![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ধ্বংস শব্দটির অর্থ বিনাশ করা বা সৃষ্টিকৃত কোন জিনিসকে ভেঙ্গে দেওয়া বা নষ্ট করে দেওয়া ।আর এই ধ্বংসের সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত তান্ডব । যার অর্থ নৃত্য, তণ্ডু মুনি এই নৃত্যের আবিষ্কর্তা হলেও এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে কিংবা মিডিয়ায় এবং প্রশাসনে থাকা পু্লিশ কিংবা নেতা-নেত্রীরা সবাই ভয়ংকর সব তাণ্ডব দেখিয়ে চলেছেন। কেউই নৃত্য বা খেলার নিয়মকানুন মানছেন না।
সাম্প্রতিক বাংলাদেশে যেসব কাণ্ড ঘটে চলেছে, তাকে তাণ্ডব বা বিশৃঙ্খলা বললে কম বলা হয়। এটিকে আখ্যায়িত করা যায় মহাতাণ্ডব বা মহাবিশৃঙ্খলা নামে। কিন্তু মাস কয়েক ধরে বাংলাদেশে যে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে চলেছে, তার থেকে কী সৃষ্টি হয়, গণতন্ত্র না ধ্বংসতন্ত্র, সেটাই দেখার বিষয়। ইতিমধ্যে ২০০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যানবাহন, ট্রেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দির জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকে বলছেন-এটাতো মাত্র শুরু,আরও কত তান্ডব,ধ্বংস কিংবা প্রাণ যাবে তার কোন হিসাব নাই ! দেশের মানুষ দেখবে রাজনীতি আর অপরাজনীতির বলি আর খাণ্ডবদাহন?
বাংলাদেশের রাজনীতির মূল সমস্যা হলো, কেউ হারার জন্য প্রস্তুত নয়। সবাই জিততে চায়, ছলে বলে কলে কৌশলে নয়, একেবারে জবরদস্তি করে। এই জবরদস্তির জন্য যেমন এক দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এসেছিল, তেমনি সেই জবরদস্তির জন্য তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা ২০০৬-০৭ সালে অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। আবার ২০১১ সালে আরেক জবরদস্তির মাধ্যমে তা বাতিলও করা হলো। যাঁর যখন খুশি, তাঁর সুবিধামতো সংবিধান ব্যবহার করেন। আইন বদলান। কিন্তু নিজেদের বদলানোর চেষ্টা করেন না।
নির্বাচন হবে আট-দশ মাস পর। ক্ষমতায় আসার আগে এই সরকারের একটা বড় কমিটমেন্ট ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার,তারা করছেনও বটে । কিন্তু অসঙ্গতিপূর্ণ বিচার ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে শেষ করতে বা জামাতকে শেষ করতে উঠে পড়ে লেগেছেন ।আর এখানেই জনগনের সরকারের ইচ্ছার উপর সন্দেহ হতে শুরু করে ।যে ট্রাইবুনাল সরকার গঠন করেছে তার উপর কারও ( দেশে ও আন্তর্জাতিক ভাবে ) আস্থা নেই শুরু থেকে ।কাদের মোল্লার রায়ের পর শাহবাগের যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল প্রথমে একে নিরপেক্ষ নামে অভিহিত করলেও পরে এতে সরকারের ইন্ধনটি সুস্পষ্ট প্রকাশ পেয়ে যায় ।সরকার চেযেছিল শাহবাগের আন্দোলন দিয়ে একসাথে অনেকগুলো শিকার করবে ।কিন্তু নানা অসঙ্গতিতে ভরা এই শাহবাগের আন্দোলনের নায়করা এখন দেশের বড় ভিলেনে পরিণত হয়েছে ।যার ফলশ্রুতিতে দেশব্যপী তাদের নিষিদ্ধ আর নাস্তিকের ধুঁয়ো ধ্বনিতে প্রকম্পিত হচ্ছে ।আর যাঁরা ওই শক্তির ( জামাত-শিবির কিংবা সরকারের ) বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই চালিয়ে যেতে চাইছেন, এই বিষয়টি তাঁদের মাথায় রাখা জরুরি। লড়াইটা আসলে দীর্ঘস্থায়ী।
দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবক্ষয়ে অনেকে মনে করছেন, সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মেনে নিলেই সব রাজনৈতিক প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যাবে। একাত্তর ও সাতচল্লিশের দ্বন্দ্ব মিটে যাবে। আসলে বিষয়টি এত সহজ নয়। তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নটি মূল হলে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির অনুসারী হতো, এখন তো বিএনপিই জামায়াতের পথে হাঁটছে। তাদের শক্তির ওপর ভরসা করেই বিএনপি আন্দোলনের কর্মসূচি দিচ্ছে।
এই যে দেশজুড়ে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ, সংখ্যালঘুদের ওপর হানা—সবই কি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য? বিশ্বাস হয় না। তাহলে একটি মামলার রায় নিয়ে কেন দেশব্যাপী এই যে ‘অঘোষিত যুদ্ধ’, তার যুক্তি কী? কার বিরুদ্ধে তাদের আক্রোশ? ক্ষমতাসীন দল বা গোটা বাংলাদেশের?
