নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বসে আছি অন্ধকারে, \nআমাকে বুঝতে দাও \nমানুষ কেন আলোর \nপ্রত্যাশা করে!

আসোয়াদ লোদি

জীবন ও যন্ত্রণার মরুচরে আমি প্রপাতের ধারা ।

আসোয়াদ লোদি › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্প ।। বড় খতরনাক জ্বিন

১২ ই মে, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:২২


হাবিবুল গ্রামের অন্য আট দশটা ছেলের মত নয় । হৈহুল্লড় এড়িয়ে চলে । একা থাকতে পছন্দ করে আর কোন না কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকে । ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে সে ভাবে, নীল আকাশে ঘুড়িকে ছোট দেখায় কেন ? কিন্তু এর কোন উত্তর সে খুঁজে পায়না । আবার কখনো ভাবে মেঘ কোথা থেকে আসে, আবার ওড়ে ওড়ে কোথা চলে যায় । পাখির ওড়ে যাওয়া দেখে ভাবে, পাখিরা কেন ওড়তে পারে সে কেন পারেনা ? যদি সে পাখির মত ওড়তে পারত তবে কত মজাই না হত । পাখির মত ওড়বার স্বপ্ন ধীরে ধীরে তার মনে বড় হতে থাকে ।
হাবিবুলের বয়স দশ । দোলনা গ্রামে তার বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে ইস্কুলে যায় না, কিন্তু হাবিবুল ইস্কুলে যায় । স্বভাবে শান্ত হলেও ইস্কুল কামাই ও লেখাপড়ায় অমনোযোগিতার লক্ষণ তার মধ্যে দেখা যায় । প্রতিদিন সে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় আর গাছের গুড়ির উপর বসে আকাশ দেখে, মেঘ দেখে,পাখি দেখে । মাঝে মাঝে তার মন পাখি হয়ে ওড়ে যায় দূরে, বহুদূরে । তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলেও হাবিবুল ঘরে ফেরার কথা ভুলে যায় ।
ছমিরালী প্রায় জঙ্গলে খুঁজে খুঁজে ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনে । হাবিবুল ঘরে থাকলেও আনমনা হয়ে বসে থাকে । না হয় জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে । কারো সঙ্গে তেমন কথাও বলে না ।ছমিরালী ছেলের দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়ে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।
ফজিলা ছেলের দিকে তাকাতে পারেনা । কেন জানি তার বুক ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় । সে ছেলের দিকে তাকিয়ে আঁচলে চোখের কোণ মুছে আর স্বামীর উপর চড়াও হয় ।
আপনেরে তো মেলাদিন কইলাম, পোলাডারে একবার বাদশা কবিরাজের কাছে লইয়া যান । আমার কথাডা হুনলান না । খালি টাইম খাওনের তালে থাহেন । পোলাডার দিকে তাহানো যায় না । আমার কলিজা মোচড় দিয়া আহে ।
ফজিলা হাবিবুলের চুলে আঙুল চালায় । হাবিবুলের চুল বেশ লম্বা এবং ঘন । তার আঙুল চুলের নিচে ডুবে গেলে সে ভাবে নাপিতের কাছে যাওয়ার টাইম আসছে ।
ছমিরালী ফজিলার দিকে তাকায় না । সে একটা জলচৌকির আলগা হয়ে যাওয়া অংশে পেরেক গাঁথে । হাতুড়ি টকটক শব্দ করে ।
বাদশা কবিরাজ ঠকবাজ । হে কবিরাজির কী জানে ? ছমিরালী ফজিলার দিকে না তাকিয়ে জবাব দেয় ।
শহরে যাইবার কথা ভাবতাছেন, সরকারি ডাক্তারের কাছে ?
ফজিলা হাবিবুল কে বুকে জড়িয়ে রাখে । হাবিবুল মায়ের বুকে মাথা রেখে পাখির মত উড়ার কথা ভাবতে থাকে । ছমিরালী জলচৌকিতে দ্বিতীয় পেরেকটি গাঁথে । ভাবতাছি কুতুব হুজুরের লগে একবার বুইঝা লই । হের পানিপরা, তাবিজ-কবজের মারফতি গুণ আছে ।
কবে যাইবেন ? ফজিলা গ্রীবা ঘুরিয়ে তাকাল স্বামীর দিকে ।
কাইল দুপুরবেলা । অহন হাবিবুল আর আমারে ভাত দাও । বাপ-পুতে খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ি ।
পরদিন দুপুরের আহার শেষ করে কুতুব হুজুর দাওয়ায় বসে কুলকুচি করছিলেন । ছমিরালীকে দেখেই কুতুব হুজুরের চোখ চকচক করে ওঠল ।
আরে ছমির যে, আস আস মিয়া ! আমি তোমার কথাই ভাবতাছিলাম । তাইলে খবর পাইছ তুমি ?
