নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নাহিদা আক্তার তান্নি। বিবিএ ৪র্থ বর্ষ (হিসাববিজ্ঞান)।নোয়াখালি সরকারী কলেজ, নোয়াখালী।

নাহিদ তান্নি

নাহিদা আক্তার তান্নি

নাহিদ তান্নি › বিস্তারিত পোস্টঃ

হারালো কোথায় মনুষ্যত্ব?

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:৪৫

সম্ভ্রান্ত চৌধুরী পরিবারের ছোট বউ পারভীন।আজ তার ৭মাসের অনুষ্ঠান চলছে।পুরো বাড়ী আজ উৎসবমুখর।সবার আশা চৌধুরী পরিবারের ঘর আলোকিত করে নতুন একজন মেহমান পৃথিবীতে আসবে।

দেখতে দেখতে পারভীনের ডেলিভারীর তারিখ চলে এল।রাত ১১টা।পারভীন হসপিটালের বেডে তীব্র ব্যাথায় চিৎকার করছে।কেবিনের বাইরে পারভীনের স্বামী রবি, শ্বশুর,শাশুড়ী সবাই অপেক্ষা করছে।অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে কান্নার শব্দ ভেসে এল ভেতর থেকে।ডাক্তার সাহেব বের হয়ে এলেন।সবাই কৌতুহল আর আনন্দ নিয়ে বাচ্চাকে দেখতে ভিতরে ঢুকল।কিন্তু বাচ্চাকে দেখে মুহূর্তেই সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল।কেউ তাকে কোলে নেওয়া তো দূরে থাক, একটি বার ছুঁয়েও দেখল না।কারণ বাচ্চাটি ছিল তৃতীয় লিঙ্গের একটি মানুষ, যাকে আমরা হিজরা বলে ডাকি।
পারভীনের স্বামী বা শ্বশুর কেউই বাচ্চাটিকে ঘরে রাখবেন না। এতদিন পর্যন্ত যে বাচ্চার জন্য এত অপেক্ষা আজ সে বাচ্চাকে ঘরের একটি কোণে ঠাঁই দিতে কেউ রাজি নয়।সমাজে জানাজানি হলে বংশের কলঙ্ক হবে এই ভয়ে তারা বাচ্চাটিকে হাসপাতাল থেকে ঘরে নিতেও রাজি নয়।রাতের অন্ধকারে বাচ্চাটিকে আবর্জনার মত রাস্তার ধারে ফেলে এল পারভীনের স্বামী।পারভীন একটি বারের জন্যও প্রতিবাদ করল না, যদিও তার কাছে কষ্ট লাগছিল।তবুও সে চুপ রইল। সন্তানের প্রতি মমতায় তার মন ভরা।কিন্তু বংশের মান সম্মানের কাছে সে তার মমতাকে খুব তুচ্ছ মনে করল।

সকালের সূর্য উঠল।চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হল পারভীন মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছে।সবাই শোক প্রকাশ করছে তাদের পরিবারের জন্য।

অন্যদিকে বাচ্চাটি এখনো পড়ে আছে রাস্তায়।ছেলে বা মেয়ে হলে হয়তো কেউ না কেউ এতক্ষণে তাকে নিয়ে যেত।কিন্তু এখন তাকে এক নজর দেখেই সবাই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।হঠাৎ একদল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সেখান দিয়ে যাচ্ছিল।তাদের দেখে সবাই সরে গেল।বাচ্চাটিকে দেখে তাদের খুব মায়া হল।তারা বাচ্চাটিকে নিজেদের সাথে নিয়ে নিল।চলার পথের নতুন সঙ্গী হিসেবে তারা তাকে গ্রহণ করল।তারা বাচ্চাটির নাম রাখল শুভ।শুভকে তারা খুব আদর করে।তবে শুভকে বড় করতে তাদের কষ্ট হয়েছে খুব।এইটুকু বাচ্চাকে মায়ের মত কেউই যত্ন করতে পারে না।তবুও তারা নিজেদের শক্তি, সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ আদর যত্ন শুভকে করেছে।

ধীরে ধীরে শুভ বড় হতে লাগল।ওর বয়স এখন পাঁচ।যারা শুভকে লালন পালন করছে তারা ঠিক করল শুভকে লেখাপড়া শেখাবে।তারা শুভকে স্কুলে নিয়ে গেল ভর্তি করাতে।কিন্তু স্কুলের শিক্ষকেরা কেউ তাকে ভর্তি করালো না।দূর দূর করে তাদের তাড়িয়ে দিল।স্কুলের ছেলেমেয়েরাও তাদের নিয়ে উপহাস করতে লাগল।