ক্ষমতার রাজনীতি এতটাই অন্ধ যে রাজনীতির কুশীলবেরা আক্রান্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে তাদের নিয়ে রাজনীতি করতে বেশি উৎসাহী। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের পর এখন সরকার ও বিরোধী দল কাদা-ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত। একে অপরের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার ছাড়ছে। কিন্তু সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তদের হাত থেকে অসহায় মানুষকে বাঁচাতে কাউকেই তেমন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। পদ্মা সেতু কেলেংকারী,হলমার্ক কেলেংকারী কিংবা সারাদেশে যে ভিটামিন `এ` নিয়ে কেলেংকারী তা সত্যি হোক বা অপপ্রচার হোক তা নিয়ে সরকার বা বিরোধীদল কেউই জনগনের পাশে এসে দাড়াননি ।বরং সরকার পুলিশ দিয়ে বিরোধী অফিসে হামলা আর বিরোধীদল জনগনের কাছ থেকে সহানুভূতি আদায়ে উঠেপড়ে লেগেছে ।দেশের জনগনের জন্য কিংবা দেশের জন্য সত্যিই তাদের মন কাঁদে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর কখনও পাওয়া যাবে না ।
সরকারে থাকলে অনেকেই অন্ধ হয়ে যান, অনেকেই সমালোচনা শুনতে চান না, আবার বিরোধী দলে গেলে তাঁরা বিনয়ের অবতার হন। রাজনীতির নামে এই কপটতা কত দিন চলবে?
যেকোনো রাজনৈতিক দুর্যোগে দেশের সাধারণ ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া,সন্তানদের রাজনৈতিক বলি,হরতালের নামে অর্থনীতি হতে শুরু করে শিক্ষা ব্যবস্থা সব কিছুতে ধ্বংসের আলামত সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান ভেঙে আমরা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি এবং সেই বাংলাদেশও ৪২ বছর পার করেছে। কিন্তু আমাদের মনের গভীরে সেই পাকিস্তানি মানসিকতাই রয়ে গেছে। ‘এ আমার পাপ, এ তোমার পাপ’। এরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ওরা বিপক্ষের শক্তি এই নিয়েই চলেছে কাঁদা ছোড়াছুড়ি ।এটাই আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা। এ রাজনীতির ব্যর্থতা, নেতা-নেত্রীদের দায়হীনতা।
বাংলাদেশ পৃথিবীর একক জাতিসত্তার দেশ, যে দেশের ৯৯ ভাগ মানুষ একই ভাষায় কথা বলে, একই নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর। তাদের মধ্যে কেন এত সংঘাত-সংঘর্ষ হবে? এত শত্রুতা জিইয়ে রাখা হবে? চীনে একসময় আফিম খাইয়ে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। এখন দলীয় ও সংকীর্ণ রাজনীতি এবং সাম্প্রদায়িকতার আফিমে মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজবেন যে রাজনীতিকেরা, বুদ্ধিজীবীরা, তাঁরাই পথহারা।