মেহেদি করা দাড়িতে খিলাল করে গামছায় মুখ মুছলেন কুতুব । তারপর ঘরের ভিতরের দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁক দিলেন-সরবতির মা পান পাঠাও ।
হাতল ভাঙ্গা চেয়ারে বসতে বসতে কুতুব হুজুর বললেন, তোমার কথাই ভাবতাছিলাম । আইছ ভালা করচ । কথাবার্তা যা হওনের আছে মুখামুখি হওন ভালা ।
আমি কিছু বুঝতাছিনা । বিষয় কী হুজুর ? ছমির টুলের উপর বসে দুহাতের মুঠোয় ছাতাখানি ধরে ডানে-বামে দোলাতে থাকে ।
ফজল তোমারে কিছু কয় নাই ! বিস্ময় নিয়ে দাড়ি চুলকায় কুতুব ।
হের লগে আমার মাথবুল নাই । হে আমারে কী কইব ?
ফজল আইছিল আমার কাছে । বেচারা ঠেকছে নাকি । সুপারি বাগানের লাগোয়া জমিটা বেচতে চায় । আমি আবার হক-হালাল চিনি, আল্লাহ্-রসুল মানি । তোমার মত কী? কুতুব টুপির উপর দিয়ে মাথা চুলকায় ।
বাপজান মরণেরকালে কইছিল সুপারি বাগানের লাগোয়া আধবিঘা জমি আমার ভাগে পরচে । মেলাদিন বাদে ফজল জোর খাটাইতেছে । আমি দাবী ছাড়ি নাই । হাতে কিছু টাকা আসলে মকদ্দমা করব ।নূরু মুন্সির লগে কথা কইয়া রাখছি । ছমিরালীর মুখে দুঃশ্চিন্তার ছায়া নেমে আসে ।
দেখ, ছমির তোমারে একটা ভালা বুদ্ধি দিই । ভাইয়ে ভাইয়ে ফ্যাসাদ না করি মিটমাট করি ফেল । জমিটা আমারে দিয়া দাও । নায্য দাম পাইবা । আমি নিয়ত করছি আল্লাহ্র রাস্তায় দিব । একটা মসজিদ বানাব । আমাদের পাড়ায় তো মসজিদ নাই ।
এতো ভালা কথা হুজুর । ভাইবা দেখি । ছমিরালী মাথা চুলকায়
কুতুব মুখে পানের খিলি গুঁজে দিয়ে পিরিচখানা ছমিরের দিকে টেলে দিল । লও মিয়া, পান লও । তারপর তর্জনীর ডগা থেকে দাঁত দিয়ে চুন টেনে নিল । তয় তোমার পোলাডা কেমুন আছে । হুনছিলাম হে নাকি আজগুবি কিসিমের কথাবার্তা কয় ।
ঠিকই হুনছেন । হে কয়, হে নাকি একদিন পাখির লাহান ওইড়া যাইব । খানাপিনা নাই । মর্জি হইলে খায়, নাইলে খায় না । একলা জঙ্গলে গিয়া বইয়া থাকে । ঘরে থাকলে খিড়কি দিয়া আসমান দেখে । আচানক পোলাডার হইল কি বুঝবার পারতাছিনা । আমি আইছি আপনের কাছে পোলাডার এলাজের লাইগ্যা ।
ছমিরালী আশাভরা দৃষ্টি নিয়ে কুতুব হুজুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ।কুতুব পানের পিক ফেলে পিকদানীতে । তারপর দাড়িতে লেগে থাকা পানের রস মুছে নিল গামছা দিয়ে । বুঝলা মিয়া জ্বিন । তোমার পোলারে জ্বিনে পাইছে ।
কী কন হুজুর ! ছমিরালী উৎকন্ঠা চেপে রাখতে পারে না । তার চোখ দুটো বড় হয়।
হঅ, জ্বিন দুই কিসিমের। এক কিসিমের জ্বিন ভালা, আরেক কিসিমের জ্বিন আছে খারাব । ভালা জ্বিনে পাইলে ভালা । খারাব জ্বিনে পাইলেও অসুবিধা নাই । জ্বিন খেদানোর তরিকা আমার জানা আছে । তোমার পোলাডারে নিয়া আস ।দেখলে আমি কইতে পারব এইডা কোন কিসিমের জ্বিন ।
ছমিরালী হায় হায় করে ওঠল । আল্লাহ্ আমার পোলাডারে জ্বিনের হাত থেইক্যা বাঁচাও ।
কুতুব ধমক দিলেন । আরে মিয়া অস্থির হওনের কি আছে । তুমি জান না আগে এই গেরামে কত জ্বিন, পরী, ভূত-পেত্নী আচিল । রাতে একলা ঘর থেইক্যা বাহিরে যাইতে ডরাইত । কেউ কেউ আবার পথের বিঝখানে মূর্ছা গিয়া পইড়া থাকত । এই কুতুব হুজুর সবডারে খেদাইছি । কুতুব হুজুরের নাম হুনলে জ্বিনের বাদশা ও কাঁপে । যাও, হাবিবুলরে লইয়া আস । কুতুব দশ আঙুল দিয়ে হাতির পেটের মত ফুলে ওঠা ভুড়ি চুলকায়।
