![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটি বিতর্ক যুদ্ধ
কতিপয় লোক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যে, যে মুসলমান অনবরত গুনাহ করে এবং এর উপর অবিচল থাকে তার হুকুম কি? একদল বলেছেন, সে কাফির। অন্যরা বলেছেন, না না, সে মুসলমান। ঈমান অটুট থাকলে গুনাহ করলে আর কি হয়? অপর দল বলেছেন, ঈমান ও কুফরের মাঝখানে একটি স্তর আছে। সে এই পর্যায়ভুক্ত।
এ ছিল একটি শব্দগত বিতর্ক। এর ভিত্তিতে মুসলিম উম্মাহ দুটি পরস্পরবিরোধী দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং এর পরিণতিতে একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বাস্তবিকপক্ষে এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করাটাই ভুল, বরং নাজায়েয। এটা মূলত ইসলামের মেজাজ-প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতারই ফল।
ইসরার (পুনঃ পুনঃ) শব্দটির মধ্যে ইচ্ছার একাগ্রতা এবং সংকল্পের দৃঢ়তার অর্থও নিহিত আছে। এ থেকে প্রকাশ পায় যে, কোন ব্যক্তি বাঞ্ছিত ফলাফল অনুমান করে নিয়েছে এবং উপায়-উপকরণ ও কার্যকারণ শক্তির উপর তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে। অন্য কথায় বলা যায়, এটা আল্লাহর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ স্বরূপ, তাঁর সাথে নাফরমানী করার সংকল্প, তাঁর প্রতি বেপরোয়া মনোভাবের প্রকাশ এবং তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ঘোষণা। একজন মুসলমানের বেলায় এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গী কল্পনা করা যায় না।
নিঃসন্দেহে কোন নিষ্ঠাবান মুমিনের ইচ্ছা-শক্তির মধ্যে দুর্বলতা থাকতে পারে তার প্রবৃত্তির মধ্যে উত্তেজনা এবং তার আবেগের মধ্যে উচ্ছ্বাস থাকতে পারে, এভাবে সে খারাপ কাজের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। কিন্তু এটাকে ‘ইসারার’ বলা যায় না। যে ইতিবাচক শক্তি মানুষকে ভাল কাজের দিকে ধাবিত করে, তার দুর্বলতার কারণে সে যদি খারাপ কাজ করে বসে তাহলে এটাকে ‘দুষ্কর্মের উপর অবিচল থাকা বা তা বারবার করা’ বলাটা ঠিক হবে না। কেননা মুমিন ব্যক্তির কখনো পদস্খলন ঘটলে অবশ্যম্ভাবীরূপে তার মধ্যে এক ধরনের অপমান এবং লজ্জাকর অনুভূতি জাগ্রত হয় –চাই সে অনুভূতি দুর্বল হোক অথবা সবল।
কিন্তু যদি এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, কোন মুসলমান হাসতে হাসতে মারাত্মক অপরাধে লিপ্ত হয় এবং ইসলামী শরীআতকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতে থাকে তাহলে বলতে হবে তার অন্তর থেকে আল্লাহর দীন বিদায় নিয়েছে এবং ইসলামের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।
অপমানবোধ এবং অনুভূতিই যেকোন মুমিন ব্যক্তিকে তওবার দিকে ধাবিত করে –চাই সে অবিলম্বে তওবা করুক বা বিলম্বে। এই অনুভূতিই তাকে ঈমানের সাথে সংযুক্ত করে রাখে। কিন্তু যদি এই বোধশক্তি বিদায় হয়ে যায় তখন ঈমানের আর কি বাকি থাকে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
