নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভাষা সৈনিক ও চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমেদ ১৯৪৮ সালে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক থাকাবস্থায় বাংলা মাতৃভাষা জন্য রাজপথে আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাবরণ করেছেন একাধিকবার। ১৯৫০ সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দি থাকাবস্থায় গুলি বর্ষণ করা হলে বুদ্ধি বলে প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
১৯৫২-৫৩ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় রাজধানীতে জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক থাকা অবস্থায় সফিউদ্দিন আহমদ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েও তিনি কারাবরণ করেন। এর ফলে তিনি ভাষা সৈনিক হিসেবে উপাধি পান।
দেশের বিভিন্ন সংগঠন ভাষা সৈনিক ও চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমেদকে সংবর্ধনা প্রদান করে। তার মধ্যে জেলা প্রশাসন আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে শরীয়তপুর বাসীর পক্ষ থেকে ১৯৯৯ সালে ভাষা সৈনিক সফিউদ্দিন আহমদকে গণসংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
ছাত্র অবস্থায় বিট্রিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি দেশ ও দেশের জনগণের এবং মফস্বল সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। ভাষা সৈনিক সফিউদ্দিন আহমদ সংবাদপত্র ও মফস্বল সাংবাদিকতাকে ব্রত করে দেশ ও জনগণের সমস্যা এবং গণ মানুষের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করার দায়িত্বটুকু নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করে গেছেন।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন :
ভাষা সৈনিক সফিউদ্দিন আহমদের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হাড়িদিয়া গ্রামে । তার বাবা জলকদর দেওয়ান বার্মিজ জাহাজের সারেং ছিলেন। আর্থিক অনটন ছিল না এ পরিবারে। তাই কমিউনিস্টদের জলকদর দেওয়ানের বাড়িতে আশ্রয় পেতে কোনো অসুবিধা হতো না। পুলিশও সন্দেহ করতো না-মুসলমানের বাড়িতে কমিউনিস্টদের স্থান নেই- এটাই ছিল ব্রিটিশ যুগে বিক্রমপুরে কর্মরত পুলিশের ধারণা। তাদের গ্রামের বাড়ি ছিল তৎকালীন কমিউনিস্ট রাজনীতিকদের একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
ছেলে এন এ শুক্তি জানান, স্কুলের ছাত্রাবস্থায় সফিউদ্দিন আহমদ তাদের বাড়ির বাংলা ঘরে আশ্রয় নেওয়া বিপ্লবী-কমিউনিস্টদের খাবার পরিবেশন করতেন। ভিতর বাড়ি থেকে খাবার রান্না করে দিতেন তার মা। এ সময়ে তিনি কমিউনিস্টদের চিঠি বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতেন। স্কুলের উপরের ক্লাসে ওঠার পরে তার বড় ভাই শামসুদ্দিন আহমদ মুন্সীগঞ্জে শহরে নিয়ে তাকে উচ্চ ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করে দেন।
এ সময়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে। সফিউদ্দিন আহমদ স্কুলের পড়া লেখার অবসরে হকারি করতেন। কলিকাতা থেকে আসা ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকা তিনি মুন্সীগঞ্জ শহরে বিক্রি করতেন। পত্রিকা বিক্রি ও পড়া থেকেই তার মনে রাজনীতির সঙ্গে সাংবাদিকতা করার আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় বিক্রমপুরের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে সংবাদ লিখে পাঠাতেন। ব্রিটিশ আমলের তেভাগা আন্দোলনসহ নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় কৃষক সভার জাতীয় সম্মেলনে সফিউদ্দিন আহমদ বিক্রমপুর কৃষক সভার কর্মী হিসেবে জিতেন ঘোষের সঙ্গে যোগদান করেছিলেন। পরবর্তীতে বড় ভাইয়ের সঙ্গে ১৭ বছর বয়সে ১৯৪০ সালের লাহোর সম্মেলনে যোগদান করেন। তার ভাবধারা এবং পছন্দের পার্টি সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সদস্য হন ১৯৪২ সালে।
ভাষা আন্দোলনে ভুমিকা :
