![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভালোবাসি মেঘ, মেঘমালা.......
'সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া যন্ত্রধ্বনি তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে!'....
এভাবেই ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালে বাল্য ও কৈশোরের স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদের কথা তার কবিতায় তুলে ধরেছিলেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কবির এ রচনা অনেক কাল আগের। এ নদের তীরে যশোরের কেশবপুর উপজেলার সাগরদাড়ি গ্রামে জন্মেছিলেন কবি। কপোতাক্ষের সাথে ছিল তার নাড়ির সম্পর্ক। তখন এ নদ ছিল খরস্রোতা। পানি ছিল কপোতের (পায়রা) অক্ষির মতোই স্বচ্ছ- যেখান থেকে নদের এ রকম নামকরণ। কপোতাক্ষ ছিল দুই তীরের মানুষের কৃষি-অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই কপোতাক্ষ আজ মরা খালে পরিণত হয়েছে। প্রকৃতির বৈরী আচরণ ও প্রভাবশালীদের অশুভ তত্পরতায় এ নদ এখন যশোর, সাতক্ষীরা ও খুলনার সাত উপজেলার লাখ লাখ মানুষের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দক্ষিণ-পশ্চিমের নদ-নদীগুলোর পানির উত্স ছিল পদ্মার অন্যতম প্রধান শাখা মাথাভাঙ্গা। মাথাভাঙ্গার মাধ্যমে প্রবাহ পেত ভৈরব। যশোরের চৌগাছা উপজেলার তাহিরপুরে ভৈরব থেকে কপোতাক্ষের উত্পত্তি। যশোরের চৌগাছা, ঝিকরগাছা, কেশবপুর ও মনিরামপুর, সাতক্ষীরার কলারোয়া ও তালা এবং খুলনার পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলা হয়ে খোলপটুয়া নদীর সাথে মিলিত হয়ে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে সাগরে পড়েছে কপোতাক্ষ। এ নদের দৈর্ঘ্য ১৮০ কিলোমিটার। সুফিয়াবাদ এলাকায় নদের প্রশস্ততা ছিল ১৫০ মিটার। কয়েক বছর আগে এখানে গভীরতা ছিল ৫ মিটার। এককালে কপোতাক্ষের বুক চিরে ঝিকরগাছা পর্যন্ত লঞ্চ-স্টিমার চলত। কপোতাক্ষের অববাহিকা ৮০০ বর্গকিলোমিটার।
সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৭৯৪ সালে কপোতাক্ষের উত্পত্তিস্থলে ভৈরবে চর জাগে। যশোরের কালেক্টর কপোতাক্ষের উত্সমুখে বাঁধ দিয়ে পানি ভৈরব দিয়ে প্রবাহের চেষ্টা করেন। এতে হিতে-বিপরীত হয়। প্রবল স্রোত বাঁধ এড়িয়ে কপোতাক্ষ দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এরপর মনুষ্য সৃষ্ট কারণে ভৈরব-কপোতাক্ষের মৃত্যুর সূচনা হয়। ১৮৬২ সালে কলকাতার শিয়ালদহ থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ সমপ্রসারণের কাজ শুরু হয়। দর্শনার পাশে জয়নগরে এক অপ্রশস্ত রেলসেতু নির্মাণ করা হয়। এতে মাথাভাঙ্গা থেকে ভৈরব নদ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সামান্য পরিমাণ প্রবাহ পেতে থাকে ভৈরব। ওই প্রবাহে কপোতাক্ষে পানি যেত না।
দর্শনা রেল সেতুর কাছে ভৈরব-মাথাভাঙ্গার চক্রাকার একটা বাঁক ছিল। নদীয়ার জেলা কালেক্টর সেক্সপিয়র খাল কেটে ওই বাঁক সোজা করে দেন। এর ফলে সব পানি মাথাভাঙ্গাতে পড়ে। ভৈরব মরে গেল। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় কপোতাক্ষেরও মৃত্যু ঘণ্টা বেজে উঠে। উজানের কপোতাক্ষ দিনে দিনে মজে যেতে থাকে। উত্পত্তিস্থল তাহিরপুর থেকে ঝিকরগাছা পর্যন্ত শুকিয়ে যায়। ভাটিতে জীবিত থাকে। তারপর প্রাকৃতিক কারণে ভাটির অংশ পলি জমে ভরাট হতে থাকে।
কপোতাক্ষ জোয়ার-ভাটার নদ। জোয়ারের সময় স্রোত বিপুল পরিমাণ পলি বহন করে উজানে আনে। উজান থেকে কোন পানি প্রবাহ না থাকায় জোয়ারের সময় বয়ে আসা পলির সবটা ভাটার সময় আর সাগরে যায় না। কিছু অংশ নদ বক্ষে জমা হতে থাকে। এভাবে প্রথমে কয়রা ও তালা এলাকার নদ ভরাট হতে থাকে। তারপর উজানের কেশবপুর, মনিরামপুর ও ঝিকরগাছা পর্যন্ত পলি জমে কপোতাক্ষ ভরাট হয়ে যায়। ২০০০ সালের বন্যার পর শুরু হয় কপোতাক্ষ অববাহিকার মানুষের দুঃখ। ভারি বর্ষণ হলে কপোতাক্ষের উত্তর অংশের পানি সরতে পারে না। আবার নিম্নাংশে জোয়ারের পানির সাথে বৃষ্টির পানি যুক্ত হয়ে স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। বাড়িঘর ও ফসলী জমি তলিয়ে যায়। কপোতাক্ষ পাড়ের অন্তত ১০ লাখ মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টে পড়ে।