মুমিন এবং ঈমানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে যেন খুঁটিতে বাঁধা একটি ঘোড়া। তা চারদিকে চক্কর দেয় আবার নিজের খুঁটির কাছে কাছে ফিরে আসে। মুমিন ব্যক্তি ভুল করে বসে কিন্তু সাথে সাথে নিজের প্রতিপালকের কাছে ফিরে আসে।–মুসনাদে আহমাদ, ৩য় খণ্ড, পৃ. ৩৮-৫৫
তিনি আরো বলেছেনঃ
মুমিন ব্যক্তি অপরাধী এবং তওবাকারী ও ক্ষমা প্রার্থনাকারী। যে ব্যক্তি তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে মারা যায় সে-ই হচ্ছে সৌভাগ্যবান।
ইসরার বা বাড়াবাড়ি এমন একটি জিনিস যা সহসা সৃষ্টি হয় না। মানুষ একবার, দু’বার, তিনবার, এভাবে বারবার গুনাহ করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত তার অনুভূতির মৃত্যু ঘটে। এখন সে কেবল অপরাধই করে না, বরং অপরাধের প্রতি তার আকর্ষণ সৃষ্টি হয়ে যায়। এই অবস্থায় নামই হচ্ছে ইসরার। অপরাধের গলিপথে পা রাখার পর ঈমানের শিকড়গুলো কাটা শুরু হয়ে যায় এবং মানুষ যদি তওবার দিকে অগ্রসর না হয় তাহলে ঈমানের শিকড়গুলো কাটতেই থাকে।
এটা এমন একটা বিষয় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যাপারগুলোর সঠিক অধ্যয়ন এবং ঘটনাবলীর সঠিক মূল্যায়ন ছাড়া নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব নয়। অন্যথায় বিতর্ক ও শব্দের মারপ্যাচ একটি খেলা ছাড়া আর কিছুই নয়।
আমি এখানে নীতিশাস্ত্রের কিছু স্বীকৃত তত্ত্ব তুলে ধরতে চাই। এর আলোকে দুষ্কর্মের শ্রেণীবিভাগ, তার ধরন, দুষ্কৃতিকারীদের স্তর এবং এর ফলে কুফর অথবা ঈমানের সাথে তাদের কতটা কাছে অথবা দূর সম্পর্ক সৃষ্টি হয় –তা অনুধাবন করা যেতে পারে। উস্তাদ মুহাম্মদ ইউসুফ মূসা তার ‘মাবাহিসুন ফালসাফিয়াতুন ফিল আখলাক” নামক গ্রন্থে বোধশক্তির কয়েকটি স্তর বর্ণনা করেছেন। তা সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করা হলঃ
উদ্ভিদেরও খাদ্য এবং আলো-বাতাসের প্রয়োজন হয়। খাদ্য সংগ্রহের জন্য শাখা-প্রশাখা শূন্যের দিকে উঠে যায়। এটাকে তিনি ‘প্রয়োজন’ নাম দিয়েছেন।
যেসব জিনিস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে পশু জীবন ধারণ করে সে সেদিকেই ধাবিত হয়। সে জিনিস তার প্রয়োজন সে সম্পর্কে তার সীমিত জ্ঞানও আছে। কিন্তু এসব জিনিস লাভ করে যে ফল পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে পশুর কোন বোধশক্তি বা চেতনা নেই। তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘ক্ষুধা’।
তিনি পুনরায় বলেন, এরপর আমরা মানুষের দিকে অগ্রসর হব। আমরা দেখছি মানুষ তার প্রয়োজনীয় প্রতিটি জিনিসের জন্য চেষ্টা সাধনা করে এবং এ সম্পর্কে তার পরিপূর্ণ বোধশক্তিও রয়েছে। তা অর্জন করতে পারলে যে আনন্দ পাওয়া যায় এবং হারিয়ে গেলে যে কষ্ট পাওয়া যায় –এ সম্পর্কে তার পূর্ণ অনুভূতি রয়েছে। এই জিনিসই তাকে জন্তু-জানোয়ারের থেকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দান করে। তার এই বৈশিষ্ট্যকে ‘ইচ্ছা বা মনোযোগ’ নাম দেওয়া যায়। মানুষ যে জিনিসের সঠিক ধারণা রাখে এবং এর ফলাফল সম্পর্কেও জ্ঞান রাখে –তার দিকে মনোনিবেশের নাম হচ্ছে ‘ইচ্ছা বা মনোযোগ’। মানুষের উদ্দেশ্য-লক্ষ্য বিভিন্নরূপে হয়ে থাকে এবং তদনুযায়ী ইচ্ছাও বিভিন্নমুখী হয়ে যায়। কারো লক্ষ্য হচ্ছে বিখ্যাত ব্যক্তি হওয়া, কারো উদ্দেশ্য হচ্ছে নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব হস্তগত করা, কারো উদ্দেশ্য হচ্ছে ধন-সম্পদ অর্জন করা ইত্যাদি।
