![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ হয় গাজীপুরে (তৎকালীন জয়দেবপুরে)। ১৯শে মার্চ পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিকামী জনতার লড়াইয়ের পরই দেশজুড়ে স্লোগান ওঠে-‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। সেদিন পাকবাহিনীর গুলিতে গাজীপুরের নিয়ামত আলী, মনু খলিফা ও হুরমত আলী জীবন দিয়ে মুক্তির পথ তৈরি করে পতাকা এনেছেন। কিন্তু তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক মুক্তি আজও আসেনি। বছর ঘুরে দিনটি এলে গভীর শ্রদ্ধায় নানা আয়োজনে মেতে উঠেন নগর ও জেলাবাসী। কিন্তু প্রথম প্রতিরোধ সংগামে সেদিন, যাদের রক্তে স্বাধীনতা যুদ্ধের পথ আরও গতি পায়, উদ্বেলিত হয় তাদের পরিবারের সদস্যদের এখনও রয়েছে নানা কষ্ঠ আর আকুতি। সেদিনের নেতৃত্ব দেয়া যোদ্ধাদেরও রয়েছে নানা দাবি। পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধে শহীদ মনু খলিফার স্ত্রী রহিমা আক্তার (৬৩) অশ্রুসিক্ত নয়নে জানান তার নানা দুঃখের কাহিনী। বলেছেন, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও তিনি কোনো সরকারের কাছ থেকে তেমন কিছুই পাননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রহিমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঢাকার মিরপুরে বাড়ি দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি তার স্বপ্নই থেকে গেছে। জিয়াউর রহমানের আমলে তাকে গাজীপুরের জোলার পাড়া এলাকায় ১ বিঘা জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। নানা জটিলতায় সে জমির দখল পাননি এখনো। বর্তমানে প্রতিমাসে মাসে অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পান। কিন্তু সে টাকার ভাগ অস্বচ্ছল মেয়েদেরও দিতে হয়। কেন না ওই ভাতায় তাদেরও হক রয়েছে। তার ৫ মেয়ের বিয়ে-সংসার হলেও সবাই স্বচ্ছল নয়। রহিমার নিজের কোনো ঠিকানা নেই। স্বামী রেখে যেতে পারেননি ভিটে বাড়ি, সহায়-সম্পদ। তিনি এখন শহীদ স্বামী মনু খলিফার ছোট ভাইয়ের বাসায় থাকেন। চোখের পানি ছেড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, বেঁচে আছি কাজের মেয়ের মতো। মার্চ মাস, ১৯শে মার্চ আসলে অনেকে আসেন খোঁজখবর নিতে। আর সারা বছর কেউ কোনো খোঁজ নিতে আসেন না। রহিমার আকুতি, জেলা শহরে সামান্য একটু জায়গায় হলেও একটা ঘর তৈরি করে বসবাসের ঠিকানা করে দেয়া হোক। শহীদ নিয়ামত আলীর বড় ভাই গোলাম তাজ আলীর রয়েছে নানা ক্ষোভ। গত ৪৪ বছরে জেলা শহরের উন্নতি হয়েছে অনেক। উঁচু উঁচু দালান-কোঠার মাঝে এখনও টিকে আছে শহীদ নিয়ামত আলীর রেখে যাওয়া মাটির ঘর। ওই ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে গোলাম তাজ আলী বর্ণনা করেন অগ্নিঝরা মার্চের ইতিহাস আর ক্ষোভের কথা। তিনি জানান, ১৯শে মার্চ নগরের জয়দেবপুরের তাদের মারিয়ালি এলাকা থেকে তার নেতৃত্বে ছোট ভাই নেয়ামতসহ গ্রামের বীর জনতা প্রতিরোধ স্থলে যান মিছিল নিয়ে। পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে চোখের সামনেই মারা গেছেন ছোট ভাই নেয়ামত। দাফন হয়েছে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে। মনু খলিফাকেও দাফন করা হয় এক সঙ্গে। তিনি আরও বলেন, কবরস্থানটিতে বর্তমান সরকার সীমানা প্রাচীর তৈরি করলেও পুরোপুরি সুরক্ষিত করা ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তৎকালীন মুক্তি সংগ্রাম পরিষদের সদস্য আব্দুস সাত্তার মিয়া ও শেখ আবুল হোসাইনের দাবি, বীরত্বগাঁথা সেদিনটিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা এবং শহীদ পরিবারের সদস্যদের যথাযথ সম্মান দেয়া হোক। শহীদ পরিবারের লোকজন জানান, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও শহীদদের স্বজনদের দিন কাটছে নানা কষ্টে। সরকারিভাবে ১ বিঘা করে জমি বরাদ্দ হলেও তা পাননি তারা। শহীদ পরিবারের নামে বরাদ্দ করা জমি, সুবিধাদি দেয়াসহ তাদের রয়েছে নানা দাবি। সেদিনে ওই