নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভালোবাসা সবার উর্ধ্বে
অনিকেত কামাল
বেতারে ভেসে এলো একজন কবির লেখা কবিতার যাদুকরী পঙতির উচ্চারণ। অনি তন্ময় হয়ে শুনছে কবিতা। শিশুকাল হতেই কবিতার প্রতি ভীষণ দুর্বল অনি। কবিতা ভালোবাসে চেতনার সম্পদ দিয়ে, অন্তরের গভীর মমতা দিয়ে। কিন্তু অাজ কবিতার পাশাপাশি কবিকেও ভালোবেসে ফেলল। একটু একটু করে অনুভবের মাত্রাও বাড়তে লাগল। খুঁজতে লাগল কল্পনার বিস্তীর্ণ জগতে। ভাবনার পরিধি দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হতে লাগল। এক অচেনা অজানা মায়াবী সুখের পরশে হারিয়ে যেতে লাগল মন। কি অাশ্চর্য গভীর অাস্থা অনির। মনের গাঢ় বিশ্বাসের প্রিজম দিয়ে দেখছে কবিকে। অদ্ভুত ভাবনার ডালি সাজিয়ে নির্জন নিরবতায় অনি সাধনা করে কবি জ্যোতিকে।
বাংলাদেশ জাতীয় বেতার কেন্দ্র ঢাকা মাসিক শেষ মঙ্গলবার 'সৃজনী' অনুষ্ঠান নামে তরুণ কবিদের লেখা নিয়ে কবিতার অাসর বসত। সেই অণুষ্ঠানে প্রচারিত কবিতার ভালোলাগা থেকে কবি জ্যোতিকে অনি চিঠি দেয়। কবি জ্যোতিও সাড়া দেন। জল গড়াতে গড়াতে যে সাগরে মিশে যায় তেমনি জ্যোতি ও অনির সম্পর্ক গড়াতে গড়াতে গাঢ় প্রতিশ্রুতির বন্ধনে অাবদ্ধ হয়। বাস্তবের দৃষ্টিতে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে দু'জন। উভয়ের সাক্ষাতের জন্য নির্ধারিত হয় ২য় ধলেশ্বরী সেতুর পাথরপ্রিয় চরে। করি জ্যোতি অাগেই সেখানে পৌঁছেছিল । অনি দূর থেকে
অবলোকন করছে জ্যোতির অপেক্ষারত উদ্বিগ্ন মুখ।
হঠাৎ অনির মোবাইলে দুসংবাদ ভেসে এলো। অাকাশ ভেঙ্গে পড়ল অনির মাথায়। ছুটে গেল বাবার রোড এ্যকসিডেন্টের লাশের পাশে। পড়ে থাকল অস্পুট ভালোবাসার স্বপ্ন ছোঁয়া গোলাপ। বিধি বাম সাথে সাথে মোবাইলেরও চার্জ শেষ। সম্ভব হয়নি জ্যোতিকে জানানো। জ্যেতি অনিকে ভুল বুঝল। অনিও ভাবল ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ভাবনার অাকাশে চাঁদের অালোয় অালোকিত যে মন সে মন চাঁদকে স্পর্শ করার পূর্বেই দুঃখের মেঘ নেমে এলো। অনিও মনে মনে ভাবল প্রতিজ্ঞা করল অার কখনো লিখব না, অার কখনো ভালোবাসার কোমল জমিনে স্বপ্নের সবুজ চারা রোপন করব না।
অভিমান প্রতিজ্ঞা অার ভুল বুঝার সময় গড়াতে গড়াতে কেটে গেলো পাঁচটি বছর জ্যোতিও মনের ক্ষোভে কবিতা
লেখেনি। পড়াশুনায় ব্যস্ত ঢাবিতে অর্নাস করছে। অনেক অনেক ভালোবাসার অাবেদন উপেক্ষা করলেও অনির ভালোবাসায় বেঁধে রাখা মনটি শুধু অনির স্বপ্নময় ভালোবাসার অাবেসের কারণেই কাউকে ভালোবাসতে পারেনি। কঠিন প্রতিজ্ঞার প্রচীরও কেউ ভাঙ্গ্তে পারেনি।