ছমিরালী পথে নামে । ছিপচিপে শরীর নিয়ে লম্বা পা ফেলে । সূর্য মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে । ছমিরালী একবার আকাশের দিকে তাকায় । বগল থেকে ছাতা নিয়ে সূর্যকে আড়াল দেয় । পথের দুইপাশে ধানক্ষেত । বাতাসে ধানপাতাগুলো কাঁপছে । তার জোত-জমি বেশি নেই । যা আছে তা দিয়ে অভাবে পড়তে হয়না । তার মনের ভেতর দুশ্চিন্তাটা আবার ফিরে আসে । তার ভাগের জমি ফজল বেচে দিতে চায় । ভাই হইয়া ভাইয়ের সর্বনাশ । এর একটা বিহিত করতেই হবে ।
দুপুরে হাবিবুল কিছুতেই ভাত খাবে না । ফজিলার চেষ্টার কমতি নেই । কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ । হাবিবুলের এক কথা বুক নাই মা ।
ফজিলা ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে । তার চোখ অস্থিরভাবে নড়াচড়া করে । সে আবার অনুনয় করল, খা বাজান । চাইরডা মুখে দে ।
কইলাম তো মা বুক নাই । হাবিবুল চোখ উল্টায়, মাথা নাড়ে ।
বাজান তোর কী হইছে ? দিন দিন কেমুন হইয়া যাইতেছস । আমারে কঅ বাজান ! ফজিলার চোখে বাষ্প জমে ওঠে ।
আমার কিছু হয় নাই । তুমি আমারে এক গেলাস পানি দাও মা । পানি খামু ।
ফজিলা মাটির কলসি থেকে পানি ঢালে । কিছু পানি গেলাস উপচে মাটিতে গড়িয়ে যায় । হাবিবুল এক নিঃশ্বাসে গেলাস খালি করে ফেলল । তারপর হাই তুলে বলল, আমার ঘুম পাইতেছ মা । আমি ঘুমাব ।
হাবিবুল ঘুমিয়ে পড়লে ফজিলা ঘরের কাজে মনোযোগ দেয় ।ঘর-গেরস্তালির কাজ সে একাই সামাল দেয় । প্রতিদিন কত গোছগাছ করে, তবুও অনেক কাজ জমা হয়ে থাকে ।সে খাবারের থালাবাটি উঠিয়ে রাখে,জলচৌকি সরিয়ে রাখে, নাটাই-ঘুড়ি তাকের উপর তুলে রাখে । তারপর কোমর বাঁকা করে ঘর ঝাড়ু দিতে থাকে । এমন সময় উঠান থেকে হাঁসেরা ভেক ভেক করে ডেকে উঠে । ফজিলার মনে পড়ে হাঁসদের খাবার দেয়া হয়নি ।ওদেরও ভুক লেগেছে মনে হয় । আইতাছি,আইতাছি বলে সেদিকে ছুটে যায় । হাঁসদের খাবার দিতে দিতে ফজিলা হাবিবুলের অসুখ নিয়ে ভাবে ।
হাবিবুল ঘুমে অবিশ্বাস্য এক স্বপ্ন দেখতে পেল । মেঘের ওপাশ থেকে কে যেন ওড়ে আসছে । চাঁদের মত গোল চেহারা । পিঠে রূপালী জোছনার দুটি পাখা । বাতাসে পাখা দুটি কাঁপছে । পুরো শরীর থেকে চাঁদের মত জোছনা ছড়িয়ে পড়ছে । আকাশে অনেকগুলো ফুলের বাগান । আগন্তুক প্রতিটি বাগান পার হয়ে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসছে। যেন চোখের পলকে আগন্তুক হাবিবুলদের পুকুরপারে তালগাছের উপর এসে দাঁড়াল । তারপর টিনের চালের দিকে তাকিয়ে হেঁসে ডাক দিল তিনবার-হাবিবুল! হাবিবুল! হাবিবুল !
হাবিবুল লক্ষ করল আগন্তুকের হাসি থেকে মুক্তোদানা ছড়িয়ে পড়ছে তাদের পুকুরের জলে । সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এসে দাঁড়াল পুকুরপারে । আগন্তুক বলল, আপনি পাখির মত উড়তে চেয়েছিলেন না । আল্লাহ্ আপনার মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন । আমি আদিষ্ট হয়েছি আপনাকে উড়াল শিখানোর জন্য ।
হাবিবুল মোটেও ভয় পেলনা । জিজ্ঞেস করল, তুমি কেডা ?
আগন্তুক বলল, আল্লাহ্ আমাকে ফেরেস্তা জিব্রিল বলে ডাকেন । হাবিবুলের ওস্তাদজির কথা মনে পড়ল । মক্তবে পড়ার সময় ওস্তাসজি বলতেন, ফেরেস্তারা আল্লাহ্র আদেশে সব কাজ করতে পারেন । আনন্দে তার চোখ চকচক করে উঠল । বলল, আমি তো তালগাছ বাইতে পারিনা । কেমনে তোমার কাছে যামু ?