১৯৪৮ সালে ‘উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’র প্রতিবাদে গ্রেফতার হন এবং কারাবরণ করেন। ১৯৫০ সালে রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দি ছিলেন তিনি। বন্দি অবস্থায় গুলিবর্ষণ করা হলে তাৎক্ষণিক বুদ্ধিবলে প্রাণে বেঁচে যান তিনি। ১৯৫২-৫৩ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা জগন্নাথ কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সফিউদ্দিন আহমদ। ‘১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েও তিনি কারাবরণ করেন।
এন এ শুক্তি জানান, ভাষা সৈনিক হিসেবে দেশের বিভিন্ন সংগঠন ভাষা সৈনিক ও চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমেদকে সংবর্ধনা প্রদান করেছে। তার মধ্যে জেলা প্রশাসন আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে শরীয়তপুর বাসীর পক্ষ থেকে ১৯৯৯ সালে ভাষা সৈনিক সফিউদ্দিন আহমদকে গণসংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
তিনি আরো জানান, ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের প্রথম দিনের রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সফিউদ্দিন আহাম্মদ, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আবুল মনসুর আহমদ ও কফিল উদ্দিন চৌধুরীসহ ১৭ জনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নিজ এলাকায় যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী এম কোরবান আলীর পক্ষে সফিউদ্দিন আহমদ দৃঢ় অবস্থান নেন। মুসলিম লীগের প্রার্থী ছিলেন তার আপন বড় ভাই শামসুদ্দিন আহমদ। বাম রাজনীতি ছেড়ে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের রাজনীতি ধারণ করার জন্যই তিনি বিক্রমপুরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে আপন বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তার এ ভূমিকা তৎকালীন পাকিস্তানে দারুন প্রশংসিত হয়। সফিউদ্দিন আহমদের নজিরবিহীন এ ভূমিকা যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে লৌহজং আসন থেকে এম কোরবান আলীকে প্রদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভোটে বিজয়ী হতে সহায়তা করে।
১৯৬৫ সালে সম্মিলিত বিরোধী দলীয় মোর্চ্চা (COP) গঠিত হলে তিনি মুন্সীগঞ্জ মহকুমার আহ্বায়ক হন। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ও ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে তিনি বিক্রমপুরের সব জায়গায় চষে বেড়ান। কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে পরবর্তীকালে তিনি মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর দল ন্যাপে যোগ দেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিজের অবস্থান থেকে অংশ নিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হবার পরে তিনি সর্বদাই ক্ষমতাসীনদের বিরোধীতা করেছেন। কখনও ন্যাপ ভাসানী, কখনও কমিউনিস্ট পার্টি ও মোজাফফর আহমদের ন্যাপ এ থেকে রাজনীতি করেছেন। সংসদ নির্বাচনে একাধিকবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হয়েছেন।
১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন কারাগারে বিভিন্ন মেয়াদে মোট ১০ বছর জেলজীবন এবং ১৩০ দিন অনশনে কাটান তিনি। রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে গুলিবর্ষণে প্রাণে রক্ষা পেলেও বিভিন্ন সময় বহুবার নির্যাতিত হয়েছিলেন তিনি।
সফিউদ্দিন আহমদ স্কুলে লেখাপড়া শুরু করেন অনেক বয়সে। স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে তিনি মাঠে গরু চড়াতেন। তার ভাষায় ‘স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে আমি রাখাল ছিলাম’।
ভাষা সৈনিক সফিউদ্দিন আহমদ সংবাদপত্র ও মফস্বল সাংবাদিকতাকে ব্রত করে দেশ ও জনগণের সমস্যা এবং গণমনের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করার দায়িত্বটুকু নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করে গেছেন। তিনি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় সিপিআই বা কমিউনিটি পার্টি অব ইন্ডিয়ার সাপ্তাহিক মুখপত্র জনযুদ্ধ কলকাতা থেকে এবং ইংরেজি ভার্সন বোম্বে থেকে প্রকাশিত ‘পিপলস ওয়ার’ পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়ে সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করেন।
