরবর্তীকালে তাদের হত্যা করা হয়। মুজাহিদের মামলায় আসামিপক্ষ আপিল করেছে। এখনও আপিল শুনানি শুরু হয়নি।
আলবদর বাহিনীর আরেক শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে মোট ১৬টি অভিযোগ গঠন করা হয়। ১৩, ১৪ ও ১৬ নম্বর অভিযোগের সঙ্গে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সংযোগ হয়েছে। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের অভিযোগও আনা হয়। গত ২০ নভেম্বর বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে নিজামীর মামলার রায় অপেক্ষাধীন রেখেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।
আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা মীর কাসেমের বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তার বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির অভিযোগও রয়েছে। এ মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ স্থানান্তর হওয়ার পর ১০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।
বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীনের মামলাটিকে। তাদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে ১০-১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা মামলার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মোট ১১টি অভিযোগ গঠন করেন। তাদের বিরুদ্ধে ১৮ জন বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ আনা হয়। সবগুলো অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল রায়ে সবকয়টি অভিযোগেই মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, তাদের এ ঘৃণ্য অপরাধ শুধু ও শুধুমাত্র মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য। এ অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড না দিলে তা হবে বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতা। রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল উল্লেখ করেন, জামায়াত ও পাকিস্তানি বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদে এই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মিশনটি আলবদর বাহিনী সম্পন্ন করে। চৌধুরী মঈনুদ্দীন ছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড ও অপারেশন ইনচার্জ এবং আশরাফুজ্জামান খান ছিলেন চিফ এক্সিকিউটিভ। ট্রাইব্যুনালের রায়ের ৭৬ ও ৭৭ অনুচ্ছেদে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে আলবদর বাহিনীর ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়। ৮১ ও ৮২ অনুচ্ছেদে প্রত্যক্ষভাবে আলবদর বাহিনীর যুক্ত থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে ৪৪৯-৪৫২ অনুচ্ছেদে চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে ১১টি অভিযোগের প্রত্যেকটিতে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদানের যুক্তি তুলে ধরা হয়।
এ বছরের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস অন্য যে কোনো বছরের চেয়ে ভিন্ন তাৎপর্য বহন করছে। দীর্ঘ ৪২ বছর পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের অনেকগুলো অভিযোগের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। একজনের মৃত্যুদণ্ড এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে। এবারের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস এসেছে ন্যায়বিচারের বার্তা নিয়ে।
©somewhere in net ltd.