![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শুক্রবার, ৭ জানুয়ারী ২০১১ সময় ভোর ৫টা , স্থান কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার অনন্তপুর সীমান্ত। চলছে এক লাইভ হরর মুভির কাস্টিং । পনের বছর বয়সের একটা মেয়ে বাবার সাথে সীমান্ত অতিক্রম করছে , কাটা তারে তার কাপড় আটকে যাওয়ায় ভয়ে সে চিৎকার করে । তার চিৎকারে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ কয়টা সীসার টুকরা তার শরীরকে খাইয়ে দেয়। এরপর আধাঘণ্টা ধরে কাঁটাতারে আটকে থেকে পানি পানি বলে চিৎকার করে। গুলি চালানোর পর অনন্তপুর ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা পাশ দিয়ে টহল দিতে থাকে । এক সময় স্তব্ধ হয়ে যায় ফালানী। ঝুলে থাকে ফালানীর লাশ। ফালানীর বাবা কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে বাংলাদেশে এলেও মেয়ের আর্তচিৎকারে সাড়া দিতে পারেননি। পাঁচ ঘন্টা আর লাশ কাঁটাতারে ঝুলে থাকে। এ ঘটনার ৩০ ঘণ্টা পর ৮ জানুয়ারী বিএসএফ কিশোরীর লাশ ফেরত দেয়।
হ্যাঁ বলছি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার রামখানা ইউনিয়নের বানারভিটা গ্রামের দিনমজুর নুরুল ইসলামের মেয়ে ফেলানীকে (১৫) কথা। নুরুল দিনমজুরি করে সংসার চালান। সংসারে তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। তাঁরা সবাই ভারতের দিল্লিতে ইটভাটায় কাজ করেন। কাজ করে কিছু টাকা জমা হওয়ার পর ফেলানীকে বিয়ে দিতে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসছিলেন। মেয়ের বিয়ে দেওয়া হলো না নুরুলের । নুরুল ও ফেলানী ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে সীমানা পার হওয়ার চেষ্টা করেন। নুরুল প্রথমে মই বেয়ে কাঁটাতার পেরিয়ে আসেন। ফেলানী মইতে উঠলে তার কাপড় কাঁটাতারে আটকে যায়। এ সময় সে ভয়ে চিৎকার শুরু করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিএসএফ এর বুলেট তার বুক ছিদ্র করে দেয়।।মৃত্যুর পরও দীর্ঘ সময় ফেলানীর লাশ সীমান্তের কাঁটাতারের সঙ্গে ঝুলতে থাকে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সীমান্তের মানুষ।
পরিসংখ্যান বলে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের বিগত ৫ বছরে সীমান্তে বিএসএফ হত্যা করেছে প্রায় ৩০০ জন বাংলাদেশিকে। ছয়টি দেশের সঙ্গে সীমান্ত থাকলেও শুধু বাংলাদেশ সীমান্তেই হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে ভারত। উল্লেখ্য ভারতের সবচেয়ে বৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তান সীমান্তে গত ১০ বছরে কোনো বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। ২০০০ সালের পর গত একযুগে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ১০৩৯ নিরীহ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। এ সময় ভারতের সঙ্গে অন্য পাঁচটি সীমান্তে একটি হত্যার ঘটনাও ঘটেনি। ২০০৯ সালের ৯৮ জন, ২০১০ সালে ৭৮ জন ও ২০১১ সালে ৩১ জন এবং ২০১২ সালে ৩৮ জন বাংলাদেশী নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন এই ঘাতক বাহিনীর হাতে। ১৯৭১ সালে ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা করে। পাকিস্থানিদের হাত থেকে মুক্তি পেলেও আমরা মুক্তি পাই নি ভারতের এই রকম বন্ধুত্বের হাত থেকে। মনে হচ্ছে স্বাধীন হয়েছিলাম আমরা ভারতীয়দের হাতে সীসা খেয়ে মরার জন্যে। আর এই সীসার খাওয়ার ঘটনার ৯৯ ভাগই কিন্ত ঘটে নিজ বাড়িতে মানে বাংলাদেশের ভিতরে।
