| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মেয়েটাকে নিয়ে যে একটু বেশী বাড়াবাড়ি হবে, আগেই বুঝেছিলাম। আজ খবর পেলাম ঢাকায় আনা হচ্ছে চিকিৎসার জন্য। প্রধানমন্ত্রী দ্বায়িত্বও নিয়েছেন তাঁর চিকিৎসার। ঐ যে, যে মেয়েটার ছবি কিছুদিন আগেই দেখলাম, প্রায় সব পত্রিকার প্রথম পাতায় এসেছে। কোন পত্রিকায় এক চোখে ব্যান্ডেজ বেধে শুয়ে আছে। কোন পত্রিকায় চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে আর তাঁর মা হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে আছে। চট্টগ্রামের মেয়ে। বুঝতে পারছেন? কোচিং করতে যাওয়ার পথে কক্টেলের স্প্লিন্টার চোখে লাগার কেসটা। প্রায় সবাই এই ছবি ছাপিয়ে দারুণ সব সেন্টিমেন্টাল প্রতিবেদন করেছে। কোন মানে হয়? সব পত্রিকারই আসলে ধান্ধা পত্রিকা বিক্রি করা।
এক পত্রিকা তো আবার হেডলাইন করেছে, ‘কি দোষ ছিল এই মেয়ের?’ আচ্ছা বলুন, এসব প্রশ্ন করার কোন মানে হয়? দোষ তো আমরা সবাই জানি। হরতালের দিন বাইরে বেরোনো কেন বাবা? জানেই তো রাস্তা ঘাটে গাড়ী ভাংচুর, আগুন দেয়া এসব ঘটবে। রিক্সা ভাংচুর, ঢিল ছোড়া এসব কি টিভিতে দেখায় না? দু একটা কক্টেল না ফাটালে হরতাল হলো? শুধু হরতাল ডাকলেই কি মানুষ সদল বলে হরতাল করে? না জোর করে করাতে হয়? সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে কি করা হয় তা তো জানেন ই। আমরাও তাই করেছি। বর্তমান সরকারী দল যখন বিরোধী দলে ছিল তখন তাঁরাও তাইই করেছে। সব জানবার পরেও রাস্তায় বেরোলে এসব তো ঘটবেই। যেমন কর্ম তেমন ফল।
কক্টেল ফাটানো তো ইদানীং শুরু করেছি। তাও জামায়াতের দেখাদেখি। আগে তো শুধু গাড়ী ভাংচুর আর লাঠি সোটা নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করতাম। তাতে খুব ভালো কাজ হতো না। মানুষ পায়ে হেঁটে কিংবা রিক্সায় অফিসে যাওয়া আসা শুরু করেছিল। প্রায় অফিস ই চলতো। তাই আজকাল কক্টেল ফাটানো টা একটা স্ট্যান্ডার্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। না ফাটানোর মানে সেই দলের কাছে কক্টেল নেই। আরও সহজভাবে বললে, দলে ক্যাডার নেই। এমন দলকে কে পাত্তা দিবে বলেন?
তাবে যাই বলুন, কক্টেল ফাটানো, গাড়ী ভাংচুর আর আগুন দেয়ায় একটা আলাদা আনন্দ আছে। গরীব সব টেম্পু ওয়ালা যখন করজোর করে ভিক্ষা চায়, ‘গাড়ীটা ভেঙ্গেন না’ নিজেকে তখন রাজা মহারাজা মনে হয়। আমার কাছে দয়া ভিক্ষা চাইছে। কিন্তু উপায় নেই। গাড়ী ভাংচুর না করলে সবাই গণ হারে গাড়ী বের করা শুরু করবে। হরতালের তখন কি হবে? দিনশেষে বলতে হবে না ‘হরতাল সর্বাত্মক ভাবে সফল হয়েছে’। জনগণকে ধন্যবাদ দিতে হবে না? সেই টেম্পু ওয়ালা কিংবা রিক্সা ওয়ালার সাময়িক ‘মালের ক্ষতি’র বিনিময়ে দেশকে গনতন্ত্র উপহার দিতে হবে না? সে জন্যই তো এই আন্দোলন। চোখ নষ্ট হয় হোক, গনতন্ত্র সবার আগে।