প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্বে দেন যিনি, আজকে দেশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি। তার কাছেই এখন নানা দাবি শহীদ পরিবারের লোকজন ও মুক্তিযোদ্ধাদের। তবে গাজীপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার এসএম মজিবুর বলছেন, দিবসটিকে জাতীয়ভাবে মর্যাদা দেয়ার ব্যাপারে নানা উদ্যোগ ও কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। অবশ্য ১৯শে মার্চের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে চান্দনা চৌরাস্তায় নির্মাণ করা হয়েছে স্মারক ভাস্কর্য ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী’ এবং জয়দেবপুর বটতলায় ‘মুক্তমঞ্চ’। প্রতি বছর পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় গাজীপুরবাসী এ দিনটি উদযাপন করেন। এবারও রয়েছে নানা আয়োজন। ১৯শে মার্চকে ‘সশস্ত্র প্রতিরোধ’ দিবস হিসেবে জাতীয়ভাবে পালন আর শহীদ পরিবারের সদস্যদের প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান মুত্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন, এমনটাই আশা করছেন গাজীপুরবাসী।
বীরত্বগাথা সেই দিন ১৯শে মার্চ
মার্চের প্রথম দিকে দুই ধাপের জয়দেবপুর মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। মরহুম হাবিব উল্লাহ এমপির নেতৃত্বে প্রয়াত মণিন্দ্র্রনাথ গোস্বামী ও শ্রমিক নেতা মরহুম এমএ মুত্তালিবকে সদস্য করে ৩ সদস্যের হাইকমান্ড এবং বর্তমান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপিকে আহবায়ক করে অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মো. নজরুল ইসলাম খান এবং সদস্য ছিলেন মো. শহীদুল্লাহ বাচ্চু (মরহুম), শেখ মো. আবুল হোসাইন, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার মিয়া, হারুন আর রশিদ ভূঁইয়া, মো. শহীদুল ইসলাম পাঠান (মরহুম) ও মো. নুরুল ইসলাম। গাজীপুরের তৎকালীন নাম ছিল জয়দেবপুর। জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ীতে অবস্থান ছিল তৎকালীন পাকবাহিনীর ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ১৯শে মার্চ সকালে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব এক কোম্পানি সৈন্যসহ জয়দেবপুর সেনানিবাসে এসে উপস্থিত হন। এসময় ওই রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করা হবে- এমন সংবাদে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে মুক্তিকামী সর্বস্তরের বীরজনতা। জনতার সঙ্গে ছিল লাঠি-সোটা, তীর-ধনুক, বলম, রড আর শাবল। জনতা রাজবাড়ী সড়কে তৈরি করে দুর্ভেদ্য অবরোধ। তারা রেলস্টেশন থেকে মালগাড়ির একটি ওয়াগন এনে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। সংগ্রাম পরিষদের ডাকে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেয় বীর জনতা। জয়দেবপুর বাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সামনে পৌঁছুলে জনতা তাদের কাছ থেকে ৪টি চাইনিজ রাইফেল ও একটি স্টেনগান কেড়ে নেয়। পাকহানাদার বাহিনী নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালায়। এতে শহীদ হন। মরহুম কাজী আজিম উদ্দিন মাস্টারের ব্যক্তিগত বন্দুক দিয়ে পাল্টা গুলি চালানো হয়। সেদিন পাকসেনাদের সঙ্গে মুক্তিকামী জনতার লড়াইয়ে তিনজন বীরজনতা নিয়ামত আলী, মনু খলিফা ও হুরমত আলী শহীদ হন। এ দিকে জয়দেবপুর বটতলা ব্যারিকেড ভেঙে ঢাকায় যাওয়ার পথে পাক সৈন্যরা চান্দনা চৌরাস্তায়ও শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এখানেও পাকসেনারা নির্বিচারে গুলি চালায়। এসময় ভোগড়া গ্রামের সাহসী যুবক ফুটবলার হুরমত আলী এক পাকসেনার রাইফেল ছিনিয়ে নিতে গিয়ে অপর এক সেনার গুলিতে শহীদ হন। এসময় কানুবীরসহ অনেকে আহত হন। এর পরই দেশজুড়ে স্লোগান ওঠে-‘ জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কানুবীরও মারা যান।
তথ্য ও ছবি : ইন্টারনেট ও A.MAMUN আর্কাইভ
©somewhere in net ltd.