তার চোখের পলক ও পড়ল না দেখল ফেরেস্তা তার সামনে দাঁড়ানো । বলল, আমার দুই পাখার মাঝখানে উঠে বসেন ।
হাবিবুল ফেরেস্তার নির্দেশ পালন করল । তার মনে হল যেন এক বিরাট সূর্যমুখী ফুলের মাঝখানে বসে আছে । ফেরেস্তা উড়ে চলল আকাশের দিকে । আকাশ যেন অনেক দূর । পথ আর ফুরাতে চায় না । হাবিবুল যখন মেঘের দেশে এসে পৌছাল, ঠান্ডায় তার শরীর কাঁপছিল । মেঘের দেশ পার হলে সে বিরাট বিরাট তারা দেখতে পেল । মনে হল তারাগুলো যেন তার দিকে ছুটে আসছে । সে ভয়ে চোখ বন্ধ করল । কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখেছিল তার মনে নেই । যখন চোখ খুলল, দেখে কোথাও ফেরেস্তা নেই । সে একা একাই আকশে উড়ছে । আকাশে চক্কর দিতে দিতে সে তাদের পুকুরপারে এসে নামল । অম্নি তার ঘুম ভেঙ্গে গেল । দেখে,সে বিছানা থেকে মাটিতে পড়ে গিয়ে মা মা করে ডাকছে।
হাবিবুল খোয়াবের কথা চেপে গেল । মার কাছে একবার শুনেছিল, খোয়াবের কথা কাউকে বললে তা আর সত্য হয়না । ফজিলা বলল, তুই কী খোয়াব দেখিছস বাপ ? হাবিবুল উত্তর দিল না । বাতাসে উড়ন্ত পতাকার মত মাথা দোলাল ।
ছমিরালী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল, কঅ বাজান তুই কী খারাব খোয়াব দেখিচস ? ভূত,পরী এইসব?
হাবিবুল পূর্বের মত মাথা নাড়ে । ফজিলা স্বামীর দিকে তাকায় । তুমি তো হুজুরের কাছে গেছিলা । হুজুর কী কইছে ?
ছমিরালী জোরে দম ছাড়ে । জ্বিনের আছর । ওরে নিবার লাইগ্যা কইছে । না দেইখ্যা এলাজ নাই ।
ফজিলার মনে হল স্বামীর নিঃশ্বাসে যেন ঘর ভর্তি হয়ে গেল । তার মনটা ভারী হয়ে এল । আমারও তাই মুনে অয় । জ্বিনের আলামত । কবে নিবা ?
ছমিরালী ফজিলার দিকে তাকাল । কাইল বিয়ান বেলা ।
কুতুব হুজুরের দিকে হাবিবুল ড্যাব ড্যাব করে থাকিয়ে রইল । তার চোখ ছিল গোল গোল পাখির ডিমের মত । কুতুব তাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে করতে দাড়িতে হাত বুলাচ্ছিলেন । তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, হাবিবুল তুমি যে একলা জঙ্গলে বইয়া থাক তোমার ডর করে না ?
হাবিবুল মাথা নাড়ল ।
আইচ্ছা, তুমি কুনো সময় জঙ্গলে বকরী-টকরী দেখছনি ?
হাবিবুল উচ্ছ্বাস নিয়ে কথা বলে উঠল । হঅ দেখছি, গাছের পাতা খাইতাছে । কুতুব আড়চোখে তাকাল ছমিরালীর দিকে । আর কিছু দেখচনি ?
পাখি দেখছি, সাপ দেখছি ব্যাঙ গিলতাছে ।
কুতুব চোখ বন্ধ করে রইল। তার ঠোঁট বিড়বিড় করে কাঁপছে । মনে হচ্ছে কোরআন শরীফের আয়াত পাঠ করছেন । কিছুক্ষণ পর তার ঠোঁটের কম্পন থেমে গেলে তিনি গম্ভীর হয়ে তাকালেন ছমিরালির দিকে । ছমির কিছু বুঝে উঠতে পারল না । বিহবল হয়ে তাকিয়ে রইল ।
জ্বিন ছুরত বদল করতে পারে, ইনসান পারেনা । হাবিবুলের চোখে জ্বিনের মাইয়ারা নৃত্য করে । একটা দুইটা না অনেকগুলা । তার চোখ কেমুন ডাগর ডাগর দেখচনি। জ্বিন বকরীর ছুরত নিয়া আসে, কখনও পাখি আবার কখনও সাপ ।
কুতুব হুজুর থামে । একবার হাবিবুলের দিকে তাকায় । আবার বলতে শুরু করে। এরা খোয়াবের মধ্যেও দেখা দেয় । নানান কিসিমের কেরামতি দেখায় ।
হঠাৎ হাবিবুল বলে উঠল, বাবা খোয়াবে যেটা দেখছি ওটা জ্বিন না । আমারে কইলো....। হাবিবুল থেমে যায় । কথা শেষ করে না । তার মনে পড়ল খোয়াবের কথা বলতে নেই ।
ছমির কৌতুহলী হয়ে তাগাদা দিল, কঅ বাজান, কঅ খোয়াবে কী দেখছস ? হাবিবুল চুপ করে থকল । ঠোঁটে ঠোঁট পিষে রাখল ।
কুতুব হুজুর ঊরুসন্ধি চুকাতে চুলকাতে বললেন, হঅ বুঝতে পারছি অ আর একটি কথাও কইব না । জ্বিন বাঁধা দিতাছে । বড় খতরনাক জ্বিন ।
কুতুব উঠানের কোণের ভেরেন্ডা গাছ থেকে পাতা ছিড়ে নিলেন কয়েকটা । হাবিবুলের শরীরে ভেরান্ডা পাতা দিয়ে ঝাড়ফুক দিলেন । গলায়, কোমরে , বাহুতে তাবিজ বেঁধে দিলেন । খাবার জন্য দিলেন দুই লিটার বোতলে পানিপরা । কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে জোরে জোরে ফু দিলেন । এমন জোরে ফু দিলেন তার মুখের থুথু হাবিবুলের গায়ে ছিটিয়ে পড়ল । তারপর ঘুরে ছমিরের দিকে ফিরলেন । পোলারে লইয়া এবার বাড়িত যাও । কাম অহনো খতম হয় নাই । তোমারে আরও একখান কাম করতে হইব ।
ছমির হুজুরের ঘোলা ঘোলা চোখের দিকে তাকায় । কী কাম হুজুর ?
