![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কয়দিন ধরে তিন ধাপে পারমিতা হিমের "নার্গিস" পড়ে শেষ করলাম। এক্সপেক্টেশন লেভেল এমনিতেই কম ছিল, কারণ বিভিন্ন নতুন লেখকের বই অনেক আশা নিয়ে পড়তে গিয়ে হতাশ হতে হতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাই এক্ষেত্রে অভাবনীয় কিছু পাবো, সেটা ভাবি নি। তবে এই বইটা আরেকটা পারফেক্ট একজাম্পল, কেন তরুণ লেখকদের মধ্য থেকে ভালো লেখা উঠে আসছে না, সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও।
যাহোক, বইয়ের নাম "নার্গিস"। এবং বইয়ের ফ্ল্যাপেও এমন সব তথ্য নার্গিস সম্বন্ধে দেওয়া, তাতে মনে হতে পারে, নার্গিসকে নিয়েই বইটা, কিন্তু টাইটেলটা কিছুটা মিসলিডিং। বইটা লেখা হয়েছে ফার্স্ট পারসন পার্সপেক্টিভ থেকে, যেখানে উত্তম পুরুষে (নাকি উত্তম মহিলা বলা উচিৎ?) আছেন রোকসানা, মূলত তিনিই উপন্যাসটির মূল চরিত্র। আমি বিশ্বাস করি, সকল উপন্যাস-ই একপ্রকার মডিফাইড বায়োগ্রাফি, নিজের জীবন থেকে বা কারো সাথে খুব গভীর কথোপকথন থেকে জীবনকে না বুঝতে না পারলে সে বিষয়বস্তু নিয়ে সেভাবে লেখা যায় না। গল্পের শুরু হয় রোকসানা ও নার্গিসের কিশোরী জীবনটা নিয়ে। উপন্যাসের এই অংশটা আমার বেশ ভালো লেগেছে, কিশোরী জীবনে বিভিন্ন কালচারাল, সোশ্যাল, ইমোশনাল শক এবজর্ভ করার অভিজ্ঞতা, কিভাবে রোকসানা নার্গিসের সাথে বন্ধুত্ব হবার কারণে কৈশোরকে একটু অন্যরকম ভাবে কাটিয়েছে, সেই বর্ণনাটা হয়তো নিজের জীবনের মধ্য থেকেই এসেছে, এজন্যই বেশ ভালো লেগেছে উপন্যাসের প্রাথমিক কিছু চ্যাপ্টার। আমাদের জীবনের ২০+ বছর বয়সে অনেক নতুন নতুন কনসেপ্টের সাথে পরিচিত হই, লেখিকা হয়তো পরবর্তী জীবনে এটাই আফসোস করেছেন যে এই কথাগুলো ওনার কৈশোরে ওনাকে কেউ জানালে খুব ভালো হত। সেই আফসোস থেকেই নার্গিস নামে বেশ ম্যাচিউর ও কমপ্লিকেটেড ক্যারাক্টারের সৃষ্টি (যাকে সেভাবে বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র না মনে হলেও গল্পের প্রয়োজনে মানিয়ে নেওয়া যায়), আর রোকসানাকে লেগেছে লেখিকার নিজস্ব সত্ত্বা থেকে নিংড়ানো কোন ব্যক্তিগত চরিত্র। এবং সেই কৈশোর জীবন নিয়ে লেখার সময় টানা কোনও ফ্লোতে লেখিকা লিখেছিলেন, সেজন্য বেশময় প্রাণবন্ত ও গতিময় লেগেছিলো।