এরপর কপোতাক্ষ বেদখল করে প্রভাবশালীরা ঘের তৈরি করে মাছ চাষ শুরু করে। নদের স্বাভাবিক প্রবাহ আরো ব্যাহত হয়। জলাবদ্ধতার পরিমাণ আরো বেড়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে কপোতাক্ষ শুকিয়ে যায়। কচুরিপানায় ভরে যায়। বর্তমানে উত্সমুখ থেকে সাগরদাড়ি পর্যন্ত কচুরিপানায় ভরে গেছে। উজানে নদ বক্ষে চাষাবাদ হয়ে থাকে।
কপোতাক্ষকে ফের জীবিত করতে এবং জলাবদ্ধতা দূর করতে গড়ে উঠে কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন। তাদের দাবির প্রেক্ষিতে সরকার কপোতাক্ষ খননে হাত দেয়।
কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনের সমন্বয়ক অনিল বিশ্বাস বলেন, ২০০১ সালে প্রথম বক্স সিস্টেমে সাগরদাড়ির নিচ থেকে উজানে মিল্লাতবাড়ি পর্যন্ত খনন করা হয়। ভাটিতে বিপুল পরিমাণ পলি জমে ভরাট হয়। এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর সরসকাটি ব্রিজের নিচ থেকে ৪৫ কিলোমিটার ড্রেজিং করা হয়। কিন্তু একই পরিণতি হয়। বিপুল পরিমাণ টাকা পানিতে যায়। সর্বশেষ কপোতাক্ষকে জীবিত করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ২৬১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়সাপেক্ষ কপোতাক্ষ অববাহিকা জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ৫ বছর মেয়াদী এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে ২০১১ সালে। ২০১৫ সালে শেষ হবে। এ প্রকল্পের পরিচালক পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী দীপক কুমার সরকার জানান, অ্যাকশান প্লান কর্মসূচিতে উজানে নদ খনন করা হয়। কিন্তু ভাটিতে মনিরামপুর, কেশবপুর, তালা, কয়রা হয়ে কপিলমুনি পর্যন্ত নদ বক্ষ ভরাট হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় তীব্র জলাবদ্ধতার। টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প (টিআরএম)'র অধীন নতুন প্রকল্প নেয়া হয়। এ প্রকল্পে কপোতাক্ষের পানি জোয়ারের সময় পাখিমারা বিলে নিয়ে যাওয়া হবে। ৬৫০ হেক্টর আয়তনের এ বিলের চারদিকে পেরিফেরাল বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। কপোতাক্ষ থেকে একটি লিংক ক্যানেল কাটা হবে। জোয়ারের সময় পানি লিংক ক্যানেলের মাধ্যমে বিলে পড়বে। জোয়ারের পানির সাথে আসা পলি বিলে জমবে। ভাটার সময় স্বচ্ছ পানি বের হবে। ওই পানি নদ বক্ষের কিছু পরিমাণ করে পলি কেটে নিয়ে যাবে। এতে নদের নাব্যতা বজায় থাকবে বলে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী জানান। এরপর পাইকগাছা থেকে তাহিরপুর পর্যন্ত ৯০ কিলোমিটার কপোতাক্ষ খনন করা হবে। খননকৃত পলি দিয়ে নদের দু'পাশে ভেড়িবাঁধ তৈরি হবে। যাতে বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ওই মাটি ধুয়ে নদে না পড়ে। এছাড়াও নদ তীরবর্তী খাল খনন করা হবে। ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ শীলখা খাল খনন এ কর্মসূচির মধ্যে আছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে এক লাখ ২ হাজার হেক্টর জমি জলাবদ্ধতা মুক্ত হবে বলে তিনি জানান।
কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলনকারীরা বলছেন, এ টিআরএম প্রকল্পে স্থায়ী সমাধান আসবে না। তাদের দাবি ভৈরব, মাথাভাঙ্গা ও পদ্মার সংযোগ সৃষ্টি করা। উজানের পানির স্রোত কপোতাক্ষে নিয়ে আসতে হবে। এ স্রোতে কপোতাক্ষের বক্ষে জমা পলি অপসারণ হবে। আর এটাই কপোতাক্ষ সমস্যার স্থায়ী সমাধান বলে তাদের কথা। এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বলেন, গঙ্গাবাঁধ নির্মাণ হলে স্থায়ী সমাধান হবে। তখন পদ্মার পানি মাথাভাঙ্গা, ভৈরব হয়ে কপোতাক্ষে আগের মত পড়বে।
(সংকলিত ittefaq.com.bd)
©somewhere in net ltd.