কাইল মুয়াজ্জিন যখন ফজরের আজান দিব, তুমি লগে লগে একটা কলাগাছ কাটবা । দায়ের এক কোপে কাটবা । যদি এক কোপে কাটতে না পার তাইলে তিন কোপে কাটবা । খবরদার, দুই অথবা তিনের বেশি কোপে কাটবা না । সামনের শুত্রুবার জুমার আগে একটা বকরী ছদগা দিবা । মনে রখবা বকরী যাতে কালা রঙের হয় ।
ছমির মাথা নেড়ে বলল, আইচ্ছা হুজুর ।
কুতুব নিতম্ব চুলকালেন দুইবার । আর শুন, কুনো অসুবিধা হইলে আমারে খবর দিবা ।
হাবিবুল গলার তাবিজ আঙুল দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে আর বাপের পিছে পিছে হাঁটে । কিছুদূর যেতেই তার দৃষ্টি আকাশের দিকে চলে যায় । আকশের নির্জনে একটি চিল উড়ছে । চিলের ওড়া দেখতে দেখতে হাবিবুলের গতি শ্লথ হয় । ছমির শিরীষ গাছটির নিচে এসে বুঝতে পারে হাবিবুল তার সাথে নেই । পেছনে ফিরে দেখে অনেক দূরে । তার বুক কেঁপে উঠল । নিশ্চয় জ্বিন হাবিবুলরে পথ ভোলাতে চায় । দৌড়ে গেল ছেলের কাছে। ছমির লক্ষ করল, হাবিবুল আকাশে একটা চিলের দিকে তাকিয়ে আছে । ছমির বলল, বাজান ওদিকে তাকাইস না । ওটা চিল না চিলের ছুরতে জ্বিন উড়তাছে ।
হাবিবুল বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, জ্বিন কী বাবা ?
জ্বিন, জ্বিন হইল গিয়া ..। ছমির থেমে যায় । বুঝতে পারল জ্বিন সম্পর্কে তার তেমন ধারণা নেই । সে তো কখন ও জ্বিন দেখে নাই । হুজুরের কাছে শুনেছে জ্বিন ছুরত বদল করতে পারে । এতটুকুই তার জ্ঞান । জ্বিন হইল গিয়া অদের নিজের ছুরত নাই । নিজের ছুরতে অদের দেখা যায় না । বুঝছস ।
হাবিবুল মাথা নাড়ে আর ভাবে জ্বিন হইতে পারলে খুব মজা হত । তাকে কেউ দেখতে পেত না । সে বন্ধুদের ভয় দেখাতে পারত । বাবা মানুষ কী জ্বিন হইতে পারে ?
