![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সিএনজি থেকে নেমে ড্রাইভারকে ৫ টাকার একটা ছিঁড়া নোট দিয়ে দিলাম।
'দেখেন মামা চলবে কি না!'
'চলবে, আমি না নিলে আরেকজন ঠিকই নিবে'
একটা হাসি দিয়া সিএনজি ড্রাইভার গাড়ি টান মেরে ভু করে চলে গেলো। এমন ড্রাইভার চট্টগ্রামে খুব কমই পাওয়া যায়। বলে রাখা ভাল চট্টগ্রামে লোকাল সিএনজি আছে। এইসব সিএনজি তে স্থান অনুযায়ী ভাড়া। যেমন, ৫ টাকা, ৬ টাকা, ৮ টাকা, ১০ টাকা, ১২ টাকা ইত্যাদি।
এমন ড্রাইভারের মত একজন দোকানদার আছে। উনার কাছে কিছু কিনতে গেলে টাকা বের করার পর যদি দেখি অল্প একটু ছিঁড়া তখন টাকা টা তাকে দিয়ে বলি-
'মামা দেখেন তো টাকা টা চলবে কি না, আর না চললে আমাকে পরের বার ফেরত দিয়েন'
দোকানদার হাসি দিয়া টাকা টা বক্সে রেখে দেয়।
চট্টগ্রামে একটি বড় সমস্যা হলো কেউ টাকা ভাংতি দিতে চায় না এবং একটু ছিঁড়া হলেই টাকা নিতে চায় না। ছিঁড়া টাকা চালানোর কৌশল বললাম, ভাংতি টাকার কৌশল অন্যদিন বলবো। এখন আসল কথায় আসা যাক।
সিএনজি থেকে বিদায় নিয়ে স্টুডেন্টের বাসায় গেলাম। আজ প্রায় ২০ মিনিট আগেই চলে আসছি। তারপরেও দেখি স্টুডেন্ট বই নিয়ে আমার অপেক্ষায় বসা। ভাবছিলাম স্টুডেন্ট হয়তো ঘুমাইতেছে নয়তো মোবাইলে টম এন্ড জেরি দেখতেছে।
যাইহোক যথারীতি হোমওয়ার্ক দেখার পর গণিত ও ইংলিশ পড়ানোর পর সামাজিক বিজ্ঞানের পড়া ধরলাম। বলে রাখা ভাল এখন হাই স্কুলে এই নামে কোনো সাবজেক্ট নেই। সাবজেক্টটির নাম বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচিয়।
আমি আমার স্টুডেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম-
"বৌদ্ধধর্মগ্রন্থের নাম কি?"
"বৌদ্ধধর্মগ্রন্থের নাম হলো ত্রিপিটক। স্যার আমি অন্যান্য আরো কিছু ধর্মগ্রন্থের নাম জানি"
"আচ্ছা বলো শুনি।"
"ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাত বা ওল্ড টেস্টামেন্ট, হিন্দুদের বেদ, স্যার বেদ আবার চার প্রকার- ১. ঋক্বেদ, ২. সামবেদ, ৩. যজুর্বেদ, ৪. অথর্ববেদ।"
'এত বিস্তারিত বলতে হবেনা তুমি প্রধান গুলি বলো'
'ওকে স্যার। জরথুস্তদের আভেস্তা, কনফুসীয়দের লুন ইয়ু, তাওবাদদের তাও তে চিং, শিন্তোদের কুজিকি, খ্রিষ্টানদের ইঞ্জিল/বাইবেল/নিও টেস্টামেন্ট, মুসলিমদের কুরআন এবং শিখদের ধর্মগ্রন্থের নাম গ্রন্থসাহেব'
আমি ওর এই রকম তথ্য শুনে পুরাই চমকাইয়া গেলাম। মাত্র হাই স্কুলে পড়ে কিন্তু এত তথ্য কিভাবে জানলো।
'তুমি এত কিছু জানলে কিভাবে?'
'স্যার আপনি একদিন মাসিক সম্পাদকীয় বই নিয়ে আসছিলেন। ঠিক ঐ রকম আরেকটা বই আমাদের স্কুলের পাশে লাইব্রেরিতে ছিল। আমি কিনে এনেছিলাম সেখানেই লিখা আছে এসব। স্যার বইটাতে আরো সুন্দর সুন্দর লিখা আছে।'
'ও আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে মাসে মাসে কিনে পড়িও তাহলে আরো জানতে পারবে'
'ওকে স্যার'
এই মাসের মাসিক সম্পাদকীয় কিনা হয়নি। মনে মনে ভাবলাম যাওয়ার সময় কিনে নিয়ে যাব।
ওর কথা বলতে গিয়ে আমার কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের কথা মনে পড়ে গেলো।
কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে থাকা অবস্থায় একটা ফোরের স্টুডেন্ট পড়াইতাম। স্টুডেন্ট খুবই ব্রিলিয়ান্ট ছিল। কিন্তু আসল কাজে সময় ব্যয় না করে নিরর্থক কাজে সময় ব্যয় করতো। যেমন, ডিশ লাইনে কার্টুন দেখা আর মোবাইলে গেইম খেলা। একদিন ওকে বিজ্ঞান বই পড়াচ্ছিলাম, পড়া বাদ দিয়ে বলে উঠলো-
'স্যার আমার ল্যাপটপে স্কাইপ আছে, আমার মামার সাথে ভিডিও কথা বলি, স্যার আমাকে একটা ফেইসবুক খুলে দিবেন?'