ছাত্র রাজনীতির পাশাপাশি ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পূর্বে কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ, দৈনিক মিল্লাত, আমার দেশ এবং সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার সংবাদদাতা হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পাকিস্তান (পরবর্তীকালে দৈনিক বাংলা), অবজারভার (পাকিস্তান), দৈনিক ইত্তেফাক, মর্নিং নিউজ প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার সুযোগ পান। এছাড়া, একজন সংবাদকর্মী হিসেবে অনেক সংবাদ সংস্থার সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তার মধ্যে ইউপিপি, এনা, এপিপি, বিএসএস প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও সাংবাদিকতা চালিয়ে যান। দৈনিক বাংলায় থাকা অবস্থায় তিনি দৈনিক জনতার ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। এছাড়া দেশ- বিদেশের আরো অনেক সংবাদপত্র এবং সংস্থাসমূহে কাজ করেছেন।
শুধু সাংবাদিক হিসেবেই নয়, সংগঠক হিসেবেও তিনি ছিলেন দক্ষ ও কঠোর পরিশ্রমী। তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও ১৯৬১ সালে তিনি এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির বহুবার সভাপতি হন।
মফস্বল সাংবাদিকদের ন্যায্য বেতন ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন তিনি। সরকার নির্ধারিত বেতন (রোয়েদাদ) অর্থাৎ ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের লক্ষে প্রেস কমিশন আর কাউন্সিলের সদস্য হয়ে সংবাদকর্মীদের বেতন কঠামো গঠনে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে গেছেন।
এছাড়া, তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য এবং মুন্সীগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ও বিক্রমপুর প্রেসক্লাবের প্রাক্তন সভাপতিসহ বিভিন্ন সংগঠন সংস্থা এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট কর্তৃক আয়োজিত ২৬ জাতি দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সাংবাদিকদের কনফারেন্সে তিনি বাংলদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের প্রতিযোগিতা অংশে, সিরিজ বক্তৃতায় বাংলাদেশের গ্রামীণ সাংবাদিকতার ওপর বক্তব্য রেখে তিনি প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৮৭ সালে ভারতে অসমের গোয়াহাটিতে অনুষ্ঠিত অল অসম জার্নালিস্ট কনফারেন্সে তাকে প্রধান অতিথি করে, পরে অসম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সম্মাননা প্রদান করেন।
এছাড়া, সাংবাদিকতায় অবদান রাখায় ১৯৯৯ সালে জনকণ্ঠ প্রতিভা সম্মাননা’, ২০০২ সালে মাওলানা মনিরুজ্জামান (চট্টগ্রাম) স্বর্ণপদক, মওলানা ভাসানী স্বর্ণপদক, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া পদক পান। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারদলীয় জোট সরকারের সময় বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকা অবস্থায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ২০০৬ সালে এক সুফি সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বন্দি থাকা রাজবন্দী সফিউদ্দিন আহমদকে সম্মাননা ও পদক প্রদানসহ জায়নামাজ ও তসবি প্রদান করেন। বাংলাদশে সুফি পরিষদ-২০০৬ পদক ও অতীশ দীপঙ্কর পদকসহ আরও গুণীজন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের বিখ্যাত চারণ সাংবাদিক এবং বিক্রমপুরের কৃতিসন্তান হিসেবে ২০০০ সালে ভারতের কলকাতায় বিক্রমপুর সম্মেলনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদান করেন।
দেশের এই সংগ্রামী কৃতি সন্তান ও মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ গ্রামীণ সাংবাদিক ও ভাষা সৈনিক সফিউদ্দিন আহমদ ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর রাতে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানের পারিবারিক কবরে তাকে সমাহিত করা হয়।
আজীবন সংগ্রামী, আপোষহীন ছাত্রনেতা, ভাষা সৈনিক ও চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমদ তার ত্যাগ ও আদর্শের জন্য অমর হয়ে থাকবেন।
©somewhere in net ltd.