![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পরিকল্পনাটাতো সমসাময়িক। ছুটি মানেই অজানা কোন গন্তব্বে বেরিয়ে পড়া মনের কোন এক অজানা গহ্বরের টানে। এবার তার ব্যাতিক্রম হল না।
সকালের শুরুটা মোটেও ভালো লাগল না। রওাংছরির দিকে যাত্রা করতে দুপুর বেজে গেলো,কারণ মাত্র বাকি ২ সঙ্গি এসে পৌছালো। যাক পাহাড়ি সে বাজারে হাল্কা কিছু নাস্তা সেরে রওনা দেওয়ার পালা। মোটরযানের হাঁক ডাক এখানেই শেষ, বিস্তর পায়ে হাঁটার গন্তব্য এখান হতেই শুরু। বরাবরের মত এবারো নিরাপত্তা রক্ষী ও পাহাড়ি গাইড এর চোখ এড়িয়েই চলে এলাম। অজানা রাস্তায় দূরের পথে হাঁটতে চাইলে এটা জরুরী। পথে এক বুড়ো মহিলার কাছে সামনের গ্রাম এ যাওয়ার রাস্তা সম্পর্কে আবছা ধারণা নিয়ে নিলাম। বাজার হতে পশ্চিম এ কিছু দূর এগিয়ে আসতে এক ছড়া চোখে পড়ল। তিনি বলে দিয়েছিলেন এ ছড়া ধরে উৎসের দিকে বেশ খানি পথ এগিয়ে গেলেই পাহাড় বয়ে এক রাস্তা চলে যাবে গ্রামের দকে। কথা মত সে রাস্তা ধরে এগুতে থাকলাম। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা তখন প্রায় প্রায়। গোধূলি মুহুরতে দেখলাম কিছু আদিবাসী জুমের কাজ শেষ করে ছড়া ধরে বাজারের দিকে ফেরত যাচ্ছে। প্রায় ১ .৫ ঘণ্টা পথ চলার পর আসলাম ছড়ার শেষ মাথায়। এখানে কিছুটা গভীর গাছপালা, বামদিকের ছোট এক রাস্তা উঠে গেছে পাহাড় এর উপর, বুঝতে কষ্ট হল না এটা ধরেই গ্রামে যেতে হবে। তখন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে প্রায়। টর্চ এর আলোয় আমরা তিনজন এগুতে থাকলাম পাহাড় আর জঙ্গল পার হয়ে। অন্ধকার হয়ে আসায় আসে পাশের দৃশ্যমান কিছু নজরে এল না। সাথে কেউ না থাকায় বুঝতেও পারছিলাম না কতদুর পথ এগুলম। কিন্তু এত টুকু যানতাম রাত যতই হোক এ পথ কোন না কোন একটা গ্রামে নিয়ে পৌছবেই। ব্যতিক্রম হোল না তার, রাত ১০.৩০ এ পৌঁছলাম পাইখং নামে এক গ্রামে, এখানে বম উপজাতিদের বসবাস। এখানে ছোট এক দোকান হতে সেরে নিলাম টুক টাক হাল্কা খাবার। ক্লান্ত শরীরে খিদা নিবারনে সে রাতে অটুকুই যথেষ্ট ছিল।
ছবি - রাতের নিভি নিভি আলোয় গ্রামের এক মাত্র দোকান।
গ্রামের এক লোক কে জিজ্ঞেস করে, গ্রামের পাশেই, বাগান ঘর এ উঠে পরলাম। এ ঘরটিতে কেউ থাকে না। আজ রাতের আশ্রয়স্থল এখানেই। সে রাত টা ঐ জুম এর মাচায় চাদর মুড়িয়েই তিনজন ঘুমিয়ে পরলাম।