মনে মনে ভাবলাম মাত্র ফোরে পড়ে আর এখন যদি ফেইসবুক চালায় তাহলে বাকি পড়ালেখা আর হবে কি না সন্দেহ। এটার থেকে চিন্তাচেতনা সরানোর জন্য একটা ট্রিক্স বের করলাম।
'শুনো ফেইসবুক চালাতে হলে বয়স ও যোগ্যতা লাগে। তুমি ফাইভ পাস করো এরপর আমি খুলে দিব। এখন যাও তোমার নকিয়া মোবাইল টা নিয়া আসো। তোমাকে ফেইসবুকের চেয়েও মজার জিনিস দিবো।'
'ঠিক আছে স্যার'
ওর মোবাইলে আমি E2B Dictionary টা দিয়ে দিলাম। এটা জাভা ছিল, যারা নকিয়া বা এন্ড্রয়েড আসার আগে ক্যামেরা ফোন চালাইছেন তারা এই ডিকশনারির সাথে পরিচিত থাকতে পারেন।
আমার স্টুডেন্টকে আমি ওর ইংলিশ বইয়ের থেকে কয়েকটা ওয়ার্ড ডিকশনারিতে টাইপ করে দেখিয়ে দিলাম যে কিভাবে এর বাংলা অর্থ চলে আসে। আমার স্টুডেন্টের চেহারা দেখে মনে হলো বেচারা মহাখুশি।
এর মাস খানেক পর ইংলিশ পড়ানোর সময় আমার স্টুডেন্ট আমাকে বললো-
'স্যার আপনি আমাকে আমার বইয়ের যেকোনো ইংলিশ ওয়ার্ড ধরেন আমি বলে দিত পারব।'
'তাই নাকি'
'জ্বী স্যার'
ওকে প্রায় ওর বই থেকে কঠিন ২০/২৫ টা ওয়ার্ড ধরলাম দেখি সবগুলো বলে দিলো। ব্যাপারটা আজব লাগলো আমার কাছে।
২০১৬ সালে একটা কোচিং সেন্টারে কিছুদিন এইচ.এস.সি ব্যাচের ক্লাস নিয়েছিলাম। শেষ ক্লাস আমার ভাগ্যে পড়েছিল।
তাই সেদিন ক্লাসে স্টুডেন্টদের বললাম আজ কোনো কিছু পড়াবো না। এ কথা বলতেই স্টুডেন্টরা খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলো। আমার ক্লাসে এই প্রথম ওদের এত বেশি খুশি মনে হলো। মনে মনে ভাবলাম আমার ক্লাসকে ওরা কতই না অত্যাচার মনে করে। গল্প বলতে বলতে কয়েকজন বড় ভাইয়ের সফলতার গল্প ওদের শুনিয়ে দিলাম।
এরপর কিছু উপদেশ দিয়ে বললাম-
'যে যুগে মানুষ যেসব জিনিসের প্রতি বেশি আসক্ত সেসব জিনিস থেকে কেউ যদি বের হয়ে আসে এবং কঠোর পরিশ্রম করে তাহলে সফলতা আসবেই। সামনে এক্সাম এরপর ভার্সিটি এডমিশনের পড়াশুনা, তাই রিলেশন ঠিলেশন, মোবাইল গেইম, ফেইসবুক চ্যাটিং এগুলা বাদ দিয়া পড়াশুনা করো বড় ভাইদের মত তোমরাও সফল হবা।'
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে তূর্ণা এক্সপ্রেস ট্রেনে সেই ব্যাচের একজন ছাত্রের সাথে দেখা। অনক কথা বার্তাই হলো। সকালে কমলাপুর থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সে বললো-
'স্যার আমি ফেইসবুক চালানো বাদ না দিলে জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটি তে চান্স পেতাম না'
কিছুদিন আগে এক ছোট ভাইয়ের লগে দেখা হইছিল। কথাবার্তা বেশ হলো সাথে হালকা নাস্তা ও চা ছিলো। ছোট ভাই কথার পৃষ্ঠে এক পর্যায় জিজ্ঞেস করলো,
- ভাই লাইফ টা ছ্যারাব্যারা হইয়া গেছে। এই প্যারা থেকে কিভাবে মুক্তি পাবো ভাই??
আমি উত্তরে বললাম,
- ফেইসবুক বাদ দিয়া কিছুদিন গল্প, উপন্যাস পড়ো আর ঐতিহাসিক স্থানে একটা ট্যুর দাও। দেখবা লাইফ ইজ কালারফুল।
অনেকদিন পর সেই ছোট ভাইয়ের একটা স্ট্যাটাস চোখে পড়লো। মাত্র এক লাইনে লেখা, 'Life is colorful.'
©somewhere in net ltd.