একই শ্রেণীভুক্ত ঝোঁকপ্রবণতা যা একই উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে তাকে ‘আলাম’ বলা হয়। আর এখান থেকেই আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। যখন কোন ঝোঁক-প্রবণতা সমশ্রেণীর অন্যসব ঝোঁকপ্রবণতার উপর বিজয়ী হয় এবং এগুলোকে পূর্ণরূপে পরিবেষ্টন করে নেয় তখন এটাকে বলা হয় ‘আকর্ষণ’।
অতঃপর যে জিনিসের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি হয় –সে সম্পর্কে মানুষ যখন চিন্তা-ভাবনা করে, তার পথে যেসব প্রতিবন্ধকতা থাকে তা দূরীভূত করে, যেসব গিরিপথ থাকে তা সমতল করে নেয়, অতঃপর তা অর্জনের জন্য একাগ্র হয়ে উঠে –এটা হচ্ছে আকর্ষণের পরবর্তী পর্যায়, আর এর নাম হচ্ছে ‘সংকল্প’। আকর্ষণ এবং সংকল্পের মধ্যে পার্থক্য এই যে, আকর্ষণ অনেক সময় পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় না। তা বাঞ্ছিত ফলাফল থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। মানুষের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি হয় কিন্তু তা অর্জন করা সম্ভব হয় না।
ইচ্ছা বা সংকল্প সম্পর্কে বলা যায়, মানুষ প্রথমে কোন জিনিস সম্পর্কে চিন্তা করে, যাবতীয় উপায়-উপাদানের পরিমাপ করে, অবস্থা ও পরিবেশ যাচাই করে, বাঞ্ছিত জিনিস লাভ করা সম্ভবপর মনে হলে তা অর্জনের সংকল্প করে। অতঃপর বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের পালা আসে। যদি তা স্বভাবের মধ্যে ঢুকে যায় তখন তার নাম দেওয়া হয় স্বভাব। অতএব জানা গেল আভ্যন্তরীণ শক্তির এক আলামের উপর অপর আলামের বিজয়ী হওয়ার নাম হচ্ছে সংকল্প।
মনোবিজ্ঞানের এই ব্যাখ্যা থেকে পরিস্কার হয়ে যায় যে কবীরা গুণাহ বারবার করাটা এমনিভাবেই হয় না। এর পূর্বে বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করতে হয়, যার পরিণতি হচ্ছে কবীরা গুনাহ। যেখানে এক স্তর শেষ হয় সেখানে পরবর্তী স্তরের সূচনা হয়। এভাবে সর্বশেষ স্তরে পৌঁছে যায়।
অতএব যখন আমরা জানতে পারলাম যে, কোন সাময়িক ঝোঁক-প্রবণতা অথবা কোন দুর্বার ইচ্ছার পরিণতিতে যে অপরাধ সংঘটিত হয় তা ঈমানকে অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়। তা তার দেহে এত গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত তার উপর তওবার কাঁটা ফুটানো না হয় এবং অনুশোচনার ব্যাণ্ডেজ না লাগানো হয়, ততক্ষণ তা নিরাময় হয় না।–নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