সকাল টা ভাঙল পাখির কিচির মিচির এ, সারা রাত খোলা আকাশের নীচে বাঁশের মাচার ঘুম টা মন্দ হোল না। ব্যাগ গুছিয়ে যাত্রা শুরু করে দিলাম সে দিন টার। সকালের নাস্তা হিসেবে জুটল কলা ও পেঁপে। আজকে সকালের প্রকৃতির অভ্যর্থনা মোটেও পছন্দ হল না। তিক্ত রোদ রাস্তাটিকে কঠিন করে তুলছিল। কাঁধের তাঁবু ও ব্যাকপ্যাক নিয়ে সেই ক্লান্ত পথেই রাস্তা চলতে থাকলাম। পাইখং হতে পরবর্তী গ্রাম রনিন পাড়া কিছুটা উঁচুতে অবস্থিত। কিন্তু পথের স্বর্গস্থলিও জুম ঘর গুলো যেন ঈশ্বর প্রদত্ত বিশ্রাম এর কোন স্থান। ক্লান্ত রাস্তায় পথ চলায় জুম ঘরে মিনিট দশেক এর বিশ্রাম এর কোন জুড়ি নেই।
ছবি - ক্লান্ত দুপুরের বিশ্রামের জুমঘর।
বেশ খানিকটা রাস্তা এগিয়ে এসে রনি পাড়ার কিছু আগে ২ জন আর্মির সাথে দেখা। বুঝলাম পাশে ক্যাম্প এ যাবার রাস্তা আছে। তারা কিছুটা অবাক হলেন ঈদ এর দিন আমাদের ওখানে দেখে এবং সাথে রাস্তা চিনিয়ে দেওয়ার মতন কোন গাইড না থাকায়। কিছুটা আশঙ্কাগ্রস্থ হলেন সামনের রাস্তা কি করে চিনব এ নিয়েও। দুর্গম রাস্তায় পথ খুজে পাওয়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেক কথা হোল তাদের সাথে। এর পর তারা ছারলেন। দুপুর ১ টার দিকে প্রবেশ করলাম রনি পাড়ায়। পাহাড় এর কোনায় ঘুমিয়ে থাকা বেশ বড় সড় একটা গ্রাম। গ্রাম এর শুরুতেই অভ্যর্থনা জানাতে দাড়িয়ে আছে বিশাল আকারের এক বট গাছ ও খ্রিস্টান ধর্মের এক Graveyard. গ্রামে ঢুকতেই উৎসুক মানুষজন ও আদিবাসী ছোট ছেলে মেয়ে গুলো অবাক নয়ন এ তাকিয়ে রইল। কিছুটা বিব্রত বোধ করার মতন ই ব্যাপার। যাক এ গ্রামেও এক দোকান পাওয়া গেলো। কিছু চিড়া, কলা কিনে খেলাম ও সাথে করে কিছু নিয়ে নিলাম যেহেতু সামনের রাস্তায় আর কোন খাবার পাওয়া যাবে না। এ গ্রাম হতে ভালো করে কাগজে কলমে সামনের রাস্তা সম্পর্কে ধারণা নিয়ে নিলাম, কারণ সামনের গ্রাম টি অনেক দূরে অবস্থিত এবং যাওয়ার রাস্তাও অনেক দুর্গম। গ্রাম থেকে উপদেশ দিল সাথে একজন লোক নিয়ে নেবার রাস্তা দেখিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু অজানার উদ্দেশ্যে গমন করার ইচ্ছে নিয়ে যখন বেরিয়েছি, ঠিক করলাম নিজের রাস্তা নিজেই খুজে নিবো, হোক না সেটা হারানো কোন পথেই।
ছবি - রনি পাড়া যাবার পথে।
ছবি - রনি পাড়ায় প্রবেশ করলাম তখন মাত্র।
দুপুর ২ টায় রওনা দিলাম পরবর্তী গন্তব্য সিপ্পি পাড়ার উদ্দেশে, এ পাড়াটি তে যেতে পাড়ি দিয়ে যেতে হবে বান্দরবান এর রওাংছরি রিজিওন এর সব চাইতে উঁচু পর্বত সিপ্পি আরসুয়াং, ভুপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা প্রায় ২৮০০ ফিট। সিপ্পি পাড়া ঠিক পাহারটির অন্য প্রান্তেই অবস্থিত। যাত্রার শুরুতেই শুরু হোল পাহাড় ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যাওয়া, সাথে তপ্ত দুপুরের কাঠ ফাটা রোদ ও পিঠে বিশাল ওজনের ব্যাক প্যাক ও টেন্ট। খুব একটা বেশি সময় নিল না সবার ক্লান্ত হয়ে পরতে। তার পর ও পথ চলা তো আর থেমে থাকবার নয়। পথে প্রথম ১ ঘণ্টা কিছু আদিবাসী জুম চাষি পেলাম যাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে নিচ্ছিলাম যে আমরা ঠিক পথেই গন্তব্বের দিকে এগুচ্ছি কিনা, কিন্তু কিছুটা পশ্চিম এর দিকে এগুনর পর ১ টা রাস্তা গভীর জঙ্গল এর দিকে আমাদের নিয়ে গেলো, সেখান হতে অনেক দূর পথ চলার পর ও কোন মানুষের অস্তিত্ব পেলাম না, এবং রাস্তাও কিছুটা আবছা ও অপরিষ্কার হয়ে আসছিল। লাঠি ও ছুরি ব্যাবহার করে সে অস্পষ্ট রাস্তা বের করে নিচ্ছিলাম, এত টুকু মনে বল ছিল যে যতক্ষণ রাস্তার বিন্দু মাত্র ছাপ ও চোখে পরবে ততক্ষণ নিশ্চিত যে এ রাস্তা কোন না কোন গ্রামে গিএ ফুরোবে। কিন্তু এভাবে শ্লো আগাতে গিয়ে বিকেল গড়িয়ে এল প্রায়, কোন গ্রাম, কোন কোন সভ্যতার ছাপ আসে পাশে তখনো দৃশ্যমান হোল না।
ছবি - সিপ্পি আরসুয়াং যাওয়ার দুর্গম একটি পথ।
বুঝতে পারলাম অন্ধকার ঘনিয়ে আসবে, কিছু একটা করতে হবে। আগের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে উঁচু স্থান এ উঠে পরলাম, কারণ জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেললে উঁচু স্থান থেকেই আসে পাশের রাস্তা খুজে নিতে হয়। কিন্তু একটি নয় দু দু টি উঁচু পাহাড় এর পিক থেকেও আসে পাশের কিছু চোখে পরল না, কারন দক্ষিণ এর ভিউ আটকিয়ে ছিল বিশালাকৃতির এক পাহাড়। কিছুটা অনুমানে বুঝতে পারলাম এটিই হবে সিপ্পি আরসুয়াং, এ ক্ষেত্রে করনীয় একটাই এটি পুরটা ডিঙ্গিয়ে ওপারে গিয়ে রাস্তা খোঁজা। তখন ঘড়িতে ৬ টা। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে খুভ দ্রুত, আর ঘন জঙ্গলে অন্ধকার বরাবরের চাইতে একটু দ্রুত নেমে আসে। সব চাইতে আশ্চর্যের ব্যাপার হোল যে স্থানটিতে আটকিয়ে আছি, আসে পাশের কথাও তাঁবু বিছানোর সামান্য তম সমান্তরাল কিছুটা পরিষ্কার কোন স্থান পর্যন্ত নেই, না আছে কোন জুম ঘর, না আছে কোন ঝিরি পথ। চোখ যত দূর যায়, রাস্তা টেনে নিয়ে গেছে ঘন অন্ধকার এক জঙ্গল এর দিকে। সাথে থাকা ২ সঙ্গি মানসিক ভাবে প্রচণ্ড ভেঙ্গে পরল, সারাদিনে ক্লান্ত শ্রান্ত ক্ষুধার্ত শরীর নিয়ে সামান্য তম বল টুকু পাচ্ছে না সামনের ঐ বিশালাকৃতির পর্বত পাড়ি দেওয়ার। মাথায় কোন হুশ জ্ঞান না পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম সামনে