এদিকে বাবার মৃত্যুতে অনি ভেঙ্গে পড়ে। নামতে হয় ভাগ্যের অন্বেষণে। বেঁচে থাকার তাগিদে কখনো কখনো মানুষের স্বপ্নের সাজানো প্রাসাদ ধূলিসাধ হয়ে যায়। স্বপ্নগুলো কাঁদে নীরবে নিভৃত্যে। অভিলাষের বুকে শুধু ব্যর্থতার রক্তক্ষরণ ঘটে, তবুও বাঁচতে হয়। নিয়তির অঘোম বিধানকে মেনে নিতে হয়। মনের অনিচ্ছা সত্বেও অাশার গোলাপকে কবর দিয়ে অনি এখন টেম্পো চালায়। অনি নামটি ছিল জ্যোতিরই দেওয়া। এখন সে ঐ নাম ব্যবহার করে না। পাভেল নামেই সে পরিচিত। পাভেল অণুবীক্ষণের চোখ দিয়ে অাবিস্কার করার পরে প্রতিদিন
জ্যোতি ও এলেক্সকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যায় এবং অানে। একদিন টেম্পু যোগো বাসায় ফেরার পথে বান্ধবী এলেক্স জ্যোতিকে বলল চলনা অাজ বোটানিক্যাল গার্ডেন হতে ঘুরে অাসি। জ্যোতি নামটি শুনে পাভেল চমকে উঠল। পিছনের ফেলে অাসা জীবনের কথা ভাবতে গিয়ে অনির দু'চোখ জলে সিক্ত হল।
ভাবল মানুষের নামে তো মানুষ থাকে, চেহারার সাথে চেহারার মিল থাকাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। অাবেগের কোমল বাতাসকে ঘৃণা ও অভিমানের অাক্রোশে উপেক্ষার ঘুর্ণিঝড়ে তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করল। বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেটে টেম্পু থামলে জ্যোতি বলল অাপনি অপেক্ষা করবেন, ভাড়া যা হয় দিয়ে দিব। অনির ভিতরের পৃথিবীটা কাল বৈশাখীর ঝড়ে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। স্নৃতির মলিন অায়নায় ভেসে উঠে ভালোবাসার প্রিয়তমার নাম। মনের ধূসর স্নুতিপট ভেদ করে উঁকি দেয় অাশার জ্যোস্না। হৃদয়ের গহীণ কোণে টোকা পড়ে। ভাবনার বৃষ্টিতে ভিজে কাকভেজা হয় মনের অাঙিনা।
জীবনের অাবস্থানের হিসেব মিলাতে গিয়ে অনি সময়ের কাছে হার মানে। মনে মনে ভাবে দুর্ভাগ্য হয়ত অামার পিছু ছাড়ছে না। অার ঢাকায় না। যেই ভাবা সেই কাজ । চলে যায় গাজিপুরে। বোটাঃ গার্ডেন থেকে ফিরে এসে জ্যোতি এলেক্স টেম্পু অালাকে না পেয়ে মনটা কিছুটা খারাপ হয়। অারে অাজব মানু্ষ তো টাকা না নিয়ে চলে গেলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর তারা ব্যর্থ মনোরথে বাসায় ফিরে। এলেক্স বলল কিরে একজন টেম্পুওলার জন্য তোর মন খারাপ নাকি। না না তা হবে কেন । তাহলে কথা বলছিস না কেন!!