শুভকে নিয়ে ওরা ফিরে এল ওদের বস্তিতে।ওদের খুব মন খারাপ হয়ে গেল।ভেবেছিল শুভকে লেখাপড়া শেখাবে।কিন্তু তা আর হল না।

দেখতে দেখতে শুভর বয়স ১৫ হয়ে গেল।বাস্তবতা এখন সে সম্পূর্ণই বোঝে।সমাজ যে তাদের সাধারণ চোখে দেখে না এটা সে এখন বোঝে।এই মানুষগুলোর জীবন কতই না কষ্টের! কাউকে জন্মের পরই ফেলে দেওয়া হয়েছে আবর্জনার মত, কাউকে একটু বড় হলেই ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।পরিবার থাকার পরেও তারা পৃথিবীতে একা।নিজেদের মত এরকম বৈশিষ্ট্যের মানুষদের মাঝেই তারা তাদের পরিবারকে খুঁজে নিয়েছে।সবার কাছে এরা খুব খারাপ।জোর করে, ভয় দেখিয়ে মানুষের থেকে টাকা আদায় করে।অথচ যখন তারা কাজ করে আয় করতে চায় তখন তাদের কেউ কাজ দেয় না।
আমরা মানুষেরা এতটা খারাপ যে, উভয় লিঙ্গের এই মানুষগুলোকেও আমরা যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা দিই না।
এইতো সেদিন শুভ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।শুভর শরীরের গঠন কিছুটা মেয়েদের মত।কিছু বখাটে তাকে একা পেয়ে তার দিকে ছুটে এল। শুরু করল তাদের পৈশাচিক আচরণ ।শুভ অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে আনল।
কাউকে দূর্বল দেখলেই আমরা তার উপর অত্যাচার করতে চাই। তাই হয়ত নিজেকে রক্ষা করার জন্যই এরা মানুষের সামনে এমনভাবে থাকে যাতে কেউ তাদের উপর অত্যাচার না করে।ভয় পায় তাদেরকে।

দুপুর বেলা খেতে বসেছে সবাই একসাথে।পাতিলে খাবারের পরিমাণ খুব কম।তবুও তারা হাসিমুখে তৃপ্তি নিয়েই খেল।কে বলবে এই মানুষগুলোর মনে জমে আছে কত শত কষ্ট…?

একদিন শুভর খুব জ্বর আসল।গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।শরীর কাঁপছে।তার সঙ্গীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।কিন্তু তাদেরকে হাসপাতালে ঢুকতেই দেওয়া হল না।তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল,আমাদের কি বেঁচে থাকার অধিকার নেই? চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার নেই?
আসলে তাদের কষ্ট দেখার সময় কারও নেই।
হাসপাতালে ঢুকতে না পেরে তারা তাদের বস্তিতে ফিরে এল। শুভর মাথায় পানি ঢেলে জ্বর কমানোর চেষ্টা করল।পলিথিনের ছাদের ঘরে থাকতে এমনিতেই অনেক কষ্ট হয় তাদের।তার উপর শুভ অসুস্থ।রাতে তার জ্বর অনেক বেড়ে গেল।তাদের মধ্যে কয়েকজন ফার্মেসিতে গেল ওষুধ আনতে।তাদের দেখেই তাড়িয়ে দিচ্ছিল ওষুধ বিক্রেতা।এবার তারা চুপ রইল না।ওদের মধ্যে একজন লোকটার গলা টিপে ধরল।বলল, ওষুধ দে বলছি।এবার লোকটি ঠিকই ওষুধ দিল।ওষুধ নিয়ে তারা ছুটে গেল শুভর কাছে।সবাই শুভকে সেবা যত্ন করে, ওষুধ পথ্য খাইয়ে সুস্থ করে তুলল।

২/৩ দিন পর ওরা সেজেগুজে চৌধুরী বাড়িতে এল।সেদিন কারো বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল।বিভিন্ন বিয়েশাদীর অনুষ্ঠানে এরা নাচগান, নাটক করে থাকে।বিনিময়ে যা পায় তাতেই তারা খুশি।মাঝে মাঝে আবার আবদার করে একটু বেশিও চায়।
চৌধুরী বাড়িতে আজ ওরা নতুন এসেছে। শুভ জানেনা এটা তার নিজেরই ঘর।এদেরকে দেখে আজ পারভীনের তার সন্তানের কথা খুব মনে পড়ছে।অনেক বছর আগে যে সন্তানকে আগলে রাখতে পারেনি আজ তার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।তবে গত ১৫বছরে একটি মুহূর্তের জন্যও নিজেকে সে ক্ষমা করতে পারে নি সে।প্রতিটি এ ধরণের মানুষকে দেখলেই তার নিজের সন্তানের কথা মনে পড়েছে, আর অন্ধকার ঘরে কেঁদে বুক ভাসিয়েছে।

