![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
২১ ডিসেম্বর দুপুরে ছিল আমার ৫ম সেমিস্টার ফাইনাল এর শেষ পরীক্ষা। রাতে মাত্র ২ ঘন্টা ঘুমায়ে সকাল ৭টা ঘুম থেকে উঠে হালকা পড়াশোনা করে দুপুর ১.৩০ এ পরীক্ষা দিতে গেলাম। ৪.৩০ এ পরীক্ষা শেষ করে হালকা নাস্তা খেয়ে রুমে চলে গেলাম। রুম এবং আমার ব্যাগ গুছায়ে রাত ৯.২০ এ ঢাকাগামী বাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ৩০ মিনিট দেরী করে রাত ১০ টার দিকে বাস ছাড়ল!!! বাসে আমি তেমন ঘুমাতে পারি না বলে সারারাত প্রায় না ঘুমিয়েই কাটালাম!! মাঝখানে এক বান্ধবীর দেখা পেয়ে তার সাথে কিছুক্ষণ আড্ডাও দিলাম!! সকাল বেলা ঢাকায় আমার বাসায় পৌছালাম। তখনও আমি না ঘুমিয়ে। তাই তাড়াতাড়ি সকালের নাস্তা খেয়ে প্রায় ২ ঘন্টার মত ঘুমালাম। তারপর আব্বু-আম্মুর ঝাড়ি খেয়ে সেলুন থেকে শেভ এবং চুল কেটে আসলাম!!
তারপর আবার নতুন করে ব্যাগ গুছায়ে ক্যামেরা ঠিক করে রেডি হয়ে রাতের খাবার খেতে যাব, ঠিক তখনই বাধল বিপত্তিটা!!! মেমরি কার্ড খালি করব বলে যখন ল্যাপটপে কার্ড ঢুকালাম, তখন অবাকের সহিত লক্ষ্য করলাম, আমার ৩২ জিবির মেমরি কার্ড টা কোনো এক কারণে ডেমেজ হয়ে গেছে!!!
আমার ছোটোবেলার কোনো প্রেমিকা যদি থাকত, এবং বিয়ের আগমুহূর্তে যদি অন্য কোনো ছেলের সাথে পালায় যেত, তখনও এত ছ্যাকা খেতাম না, যতটা না সেই মুহুর্তে পেয়েছিলাম। আমার কাছে আব্বুর ডিজিটাল ক্যামেরার ৮ জিবি মেমরি কার্ড ছিল। কিন্তু আমি RAW ফরম্যাট এ ছবি তুলি, এবং ৮ জিবির মেমরি তে সেই হিসেবে ২৩০ টার মত ছবি তোলা যাবে (RAW ফরম্যাট এর একটা ছবি ১৫-২০ mb করে হয়)। তার উপর বিদেশে থাকব ৬ দিনের মত। হাতে তখন সময় ছিল না। তাই যা আছে কপালে ভেবে আল্লাহর নাম নিয়ে আমার পেনড্রাইভটা ব্যাগে ভরে মিশরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
এয়ারপোর্ট এ যাই রাত ৯.৩০ এর দিকে। ব্যাগ চেকিং, বোর্ডিং এবং ইমিগ্রেশন শেষ করে ওয়েটিং রুমে প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।
আমাদের এয়ারলাইন্স টা ছিল বিশ্ববিখ্যাত Emirates Airlines. প্লেনের ভিতর ঢুকে বিজনেস ক্লাস এবং ফার্স্ট ক্লাস কেবিন পার হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইকোনমি ক্লাসে ঢুকলাম!!! যেহেতু একটা আন্তর্জাতিক মানের এয়ারলাইন্স, স্বাভাবিকভাবেই একটা উচ্চ এক্সপেকটেশন ছিল, এবং হ্যা, কখনোই নিরাশ হতে হয় নাই আমাদেরকে। ইকোনমি ক্লাস হয়েও সার্ভিসগুলো দেখার মত ছিল, বিশেষ করে এয়ার হোস্টেসগুলো!!
ঢাকা থেকে মিশরের রাজধানী কায়রো তে যাওয়ার কোনো সরাসরি ফ্লাইট নাই। তাই প্রথমে দুবাইতে নিয়ে ট্রানজিট করে কাইরো এর ফ্লাইট ধরতে হয়। অত:পর প্রায় ৪.৩০ ঘন্টা জার্নি করে ঢাকা থেকে দুবাইতে পৌছালাম। মাঝখানে প্রায় ৩ ঘন্টার বিরতির পরে ট্রানজিট করে আবার কায়রো এর ফ্লাইট ধরে প্রায় ৩.৩০ ঘন্টার জার্নি করে দুবাই থেকে অত:পর মিসরে পৌছালাম। বাংলাদেশ থেকে দুবাই এর সময় ২ ঘন্টা আগানো, এবং মিশরের সময় আরও ২ ঘন্টা, মোট ৪ ঘন্টা আগানো। তাই প্রায় ১৮ ঘন্টা জার্নি করে মিসরে পৌছানোর পর ঘুম, খাওয়াদাওয়া সব কিছুর রুটিনেরই সোজা কথায় মা-বাপ হয়ে গেল!!! খাওয়াদাওয়া, ঘুম কোনোকিছুরই আর হিসেব থাকল না।
এবার আসি মিশরের কথায়। ভাবছিলাম কোথায় মরুভূমি, বালির দেশে আবহাওয়া গরম-টরম থাকবে, উল্টো দেখলাম বাংলাদেশ থেকে তাপমাত্রা আরও ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস কম!! প্লেন থেকে Cairo International Airport নামতেই একটা ঠান্ডা শীতল বাতাস শরীরে কাপুনি ধরিয়ে আমাদের স্বাগতম জানালো!!
আমরা আসলে ট্যুরে আসছিলাম ট্যুরিজম কোম্পানি লেক্সাস এর একটা প্যাকেজে। আমরা সহ আরও বেশ কয়েকটি পরিবার মিলিয়ে প্রায় ৪০ জনের মত একসাথে আমরা আসছি। যেহেতু ৫-৬ দিন আমরা একসাথে ঘুরব, তাই আমরা অনেকেই একে অপরের সাথে পরিচিত হয়ে নিলাম। কে জানে, হয়ত বা ভবিষ্যৎ এও দেশে ফেরার পর এই সুন্দর সম্পর্কগুলো টিকে থাকবে।
এবার আসি গাইডের কথায়। আমাদের গাইডের নাম "আহমেদ"। গাইডের ভাষায় "আহমেদ" নামটা নাকি মিশরে খুবই জনপ্রিয়। এবং প্রতি ১০০ জনের মধ্যে "আহমেদ" নামের প্রায় ২০ জন পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে!!! ভদ্রলোকের বয়স ৩০ এর উপরে, স্ত্রী-সন্তানসহ মিশরে থাকে এবং প্রায় ১৫ বছরের উপরে উনি গাইডের পেশায় রয়েছেন। সেই সুবাদে পৃথিবীর অসংখ্য দেশে ঘোরাঘুরি তার হয়ে গেছে। গাইডটাকে আমাদের সকলেরই পছন্দ হইছিল। অনেক বিনয়ী, ভদ্র এবং যথেষ্ট পরিমাণে কৌতুকবোধও তার রয়েছে। যেসব জায়গায় ঘুরতে যেতাম, সেই সব জায়গার পরিচিতি, বর্ণনা, নিয়ম-কানুন সব কিছুই বাসে বিস্তারিত বলে দিত। তবে আমাদের দেশের সমাজ শিক্ষকরা রসহীন ভাবে যেরকম বইপত্র এবং চোথাপত্র দেখে দেখে ভূগোল এবং ইতিহাস পড়ায়, সেরকম কিছু না। খুবই সরল সাবলীল ভাষায় যতটা সম্ভব আকর্ষণীয় ভাবে একটা জায়গাটাকে তুলে ধরা যায়, সেভাবে জায়গাটার পরিচিতি তুলে ধরত। শুধুমাত্র তার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনার জন্য মাঝেমধ্যে বাসে তাড়াতাড়ি এসে সামনের সিটে বসতাম। এবং আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়, মিশরের স্থানীয় লোক হয়েও তার ইংরেজি উচ্চারণ অস্বাভাবিকরকম সুন্দর এবং স্পষ্ট, যেটার অন্যতম কারণ উনি হাই স্কুল থেকে ইংরেজি মিডিয়াম এ লেখাপড়া করেছেন। এবং হ্যা, উনি হার্ভাড থেকেও পড়াশোনা (খুব সম্ভবত ইতিহাস বিষয়ে) করে এসেছেন। বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন এ আমাদের সাহায্য করা থেকে শুরু করে প্রত্যেক জায়গায়, প্রত্যেক সময় আমাদের সাথে থেকেছেন। আমাদের সাথে কথা বলার সুবিধার্থে উনি কিছু বাংলা শব্দ শিখে নিছিলেন। তার মধ্যে “আসুন,আসুন। তাড়াতাড়ি আসুন” উল্লেখযোগ্য!!!