আর দু এক জায়গায় টায়ারে আগুন না জ্বালালে ঠিক আন্দোলনের ফ্লেভার আসে না। কেমন মিনমিনে টাইপের মনে হয়। অনেকে আবার ‘সাহস নেই’ কিংবা ‘ভীতু’ মনে করে। এই পত্রিকা ওয়ালারাই হয়তো রিপোর্ট করবে ‘হরতাল ডেকে নেতা কর্মীরা মাঠে নেই’। কিংবা রিপোর্ট করবে ‘সারা দেশে ঢিলে ঢালা হরতাল’। আন্দোলন সহিংস হলে তা কাভারেজ পায় ভালো। দু একটা লাশ পড়ল আর প্রথম পাতায় লাশের ছবি কিংবা ক্রন্দনরত মা বা স্ত্রীর ছবি না ছাপলে পত্রিকা চলবে কিভাবে? বলেন? এই যেমন এই মেয়েটার ছবি সবাই ছেপেছে।
একটা হরতাল ডাকা হবে আর সেদিন রাস্তা ঘাটে দেদারসে গাড়ী ঘোড়া চলবে, স্কুল কলেজ ব্যাংক খোলা থাকবে। অফিস আদালত সব চলবে। তাহলে আমাদের কি হবে? আমাদের রেপুটেশান বলে কিছু থাকবে? এই কয়েকজন নিরীহ দরিদ্র মানুষের জন্য তো আর আমরা আমাদের রেপুটেশান নষ্ট করতে পারি না। আমাদের ডাকা হরতালে, হরতাল হওয়া চাই। তা সে যেভাবেই হোক। ভদ্র কথায় মানলে ভালো নইলে কক্টেল ফাটিয়ে ভয় দেখিয়ে, গাড়ী ভাংচুর করে আমাদের হরতাল সফল করতে হবে। এই মেয়ে আহত হয়ে ভালোই হয়েছে। বাকী সবার জন্য শিক্ষণীয় একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে। এরপর হরতালের দিনে কেউ কোচিং এ যেতে দুইবার ভাববে। একটা চোখের বিনিময়ে এটাই কি কম পাওয়া?
চুপি চুপি আরও একটা কথা বলে রাখি। এসব কক্টেল কিন্তু সবার হাতে দেয়া হয় না। একটু ক্যাডার হওয়া লাগে। কথায় কথায় ছুরি চাকু বের করতে পারে কিংবা গালি গালাজ ‘আমারে চিনস ?’ ধাঁচের কিছু হুমকি দেয়া। এসব করে প্রথমে নিজেকে ডেয়ারিং প্রমাণ করতে হয়। এরপর নিজের স্ট্যাটাস বাড়লে তখন কক্টেল চার্জ এর অনুমুতি পাওয়া যায়। আর ক্যাডার স্ট্যাটাস পাওয়া মানেই আজ হোক কাল হোক নেতা হওয়ার সুযোগ। দল ক্ষমতায় গেলে টেন্ডার বাজির সুযোগ। এমন সুযোগ কে হাতছাড়া করে বলেন? কক্টেল চার্জ তো আমাকে করতেই হবে। মেয়েটারই উচিৎ ছিল সাবধানে চলা কিংবা না বের হওয়া।
তাই যতই দরদ দেখান এই সব কক্টেল আহতদের জন্য, এতে আমরা থামবো না। হয়তো এবার একটু সতর্ক হয়ে কক্টেল মারবো, এই যা। তবে কক্টেল কিংবা জ্বালাও পোড়াও হরতালের দিন থাকবেই। গাড়ী ভাংচুর আজকাল আগের দিন করি। হরতালের দিন সাধারণতঃ কেউ গাড়ী বের করে না। ফলে ভাঙ্গার মত গাড়ী পাওয়া যায় না। দুএকটা বাস বেরোয়। সেগুলোতে হামলার চেষ্টা তো থাকেই। ভাংচুরের দৃশ্য টিভি চ্যানেলে দেখালে আবার নেতাদের কাছে দাম বাড়ানো যায়। কখন দল ক্ষমতায় আসে, বোঝেন ই তো।
খুব বেশী তো কিছু হয় নি। মরে তো নি। আর মরলেও তো তাঁর জন্য বাণী আছে ‘আল্লাহ্র মাল...’। আচ্ছা, আমার কথাগুলো কি খুব নিষ্ঠুরের মত শোনাচ্ছে? এতদিনেও আপনাদের বিবেক মরে নি? এদেশে আজ পর্যন্ত কি কোন রাজনৈতিক খুন কিংবা হরতালের দিনে ঘটে যাওয়া মৃত্যুর কোন বিচার হয়েছে? বা হবে মনে করেন? নিজের বিবেককেই জিজ্ঞেস করুন। তাহলে আর শুধু শুধু একজনের জন্য চোখের পানি ফেলছেন কেন? ‘আহা’ ‘উহু’ ‘ইস’ এসব কয়দিন বলে তো ঠিকই চুপ মেরে যান। পত্রিকায় আরও খবর আছে সেগুলো পড়তে শুরু করেন। এর আগের খুন জখমগুলো যেভাবে মেনে নিয়েছেন, এবারের টাও মেনে নেন। আর না পারলে, এতক্ষণ যা বললাম সেসব গল্প বলে নিজের বিবেককে চুপ করান।
©somewhere in net ltd.