শুভ ও তার সঙ্গীরা নাচগান শেষে বকশিশের জন্য দাঁড়িয়ে রইল।আজ পারভীনের শ্বশুর নিজের হাতে তাদের বকশিশ দিলেন।তাও আবার মাত্র ৬জনের জন্য ২০,০০০ টাকা।তাদের জন্য বাড়িতেই খাবারের ব্যবস্থা করলেন।
কিন্তু পুরোটাই ছিল লোক দেখানো।পুরো গ্রামের মানুশ আজ তার বাড়িতে উপস্থিত।তাই তিনি এই লোক দেখানো কাজগুলো করছেন।মুখে বলছেন, এরাও তো আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টি।এদেরও তো হাসিখুশি থাকার ইচ্ছে হয়।এরাও তো মানুষ। ইত্যাদি ইত্যাদি… সবাই ভাবল কি মহান ব্যক্তি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সবাই চৌধুরী পরিবারের জয়গান করতে লাগল।

এসব দেখে পারভীনের মাথায় আগুন ধরে গেল। হঠাৎ সে চিৎকার করে উঠল,
বন্ধ করুন এসব নাটক।
আজ এদের প্রতি এত ভালবাসা কেন হচ্ছে আপনাদের?য্দি সত্যিই এত ভালবাসা থাকে তাহলে কেন সেদিন রাতের আঁধারে আমার সন্তানকে রাস্তায় ফেলে এসেছিলেন?নিজের পরিবারের মধ্যে ৩য় লিঙ্গের একজন মানুষকে আপনারা সহ্য করতে পারেননি।আপনাদের মান সম্মান যাবে।তাহলে আজ তাদের প্রতি এই লোক দেখানো ভালবাসা কেন?

সবার মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল এসব কথা শুনে।যে সন্তানকে সবার কাছে মৃত পরিচয় দিয়েছে সে সন্তানকে আসলে তারা রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল শারীরিক গঠনের কারণে!এতক্ষণ যারা চৌধুরী সাহেবের জয়গান করছিল এখন তারাই তাকে ধিক্কার দিচ্ছে…

পুরো বিষয়টা ভালভাবে খেয়াল করল শুভর সাথের মধ্যবয়স্ক একজন সঙ্গী।সে বুঝতে পারল শুভই পারভীনের সন্তান।তারা যেখানে বাচ্চাটিকে ফেলে এসেছিল সেখান থেকেই তারা শুভকে পেয়েছে।পারভীনের কাছে পুরো বর্ণনা শুনে সে নিশ্চিত হয়ে গেল শুভ পারভীনের সন্তান।
শুভর আসল পরিচয় পেয়ে পারভীন ছুটে এল তাকে জড়িয়ে ধরতে।কিন্তু শুভ পারভীনকে দূরে সরিয়ে দিল।
সে পারভীনকে বলল, এতদিন কোথায় ছিলেন আপনি?আজ ১৫ বছর পর আমাকে বুকে টানতে হবে না আপনার। সেদিন কোথায় ছিল আপনার মমতা যেদিন আপনার চোখের সামনে থেকে আমাকে নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়েছিল কোন আবর্জনার মত? এই যে, এই মানুষগুলোকে দেখছেন, এরাই সেদিন আমাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়েছিল।নিজে না খেয়ে আমাকে খাইয়েছে, রাত জেগে আমার সেবা করেছে অসুস্থতার সময়,পরিবারের অভাব কখনো বুঝতে দেয় নি।এরাই আমার পরিবার। এরাই আমার সব।
হ্যাঁ, আপনাকে আমি মা বলে স্বীকার করতাম যদি সেদিন আপনিও আমার সাথে ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসতেন।কই আপনি তো তা করেন নি! আচ্ছা আপনি কি একটিবারের জন্যও বলেছিলেন যে, তোমরা আমার বাচ্চাটিকে আমার থেকে আলাদা করোনা? আপনার কাছে সেদিন বংশের মান সম্মানই বড় ছিল। তাহলে আজ কিসের এত মমতা? চাই না আমি।

পারভীন নির্বাক দাড়িঁয়ে রইল।তার কাছে শুভর কথাগুলোর কোন উত্তর ছিল না।
শুভ ও তার সঙ্গীরা বের হয়ে চলে এল।আসার সময় চৌধুরী সাহেবের দেওয়া বকশিশ তারা ফিরিয়ে দিয়ে এল পারভীনের স্বামী অর্থাৎ শুভর বাবার হাতে…

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২৪

সুমন কর বলেছেন: চমৎকার একটি বিষয়কে গল্পে তুলে ধরেছেন। ভালো লাগা রইলো। +।

১১ ই অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ৭:৫৯

নাহিদ তান্নি বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.