এগুব হাতে টর্চ নিয়ে, কারন এ স্থান এ গভীর জঙ্গলে বসে বসে রাত পাড়ি দেওয়া সম্ভব না। নিচে নেমে পরবর্তী পাহাড় এ উঠার রাস্তা খুজতে থাকলাম, কিন্তু কপালে যখন খারাপ থাকে, তখন ভাগ্য সব দিক থেকেই পরিহাস করে। রাস্তা আর খুজে পেলাম না, দা, ছুরি, লাঠি ব্যাবহার করে আসে পাশের সব অপশন গুলো পরিষ্কার করে দেখতে থাকলাম কিন্তু উপরের দিকে উঠে গেছে এমন কোন রাস্তার ছাপ টুকু কোথাও খুজে পেলাম না। অন্ধকার তখন জেঁকে নেমেছে ঘন সে জঙ্গলে, সাথে অদ্ভুত কিছু শব্দ, জানিনা সেটা মনের কোন ভয় নাকি। কোন কিছুর কূল কিনারা বের না করতে পেরে পিছে ফিরে গেলাম, ভালো করে টর্চ জালিয়ে খুজতে থাকলাম কোথাও সামান্য একটু সমান স্থান পাওয়া যায় কিনা যেখানে তাঁবু টা গেরে আজকের রাত টা কোন মত শেষ করা যায় কিনা। সঙ্গি ২ জন এতটাই ভেঙ্গে পরল যে, চিৎকার করে জঙ্গল এ ডাকতে থাকল, "কেউ আছেন? কেউ আছেন?" তারাও জানে সে চেষ্টা বৃথা, শুধু মাত্র নিজের মস্তিষ্ক কে জাগ্রত রাখা সে মুহূর্তে। কিছু দূর খোঁজা খুঁজির পর হঠাৎ চোখে পরল পুরনো বাঁশের তৈরি কিছু একটা, যার আদ্য পান্ত লতা গাছ ও গুল্মলতায় ঢেকে আছে। ৩ টি টর্চ ব্যাবহার করেও আন্দায করতে পারলাম না সেটি কি? কাছে যেতেও পারছিলাম না প্রচণ্ড ঘন জঙ্গল হয়ে থাকার কারনে। অবশেষে ছুরি দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে জঙ্গল সাফ করে ওটির কাছে পৌঁছে দেখলাম পুরনো একটি ঘর, যার এক পাশ ভেঙ্গে গেছে ও পুরটা ঘর লতা পাতায় ঘিরে ধরেছে। এই গভীর স্থান এ এরকম পুরনো একটি মাত্র ঘর দেখে কিছুটা আতঙ্কিত হলাম, কিন্তু আজ রাত কাটানোর ভরশা এটিই বুঝতে পারলাম। আলো দিয়ে পুরো ঘরটি চেক করে নিশ্চিত হলাম ক্ষতিকর কিছু নেই এখানে। দুরু দুরু বুকে ঘর এর ভিতরেই তাঁবু গাড়লাম, মাচায় খু সাবধান এ পা ফেলতে হচ্ছিল, কারন বিভিন্ন স্থানে বাঁশ ফেটে পরে ছিল, বুজছিলাম বেশি ওজন নিতে পারবে না পরিতেক্ত এই জুম ঘর টি। কয়েকটি শুকনো বাঁশের টুকরো জোগাড় করে এক পাশে রান্না সেরে ফেললাম ব্যাগ এ থাকা নুডুলস দিয়ে। পায়ে সবার তখন জোঁক এর আসর বসেছে, অন্ধকারে জঙ্গল মারিয়ে আসার সময় এসব চোখেও পরে নি। অনর্গল রক্ত পরছিল সবার পা বয়ে। কোন মতন পায়ে পলিথিন দিয়ে আটকিয়ে সে রাত টা আল্লাহর নাম নিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম একটা নতুন সকাল দেখবার আশায়।
সে দিন এর সকাল এর ঘুম ভাঙ্গা টা জীবনে মনে থাকবে সব সময়, একটি রাত অতিবাহিত হবার এত আনন্দ মনে হয় এই প্রথম। ঘুম থেকে উঠে আগে জায়গাটা ভালো করে দেখলাম এটি কি আসলে।