ভাল কথা হত্যাকান্ডগুলোর বেশিরভাগই কিন্ত ঘটেছে বিশেষ কোন দিনে, জানা নাই এই হত্যাকান্ডগুলো ঘটিয়ে কি তারা আনন্দ উৎসব করে নাকি নিছকই কাকতালীয়।
>> ১ জানুয়ারী ২০১৩ ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে মুক্তার আলম (২৮) ও তরিকুল ইসলাম ওরফে নূর ইসলাম (২৮),আহতরা হলেন আমজাদ (২৫), সামাদ (২৯) ও রাজু (২৩),
>> ২০ আগস্ট ২০১২ পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার জগতবেড় ইউনিয়নের ভোট হাটখাতা সীমান্তে দুপুরে ভারতীয় চেনাকাটা ক্যাম্পের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) জাহাঙ্গীর আলম বাবলু (২৫) নামে এক বাংলাদেশীকে পিটিয়ে হত্যা করে।
>> ১৬ ডিসেম্বর ২০১১ বিজয়ের ৪০ বছর উদযাপনের সময় বিএসএফের গুলিতে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সাহেববাড়িয়া সীমান্তে নিহত হন নাহারুল (৪০), একই দিন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা সীমান্তে বিএসএফ’র বোমার আঘাতে আনোয়ার হোসেন (২৭) নামে এক বাংলাদেশী নিহত হন। এ সময় আহত হন মোহর আলী (২৫) নামে আরো একজন। একই দিন দিনাজপুর জেলার বিরামপুর সীমান্তে গভীর রাতে মতিয়ার (২০) ও তাইজুদ্দিন (৩০) নামে দুই বাংলাদেশীকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে।
>>> মে দিবসে ১ বাংলাদেশিকে হত্যা। একই দিন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলা সীমান্তে বিএসএফ’র বোমার আঘাতে আনোয়ার হোসেন (২৭) নামে এক বাংলাদেশী নিহত হন। এ সময় আহত হন মোহর আলী (২৫) নামে আরো একজন। দিনাজপুর জেলার বিরামপুর সীমান্তে গভীর রাতে মতিয়ার (২০) ও তাইজুদ্দিন (৩০) নামে দুই বাংলাদেশীকে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে।
>> ২০১১ বাংলা নববর্ষে ২ বাংলাদেশিকে হত্যা
১৪ এপ্রিল ২০১১ ভোরে বাংলা নববর্ষে যশোর জেলার বেনাপোলের সাদীপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় মুন্না (১৮) নামে এক বাংলাদেশি যুবক ও আহত হয় মামুন (২৩)। একই দিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর সীমান্তবর্তী নীতপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফের গুলি করে হত্যা করে সানাউল্লাহ (৩২) নামের এক বাংলাদেশী ব্যবসায়ীকে।
অদ্ভুত, বড়ই অদ্ভুত তাই না। তপ্ত সীসা আমাদের কাছে খুব প্রিয় তাই আমরা চুপ করে নিরবে হজম করে যাই। কিন্ত এটাই তো সেই দেশ যে দেশে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের রিজিকের অভাব হয়না, তারা তারকাঁটার নিষেধ অমান্য করে দাদাদের দেশে যায়না, কাঁটার দেওয়াল অতিক্রম করে দেশেই পুলিশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এ দেশেই লুটে পুটে খায় গরিবের অন্ন। কিন্ত ফেলানীরা যায় কেন ? এ দেশে দু’মুঠু অন্য জোগাড় করতে পারে না বলে। রাজনৈতিক কর্মিরা যখন মার খায় তখন হাসিনা-খালেদা হাহাকার করে উঠে কিন্ত ফেলানীরা যখন মার খায় তখন অফ মেরে থাকে। প্রতিবাদ আসে না কারো কাছ থেকে। আসে যখন দেশে কেউ হরতাল কিংবা অবরোধে মারা যায় তখন। মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে টানা হেছড়া লেগে যায় তখন । হাসিনার দলের নাকি খালেদার দলের।
বলা যায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাহারা খাতুন কিন্ত ফেলানীকে বেওয়ারিশ ঘোষনা করে, নিউইয়র্কের এক সভায় ফেলানী বিষয়ে তাঁর বলা চারটি বাক্য প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয়। তিনি বলেছেন, ‘
“বিএসএফের হাতে নিহত ফেলানী বাংলাদেশি নয়। তারা ভারতীয়। তার পরও সরকার পরিবারটির জন্য অনেক কিছু করেছে। আমি নিজে তাদের বাড়িতে গিয়েছি।“