গাজিপুরে গিয়ে অনি বন্ধুর কাছে সব খুলে বলে। সব শুনে মামুন অনিকে সাহায্যের কথা বলে। অনি বলে মামুন অামি কারো করুণা নিয়ে বড় হতে চাই না। মামুন বলল এটাকে করুণা ভাবছ কেন? মনে কর শিক্ষক ছাত্রকে পথ দেখিয়ে দেন অার ছাত্র সেই পথে সম্ভবনার দুয়ার খুলে নিল সেটা কি শিক্ষকের করুণা। পাভেল বলল অামি ঠিক সেভাবে ভাবিনী।
মামুনের অাঙ্কেলের কোম্পানীতে অনি চাকরী পায়। অাত্নবিশ্বাসের উপর ভর করে অনি এগিয়ে চলে। কর্ম দক্ষতার গুনে অনির অবস্থান বদলে যেতে থাকে, স্বচ্ছলতার শিকড় দীর্ঘ হতে থাকে। অাশার নিবু নিবু প্রদীপ অাবার অালো ছড়াতে শুরু করে। ব্যর্থতার অাঁধারে মনের স্বপ্নেভরা পৃথিবী এক সময় অন্ধকারে হারিয়ে যেতে চেয়েছিল সেখানে অাবার নতুন করে প্রভাতের সূর্য্য উদিত হতে চায়। পরিচিতির অবস্থান বদলে গেলে মানুষও বদলে যায়।
অনি অাবার জ্যোতির কাছে চিঠি অার মোবাইল নং দেয়। জ্যোতির ফাইনাল পরীক্ষা অার একমাস বাকী। অনির পরিচয় অার মোবাইল নং পেয়ে জ্যোতি চমকে উঠে। মনের মাঝে অাবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু না ভালোবাসার মায়াবি টানের নিকট পরাজয় বরণ করে জ্যোতি। সকল শূন্যতা পূর্ণতাই ভরে উঠে। পূর্বের সমস্ত জড়তা, মান অভিমান, অভিযোগ অনুযোগ, ক্ষোভ অাক্রোশ ক্ষমার অর্ঘ্যে পূজনীয় করে তোলে, অাবার তারা সাক্ষাতের জন্য মিলিত হয়। স্বর্গ সুখের সংসারের অাশায় চির মিলনের অাশায় দেখা করে। কিন্তু এখানেও বিধি বাম। দু'জন দু'ধর্মের।
ধর্মের পটভূমিতে সম্পর্ক স্বীকৃতি পায়, স্বীকৃতি পায় সমাজ ও রাষ্ট্রে। বিশেষ করে বিয়ের ক্ষেত্রে। জ্যোতি বলে তুমি ধর্ম ত্যাগ কর, অনি বলে তুমি। যুক্তি তর্কের উপ্তত পরিবেশে জ্যোতি দীপ্ত কন্ঠে জানিয়ে দিল তুমি ধর্ম ত্যাগ না করলে এই বিয়ে সম্ভব না।
জ্যেতি অনিকে এক সপ্তাহের সময় দিল। ডানা ভাঙ্গা পাখির মত অাহত হয়ে অনি বেরিয়ে এলো। কোম্পানীর গাড়ি নিয়ে এসেছিল অনি। মহা সংকটের তীরে বিদ্ধ হতে থাকে অনির হৃদপিন্ডে । নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এ্যাকসিডেন্ট করে অনি। মাসাধিক চিকিৎসার পর ডাঃ অাতিক চেীধুরী বিদেশ নিয়ে যেতে বলেন। ভালোবাসার টানে জ্যোতি সব ত্যাগ স্বীকার করে অনিকে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করে। অনি সেটা জানে না। অনি জানে কোম্পানী সব কিছু করছে।
অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস অনি বিদেশ থেকে ভালো হয়ে ফিরে অাসেনি, এসেছে লাশ হয়ে। জ্যোতি অনির লাশের পাশে অঝোর ধারায় কাঁদছে। সব বিষ্ময়ের বড় বিষ্ময় জ্যোতির চোখের জল মৃত্তিকার বুকে লিখে দিল ভালোবাসা সবার উর্ধ্বে।
©somewhere in net ltd.