এবার আসি দেশটার কথায়। এক কথায় বলতে গেলে, এই দেশটি বিভিন্ন ঐতিহাসিক মর্যাদায় ভরপুর। এটা সবাই জানে। কিন্তু সামনাসামনি দেশটাকে দেখলে সেগুলো নিজের ভিতর অনুভব করা যায়। এখানকার হাইওয়ে গুলো বেশ প্রসস্ত। একদিকের রাস্তাটাই হচ্ছে ৮ লেনের!! মানে ৪ লেন হাইওয়ের জন্য, মাঝখানে একটু জায়গা রেখে আরও ৪ লেন লোকাল যানবাহনের জন্য। তাই উভয়দিক হতে ১৬ লেন হয়ে যায়!! আমাদের জন্য বাসের ব্যবস্থা করা হইছিল মার্সিডিজ বেঞ্চ। পুরো ৫ দিনের প্রত্যেকদিনই এই বাসে করে সব জায়গায় আসা যাওয়া করছি। ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এবং ডিনার বুফে সিস্টেম ছিল, মাঝমধ্যে সেট মেনু। কয়েকসময় নিজেদের হোটেলেই খাইছি, মাঝমধ্যে ট্যুরিস্ট স্পট এই।
মিশরের কয়েকটা বৈশিষ্ট্যের একটি হলো, দেশটার ৯৫% মরুভূমি, ৫% সবুজ অংশ। এবং ঐতিহাসিক নীলনদটা এই ৫% জায়গাগুলোর মধ্যেই পড়ছে। গাইডের ভাষায়, যতক্ষণ পর্যন্ত এই নীলনদ আছে, এই মিশর দেশটা আছে। নীলনদ নাই তো মিশরও নাই। কারণ অধিকাংশ মানুষরাই এই নীলনদকে ঘিরে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। নীলনদটা অবশ্যই ঐতিহাসিক মর্যাদায় ভরপুর, কিন্তু সেভাবে যদি এই নদীর মাঝে কেও সৌন্দর্য খুজতে যায়, তাহলে তাকে নিরাশ হতে হবে। কারণ নীলনদের সৌন্দর্য আহামরি কিছু না। তবে এই নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেল এর সৌন্দর্য অবশ্য অনেকখানি বাড়িয়েছে।
রাজধানী কায়রো তে আমরা ছিলাম নীলনদের পাড়ে প্রতিষ্ঠিত এক ৫ তারকা হোটেল "Grand Nile Tower" এ। এটি কায়রো এর অন্যতম পুরানো এবং নামকরা একটি হোটেল। প্রথমে এই হোটেলটি প্রথমে ছিল জনপ্রিয় "Grand Hayat" হিসেবে। কিন্তু তারা তাদের মালিকত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর স্থানীয় একটি প্রতিষ্ঠান এর মালিকানাধীন অবস্থায় এর নতুন নাম দেয় "Grand Nile Tower". প্রথমদিনে হোটেলে এসে রুম নিয়ে সারাদিন রেস্ট নেই। তারপর রাতের বেলা বেড়িয়ে পড়ি জাহাজে নীলনদের বুকে বিচরণ করতে। সেখানেই আমরা আমাদের ডিনার করি এবং চমক হিসেবে ছিল স্থানীয় শিল্পীদের লাইভ গান, মিউজিক, বেলী ড্যান্স, এবং বিশেষ এক ধরণের পারফর্মেন্স (নাম ভুলে গেছি, এখানে এক ব্যক্তি চক্রাকারে অনবরত ঘুরতে ঘুরতে কাপড় এবং বিভিন্ন প্রপস নিয়ে কারুকার্য দেখায়)। রাতের বেলা অবশ্যই ভালো শীতের কাপড় পড়ে বের হতে হয়, কারণ রাতে এখানকার তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রীতেও নেমে যায়। অতঃপর চমৎকার এক অভিজ্ঞতা শেষে পরবর্তী দিনের সফরের এক্সাইটমেন্ট মনে নিয়ে হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লাম।
মিশর দেশটাকে নিয়ে আরও কিছু কথা বলে নেই। দেশটায় ঢোকার পরপরই গাইড আমাদেরকে যে জিনিসটা লক্ষ্য করায় দিল, সেটি হচ্ছে, এই দেশের প্রায় সবগুলো বিল্ডিং, বসবাসের বিল্ডিং থেকে শুরু করে কমার্শিয়াল বিল্ডিং পর্যন্ত, প্রায় সবগুলোর রঙ একই!!! Brown or deep brown. এর কারণ হচ্ছে, যেহেতু এইদেশে বালির প্রাচুর্যতা, এবং বৃষ্টি হয় না বললেই চলে, তাছাড়া অনেক সময়ই এখানে Sand storm হয়, তাই ভিন্ন কোনো রঙ করা হলেও তা টিকে থাকে না। তাই এখানকার বিল্ডিংগুলো ধুলার রঙ এই কালার করা হয়। তাছাড়া এটা চরম আবাওহাওয়ার দেশ। শীতের সময় তাপমাত্রা যেমন ১১-৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস এ চলে যায়, আবার গ্রীষ্মকাল এ তাপমাত্রা ৫০-৫৫ ডিগ্রী তেও চলে যায়!!! মিশরের অর্থ কে Egyptian Pound(L.E.) বলে। 1 L.E=4.4 taka. কিন্তু কেনাকাটা করার সময় অনেক জায়গাতেই এখানে পাউন্ড এর পাশাপাশি আমেরিকান ডলার ও গ্রহণ করে। কারণ এখানকার ব্যাংকগুলোতে ডলার ভাংগানো অনেক সহজ। মিশরের অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলাদেশ থেকে খুব বেশী আহামরি না। কিছু ক্ষেত্রে আমাদের দেশ থেকেও কম। আমাদের গাইড কায়রো এর কিছু কিছু জায়গা আলাদাভাবে দেখিয়ে দিছিল যেখানে মিশরের সবথেকে দরিদ্র মানুষজন বসবাস করে।
সফরের ২য় দিনে প্রথমে ঘুম থেকে উঠে ব্রেকফাস্ট সেরে দেখতে গেলাম বিখ্যাত পিরামিড দেখতে। সর্বমোট ৩ টি পিরামিড। প্রথমে আমরা গেলাম সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত পিরামিড টা দেখতে। পূর্বে মিশরীয় রা ধারণা করত মৃত্যুর পরে তাদের আত্মা পুনরায় তাদের দেহে ফিরে আসবে, এবং তখন তাদের রাজারা নির্ধারণ করে দিবে কে জান্নাতে যাবে এবং কে জাহান্নামে। তাই পূর্বে রাজা-রানীর সবাই পূজা করত, এবং তাদের মৃত্যুর পর তাদের দেহকে মমি করে রাখত, এবং সবশেষে তা পিরামিডের ভিতরে দাফন করে রাখত। মমিফিকেশনের সময় শরীরের রক্ত বের করে, ব্রেইন থেকে শুরু শরীরের সব অরগানগুলো বের করে আনা হয় শুধুমাত্র হৃদয় ছাড়া। আর পিরামিডের আকার ত্রিভুজাকৃতির হওয়ার কারণ ছিল, আগে ধারণা করা হত, পৃথিবী ধংসের সময় পুরো পৃথিবী পানির নিচে তলিয়ে যাবে। তাই যখন তাদের রাজাদের প্রাণ আবার তার শরীরে প্রবেশ করবে, তারা যেন পিরামিড এর একদম শীর্ষে অবস্থান করে সারভাইভ করতে পারে।