ব্যভিচারী যখন যেনায় লিপ্ত হয় তখন সে মুমিন থাকে না। (অর্থাৎ তার ঈমানী প্রত্যয়ে দুর্বলতা এসে যায়, অন্যথায় সে পাপে লিপ্ত হতে পারে না)। চোর যখন চুরি করে তখন সে মুমিন থাকে না। মদখোর যখন শরাব পান করে তখন সে মুমিন থাকে না।–ইবনে মাজাহঃ ফিতান অধ্যায়।
অতএব যে ব্যক্তি মারাত্মক অপরাধের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে তার ঈমানের অবস্থা কি হতে পারে? আর অপরাধ করাটা যার মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে তার ঈমান সম্পর্কেই বা কি বলা যায়? এরূপ অবস্থায় ঈমান বাকি থাকাটা সম্পূর্ণ অসম্ভব। যদি তা অবশিষ্ট থাকতে পারে তাহলে বিতর্ক-প্রিয়দের খুপরির মধ্যেই অবশিষ্ট থাকতে পারে।
বারবার কবীরা গুনাহে লিপ্ত হওয়ার একটি মেজাজ-প্রকৃতিও আছে। তা জেনে নেয়া দরকার। বারবার অপরাধে লিপ্ত হওয়ার ক্ষতি শুধু এতটুকুই নয় যে, তা দুষ্কর্মের অন্তরালে ঈমানের সৌন্দর্যকে ঢেকে ফেলে, বরং তা মানুষকে দুষ্কর্মের মধ্যে এমনভাবে বিভোর করে দেয় যে, অতঃপর সে আর কোন ভাল কাজ করা বা কল্যাণের দিকে অগ্রসর হওয়ার যোগ্যতাই হারিয়ে ফেলে। গুনাহের কাজে অবিরত লিপ্ত ব্যক্তিদের অবস্থা ঠিক সে ধরনের নয় –যা কুরআন মজীদ উল্লেখ করেছেঃ
আরো কিছু লোক আছে যারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। তাদের আমল মিশ্রিত ধরনের –কিছু ভাল আর কিছু মন্দ। আশা করা যায় আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন। তিনি ক্ষমাকারী ও করুণাময়।–সূরা তওবাঃ ১০২
কখনও নয়, খারাপ কাজের উপর অবিচল থাকার অর্থ হচ্ছে, অন্তরের কল্যাণকর কাজ করার যে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত ছিল তা শুকিয়ে যাওয়া এবং এখন আর তার মধ্যে ভাল কাজ করার তৃষ্ণা থাকতে পারে না। এজন্যই নীতিশাস্ত্রের স্বীকৃত সত্য এই যে, যে চরিত্র বিভিন্ন রূপ ধারণ করে, কোন একটি অবস্থার উপর যার স্থায়িত্ব নেই তাকে চরিত্র বলা যায় না। উস্তাদ মুহাম্মদ ইউসুফ মূসা বলেনঃ
যে দর্শন নৈতিকতাকে আপেক্ষিক জিনিস বলে তার উপর কোন গুরুত্ব দেওয়া আমাদের মোটেই উচিত নয়। অর্থাৎ মানুষের উপর যখন যে ধরনের ঝোঁক-প্রবণতা প্রভাব বিস্তার করবে তার পরিপ্রেক্ষিতে তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হবে। যেমন কোন ব্যক্তির উপর দানশীলতার আবেগ প্রভাবশীল এবং তার মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে খরচ করার প্রবণতা রয়েছে, কচিৎ সে কৃপণতা করে –তাহলে তাকে দানশীলই বলা হবে।
সত্য-মিথ্যা, ভাল ও খারাপ সব কাজের ক্ষেত্রেই এই অবস্থাই বিরাজমান। কিন্তু উল্লেখিত দৃষ্টিভঙ্গীর উপর গুরুত্ব দেওয়া আমাদের জন্য সঠিক নয়। এজন্য যে, চরিত্র-নৈতিকতার মধ্যে দৃঢ়তা ও অবিচলতার বৈশিষ্ট্য থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। এর ফলে আমলের আকারে তার ফলাফল সর্বদা প্রকাশ পেতে থাকবে।
ঈমানের আওতায় যখন আমরা এই নৈতিক মূলনীতিকে সংযুক্ত করব তখন আমাদের মানতেই হবে যে, যেখানে পরিপূর্ণ ঈমান আছে সেখানে অবশ্যম্ভাবীরূপে নেক আমলও রয়েছে। যখনই আমলে ঘাটতি দেখা দেবে, ঈমানেও ঘাটতি দেখা দেবে। অতএব যেখানে অপকর্ম ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না সেক্ষেত্রে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতেই হবে যে, এখান থেকে ঈমান বিদায় নিয়েছে। এজন্যই আমরা বলেছি, দুষ্কর্মে অনবরত লিপ্ত থাকাটা ব্যাপক অর্থে কখনো কোন মুমিন চরিত্রে পাওয়া যেতে পারে না।