ছমির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ছেলের দিকে । জ্বিনের নাম মুখে আনিস না । জলদী চল ।
ফজিলা রান্নাবান্না শেষ করে অপেক্ষা করছিল স্বামী ও ছেলের জন্য । সে আজ আলু দিয়ে মুরগির মাংশ রান্না করেছে । হাঁসের ডিম সিদ্ধ করে তেলে কড়া করে ভেজেছে । ছমির ও হাবিবুল এসেই খাবার খেতে বসে গেল । ফজিলা ছেলের পাতে মুরগির বড় টুকরা তুলে দিল, সবচে বড় ডিমটিও তার পাতে দিল । হাবিবুল কোন বাহানা করল না । চুপচাপ গোগ্রাসে খেতে লাগল । ফজিলা আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকায় ।ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসি । তার বুকের গভীর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছমিরের গায়ে গিয়ে লাগে ।
হাবিবুল প্রতিরাতে খোয়াবটা খেতে লাগল এবং এতেই সে খুশি ।সে শালগাছের গুড়ির উপর বসে খোয়াবের কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গেল । কিছুক্ষণ পর তার মনে হল সে আকাশে ওড়ছে । মেঘ পেরিয়ে যাচ্ছে,তারাগুলো হাত দিয়ে ছুঁতে পারতেছে । যখন তার তন্ময়তা কেটে গেল তার ভেতর একটা উত্তেজনা এসে জমা হল । কারণ তার ধারণা শুধু খোয়াবে নয়, সে এখন ইচ্ছে করলেই আকাশে উড়তে পারে । কথাটা এবার বন্ধুদের জানাতে হয় । হাবিবুল মাঠে এসে মতিকে পেয়ে গেল । এই মতি শুন, তরে একটা কথা কই । কারো কবিনা কিন্তু ।
মতি নাটাই হাতে হাবিবুলের দিকে ফিরে তাকায় । আইচ্ছা কমু না । কী কথা ? হাবিবুল উড়ন্ত ঘুড়ির দিকে তাকাল । আমি একটু আগে আকাশে চক্কর দিয়া আইলাম । হাত দিয়া একটা তারাও ছুঁইয়া দেখছি ।
মতির হাতে নাটাই থেমে গেল । মতি এমন অবাক হল যেন তার চোখ দুটো জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে আসবে । হাঁচা কইতাচস !
তিল থেকে তাল হয় না, কিন্তু তিল থেকে সম্ভবত বড় বড় কথার জন্ম হয় । পরদিন সারা দোলনা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল হাবিবুলের উড়ার কাহিনী । এ নিয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল ।তারা দুই দলে ভাগ হয়ে গেল । এক দল বিশ্বাসী অপর দল অবিশ্বাসী । বিশ্বাসী দলের দাবী মতি নিজ চোখে দেখেছে হাবিবুলকে উড়তে । বিশ্বাসী দলের আরও একজন দাবী করল, সেও দেখেছে হাবিবুল তিন মাইল দূরে উড়ে গিয়ে চৌধূরীদের আমবাগান থেকে আম পেড়ে এনেছে । হাবিবুলের উড়ার কাহিনী দ্রুত আশপাশের দশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে লোকজন আসতে লাগল দোলনা গ্রামে হাবিবুলকে এক নজর দেখের জন্য ।
অবিশ্বাসীরা চ্যালেঞ্জ করল, মানুষ কিছুতেই উড়তে পারে না । সব বাখোয়াজ । শুরু হল তর্ক-বিতর্ক, হাতাহাতি,মারামারি । অবশেষে সাব্যস্ত হল ফয়সালার জন্য উভয় দল কুতুব হুজুরের কাছে যাবে ।
কুতুব হুজুর উভয় দলের বক্তব্য শুনে চোখ বন্ধ করে সুরা নাস তেলাওয়াত করলেন তিনবার । তিনি ধীরে ধীরে চোখ খুলে বললেন, কী মিয়ারা কিছু বুঝলা ? উপস্থিত জনতা চুপ করে রইল । তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া অন্যকোন শব্দ শুনা গেল না ।
অবিশ্বাসীদের একজন দাঁড়িয়ে বলল, আমরা তো আরবির মানে বুঝি না ।
কুতুব হুজুর গর্জে উঠলেন, বুঝবা কেমনে নিজের মধ্যে তো এলেম নাই । তোমরা জান না বাদশা সোলাইমান আকাশে ওড়তে পারত ? রানী বিলকিস যে জ্বিনের মাইয়া আচিল হেই কথাও কী তোমারা ভুইলা গেছ ? আমাদের গেরামের পোলা আকাশে ওড়ছে, এতে অসুবিধা কোথায় ? সবিই আল্লাহ্র ইচ্ছা । এখন যাও । হাবিবুলের জন্য দোয়া করিও আল্লাহ্ যাতে তারে সহিসালামতে রাখে ।
মাগরিবের নামাজের পর কুতুব হুজুর ডাক দিলেন, ওঅ ছমির বাড়িত আছনি ? ছমির হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসল । আহেন হুজুর আহেন ।