গাইড প্রথমেই আমাদের সবাইকে বলে রাখছিল কেডস/জুতা পড়ে নিতে। কারণ আশেপাশের সব কিছুই বালিতে ভরা, চলাচলে সুবিধা হবে। আমি আবার স্যান্ডেল পরে/খালি পায়ে পাহাড়ে ট্র্যাকিং করি কিনা, তাই আমার কনফিডেন্স আরও বেশী!!! তাই নরমাল স্যান্ডেল পরেই চলে গেলাম সবচেয়ে বড় পিরামিডটার কোলে। ওইখানে আশেপাশে অনেকগুলো হকার আছে, যারা প্লাস্টিকের বিভিন্ন সস্তা মূর্তি বেশ চড়া দামে বিক্রি করার চেষ্টা করে। রমনা পার্কে কোনো কাপলকে দেখলে পিচ্চি বিচ্ছু পোলাপান কোনো জিনিস নেওয়া না পর্যন্ত যেমন পিছু ছাড়ে না, এখানকার হকারগুলোর অবস্থাও সেই রকমই!!
যাই হোক, পিরামিডের ভিতর ঢোকার খুব সম্ভবত ২ টা দরজা আছে। ১ টা আপাতত বন্ধ, আর একটাতে আমরা যাই নাই। কারণ ১ম কথা, ভিতরে আসলে দেখার মত কিছু নাই। কারণ ভিতরের সব মমি এবং ট্রেজার বের করে জাদুঘরে রাখা হইছে, আর ভিতরে যাওয়ার টিকিট এর দাম অনেক বেশী। তবে সবচেয়ে প্রধান বিষয়, ভিতরে যাওয়ার রাস্তা এতটাই দুর্গম, যে একজনের পক্ষে ওইখানে যাওয়া অনেক কঠিন। কারণ রাস্তটি মাত্র ১ মিটার চওড়া এবং ১ মিটার উচ্চতা!!
এমনটি হওয়ার কারণ হলো, ভিতরে যেহেতু তাদের রাজাদের মমি রাখা ছিল, যাদেরকে সবাই ভগবান মানত এবং পূজো করত, তাই যে কেওই এই পথ দিয়ে যাবে না কেন, তাদের সবাইকেই যাতে সম্মানপ্রদর্শন স্বরূপ নিচু হয়ে এবং হামাগুড়ি দিতে দিতে যাওয়া লাগে, সেজন্যেই এই ব্যবস্থা!!!
সামনাসামনি পিরামিড দেখার অভিজ্ঞতাটা চমৎকার। বেশ কিছুক্ষণ পিরামিড ঘুরে, ছবি তুলে তারপর আরেকজায়গায় গেলাম যেখানে ৩ টি পিরামিডই একসাথে দেখা যায়, এবং আশেপাশের এলাকার সবচেয়ে ভালো ভিউ দেখা যায়। সেখানে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ ছবি তুলে গেলাম উটের উপর চড়তে!! উট আরোহণ করা যে এত কঠিন এবং ভয়ের এক্সপেরিয়েন্স হতে পারে তা আমার আগে জানা ছিল না!! এমনিতেই স্বাভাবিকভাবে চলার সময়ও দুলতে থাকে, কিন্তু উচু নিচু বালির সমুদ্রের উপর যখন উট চলতে থাকে তখন তা আবার রোলার কোস্টারের রূপ ধারণ করে!!
একটা কথা বলে রাখি, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো না এবং মানুষগুলো বেশ গরীব বলেই কিনা, সোজা কথায় মানুষগুলো বেশ খাইস্টা। এখানে প্রত্যেক জিনিসের জন্য তারা টাকা চায়। এবং এখানে সহজে ছবি তোলাও যায় না। কেও যদি একটা উটের ছবি নেয়, তাহলে উটের মালিক তার কাছ থেকে টাকা চেয়ে বসবে। তাই আমার মানুষগুলোর এবং আশেপাশের স্ট্রিটগুলোর ছবি নিতে প্রচুর সমস্যা হচ্ছিল। তাই এসব জিনিস মাথায় রেখে চলাচল করতে হয়। নয়তোবা বিপদে পড়া লাগতে পারে।
একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। উটের উপর আরোহনকালে ক্যামেরা আমার সাথেই ছিল। আশেপাশের ছবি তুলতেছিলাম। মাঝখানে একটা জায়গায় উট থামালে আমি নিচে যে উট চালনা করতেছিল তার হাতে ক্যামেরা দিয়ে আমার নিজের কয়েকটা ছবি তুলতে বলি এবং সাথে সাথেই আমি আমার ভুলটা বুঝতে পারি। সে ঘোচাঘচ কয়েকটা ছবি তুলে (যেগুলোর ফ্রেমিং এর মা-বাপ কিছুই নাই) আমার হাতে ক্যামেরা দিয়ে আমার কাছ থেকে পাউন্ড চেয়ে বসল। আমার কাছে পাউন্ড নাই, আব্বু আরেক উটের উপর। তাই তাকে পরে দিব বলে বাকি আরোহণ টা শেষ করে নিচে নামলাম। নিচে নেমেই পুনরায় আমাকে জেকে ধরল। আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমার আব্বু এখনো আসে নাই এবং আমার কাছে কোনো পাউন্ড নাই। কিন্তু সে (তার বয়স আমার থেকেও কম) এমন ব্যস্ততার ভাব দেখাইল, যেন তার পশ্চাতদেশে আগুন লাগছে, এবং সেই আগুন নেভানোর জন্য তাকে পুকুরে ডুব দিতে হবে। আমি তাকে আবার বোঝানোর জন্য আমার মানিব্যাগ বের করে বাংলাদেশী ২০ টাকার নোট বের করে সেটা দেখায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম, যে এটা আমার কারেন্সি, তাদের না। হঠাৎ করে সে আমার ২০ টাকার নোট ছোবল মেরে একটা সন্তোষজনক লুক দিয়ে হেলেদুলে চলে গেল (তাদের মন-মানসিকতার ধারণা আশা করি এবার পেয়ে গেছেন)। আমিও অবশ্য মুচকি হাসি দিয়ে চলে আসলাম। সে বেচারা জানতেও পারল না সে মিশরে থাকাকালে এই টাকা জীবনেও ব্যাংক থেকে ভাংগাতে পারবে না। পরে অবশ্য আফসোসও করছিলাম, কেন আমি ২০ টাকার বদলে ১০ টাকা বের করি নাই!!পিরামিড এর পর গেলাম দেখতে মিশরে আবিষ্কার হওয়া এক সিংগেল পাথরে খোদাই করা সবচেয়ে বড় মূর্তি দেখতে। যেটার নাম SPHINX. তারপর বিকাল পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করে অনেকগুলো ছবি তুলে আরও একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা শেষ করে হোটেলে ফিরে আসলাম।
একটা কথা পরবর্তীতে শুনতে পেয়েছিলাম যে আমাদের গাইড, আহমেদ, লাভ ম্যারেজ করেছিল। এবং সে তার স্ত্রীকে প্রথম দেখতে পেয়েছিল এই পিরামিডের নিচেই!! তবে প্রপোজ কোথায় করেছিল, সেটা এখন পর্যন্ত আমি জানতে পারি নাই!!