কুরআন-হাদীস এবং এর সঠিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে জানা যায় যে, শরীআত কাজের অনুপ্রেরণা ও চালিকাশক্তির উপর অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করে থাকে, যে আভ্যন্তরীণ অবস্থার প্রভাব থেকে কোন কাজই মুক্ত নয় এবং যার কারণে কোন কাজ অবিরত চলতে থাকে অথবা বন্ধ হয়ে যায় –যখন সে সম্পর্কে আশ্বস্ত হওয়া যায় তখন শরীআত ঈমান ও তার শুভ পরিণাম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত করে থাকে। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ
আদম তার প্রতিপালকের অবাধ্যাচরণ করেছে, অতএব সে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।–সূরা ত্বাহাঃ ১২১
ইবনে কুতায়বা এই আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, একথা বলা যেতে পারে যে, আদম (আঃ) নাফরমানী করেছেন, কিন্তু একথা বলা মোটেই ঠিক নয় যে, তিনি নাফরমান ছিলেন। কেননা নাফরমান কেবল সেই ব্যক্তিকেই বলা যায়, যে নাফরমানীর মধ্যে ডুবে থাকে এবং নাফরমানীকেই নিজের অভ্যাসে পরিণত করে নেয়। যেমন কোন ব্যক্তি কাপড় সেলাই করছে, তখন বলা হয়, সে নিজের কাপড় সেলাই করছে, কিন্তু একথা বলা হয় না যে, সে একজন দর্জি –যতক্ষণ সে এটাকে পেশা বানিয়ে না নেয়।
অনুরূপভাবে হযরত আদম (আঃ)-এর দ্বারা নাফরমানী হয়েছিল বটে, কিন্তু মাত্র একবার, তাও ভুলবশত। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি এখনো অপরাধ করেনি ঠিকই, কিন্তু সে তা করার সংকল্প রাখে, সে নিশ্চতরূপেই অপরাধী। তাকে অপরাধী সাব্যস্ত করা হবে এবং এজন্য শাস্তির যোগ্য বিবেচিত হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
যখন দুই মুসলমানরা উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়, তখন হত্যাকারী এবং নিহত ব্যক্তি উভয়ই দোযখের উপযোগী হয়ে যায়। বলা হল, ঠিক আছে। সে তো হত্যাকারী, কিন্তু নিহত ব্যক্তির কি অপরাধ? তিনি বললেনঃ সেও তার প্রতিপক্ষকে হত্যা করার প্রস্তুতি নিয়ে থাকবে।–নাসাঈ, ইবনে মাজাহ
নিঃসন্দেহে অপরাধ এবং পদস্খলনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গিয়ে নিয়াতকে উপেক্ষা করা যায় না। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিয়াতের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।
ঈমানের উপর গুনাহের যে কু-প্রভাব পড়ে তা নিরূপণ করতে গিয়ে আমাদেরকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর উপর নজর রাখতে হবে।