তয় হাবিবুল কেমুন আছে ? কুতুব চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ।
আল্লাহ্র রহমতে ভালা হুজুর । মনে হয় একটু ঘাবড়াইয়া গেছে । প্রতিদিন মেলা লোকজন তারে দেখবার লাইগা আইতাছে । আমি আর একেলা সামাল দিতে পারতাছিনা । আমার অন্য কাজকাম বন হইয়া যাইতাছে ।
কুতুব বললেন, বড় চিন্তার বিষয় । ভাইবো না, সব ঠিক হইয়া যাইব । তোমার লগে একখান কথা আছিল ।
কী কথা কন হুজুর ? আরে মিয়া সবকথা সবখানে বলা যায় না । একটু আড়ালে চল ।
ছমিরদের বাড়ির পিছনে ছোট্ট পুকুর । পুকুরপারে সারি সারি কলা বাগান । জায়গাটা বেশ নির্জন । সন্ধ্যার পর এদিকে কেউ আসে না । ছমির হুজুরকে নিয়ে পুকুরপারে এল । কুতুব লক্ষ করল, একটি কলাগাছ কাঁটা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে । কুতুবের মুখে হাসি ফুটল । অন্ধকারে তা বুঝা গেল না । কিন্তু কুতুব বুঝতে পারল তার সামনে উজ্জ্বল সম্ভাবনা ।
আধবিঘা জমির দাবী ফজল ছেড়ে দিল । দিনে দিনে সেখানে ঘর তোলা হল । পুকুর কাঁটা হল । কুতুব হুজুর ঘরের নাম রাখলেন জ্বিনের বাড়ি ।
হাবিবুলকে এনে রাখা হল জ্বিনের বড়িতে । দরজায় লাগানো হল তালা। তালাকে আড়াল করার জন্য ঝোলানো হল লাল পর্দা । দর্শনার্থীরা বিশেষ ব্যবস্থায় জানালা দিয়ে হাবিবুলকে দেখতে পারে । ছালবাকল, লতাপাতা, শিকড় , পানিপরার জন্য দিন দিন মানুষের লাইন দীর্ঘ হতে লাগল জ্বিনের বাড়তে । চারদিকে রটে গেল হাবিবুলের নির্দেশে জ্বিন এসব অসুধের যোগান দেয় ।
কিছুদিনের মধ্যে হাবিবুল হাঁপিয়ে উঠে । বদ্ধ জীবন তার ভাল লাগে না ।এ জীবন বড় কষ্টের । এ রকম বিপদ হবে জানলে সে আকাশে ওড়ার কথা কাউকে বলত না। সে মনে মনে বাইরে যাওয়ার ফন্দি আঁটে ।
আজ জুমাবার । গ্রামের লোকজন সবাই মসজিদ মুখী । দরজার বাইরে রবিউল একা । দরজার চাবি তার কাছেই থাকে । হাবিবুলের কোন কিছু দরকার পড়লে সে এনে দেয় । হাবিবুল জানালা দিয়ে রবিউলকে ডাকল । রবিউল !
কী ? কিছু লাগব ? রবিউল সাড়া দিল ।
মাথা নাড়ল হাবিবুল ।
তয় কী চাও ? রবিউল ঘাড় বাঁকা করে জিজ্ঞেস করল ।
ডিম !
হাবিবুল চোখ গোল করল । ওঅ ডিম খাইবার চাও ?
হাবিবুল আবার মাথা নাড়ে ।
তয় ডিম কইলা যে ?
সোনার ডিম !
কুনাই ? রবিউলের চোখ গোল হল ।
হাবিবুল ফিসফিস করল । জঙ্গলে । জ্বিন কইলো অহন না নিলে আর মিলবো না। তালাটা খুইলা দাও । ডিম আনলে তোমারে একটা দিমু । কারো কইবা না কিন্তু ।
সোনার ডিমের লোভে রবিউলের চোখ চকচক করে উঠল । সে তাড়াতাড়ি তালা খুলে দিয়ে বলল, যাও, জলদী যাও । আবার জলদী ফিইরা আইস ।
জ্বিনের বাড়ি থেকে মুক্ত হয়ে হাবিবুল দৌড় দিল জঙ্গলের দিকে । রবিউল দরজায় তালা দিয়ে টুলের উপর বসে ঝিমোতে লাগল । অনেকদিন পর মুক্ত হয়ে হাবিবুলের আনন্দের সীমা রইল না । সে শালগাছের নিচে বসে আবার পাখির মত উড়ার কথা ভাবতে লাগল । ভাবতে ভাবতে কখন যে সে শালগাছে চড়ে বসেছে বুঝতেই পারল না । সে যখন গাছের ডাল থেকে পাখির মত উড়াল দিতে চাইল অমনি মাটিতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারাল ।
জুমা শেষ হলে মুসল্লিরা দলে দলে আসতে লাগল জ্বিনের বাড়িতে হাবিবুলকে এক নজর দেখার জন্য । দর্শনার্থীরা ঘরে কাউকে দেখতে না পেলে হৈ চৈ পড়ে গেল । কোথায় হাবিবুল ? উম্মাদের মত ছুটে এলেন কুতুব হুজুর । ধমকালেন রবিউলকে । ভয়ে রবিউল আসল কথা চেপে গেল । বলল, আমি কিছু জানিনা । ঘরে তালা দেয়া আচিল । কুতুব তালা খুলে দেখেন, ঘর শূণ্য । চারদিকে রটে গেল জ্বিন হাবিবুল কে বদ্ধ ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে ।