এতক্ষণ মিশরের খাবার দাবার সম্পর্কে কথা স্কিপ করে গেছি। এবার সেই প্রসংগে আসি।
মিশরে আমার অপূর্ণ থেকে যাওয়া ইচ্ছাগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটা হলো এখানকার স্থানীয় কিছু মানুষদের পোর্ট্রেট নেওয়া, তাদের সাথে কথা বলা, এবং বিশেষ করে এখানকার স্ট্রিট ফুড খাওয়া। আমরা সব জায়গাগুলোতেই আমাদের জন্য রিজার্ভ করা বাসে যেতাম, লোকাল জায়গাগুলোর মধ্য দিয়েও আমরা গেছি, কিন্তু কারও পোর্ট্রেট তোলা বা স্ট্রিট খাবার খাওয়ার সুযোগটা আসলে হয়ে উঠে নাই। আমরা যেহেতু সব সময়ই হোটেলের ব্যুফে অথবা রিজার্ভ করা রেস্টুরেন্ট গুলোতে খাইছি, সেসব জায়গায় খাওয়া খাবারগুলোর ব্যাপারে কিছু বলতে পারি। আমি যতটুকু বুঝছি, এখানকার মানুষগুলো ঝাল খেতে অভ্যস্ত নয়। এখানকার ক্যুজিনে ঝাল একদমই ব্যবহার করা হয় না। মাছ, মুরগীর মাংস, খাসির মাংস, যেসব খাবারে বাংগালীরা ঝাল দিয়ে প্লেটে আগুন ধরায় ফেলে, সেসব খাবারও তারা মিষ্টি করে রান্না করে। আমি মিষ্টি জিনিস একদমই পছন্দ করি না, আর অস্বাভাবিকরকম ঝাল খাই। তাই আমার জন্য আশাহত হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু মজার বিষয় হলো, মিষ্টি হওয়া সত্ত্বেও এখানকার খাবার গুলোয় এক আলাদা স্বাদ আছে, মজা আছে। যা আমাদের দেশে পাওয়া যাবে না। খাবারগুলো তারা ওইভাবেই বানায়। তাই খাবারগুলো খেতে মোটেও খারাপ লাগে নাই। এখানকার অধিকাংশ মানুষই মুসলিম, তাই এখানকার খাবারগুলো সব হালাল। আর এখানকার ডেজার্ট গুলোর কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। অনেক সুন্দর ছিল মিষ্টি খাবার গুলো।
এখানকার রেস্টুরেন্ট গুলোতে স্যুপ খাওয়া বাদ দিয়ে অন্যান্য খাবার গুলোতে গোল চামচ ব্যবহার করে না। শুধুমাত্র কাটা চামচ এবং ছুরি ব্যবহার করে। তাই আমরা কখনোই রেস্টুরেন্ট এর টেবিলগুলোতে এই দুই চামচ ছাড়া আর কিছু পাই নাই। তবে খাবারগুলো তারা ওইভাবেই রান্না করে। তাই খাবার খেতে আমাদের মোটেও অসুবিধা হয় নাই।
আমাদের ২য় দিনের শুরু থেকে শেষ অব্ধি পর্যন্ত একটা জিনিসই আমার মাথাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল যে, আমার যে ৩২ জিবি মেমোরি কার্ড নষ্ট হয়ে শুধু ৮ জিবি মেমোরি আনছি, বাকি দিনগুলোর ছবি কিভাবে তুলব?? তখন আমার এক সিনিয়র ভাইয়ার পরামর্শ মনে পড়ে গেলঃ "একটা ভালো মানের ছবি তুলতে যেখানে Amateur দের ১০ টা শাটার ক্লিক লাগে, সেখানে Professional দের ৩-৪ টা শাটার ক্লিকেই হয়ে যায়। নিজেকে সেভাবেই গড়ে তুল"। আমি আগে সেভাবেই প্র্যাকটিস করতাম। এবং এই সময়ে আমার সেই প্রশিক্ষণ টা পুরোপুরিভাবে কাজে লেগে গেল। এবং সত্যি কথা, কম শাটারেই বেশীর ভাগ সুন্দর মুহুর্তই আমি ক্যাপচার করতে সক্ষম হয়েছি।
তবে সমস্যা আরেক জায়গায়। আমি RAW ফরম্যাট এ ছবি তুলি বলে অল্প ছবিতেই মেমোরি ভরে যাচ্ছিল। তখন বুদ্ধি করে আরেকটা কাজ করলাম। অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলো .jpg ফরম্যাট এ এবং বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলো RAW ফরম্যাট এ তুলতে থাকলাম। কৌশলটা ১০০% কাজ না করলেও ৮০% এর মত কাজে দিছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম, যেভাবেই হোক, আমার কিছু ছবি মেমরি কার্ড থেকে পেনড্রাইভ এ ট্রান্সফার করতে হবে। এজন্যে আমি হন্যে হয়ে একটা কম্পিউটার অথবা ল্যাপটপ খুজতেছিলাম। কারণ আমি ল্যাপটপ নিয়ে যাই নাই এবং বিদেশে গিয়ে অপরিচিত জায়গায় ল্যাপটপ খোজা যতটা সহজ মনে হয়, অতটা সহজ নয়, উলটো অনেক কঠিন, এমনকি হোটেলেও। এমনকি আমাদের গাইড এর কাছেও সাহায্য চাইছিলাম। উনিও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমাকে সাহায্যের আশ্বাস দিছিল। শেষ ভরসা ছিল আমাদের সাথে আসা বাকি পরিবারগুলো। ২য় দিনের সফরের একদম অন্তিম মুহুর্তে আমাদের সাথে আসা এক সিনিয়র আপুর কাছে জানতে চাইলাম তার কাছে কোনো ল্যাপটপ আছে কিনা। শুকনো মরুভূমি তে ২ মাস পানি না খেয়ে থাকা মানুষ এক গ্লাস ঠান্ডা পানি পেলে যে প্রশান্তি টা লাভ করে, আমিও আমার বুকে সেই প্রশান্তি অনুভব করলাম যখন জানতে পারলাম তার কাছে তার ল্যাপটপ আছে। অত:পর ২য় দিনের সকল সফর শেষে হোটেলে ফিরে মেমরি কার্ড এর ছবিগুলো পেনড্রাইভ এ ভরে আগের ট্যাকনিকে বাকি দিনের ছবিগুলো তুলতে থাকলাম।
কিছু না বলা কথাঃ আপু আর আমার রুম একই ফ্লোরে ছিল। তাই লিফট এর সামনে করিডোর এর ২ টা সোফাতে বসে আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম আর ছবি ট্রান্সফার করতেছিলাম। সেই সময় একই করিডর এ আমার আব্বু-আম্মু হাটাহাটি করতেছিল। ডিনার করার পর করিডোর এ হাটাহাটি করার কারণ জানতে চেয়ে প্রশ্ন করতেই আমার শ্রদ্ধেয় আব্বু-আম্মু সেই সিনিয়র আপুটার সামনে আমার ক্রমবর্ধমান ভুড়িটা নিয়ে একটা খোটা মেরে হাসতে হাসতে চলে গেল!! কথায় বলে "Time heals everything"। কিন্তু পাংচার হয়ে যাওয়া মান-সম্মান হিল করার ক্ষমতা খুব সম্ভবত খোদ সময়রও নেই!! সোজা বাংলায় আমার বাপ-মা আপুটার সামনে আমার ইজ্জতেরই বাপ-মা করে চলে গেল!! মনে মনে ভাবলাম এরকম বাপ-মা থাকতে জীবনে শত্রুর প্রয়োজন আছে কি??