এক. যাবতীয় গুনাহ একই প্রকৃতির নয়, সব গুনাহের প্রতি সমান আকর্ষণ থাকে না এবং এসব লোক একই ধরনের অপরাধে লিপ্ত হয় হয় না। যেমন, আমাদের দেশের কোন মুসলমান শুকরের গোশত খায় না। এর পরিবর্তে তারা আনন্দ সহকারে গরু-ছাগলের গোশত খেয়ে থাকে। অনুরূপভাবে গরীব ও নিঃস্ব লোকেরা রেশমের কাপড় পরিধান করে না এবং সোনার ব্যবহারও করে না। শূকরের গোশত খাওয়া এবং রেশমী বস্ত্র পরিধান করা গর্হিত কাজ –যা ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। কিন্তু একদিকে শূকরের গোশত খাওয়া একটি খারাপ কাজ, অন্যদিকে রেশমী বস্ত্র পরিধান করাটাও একটি খারাপ কাজ। শেষোক্তটির সম্পর্কে জৈবিক লালসার সাথে। এমন অনেক লোক রয়েছে, যারা জৈবিক ভারাসাম্যহীনতার শিকার হয়। তারা হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও কামাবেগকে বশ করতে পারে না। এই দৃষ্টিতে দেখা হলে এই দুই ধরনের অপরাধী এক সমান হতে পারে না।
দুই. এখানে এমন পরিবেশও আছে যা খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে এবং এমনও পরিবেশ আছে যা খারাপ কাজে লিপ্ত করে। অনেক লোক আছে –যারা খারাপ কাজকে চরমভাবে ঘৃণা করে। কিন্তু খারাপ পরিবেশের কারণে তাদের পা ফসকে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। এই পরিবেশ তাদের দীন ও আখলাকের জন্য আশংকাজনক। আবার এমন অনেক লোক রয়েছে যারা দুষ্কর্মের প্রতি প্রলুব্ধ। কিন্তু তারা নিজেদের সামনের সমস্ত দরজা বন্ধ দেখতে পায়। তা খোলার কোন পথ নেই। তারা এমন এক উন্নত ও পবিত্র পরিবেশে বাস করে যেখানে খারাপ কাজ করার কোন সুযোগ নেই।
তিন. পতনেরও বিভিন্ন পর্যায় আছে। কেউ পাহাড়ের সুউচ্চ শৃঙ্গ থেকে পতিত হয়, আবার কেউ পথ চলতে চলতে পা ফসকে গিয়ে পতিত হয়, কেউ গভীর গর্তে গিয়ে পতিত হয়। এদের সবার পতন এক রকমের নয়। গুনাহের গর্ভে পতিত হওয়ার ব্যাপারটিও তদ্রূপ। এক ব্যক্তি অনুকূল পরিবেশ পেয়ে যায়, মনের মধ্যে রম উত্তেজনা বিরাজ করে এবং সে অপরাধ করে বসে। অপর ব্যক্তি আনন্দ-উৎসাহের সাথে অপরাধে লিপ্ত হয়। অপর ব্যক্তি সংকল্প ও চেতনা সহকারে অপরাধে লিপ্ত হয়। চতুর্থ এক ব্যক্তি খারাপ কাজ করার সংকল্প করে, অনবরত খারাপ কাজ করতে থাকে, ধীরে ধীরে এটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। সে বার বার গুনাহ করে এবং তাতেই আনন্দ পায়। এই কয়েক ধরনের লোক এই সমতলে অবস্থান করছে না। তাদের মধ্যে বিরাট ব্যবধান রয়েছে।
চার. স্বয়ং গুনাহের বৈশিষ্ট্য এই যে, এটা যেন পরস্পর সংযুক্ত একটি বৃত্ত। মিথ্যাবাদী খেয়ানতকারী হয়ে থাকে এবং খেয়ানতকারী ঘুষখোর হয়ে থাকে। ঘুষখোর জাতির কল্যাণ ও নিরাপত্তার দুশমন। সে তার দীন, ঈমান, মর্যাদা, দেশ সবকিছু পূর্ব থেকে ক্রেতার হাতে তুলে দেয়। অনুরূপভাবে মদখোর ব্যভিচারী হয়ে থাকে এবং ব্যভিচারী নরঘাতক হয়ে থাকে। নরঘাতক এমন এক হিংস্র পশু যে দীন ও আখলাকের ভাণ্ডার তছনছ করে দেয়।