কিন্তু উপন্যাসটি হয়তো এরকম অসমাপ্ত হয়েই পড়ে ছিল বেশ কিছুদিন। এজন্য মাঝখান পর্যন্ত আসতে আসতেই উপন্যাসের জমাট গাঁথুনিটা আর পাওয়া গেল না। আবার লেখা রিজিউম করতে গিয়ে লেখিকা বোধহয় নিজের মধ্যেও সেই ফ্লো খুঁজে পান নি। আমরা অনেক সময় কিছু একটা লেখে সামনে এগিয়ে যাই, আগে থেকে কাহিনীর সমস্ত মোড় কি হবে, সেটার একটা পাথওয়ে সেট না করেই। ভাবি যে লেখতে লেখতে মাথায় কিছু চলে আসবে। কিন্তু অনেক সময় নতুন কোন আইডিয়া আসে না, চরিত্রগুলোর জীবন যেন থমকে যায়। এই অবস্থাটাই হয়তো রাইটার্স ব্লক নামে পরিচিত। এজন্যই উপন্যাস লেখার জন্য ছোট ছোট ব্লক আগে থেকে সেট করে রাখা উচিৎ, এবং ব্লক ধরে ধরে সেই চ্যাপ্টারটিকে পূর্ণ আবেগ দিয়ে লেখার চেষ্টা করা উচিৎ। আগে থেকে প্লট প্রোগ্রেশনের ব্যাপারটা একটা ফ্লো চার্ট তৈরি না থাকলে তখন এভাবে স্লথগতি কাহিনীতে এসে পড়ে। এজন্যই হয়তো লেখিকা কাহিনীর প্রয়োজনে খুব হঠাৎ বড় একটি ঘটনা এনে সেটা নিয়ে খুব দ্রুত এনালাইসিস দেখিয়ে টাইমল্যাপ্স করে এক ধাক্কায় সবার বয়স তিন চার বছর বাড়িয়ে দিলেন। কিন্তু যেভাবে গল্পটা এগোচ্ছিল, কৈশোরের সময়টাকে ফোকাস করে, ওই সময়ে কোন ট্রমাটিক পিরিয়ডে কত রকম চিন্তা মাথায় আসে, কিভাবে সেটার সাথে কোপ আপ করে, এই ব্যাপারগুলো আরো গভীর ভাবে ডিসকভার করার জায়গা ছিল। কিন্তু তখন লেখার মাঝে আগের সেই ফ্লো ছিল না, এবং এই কারণে শুধু সংবাদ পাঠকের মত এটি হয়েছে, তারপর এটি হল, তারপর ওটা হল, এরকম করে করে বর্ণনা করা হল। আরেকটা ব্যাপার হল, প্রথম থেকে নার্গিস চরিত্রটিকে বেশ কেয়ার করে বড় করা হচ্ছিল, পাঠকরা এই জানার জন্য পড়ে যাচ্ছিলেন, দেখি, নার্গিস কি করে, নার্গিসের কি হয়। হঠাৎ করে মাঝপথে রোকসানাই মূল ক্যারাক্টার হয়ে গেল, কিন্তু রোকসানাকে কেয়ার করার জন্য পাঠকদের যেভাবে শুরু থেকে রেডি করার দরকার ছিল, সেটি করা হয় নাই, তাই মাঝে যখন নার্গিস উপন্যাসের দৃশ্যপট থেকে একেবারে নাই হয়ে গেল, আর রোকসানাকে নিয়ে কথা চলে আসলো, প্রাথমিক সময়ে পড়ার আনন্দটা খুব ক্ষীণ হয়ে আসলো। নতুন ক্যারাক্টার আসলো। কিন্তু নতুন ক্যারাক্টারগুলোর সাথে খুব ভাসাভাসা ভাবে পরিচিত করা হল। তাদের প্রতি সেভাবে কেয়ার গড়ে ওঠার অবকাশও পাঠকেরা সেভাবে পেলেন না, এমনকি লেখিকা নিজেও হয়তো ঠিক অতটা কেয়ার করতে পারেন নি। বিভিন্ন পরিচিত মানুষের বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেটে জোড়া লাগিয়ে কতগুলো প্রাণহীন ফ্রাঙ্কেস্টাইন ক্যারাক্টার ক্রিয়েট করেছেন, যাদের প্রতি পাঠক কেয়ার করার সুযোগ তেমন পায় নি, তেমন ইমোশনাল ইনভেস্টমেন্টও করে নি, বুঝেছে, এই ভাসা ভাসা ক্যারাক্টার এসেছে, আবার চলে যাবে, এত গুরুত্ব দিয়ে ক্যারাক্টারকে বোঝার কিছু নেই।