সফরের ৩য় দিনে আমরা কায়রো শহর থেকে সকালবেলা যাত্রা শুরু করলাম আলেকজান্দ্রিয়ার উদ্দেশ্যে। ঢাকা-চিটাগাং এর মতই কায়রো থেকে আলেকজান্দ্রিয়ার দূরত্ব প্রায় ৩৫০ কিমি। কিন্তু যেতে সময় লাগে অনেক কম!!! প্রায় ৩.৩০ ঘন্টায় আমরা গন্তব্যস্থলে পৌছে গেছিলাম।
আলেকজান্দ্রিয়ার ভিতরে ঢোকার পরপরই আমার পুরান ঢাকার কথা মনে পড়ে গেল। এবং প্রথমবারের মত স্থানীয় মানুষদের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করলাম। ভাষা এবং পোশাক ছাড়া তাদের জীবনযাত্রা পুরান ঢাকার মানুষদের জীবনযাত্রার মতই। বিল্ডিং গুলোও পুরাণ ঢাকার আদলে গড়া। যাই হোক, যেতে যেতে আমাদের বাস এসে থামল Kom El-Shuqafa Monuments এর সামনে। এখানে মিশরের রাজা-রানীদের কবর এবং কফিনগুলো সংরক্ষণ করে রাখা হইছে। টিকিট কেটে ভিতরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। এরপর গাইড আমাদের নিয়ে গেল আসল জায়গায়,একদম আন্ডারগ্রাউন্ড এ!! মাটির নিচে ৩টি ফ্লোর রয়েছে। ১ নম্বর ফ্লোরটি এখনো পানির নিচে তলিয়ে আছে। বলে রাখি যখন এটি আবিষ্কৃত হয়, তার কিছু সময় পরে মিশরে অনেক বড় একটি ভুমিকম্প হইছিল এবং জায়গাটা পানির নিচে তলিয়ে গেছিল। তাই পানিতে বেশির ভাগ মমি এবং ট্রেজারগুলো নষ্ট হয়ে গেছিল, কিছু কিছু এখনো পুনোরদ্ধার করা যায় নাই। প্রথমে আমরা গেলাম ৩য় ফ্লোরে (যেহেতু উপর থেকে আমরা নিচে নামতেছিলাম।) । ৩য় এবং ২য় ফ্লোরে অনেকটা কবুতরের বাসার মত সিরিয়ালি খোপ খোপ করে কবর খুড়ে জায়গা বানানো আছে, যেগুলোতে আগে মমি রাখা হত। এছাড়া মানুষদের পাশাপাশি এখানে আলাদা চেম্বার রয়েছে যেখানে জীবজন্তুদের মমি রাখা হত। এছাড়া আরও বিভিন্ন রুম এবং একটি বৈঠকখানাও ছিল। এছাড়া সেখানে একটি কাচের বাক্সে পুনোরুদ্ধার করা কিছু জীবজন্তুদের হাড্ডিও সংরক্ষিত করে রাখা আছে। এবং এই সম্পুর্নো জায়গাটি এবগ হাড্ডিগুলো প্রায় ৩০০০ বছর আগের। এবং বলে রাখা ভালো, এই জায়গাটায় ছবি তোলা এবং ভিডিও করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
মনুমেন্টস এর জায়গার পর গাইড আমাদের নিয়ে গেল মিশরের বিখ্যাত সুগন্ধীর দোকানে। সাধারনত ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডের সুগন্ধীগুলোতে এলকোহল ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই জায়গায় এলকোহল ছাড়া ফুল থেকে নির্যাস বের করে সুগন্ধী বানানো হয়। (সুগন্ধী গুলোতে যে এলকোহল নাই সেটা আমাদের প্রমাণও করে দেখাইছিল)। সাধারনত আর কোনো জায়গায় এভাবে সুগন্ধী বানানো হয় না।
৩০০০ বছর আগে যেহেতু কাগজ ছিল না, তাই পূর্বে তারা প্যাপিরাস গাছ থেকে কাগজ তৈরি করে তার উপর ছবি আকত। আর এই প্যাপিরাস গাছ থেকে কিভাবে কাগজ বানানো হয় সেটা দেখানোর জন্য আমাদের আরেকটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে কাগজ বানানো ছাড়াও মিশরের বিভিন্ন বিক্যাত আর্টিস্টদের আকা বেশ কিছু ছবিও ছিল। সবই প্যাপিরাসের থেকে তৈরি কাগজের উপর আকা।
আলেকজান্দ্রিয়ায় আমরা লাঞ্চ করেছিলাম ভূমধ্যসাগরের পাড়ে!! আমরা যেখানে থেকে খাবার খাচ্ছিলাম, ধারণা করা হয় সেটা পৃথিবীর সবথেকে মধ্যবর্তী স্থান। মানে এই পাড়ের সামনের অংশে অর্ধেক পৃথিবী এবং পিছনের অংশে বাকি অর্ধেক পৃথিবী। এমনকি এই ধারণার সত্যতা সঠিক প্রমাণের জন্যই কিনা, সাগরের সামনের অর্ধেক অংশের পানি এবং বাকি অর্ধেক অংশের পানির রঙ পর্যন্ত ভিন্ন!!!
৩য় দিনের সফর শেষে আমাদের শপিং করার জন্য আমাদেরকে এলাকার একটি শপিং মলের সামনে নিয়ে যাওয়া হইছিল। এই শপিং মলটা নাকি আমাদের দেশের আড়ং এর মত। এখানকার প্রত্যেক কাপড় নাকি পিউর মিশরীয় কটন এ বানানো। কিন্তু মলে যেয়ে বুঝলাম আমাদের গাইডের বাংলাদেশের কাপড়ের মান সম্পর্কে কোনো ধারণা নাই। থাকলে অন্তত যাই হোক, এখানে আমাদের নিয়ে আসত না। আর টেক্সটাইলের দিক থেকে বাংলাদেশ যে কত উন্নত এবং কেন বাংলাদেশের পোশাকগুলো বিদেশে এত রপ্তানি হয় তা আরেকবার উপলব্ধি করতে পারলাম।
আর হ্যা, মিশরের ছেলেপেলে গুলো বেশ ভালো রকমেরই সোজা বাংলায় ছ্যাচড়!! আমরা যখন আলেকজান্দ্রিয়ার ডাউনটাউইন এ প্রবেশ করলাম এবং বাস থেকে নামলাম, কয়েকটা পিচ্চি পোলারে দেখলাম সকল বয়সের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে ফ্লাইং কিস দিচ্ছে!!! (পড়ে কেও একজন আমাকে বলেছিল এটা নাকি তাদের ট্রেডিশন, কিস দিয়ে সবাইকে স্বাগতম জানানো!)
সফরের ৪র্থ দিনে আমরা গেলাম ভূমধ্যসাগরের পাড়েই অবস্থিত একটি বিখ্যাত রাজার রাজপ্রাসাদে। আমরা আসলে রাজপ্রাসাদের ভিতর ঢুকতে পারি নাই, তবে সেটার বিশাল আঙ্গিনায় ঘোরাঘুরি করার সুযোগ হইছিল। এটাকে Qaitbay Castle বলা হয় যা মিশরের আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থিত। এর ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত বলতেছি না, আপনাদের কারও আগ্রহ থাকলে গুগল করে অনেক ভালোভাবে জেনে নিতে পারবেন। সেখানে ঘোরাঘুরি এবং ছবি তোলার পর গেলাম Montaza Palace এ। এবং সেখানের সুবিস্তৃত বাগান এ। খাওয়া দাওয়া, ঘোরাঘুরি, ছবি তোলা সহ বেশির ভাগ সময় এসব জায়গাতেই কেটে গেছিল। তবে সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করছি বাসে চলাচল করার সময় এখানকার রাস্তার মানুষদের এবং তাদের জীবনযাপনের পদ্ধতিগুলো। একটা কথা বলে নেই, কায়রো এর তুলনায় এই শহরে জ্যাম অনেক বেশী মনে হইছে। আর কিছু কিছু এলাকায় তো কাওরান বাজারের মত জনপুর্ণ ছিল। কায়রো যাওয়ার পথে আমরা একটি জায়গায় থামছিলাম। Bibliotheca Alexandria তে। এটা খুব সম্ভবত Middle east এর সর্ববৃহত লাইব্রেরী। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারণে আর ভিতরে ঢুকতে পারি নাই!!! আমরা আলেকজান্দ্রিয়ায় আরেকটা জায়গায় গেছিলাম, মিশরের সবথেকে বড় এবং অন্যতম প্রাচীন মসজিদ Abu al-Abbas al-Mursi Mosque এ। আমি আমার জীবনে যত সুন্দর মসজিদ্গুলো সামনাসামনি দেখছি এই মসজিদটি অন্যতম!!
মিশরের মানুষদের সম্পর্কে কিছু বলি। এখানকার বেশীরভাগ বয়স্ক মানুষ আলখাল্লা জাতীয় পোশাক পরে, আর মহিলারা বোরকা। তবে তাদের বোরকার সাথে বাংলাদেশের কোনো মিল পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের বোরকার থেকে এখানকার বোরকা গুলো কিছুটা টাইট ফিটিং। এবং মুখ ঢেকে রাখে না, পুরোপুরি খোলা রাখে কিন্তু হিজাব ঠিকই পরে। মিশরে আমি রাস্তায় কোনো মহিলার চুল দেখতে পারছি কিনা আমার মনে পরে না। তবে তাদের হিজাব আমাদের দেশের তথাকথিত অত্যাধুনিক মেয়েদের মত ফুলানো-ফাপানো না। ব্যক্তিগতভাবে আমি যত মুসলিম দেশেই গেছি, প্রত্যেক দেশে মেয়েদের পরিধেয় হিজাব দেখে আমাদের দেশের “অত্যাধুনিক” মেয়েদের প্রতি কেবল দীর্ঘশ্বাসই বের হইছে!! আমাদের দেশের থেকে অনেক উন্নত একটা মুসলিম দেশের মেয়েরা হিজাবটাকে অবিকৃত রেখে পরিধান করতে পারলেও আমাদের দেশের মেয়েরা এখনও তা শিখল না, উলটো সেটাকে ফ্যাশনের পর্যায়ে নিয়ে গেল!!!
যাই হোক, এখানকার রাস্তাগুলো ঘুরে আরও যে জিনিস লক্ষ্য করলাম তা হচ্ছে এই দেশে হুক্কা টানার প্রচলন অনেক বেশি। ছোটবড় প্রায় প্রত্যেক দোকানের সামনেই বেশ কয়েকটা হুক্কা রাখা থাকে যেগুলোতে ঘিড়ে মানুষজন নাস্তা করে, চা খায় এবং হুক্কা টানতে টানতে আড্ডা দেয়। ভাষা আর সংস্কৃতি ব্যতিত আমাদের পুরান ঢাকার সাথে আর কোনো পার্থক্য দেখলাম না। ৪র্থ দিনেই আমরা কায়রো তে আবার ফিরে আসলাম। ফিরে আসার পথে আমাদের কয়েকঘন্টা সময় দেওয়া হলো ডাউন্টাউন এর বাইরে হাইওয়ের সাথে অবস্থিত মিশরের অন্যতম বড় শপিং মল এ। (নাম ভুলে গেছি।)
আলেকজান্দ্রিয়ায় আমরা আরও একটি জায়গায় গেছিলাম। সমুদ্রের তীর ঘেসে, একটি ব্রীজ পার হয়ে, যেখানে মানুষজন মাছ ধরতে যায়। আমি জায়গাটার নাম এবং পরিচয় পুরোপুরিভাবে ভুলে গেছি!! নেটেও জায়াগটার পরিচয় বের করতে পারি নাই। সবার ক্ষমাপ্রার্থি।
সম্পুর্নো ভ্রমণের বিশেষ দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল আমাদের ৫ম দিন, যেদিন আমরা ভ্রমণে যাই বিখ্যাত Egyptian Museum এ। এখানে উল্লেখ্য যে, বাসে করে আমরা জাদুঘরে যাওয়ার পথে মিশরের বিখ্যাত তাহির স্কয়ার (যে স্থানে মিশরের সবচেয়ে বড় আন্দোলন সংঘঠিত হইছিল) এর মধ্য দিয়ে গেছিলাম। যদিও বাস থেকে নেমে জায়গাটা ভালোভাবে ঘুরে দেখার সুযোগটি হয়ে উঠে নাই। একটা কথা আগে বলা হয় নাই, তা হলো, এখানকার যানবাহনগুলোর স্টিয়ারিং হুইল ইউরোপিয়ান দেশগুলোর মত বাম পাশে হয়ে থাকে, আমাদের দেশের মত ডানপাশে না। যাই হোক, জাদুঘরে পৌছে বাস থেকে নামার পর গাইড আমাদেরকে হেডফোন সহ প্রত্যেককে হিয়ারিং সিস্টেম দিয়ে দিল। কারণ জাদুঘরের ভিতরে মানুষ অনেক বেশী এবং জাদুঘরটি অনেক বড়। তাই খালি গলায় গাইডের আওয়াজ শোনা অনেক কঠিন। তাই ছোট্ট একটা রেডিও নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে গাইড তার গলায় ঝুলানো মাইকে কথা বলত এবং আমরা হাডফোন দিয়ে তা ফোলো করতাম। সম্পুর্নো মিশর ভ্রমণের যত ট্যুরিস্ট স্পটেই আমরা গেছি না কেন, প্রত্যেক জায়গাতেই কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল, এন্ট্রি গেট এ ব্যাগ চেক এবং বডি চেক করা লাগত। এই জাদুঘরেও তার ব্যতিক্রম ছিল না, বরং আরও বেশী নিরাপত্তা ছিল, একাধিক জায়গায় চেকিং করাতে হইছে। আর জাদুঘরে ঢোকার আগে মোট ২ জায়গায় চেকিং করাতে হয়। জাদুঘরের ভিতরে মোবাইল এবং ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কেও যদি জাদুঘরের ভিতর ছবি তুলতে চায় তাহলে তাকে অতিরিক্ত টাকা (৫০ পাউন্ড) দিয়ে আলাদা টিকিট কেটে নিতে হয়, কিন্তু Mommies room এবং Golden room এ টিকিট দিয়েও ছবি তোলা যায় না।