ছবি - পরিতেক্ত এক জুম ঘর এ রাত কাটাবার পর।
নতুন এক উদ্দমে সে দিন টি শুরু করলাম। আজ যে করে হোক ও দিকে গিয়েই রাস্তা খুজে বের করতে হবে এবং যেহেতু সকাল বেলা একটু সাহস ও পেলাম মনে। আবারও সামনে এগিয়ে চলা। কিন্তু ভাগ্য আজ বেশ আমাদের পক্ষ নিল, কিছুদুর এগুতেই ১ জন বৃদ্ধ লোককে পেলাম যিনি কিনা সামনের পাড়া থেকে আরেক গ্রামে যাচ্ছিলেন তার অসুস্থ এক ভাগ্নি কে দেখার জন্য, বেশ তারা হুড়ার উপর ছিলেন তিনি। তাকে পেয়ে আমার ২ সঙ্গীর আনন্দের সীমা ছিল না। ওনাকে অনেকটা হাতে পায়ে ধরে অনুরধ করার পর রাজী হলেন পরবর্তী পাহাড়টিতে উঠার রাস্তা দেখিয়ে দেবার। যেখানে হতে আমরা আগের দিন আর রাস্তা খুঁজে পাই নি। অবশেষে তিনি পাহাড়ে উঠার একটি সংকীর্ণ রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। এবার পাহাড়ের পথ ধরে শুধু উঠে চলার রাস্তা, পারতপক্ষে রাস্তাটি বেশ সরু ও সংকীর্ণ এবং বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় ধসে রাস্তা বিলিন হয়ে গেছে। অনেকদুর এভাবে পথ চলার পর কিছু জুম চাষির সয়াহতায় দুপুর ১২ টায় পৌঁছে গেলাম সিপ্পি আরসুয়াং এর চুড়ায়। এত টা দুর্গম, গহীন পথ চলার পর এমন অবাক করা পাহাড় এর দৃশ্য অনুমান করতে পাড়ি নি। চূড়া থেকে নিজের অস্তিত্ব অনুভব করে মনে হচ্ছিল হ্যাঁ এ জন্যই বেঁচে থাকা। সামনে বিস্তীর্ণ পাহাড়, জুম এর পাকা ধান, অনাবিল বাতাস, দূরে মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে থাকা বার্মা রেঞ্জ এর পর্বতমালা। নিজেকে ডানামেলা পাখির সঙ্গে তুলনা করা মনে হয় খুভ একটা অহংকারের কিছু নয়।
ছবি - সিপ্পির চূড়া হতে ফ্রেম বন্দি কিছু মুহূর্ত।
সিপ্পি হতে নিচেই দৃশ্যমান দেখা যায় সিপ্পি পাড়া। ও দিকেই রওনা দিলাম। ২ দিন ধরে পেটে সামান্য ভাত ও পরে নি। দ্রুত নেমে পরলাম সিপ্পি পাড়ায়। গিয়েই গ্রামের হেড ম্যান এর বাসায় উঠলাম। তাকে খুলে বললাম এখান পর্যন্ত কিভাবে চিনে চিনে আসলাম। তিনি আমাদের ক্লান্ত শরীর দেখে তারাহুরা করেই রান্নার সরদ ও একটি মুরগি জোগাড় করে দিলেন ও গ্রামের ঝরনাটির রাস্তা চিনিয়ে দিলেন। বেশ দ্রুত ঝরনায় গোসল সেরে, রান্নার কাজে বেস্ত হয়ে পরলাম।
ছবি - সিপ্পি পাড়ায় হেড ম্যান এর জোগাড় করে দেওয়া রান্নার সরদ