এই ভুলগুলো নতুন লেখকেরা করে ফেলে। তারা জীবনকে যতটুকু দেখেছে, সব অভজার্ভেশনই যেন তাদের প্রথম উপন্যাসের বিভিন্ন ক্যারাক্টার দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চায়। কিন্তু প্রত্যেক লেখকের নিজেকে স্টিফেন কিং-এর মত রাইটার ভাবা উচিৎ, এটা ভেবে রাখা উচিৎ, আমি জীবনে বহু বহু ক্যারাক্টারের ভেতরে গিয়ে সেই ক্যারাক্টার নিয়ে আরো অনেক উপন্যাস লেখবো, আপাতত এই উপন্যাসে জাস্ট এই কয়েকটা টাইপ ক্যারাক্টার ইন্ট্রোডিউস করি। তখন পাঠকও পড়ার সময় সেই ক্যারাক্টারের প্রতি ইমোশনাল ইনভেস্টমেন্ট করার সুযোগ পায়, লেখকও আরো ডিপলি প্রত্যেক ক্যারাক্টারকে খুব জীবন্ত করে তুলতে পারেন। সব বলে দিব, সব ফিলোসফিকাল থিওরি জানিয়ে দিব, সব গিমিকি কথা এক উপন্যাসে বলে দিব, এরকম লোভ করতে গিয়ে লেখাটার সৌন্দর্য অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায়। এজন্যই শুরুতে যখন নার্গিস আর রোকসানার বন্ধুত্বের উপর ফোকাস ছিল, ক্যারাক্টার ডেভেলোপমেন্টের জন্য সময় দেওয়া হয়েছিল, পড়তে ভালো লেগেছে, আর এরপর একে একে সাজ্জাদ, বাবু, সাগর, রূপা, শাহেদ, এরকম ক্যারাক্টার এত দ্রুত এসে গেছে কোন ডেপথ ছাড়া, উপন্যাসটা আর ভালো লাগে নি তখন।
একদম শেষের দিকে একই সাথে বিরক্তি ও লেখকদের গলার কাঁটা হয়ে যাওয়া অসমাপ্ত উপন্যাসের যন্ত্রণার প্রতি সমবেদনা ফিল করেছি। অনেকটুকু আস্তে আস্তে লেখা হয়েছে, আর কত ফেলে রাখবো, কিছু একটা লেখে শেষ করে দিই, ভালো হইলে হবে, না হইলে নাই, এমন একটা ডেসপারেশন-এর মধ্য দিয়ে উপন্যাসটি শেষ করা হয়েছে। কেন, একটা উপন্যাস অসমাপ্ত থাকতেই পারে, কেন সেটাকে তাড়াহুড়ো করে প্রকাশ করতে গিয়ে এভাবে গলাটিপে মারতেই হবে। অনেক অনেক সেরা লেখা আছে, যেটা লেখক হয়তো ১০ বছর আগে শুরু করে ফেলে রেখেছেন, তারপর বিশাল ব্রেক শেষে আবার যখন ফিল করেছেন, তখন লেখে শেষ করেছেন, কিন্তু ওই ব্রেকে হয়তো অলরেডি আরও দুই তিনটা উপন্যাস লিখে শেষ করেছেন। এমনটাই হয় লেখকদের জীবনে। কিন্তু পাঁচ বছর হয়ে গেছে, নাহ, ধুর, যেভাবে ইচ্ছে হয়, লেখে দিলাম, এমন করে উপন্যাসের সমাপ্তি টানা কিন্তু নিজের সাথেই এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। আর এই যে একটা বই বেরিয়ে গেল, যদি আমার মত এরকম আরো কিছু নেগেটিভ রিভিউ আসে, দেখা যাবে, লেখার ইচ্ছেটাই হয়তো দমে যাবে। হয়তো এই একই লেখিকা অনেক ভালো কিছু লিখতে পারতেন, কিন্তু আর হয়তো ওনার লেখা হবে না। নতুন লেখকদের তাড়াহুড়োর কিছু নেই। প্রয়োজনে ৪০ বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস প্রকাশ হোক, কিন্তু তারপরও এমন একটা সৃষ্টি হোক, যার প্রতিটা শব্দ নিয়ে লেখক অহংকার করতে পারে। কিন্তু নিজেই যখন রিয়েলাইজ করতে পারে, লেখাটা অত ভালো হচ্ছে না, তাও ছাপানোর তাগিদে যখন উপন্যাসটির "সমাপ্তি" টানা হয়, তখন কিন্তু লেখকসত্ত্বার উপর আঘাত আসে। হয়তো কিছুদিন পরেই রিগ্রেট আসবে, ইশ, এত সুন্দর করে যেই নার্গিস আর রোকসানাকে বিল্ড আপ করেছিলেন, তাদেরকে আরো সুন্দরভাবে গ্রো করতে দিলে হয়তো খারাপ হত না। এই যে চট করে সাজ্জাদ, রূপা, নোভা, এরকম ক্যারাক্টারের খুব ডেপথে না গিয়ে লেখে ফেলা হল, পরবর্তী উপন্যাসগুলোতে আর ওই ক্যারাক্টারগুলো আনার সুযোগ সেভাবে থাকবে না, কিন্তু একদম ডেপথে গিয়ে সেই ক্যারাক্টারগুলোকে এক্সপ্লোর করার জায়গা কিন্তু ছিল। তাই লেখতে গিয়ে লোভ সংবরণ করা খুব বড় একটা দায়িত্ব। এই জায়গাটাতে নতুন লেখকদের আরো বেশি সচেতন হওয়া দরকার। বই একটা লিখে ফেললেই হল না।
আর বইয়ের দাম নিয়ে কিছু কথা না বললেই। মাত্র ২০০ পৃষ্ঠার বই, তাই ফন্ট চয়েজ আর লাইন স্পেসিং-এর জন্য এত পৃষ্ঠা গেছে। কিন্তু নরমালি ছাপা হলে হয়তো ১৫০ পেজও যেত না। এমনি একটি উপন্যাসের মূল্য ৩০০ টাকা, বড়জোড় ৩৫০ টাকা করা উচিৎ, আমি বইয়ের বাজার সম্পর্কে যতটুকু বুঝি, সেই ধারণা থেকে বললাম। হয়তো অনেকেই ৫০০ টাকা দিয়ে বইটা কিনবে, কিন্তু বইটা কিনে হতাশা ফিল করবে, তখন একজন তরুণ লেখক ২৫০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করলেও মনের মাঝে ক্রেতাদের এই ফিলিং আসবে, ধুর, কি আর লেখবে, ৫০০ টাকা দিয়ে কিনে তো ঠকছি, আর কত ঠকবো। ৫০০ টাকার বই কিনে ভালো লাগলে সেটা এক ব্যাপার, কিন্তু "ঠকেছি" টাইপ ফিলিং বোধ করলে সেটা আরও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করে। বেশি দামের বইকে বিভিন্নভাবে জাস্টিফাই করা যায়, কিন্তু ক্রেতাদের মনে কোন একটা জিনিসের যে "পারসিভড ভ্যালু" আছে, সেটা চট করে চেঞ্জ করা যায় না। আমার কাছে যেমন পারসিভড ভ্যালু ৩০০ ছিল, ঠিক তেমনি আরও আরও পাঠকের কাছে পারসিভড ভ্যালু কত ছিল, সেটার যদি আনবায়াসড জরিপ চালানো হয়, আমার মনে রেঞ্জ ২৫০-৩৫০ এর মধ্যেই থাকবে। আর নতুন লেখকদের কিন্তু বিখ্যাত না হয়েই বই প্রকাশ করে লাভের কথা চিন্তা করা ঠিক না। প্রথম বই প্রকাশ করতে হবে এইজন্য, আমি আমার কথাগুলো বলতে চাই, যে কথাগুলো অন্য কেউ বলছে না, যে কথাগুলো বলার জন্য প্রতিনিয়ত নিজের মাঝে তাগাদা ফিল করছি, সেই কথাটি বলতে চাই, এরকম ফিলিং থেকে। তারপর বিখ্যাত হলে না হয়, "আজ হিমুর গায়ে হলুদ", "আজ হিমুর বিয়ে", "আজ হিমুর বৌ ভাত", টাইটেল দিয়ে দিয়ে ব্যবসায়িক কারণে লেখালেখি হোক, সমস্যা নাই। কিন্তু প্রথম লেখার উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ কেবল "গল্পটা বলা", আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া না। লেখিকার এই গিমিকি ৫০০ টাকার প্রাইস রাখারও প্রতিবাদ জানাই একজন পাঠক হিসেবে, আমি চাই অন্য নতুন লেখকেরাও এই প্র্যাকটিস শুরু করে বড় কোন ক্ষতি না করুক অলরেডি ক্ষয়িষ্ণু বইয়ের বাজারে।
©somewhere in net ltd.