সত্যকথা এই যে, ব্যক্তি ও তার পারিপার্শ্বিক অবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে মাসিয়াত (অপরাধ) শব্দের অর্থের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে। যেমন ‘সফর’ (ভ্রমণ) শব্দটি কাছের জন্যও ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং সারা পৃথিবী পরিভ্রমণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অথবা ‘রোগ’ শব্দটি যেমন সাধারণ মাথা ব্যথার জন্যও ব্যবহৃত হয়। ‘মাসিয়াত’ শব্দটিও তদ্রূপ। এর অর্থের মধ্যেও দুটি দিক রয়েছে –যার মধ্যে অনেক ব্যবধান আছে। এর কারণ এই নয় যে, কতগুলো হচ্ছে খোছখাট অপরাধ আর কতগুলো হচ্ছে মারাত্মক অপরাধ। বরং মারাত্মক অপরাধের সবগুলো সমান নয়। অন্তরের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই এই পার্থক্য সূচিত হয়ে থাকে। কত বড় ভুল হবে যদি আমরা বলে বেড়াই যে, ঈমান থাকলে কবীরা গুনাহের দ্বারা কোন ক্ষতি হতে পারে না অথবা যদি খারিজীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলি, কবীরা গুনাহে লিপ্ত হলে ঈমান চলে যায়! এই নাজুক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বকালের একজন কবি বলেছেনঃ
যে ব্যক্তি মারা গেল।
কিন্তু তওবা করল না তার গুনাহের জন্য।
তার ব্যাপারটি আল্লাহর হাতে ন্যস্ত।
কবি নিম্নোক্ত আয়াতের দিকে ইঙ্গিত করেছেনঃ
আল্লাহ কখনো শিরকের অপরাধ ক্ষমা করবেন না, এ ছাড়া যত গুনাহ আছে তা যার জন্য ইচ্ছা মাফ করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক করল, সে অতি বড় মিথ্যা রচনা করল এবং কঠিন গুনাহের কাজ করল।–সূরা নিসাঃ ৪৮
এই আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ‘শিরকের অপরাধ ক্ষমার যোগ্য নয়’। শিরকের সমপর্যায়ের আরো অনেক কথা আছে। যেমন আল্লাহকে অস্বীকার করা অথবা আল্লাহকে স্বীকার করা হয় কিন্তু তাঁর বিধান প্রত্যাখ্যান করা এবং তা অনুসরণ করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা ইত্যাদি।
শিরক ছাড়া আর যত গুনাহ আছে তার মধ্যে কতক গুনাহ তিরস্কারের পর্যায়ভুক্ত। এগুলো মাফ হয়ে যাবে। কিন্তু এমন অনেক মারাত্মক গুনাহ আছে যা ঈমানের জন্য জীবন সংহারক। যেমন আমরা পেছনে উল্লেখ করে এসেছি। এই ধরনের গুনাহ শিরকের চেয়ে কম নয়। এসব মারাত্মক অপরাধের দিকেই নিম্নোক্ত আয়াত ইঙ্গিত করছেঃ
আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমাসমূহ লংঘন করে –আল্লাহ তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবেন, সেখানেই সে চিরকাল থাকবে। এটা হবে তার জন্য অপমানকর শাস্তি।–সূরা নিসাঃ ১৪
যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের কথা অমান্য করবে, তার জন্য রয়েছে জাহান্নামের আগুন। এই ধরনের লোকেরা তাতে চিরকাল থাকবে।–সূরা জিনঃ ২৩
সাধারণ গুনাহ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
আর যাদের অবস্থা এই যে, তারা যদি কোন অশ্লীল কাজ করে বসে অথবা নিজেদের উপর জুলুম করে বসে, তাহলে সাথে সাথেই আল্লাহর কথা স্মরণ করে এবং তাঁর কাছে নিজেদের পাপের ক্ষমা চায়। কেননা আল্লাহ ছাড়া গুনাহ মাফ করতে পারে এমন আর কে আছে? এই লোকেরা জেনে-বুঝে নিজেদের অন্যায় কাজ নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না।–সূরা আলে-ইমরানঃ ১৩৫
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:২৫
সামিউল ইসলাম বাবু বলেছেন: পোষ্ট লিখার জন্য ধন্যবাদ ভাই