এই জাদুঘরটি প্রায় এক হাজার বছর পুরানো, তবে এর স্ট্রাকচার এবং ভিতরের সুযোগ-সুবিধা বেশ আধুনিক। এবং জাদুঘরের ভিতর রাখা প্রত্যেক জিনিসই অথেনটিক, এবং প্রায় ৩০০০ বছর আগের পুরানো। জাদুঘরে ঢুকেই প্রথমে গাইড আমাদের দেখালো মমি করার জায়গাটি, অর্থাৎ মার্বেলের তৈরি যে জিনিসটার উপর মমি বানানো হত। তারপর দেখলাম মমি করার পর যে কফিনের ভিতর মমি রাখা হত। কফিনটাও মার্বেলের তৈরি ছিল। এবং প্রত্যেক জায়াগায় বিভিন্ন নকশা খোদাই করা ছিল। গাইডের মাধ্যমে জানতে পারলাম, সাধারণত যে মানুষের মমি রাখা হত, তার কফিনে সেই মানুষের প্রতিকৃতি সহ বিভিন্ন নকশা খোদাই করা হত। হাটতে হাটতে এরই মাঝে দেখে ফেললাম মমি তৈরি করার সরঞ্জামগুলো। এছাড়া কিছু অথেনটিক হাতে আকা ছবি (যেখানে বিভিন্ন মানুষ, দেবতাদের প্রতিকৃতি একে বিভিন্ন গল্প প্রকাশ করে) দেখলাম। তারপর গেলাম বহুল প্রতিক্ষিত Mommies Room এ। মমির রুমে ছবি বা ভিডিও করা সম্পুর্নোভাবে নিষিদ্ধ। (অনেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ছবি/ভিডীও করে, তাদের কথা আলাদা।) অনেকে ক্যামেরায় ফ্লাশ ব্যবহার করে থাকে। সাধারণোত এসব ফ্লাশে মমির ক্ষতি হয়ে থাকে। মমির রুমে ফেরাউন সহ ফেরাউন বংশের ১৩ টি মমি রাখা আছে। তাদের সবাই রাজা-রানী এবং তাদের বংশধর। তাদের কেও কেও যুদ্ধে মারা যায়, কারও মৃত্যুর কারণ অজানা। আমি আমার জীবনের যত অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর জিনিস দেখেছি, ৩০০০ বছর পুরানো এই মমিগুলো তার অন্যতম। কারণ এসব মমির অনেকগুলোতে তাদের হাত-পায়ের নখ বোঝা যায়, দাত বোঝা যায়। কয়েকজনের চুলও বোঝা যায়। হাত-পায়ের উপরিভাগ এবং মাথা সম্পুর্নো উন্মুক্ত বলে এসব দেখা যায়, এমনিতে বাকি অংশগুলো মমির কাপড়ে পেচানো। আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হওয়া সবথেকে অক্ষত মমি বলা হয় ফেরাউনের মমি কে। আসলেও তাই। যে কেওই তার মমিকে দেখলে তার আসল চেহারা কি ছিল অনায়াসে বুঝে ফেলতে পারবে। তার দাত, হাত-পায়ের নখ, মাথার চুল থেকে শুরু করে তার চেহারার চামড়া পর্যন্ত একটা লেভেল পর্যন্ত অক্ষত!!! মমির রুম থেকে বের হয়ে এবার গেলাম তুতেনখামুনের ট্রেজার দেখতে।
বাংলা ভাষায় আমরা “তুতেনখামুন” বললেও এর আসল উচ্চারণ তুত-আংখ-আমুন (Tut-ankh-amun)। তুতেনখামুন কে মিশরের এখন পর্যন্ত সবথেকে জনপ্রিয় রাজা বলা হয়। সে মাত্র ৯ বছর বয়সে রাজা হয় এবং ২০ বছর বয়সে মারা যায়। তার রাজত্বকাল ছিল মাত্র ১১ বছর। কিন্তু এই ১১ বছরে যে বিপুল পরিমান সম্পদ তার অধীনে ছিল তা বর্ণনাতীত। মিশরে আবিষ্কৃত হওয়া এখন পর্যন্ত সবথেকে বেশী সম্পদ তার অধীনে পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত আনুমানিক ৩০০০০ সম্পদ (বিশাল কফিন থেকে শুরু করে হাতের আংটি পর্যন্ত গোনা হয়েছে) পাওয়া গেছে। এসবের বেশীরভাগই নিখাদ স্বর্ণের তৈরী অথবা স্বর্ণে আবৃত!!! সম্পুর্নো জাদুঘরের প্রায় অর্ধেক অংশই তার ট্রেজার এ ভরা। অসংখ্য ট্রেজার এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল তার ব্যবহৃত অনেকগুলো খাট, সিংহাসন, তার ব্যবহৃত ছড়ি, পা দানি , বিভিন্ন জিনিসের প্রতিকৃতি, তার ব্যবহৃত ছাতা, ঘোড়ার গাড়ি, মাছ ধরার উপকরণ, তার কফিনসহ আরও অনেক কিছু। তবে তার ট্রেজার এর মধ্যে সবথেকে অক্ষত জিনিস বলা হয় তার ব্যবহৃত পাখাটি। পাখায় ব্যবহৃত পশমগুলো অনেকটাই এখনো অক্ষত রয়েছে!!! এখানে উল্লেখযোগ্য যে, তার ট্রেজারের প্রায় প্রত্যেকটাতেই বিভিন্ন সাপ, জন্তুসহ বিভিন্ন দেব-দেবীর নকশা আকা এবং খোদাই করা। তার হাতছড়ির উপরিভাগ সাপের আদলে গড়া, তার পা দানিতেও বিভিন্ন শক্তিশালী জীব-জন্তুর নকশা করা। এর কারণ হিসেবে গাইড আমাদের বলছিল, আগেরকার যুগের রাজা-বাদশারা নিজের প্রভু মনে করত এবং অসম্ভব ক্ষমতাশীল মনে করত। তাই তাদের ক্ষমতার নিদর্শনস্বরূপ তাদের ব্যবহৃত জিনিসগুলোতে এসব নকশা করে রাখত এবং বোঝাতে চাইত সকল শক্তিশালী জিনিসই তাদের মুঠোয় রয়েছে। তার ট্রেজার দেখার পর (যদিও সকল ট্রেজার দেখে আমরা শেষ করতে পারি নাই) আমরা ঢুকলাম Golden Room এ, যেখানে তুতেনখামুন এর জুয়েলারি, তার যুদ্ধে ব্যবহৃত পোশাক, সরঞ্জাম, তার মুকুট, তার তোলোয়ার, চাকুসহ তার কফিনও রাখা আছে। স্বাভাবিকভাবেই তার কফিনে তার প্রতিকৃতিসহ অসংখ্য নকশা করা আছে। এবং কফিনটি পর্যায়ক্রমে ৩ টি বিশাল বাক্সের ভিতর ছিল, যে বাক্সগুলো একটার মধ্যে আরেকটা ঢুকানো ছিল। উল্লেখযোগ্য যে, আজ পর্যন্ত তার মমিকে তার কফিন থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় নাই। ধারণা করা হয় এই মমিতে অভিশাপ লেগে আছে। মানে যে কেওই এই মমিকে উদ্ধার করার জন্য অগ্রসর হইছে, প্রতেয়কবারই তারা মারা গেছে (বিস্তারিত গুগলে দেখতে পারেন)। অবশেষে গোল্ডেন রুম থেকে বের হয়ে আরও টুকটাক কিছু জিনিস দেখার পর আমরা জাদুঘর থেকে বিদায় নিলাম।