আমরা আক্রমণ ঠেকাই না। আক্রান্ত মানুষগুলোকে বাঁচাতে এগিয়ে যাই না। আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে আগ্রহ দেখাই না। অন্যের ওপর সব দোষ চাপিয়ে নিজে সাধু সাজার চেষ্টা করি। ২০০১ থেকে ২০১৩ এই ১২ বছরেও পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।বেড়েছে রেষারেষির পাহাড় ।ক্ষমতার তান্ডবে চারিদিকে শুধু ধ্বংস আর কান্নার রোল ।বাংলাদেশে এখন সবাই তাণ্ডব চালাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের ওপর তাণ্ডব চালাচ্ছে সংখ্যাগুরুরা। সরকার তাণ্ডব চালাচ্ছে বিরোধী দলের ওপর। বিরোধী দল তাণ্ডব চালাচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর হরতাল করে, গাড়ি ভাঙচুর করে। ছাত্রলীগ তাণ্ডব চালাচ্ছে ক্যাম্পাসে, সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর। প্রশাসন তাণ্ডব চালাচ্ছে সেবাপ্রার্থীদের ওপর। যে দল যেখানে শক্তিমান, সেখানেই তাণ্ডব চালাচ্ছে। এসব তাণ্ডবের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।প্রাকাশ্যে বিশ্বজিত, নারায়ণগঞ্জে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী, রাজীব, মিনহাজ,আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ভাই এবং সারাদেশে শিবিরের অনেকে খুন সব যেন একই সূত্রে গাঁথা। কেউ বলছেন সূত্র ভিন্ন। ঘাতকের চরিত্র ভিন্ন। রাজীবের ঘাতকেরা ধরা পড়েছে। এখন সরকারের দায়িত্ব মিনহাজ ও ত্বকীর খুনিদের ধরা। যদি পারে আমরা বাহবা দেব, যদি না পারে মানুষ গুঞ্জনকেই সত্য ধরে নেবে। চুনোপুঁটি অপরাধীরা ধরা পড়লেও রাঘববোয়ালেরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়।
সারা দেশে জামায়াত-শিবির কিংবা পুলিশ তাণ্ডব চালাচ্ছে। বিএনপি হরতালের নামে জনগণের ওপর তাণ্ডব চালাচ্ছে। আর সরকার বিএনপি অফিসে এবং নেতা কর্মীদের উপর তাণ্ডব চালিয়ে বলছে, ২০০৪ সালে বিএনপির পুলিশও একইভাবে তাণ্ডব চালিয়েছিল। তাহলে আমরা কতটা এগোলাম? গণতন্ত্র কতখানি বিকশিত হলো? ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ফের আওয়ামী লীগ অফিসে তাণ্ডব চলবে। আবার সেই তাণ্ডবের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ জনগণের ওপর হরতাল নামক আরেকটি তাণ্ডব চাপিয়ে দেবে। নেতা-নেত্রীরা এভাবে গণতন্ত্রের নামে যা চালাচ্ছেন, তার নাম তাণ্ডবতন্ত্র। এটিই কি বাংলাদেশের মানুষের ভবিতব্য?
তবে এই তাণ্ডবেরও রকমফের আছে। প্রতিপক্ষের হানায় যে তাণ্ডব চলে, তার প্রতিবাদ করা চলে, প্রতিকার চাওয়া যায়। কিন্তু নিজের দল বা গোষ্ঠীর ওপর যে তাণ্ডব চালানো হয়, তা শোধরানোর উপায় থাকে না। যেমন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে নিজেদের প্যানেলটি যাতে জয়ী হতে না পারে, সে জন্য আওয়ামী-সমর্থক আইনজীবী নেতা-নেত্রীরা তাণ্ডব চালিয়েছেন। এর নাম হলো আত্মঘাতী তাণ্ডব। তাণ্ডবতন্ত্রেরই জয় হোক।আর তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি-ধ্বংসতন্ত্রে বাংলাদেশ ।
( লেখার সহায়ক- এক সাংবাদিকের তথ্য যা প্রথম আলোতে প্রকাশিত )
©somewhere in net ltd.