সে দিন টার দুপুরের খাবার সত্যিই মনে রাখার মতন। শরীর টা যেন আর ছেরে দিল খাবার পর। সামর্থ্য ছিল না সামনে এগুবর সে দিন। একটা অলস দিন কাটিয়ে দিলাম সিপ্পি পাড়ায় সে দিন। রাতে গ্রামের উঁচু তে এক ঢিবি তে বসে হেড ম্যান এর ২ ছেলের সাথে ভাঙ্গা বাংলায় গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। সে রাত ছিল আবার পূর্ণিমা রাত। পাহাড়ের পূর্ণিমার সৌন্দর্য যে দেখে নি তাকে বুঝিয়ে বলা দুস্কর। মনে হয় চাঁদ কে যেন আরো কাছ থেকে ছোঁয়া যায়।
সে রাতে সিদ্ধান্ত হোল আমার ২ সঙ্গি ঢাকার দিকে ফিরে যাবে অসুস্থ হয়ে পরায়। রাস্তার ধকল তো আর কম গেলো না। খুব ভোরে উঠে পরলাম, গ্রাম থেকে ২ জন লোক আদা বয়ে নিয়ে যাবে রওাংছরির বাজারে, ২ সঙ্গি তাদের পিছে পিছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, এ রাস্তায় আর পথ হারাবার ক্লাইম্যাক্স না। তাদেরকে বিদায় দিয়ে অবশেষ সামনে এগুবর একটু কঠিন সিদ্ধান্ত নিলাম। এবারের গন্তব্য রাইখাং খালের তিব্রতাকে কেন্দ্র করে উৎপন্ন হওয়া আকাইশামানিক এর উদ্দেশে, স্থানীও লোকজন একে আন্ধারমানিক ও বলে। গ্রাম এর এক লোক রাস্তা দেখিয়ে দিতেই রওনা দিলাম সাইজাম পাড়ার উদ্দেশে। সেখান হতেই কাউকে না কাউকে নিয়ে নামতে হবে আন্ধারমানিকে। একা থাকায় বেশ সজোরে হেঁটে সকালের সূর্য পুরপুরি উঠার আগেই পৌঁছে গেলাম সাইজাম পাড়ায়। কিন্তু পথে ভোর এর সূর্য অথার দৃশ্য সম্পর্কে কিছু না বললে আমার এই লেখাই বৃথা যাবে। স্নিগ্ধ মেঘের কোলে পুরো পাহাড় ঢেকে ছিল তখন, সূর্যর কিরণ যখন আকাশে ছুই ছুই তখন মেঘ গুলো একের সাথে পাল্লা দিয়ে পাহাড় এর চূড়া ভেদ করে অতিক্রম করা শুরু করল। কিছুটা স্তম্ভিত হলাম ভোর হবার মুহূর্ত টুকুতে প্রকৃতির এ আচরণ দেখে।
ছবি - ভোর হবার মুহূর্তে (রামঝুম সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকা - রওাংছরি, বান্দরবান)
সাইজাম পাড়ায় পৌঁছে যানতাম না এক চমক অপেক্ষা করছে আমার জন্য। নয়ন খিয়াং নামে এক জন আমাকে দেখা মাত্র দৌরে আসলেন। ওর সাথে পরিচয় হয়েছিল এ বছরই টেবিল পাহাড়ে যাবার সময়। কখনও ভাবি নি আবার দেখা হবে, তাও এত দূরে কোন গ্রামে এসে। ওর বাড়ি এখানেই। আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তার বাসায় নাস্তা করালো, তার পরিবারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ২ সঙ্গি ফিরে যাওয়ার কষ্ট অনেকটাই ম্লান হয়ে গেলো। নয়ন আমাকে একের পর এক শোনাতে লাগল তাদের গ্রামের আসে পাসে কোথায় কি আছে? কোথায় কোথায় আমাকে নিয়ে যাবে। আরো অনেক কিছু, হাতে সময় ছিল আমার ২ দিন আর অতিরিক্ত। ওকে বুঝিয়ে বলে রওনা হলাম আন্ধারমানিক এর উদ্দেশে। রাস্তা বেশ দূরের, তাই নয়ন ও আমি সাথে টর্চ নিয়ে নিলাম ও প্রধান ব্যাগ রেখে ছোট একটা বাগে টুক টাক জিনিস নিয়ে রওনা দিলাম।