সফরের ৬ দিনের মধ্যে আমাদের গাইড ৫ম দিনেই বিদায় নিছিল। ৬ষ্ঠ দিনে তার পরিবর্তে আরেকজন গাইডের কাজ করে গেছিল। ৬ষ্ঠ দিনে আমরা আমাদের ব্যাগ গুছিয়ে এয়ারপোর্ট এর দিকে রওনা হলাম। মাঝখানে আমরা একটা অনুরোধ করছিলাম গাইডকে, মিশরের সবথেকে পুরানো এবং বিশ্বের অন্যতম পুরানো বিশ্ববিদ্যালয় Al Azhar University দেখানোর জন্য। গাইড আমাদেরকে কথা দিছিল এবং শেষ পর্যন্ত তার কথাটি রাখছিল। এয়ারপোর্ট এ যাওয়ার পথে বিশ্ববিদ্যালয়টি পড়ছিল এবং বাইরে থেকে আমাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়টি দেখাইছিল। ভিতরে ঢুকতে পারি নাই, কারণ স্টুডেন্ট ব্যতিত বাইরের কেও ঢোকা এখানে নিষিদ্ধ। অতপর মাঝখানে আমরা আমাদের লাঞ্চ শেষ করে এয়ারপোর্ট এ চলে আসলাম এবং অসংখ্য স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা সাথে নিয়ে মিশরকে বিদায় জানালাম। বাংলাদেশ থেকে থেকে মিশর আসতে মোটামুটি ১৮ ঘন্টা লাগলেও মিশর থেকে বাংলাদেশ ফিরতে কাটায় কাটায় ২৪ ঘন্টা লাগছিল!!! কারণ দুবাই তে ট্রানজিট এ আমাদের ফ্লাইট ২ ঘন্টা দেরী করছিল!! অতপর দেশে ফিরে ২ দিন বাসায় বিশ্রাম নিয়ে পুনারায় চিটাগাং এ আমার ক্যাম্পাসে ফিরে আসলাম।
সংস্কৃতি আর ভাষা ব্যতিত আসলে বাংলাদেশ আর মিশরের মধ্যে খুব বেশী একটা পার্থক্য নেই। যুদ্ধে বিদ্ধস্ত এই দেশে প্রচুর ধংসাবশেষ এবং war symmetry পাওয়া যাবে। অনেক দেশের তুলনায়ই মিশর বেশ গরীব, কিন্তু এখানকার ঐতিহ্যে মিশর অনেক ধনী, যা খুব কম দেশেরই আছে। যারা বিদেশ ভ্রমণ ভালোবাসেন এবং যাদের ইতিহাস অনেক পছন্দের, তারা চেষ্টা করলে সহজেই মিশর ভ্রমণ করে আসতে পারেন, না হলে বিশাল একটা অংশ মিস করবেন। শুধু যাতায়াতের ভাড়াই অধিকাংশ, নতুবা মিশরে থাকা-খাওয়ার খরচ বাংলাদেশের তুলনায় প্রচুর কম। আর হ্যা, মিশরে গেলে একা একা বা নিজ প্রচেষ্টায় যাওয়ার চেষ্টা করলে প্রচুর পেইন খাবেন, এখানকার অনেক জায়গায় ঘোরার জন্য পুলিশের অনুমতি লাগে, অতিরিক্ত খরচ হয় আর অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। কিন্তু কোনো পর্যটন কোম্পানির অধীনে তারাই সব দায়-দায়িত্ব নিয়ে নেয় এবং সেখানে খুব ভালো একটা গাইডও দিয়ে দেয়, যারা প্রত্যেকদিন, প্রত্যেক জায়গাতেই আপনাদের সাথে থাকবে এবং দিক নির্দেশনা দিবে। আর আপনি প্রত্যেকদিন রাজার হালে পায়ের উপর পা তুলে অবিস্মরণীয় জায়গাগুলো ঘুরে বেড়াবেন!!!
কিছু না বলা কথাঃ দুবাইয়ে ট্রানজিট এ আমাদের সাথে দুবাই থেকে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অনেক শ্রমিকও দেশে ফিরতেছিল। বিদেশে যে আমাদের দেশের শ্রমিকদের সাথে খারাপ আচরণ করা হয় তা তখন আমরা স্বচক্ষেই দেখতে পেলাম। সাধারণত দুবাইতে Duty free থেকে শপিং করলে আনলিমিটেড শপিং করা যায়, ওজনও হিসাব করা হয় না। কিন্তু এক অজ্ঞাত কারণে এমিরেটস এ ঢোকার আগ মুহুর্তে সকল শ্রমিকদের ব্যাগের ওজন চেক করা হতে থাকে এবং কষ্টের টাকায় কেনা ভুরি ভুরি জিনিস রেখে দিতে হচ্ছিল তাদেরকে!!! একটা অসহায় মানুষের অবস্থা কেমন হতে পারে তা খুব কাছ থেকেই দেখলাম। তবে ট্রানজিটে থাকা সকল ফ্যামিলিকে খুব সহজেই তারা ছেড়ে দিচ্ছিল। সেটা বুঝতে পেরে আমার আব্বু হঠাট করে ৩-৪ জনের কিছু মালামাল আমাদের ব্যাগের ভিতর ভরতে থাকল। সত্যি কথা বলতে আমি একটু বিরক্তই হইছিলাম, যে হঠাট করেই আব্বু কেন জনসেবা শুরু করে দিল, তাতে আমরাই না উলটো বিপদে পরে যাই!!!আর এভাবে কতজনেরই বা সাহায্য করতে পারব?? কিন্তু আব্বুর কথা শুনে ব্যাগে একটা উকি দিতেই উলটো লজ্জা পেয়ে গেলাম!!! লোকগুলি আসলে তাদের বাচ্চাদের জন্য অনেক খেলনা আর চকলেট নিয়ে যাচ্ছিল, আর তা দেখেই আমার আব্বু তাদের লাগেজগুলো আমাদের সাথে নিয়ে নিছিল এবং পরে প্লেনে দিয়ে দিছিল। না হলে লোকগুলোকে সেসব খেলনা আর চকলেটগুলো এয়ারপোর্টেই ফেলে আসতে হতো। আর সাহায্য করার পর তাদের কথা এবং মুখের হাসি দেখেই মন ভরে গেছিল। বিশ্বাস করুন, যদি সেখানে থাকা প্রত্যেক শ্রমিকদের সাহায্য করার সুযোগ থাকত, তাহলে প্রত্যেককেই সাহায্য করতাম।
©somewhere in net ltd.