আমি নিশ্চিত এই বাক্যগুলো সকলের হাসির সৃষ্টি করবে। আচ্ছা ভাল কথা তারা যদি ভারতীয় হয় তাহলে বাংলাদেশে থাকে কি করে । আর মন্ত্রীই বা কিভাবে দেখা করেন ? !!!! এক অর্থে হয়ত তিনি ঠিকই বলেছেন। কারন উনি হয়ত ভাবেন বাংলাদেশ ভারতেরই তো একটা অঙ্গ রাজ্য।
হত্যাকান্ডের পরে সীমান্তের দুই পারের গ্রামের মানুষ এতটা নির্বিকার থাকতে পারেনি। ফেলানী যখন কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলছিল, তখন তারা বেড়ার দুই পারে মিছিল করে প্রতিবাদ করছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হত্যাকর্মের নিন্দা করতে বাধেনি অনেক ভারতীয় নাগরিকেরও। অথচ আমাদের মন্ত্রীর সেটা বাধছে! তাঁর কথা মানলে বিএসএফ বাংলাদেশের দিক থেকে দায়মুক্ত মানে জায়েজ করে দেওয়া হয়ে যায় না ? প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল দেশি-বিদেশি ব্লগ-মিডিয়া, ফেসবুকের ওয়ালে। আর এক দল বাংলাদেশী তরুন ভারতীয় সাইবার স্পেসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছিল। দিন রাত তারা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে গেছে অনেকদিন। বিনিময়ে তারা কি পেয়েছিল ভয় ভীতি আর সুন্দর সুরূচিপূর্ন গালাগালি। লাল কার্ডিগান পরা এক কিশোরী মাথা নিচু করে ঝুলছে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ায়। তার নিথর দুটি হাতও মাটির দিকে বাড়ানো। যেন পুরো জাতির কাছে সে সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়েছে। উথলে উঠে পুরো জাতির শোক। শুধু উথলে উঠে নি সরকারের নীতি নির্ধারক মহলে । যেন তাদের বিবকগুলো কাঁটাতারে আটকে আছে।
হত্যাকান্ডের তিন বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা জাতীয় লজ্জা থেকে মুক্ত হতে পারি নাই। বিচারের নামে ভারত অভিযুক্ত অমিয় ঘোষকে বেকসুর খালাস দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে তৎকালীন আইন মন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন “এটার বিরুদ্ধে কোন আপিলের বিধান আছে কীনা আমার জানা নাই। থাকলে এবং তারাই একটু যাচাই বাছাই করে একটা আপিল করলে এটা গ্রহণযোগ্যতা একটু বাড়বে।“ সরকারের পক্ষ থেকে কোন আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করা হয় নি , কিংবা ডেকে পাঠানো হয় নি ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে। যে দেশে পাখি কিংবা পশু মারা জন্যে জেল খাটতে হয়, সেই দেশে মানুষ মারা জন্যে বিচার হয় না !!
স্বপ্নবাজ তরুনদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে গুলশান সার্কেল-১ এর ১৪২ নম্বর সড়কটি ফেলানী রোড নাম করণের দাবি জানানো হয়। সরকারীভাবে কোন সাড়া দেওয়া হয় নি।অথচ এ দেশেই এয়ার পোর্ট এর নাম চেঞ্জ করার জন্যে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। স্টেডিয়াম , নভোথিয়েটার, ব্রিজ এর নাম করণ নিয়ে রাজনীতি হয়। সারা দেশের মানুষের শোকের সম্বলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয় ।
ক্ষমা কর বোন ফেলানী, আমরা পারি নাই, আমাদের চিন্তা চেতনা-চেতনা আজ ফেসবুক , ব্লগ আর মিডিয়াতেই সীমাবদ্ধ। একটা লাইক কিংবা কমেন্ট পাবার জন্যে আমরা হাহাকার করি। নিজের প্রচারের জন্য টিভি চ্যানেলগুলোকে টাকা দেই। হয়ত কয়েক যুগ পরে নতুন কোন প্রজন্ম এসে সেই বিচারের দাবি করবে। তত দিন তোমার আত্মাকে নিরবে কাঁদতে হবে। সেই সাথে নিরবে অশ্রু ফেলবে তোমার শোকে সম্ভিত হয়ে যাওয়া স্বল্প সংখ্যাক মানুষ।
তথ্য সূত্রঃ অনলাইন মিডিয়া ও বিভিন্ন ব্লগ।
©somewhere in net ltd.