গ্রাম থেকে বেরিএই রাস্তা গিএ পরল বুনো এক পাহাড়ি ঝিরিতে। সে ঝিরি দিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেলেই পরবে এক ঝরনা, নয়ন এর জোরা জুরিতে শেষ মেশ রাজী হলাম ওখানে যেতে। এ রাস্তায় মানুষের চলা চল প্রায় না বললেই চলে, মাথা নিচু করে পানি বেয়ে বেয়ে হাঁটতে ঘার ধরে গেলো বেশ। অনেকটুকু পথ চলার পর নয়ন একটু নিঃশব্দে পথ চলতে বলল আমাকে, কারণটি বুঝতে দেরি হোল না বেশি। বান্দরবান এর সীমান্তবর্তী এলাকা গুলতে চলা বিদ্যমান মিয়ানমারের কিছু বিচ্ছিনতাবাদি দলের উপদ্রব রয়েছে বেশ, ওর সতর্কতার মানে সেটাই। আমাকে আশ্বস্ত করে সামনের দিকে নিয়ে গেলো। অনেক দূর ঝিরি ধরে পথ চলার পর দূর হতে সুন্তে পারলাম ঝরনার প্রবল শব্দ, বুঝলাম ঝর্নাটি বেশ কাছেই। পৌঁছে বেশ বেগ পেতে হোল ঝরনার কাছা কাছি যেতে। গহীন অরণ্য র মাঝে লুকিয়ে থাকা বেশ বুনো একটি ঝরনা।
ছবি - রাইখাং খাল এর নিকটবর্তী কোন স্থানে বুনো এক ঝর্না।
ঝর্না পেরিয়ে এবার অন্য রাস্তা। যেতে হবে আন্ধারমানিক। বেশ কিছু দূর হাঁটার পর নয়ন নিয়ে এল এক পাহাড়ের খাঁজে। এখান হতে দেখিয়ে দিল সোজা পুরো পাহাড়টা নেমে পরলেই নীচে মিলবে আন্ধারমানিক এর দেখা। কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি, গত মাসের প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড় এর ভাজ এ ধ্বস এর স্পষ্ট ছাপ। ইভেন নয়ন ও অবাক হোল এটি দেখে। কি আর করা গাছের শিকড় এর উপর ভরসা করে বেয়ে নামতে থাকলাম ঐ তীক্ষ্ণ পাহাড় টি। নামার রাস্তার দীর্ঘতা পুরো বিরক্ত লাগিয়ে দিল। টানা ১ ঘণ্টা পাহাড় বয়ে নামার পর নীচে দেখা মেলল রাইখাং খাল এর সে স্থান টির জেটিকে গ্রামের লোকজন আন্ধার মানিক বলে।
ছবি - আন্ধারমানিক/আকাইশামানিক (রওাংছরি রিজিওন, বান্দরবান)
নয়ন এর উল্লেখ মতে এখানে শীত কালে যখন পানির স্রোত কমে যায়, তখন অনেক মাছ পাওয়া যায়। দূর দুরান্ত হতে বিভিন্ন গ্রামের মানুষজন এসে এখান থেকে মাছ ধরে নিয়ে যায়। সে শীত এ আসার আমন্ত্রন জানাল আমাকে। যাক, সে স্থানটিতে বেশ খানিকক্ষণ কাটিয়ে ফিরতি পথে রওনা দিলাম। এবার শরীর আসলেই ক্লান্ত। এত দীর্ঘ পথের গন্তব্য আজ এখানে শেষ হোল। বাড়ি ফিরে যাবার পালা। কিন্তু বাড়ি ফেরার রাস্তা টিকে কেন জানি অনেক দীর্ঘ, অনেক ক্লান্তময় মনে হচ্ছিল। হয়ত অজানা কোন এক টানে বাঁধা পরেছিলাম সে দিন, যে টানে বার বার ফিরে যাই পাহাড়ের ডাকে।
ছবি - বাড়ি ফেরা।
©somewhere in net ltd.