কুতুব হাবিবুলকে খুঁজতে লোকজন নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলেন । দেখতে পেলেন শালগাছের নিচে হাবিবুল উপুড় হয়ে পড়ে আছে ।কুতুব হাবিবুলকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন । বুঝতে পারলেন হাবিবুল মরে নাই । তার মুখে আবার সম্ভাবনার হাসি । বললেন, বড় খতরনাক জ্বিন ।

হাবিবুল গ্রামের অন্য আট দশটা ছেলের মত নয় । হৈহুল্লড় এড়িয়ে চলে । একা থাকতে পছন্দ করে আর কোন না কোন বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকে । ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে সে ভাবে, নীল আকাশে ঘুড়িকে ছোট দেখায় কেন ? কিন্তু এর কোন উত্তর সে খুঁজে পায়না । আবার কখনো ভাবে মেঘ কোথা থেকে আসে, আবার ওড়ে ওড়ে কোথা চলে যায় । পাখির ওড়ে যাওয়া দেখে ভাবে, পাখিরা কেন ওড়তে পারে সে কেন পারেনা ? যদি সে পাখির মত ওড়তে পারত তবে কত মজাই না হত । পাখির মত ওড়বার স্বপ্ন ধীরে ধীরে তার মনে বড় হতে থাকে ।
হাবিবুলের বয়স দশ । দোলনা গ্রামে তার বয়সী অনেক ছেলেমেয়ে ইস্কুলে যায় না, কিন্তু হাবিবুল ইস্কুলে যায় । স্বভাবে শান্ত হলেও ইস্কুল কামাই ও লেখাপড়ায় অমনোযোগিতার লক্ষণ তার মধ্যে দেখা যায় । প্রতিদিন সে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় আর গাছের গুড়ির উপর বসে আকাশ দেখে, মেঘ দেখে,পাখি দেখে । মাঝে মাঝে তার মন পাখি হয়ে ওড়ে যায় দূরে, বহুদূরে । তখন সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এলেও হাবিবুল ঘরে ফেরার কথা ভুলে যায় ।
ছমিরালী প্রায় জঙ্গলে খুঁজে খুঁজে ছেলেকে ঘরে ফিরিয়ে আনে । হাবিবুল ঘরে থাকলেও আনমনা হয়ে বসে থাকে । না হয় জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে । কারো সঙ্গে তেমন কথাও বলে না ।ছমিরালী ছেলের দিকে তাকিয়ে বিমর্ষ হয়ে পড়ে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।
ফজিলা ছেলের দিকে তাকাতে পারেনা । কেন জানি তার বুক ভেঙ্গে খান খান হয়ে যায় । সে ছেলের দিকে তাকিয়ে আঁচলে চোখের কোণ মুছে আর স্বামীর উপর চড়াও হয় ।
আপনেরে তো মেলাদিন কইলাম, পোলাডারে একবার বাদশা কবিরাজের কাছে লইয়া যান । আমার কথাডা হুনলান না । খালি টাইম খাওনের তালে থাহেন । পোলাডার দিকে তাহানো যায় না । আমার কলিজা মোচড় দিয়া আহে ।
ফজিলা হাবিবুলের চুলে আঙুল চালায় । হাবিবুলের চুল বেশ লম্বা এবং ঘন । তার আঙুল চুলের নিচে ডুবে গেলে সে ভাবে নাপিতের কাছে যাওয়ার টাইম আসছে ।
ছমিরালী ফজিলার দিকে তাকায় না । সে একটা জলচৌকির আলগা হয়ে যাওয়া অংশে পেরেক গাঁথে । হাতুড়ি টকটক শব্দ করে ।
বাদশা কবিরাজ ঠকবাজ । হে কবিরাজির কী জানে ? ছমিরালী ফজিলার দিকে না তাকিয়ে জবাব দেয় ।
শহরে যাইবার কথা ভাবতাছেন, সরকারি ডাক্তারের কাছে ?
ফজিলা হাবিবুল কে বুকে জড়িয়ে রাখে । হাবিবুল মায়ের বুকে মাথা রেখে পাখির মত উড়ার কথা ভাবতে থাকে । ছমিরালী জলচৌকিতে দ্বিতীয় পেরেকটি গাঁথে । ভাবতাছি কুতুব হুজুরের লগে একবার বুইঝা লই । হের পানিপরা, তাবিজ-কবজের মারফতি গুণ আছে ।
কবে যাইবেন ? ফজিলা গ্রীবা ঘুরিয়ে তাকাল স্বামীর দিকে ।
কাইল দুপুরবেলা । অহন হাবিবুল আর আমারে ভাত দাও । বাপ-পুতে খাইয়া ঘুমাইয়া পড়ি ।
পরদিন দুপুরের আহার শেষ করে কুতুব হুজুর দাওয়ায় বসে কুলকুচি করছিলেন । ছমিরালীকে দেখেই কুতুব হুজুরের চোখ চকচক করে ওঠল ।
আরে ছমির যে, আস আস মিয়া ! আমি তোমার কথাই ভাবতাছিলাম । তাইলে খবর পাইছ তুমি ?
মেহেদি করা দাড়িতে খিলাল করে গামছায় মুখ মুছলেন কুতুব । তারপর ঘরের ভিতরের দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে হাঁক দিলেন-সরবতির মা পান পাঠাও ।
হাতল ভাঙ্গা চেয়ারে বসতে বসতে কুতুব হুজুর বললেন, তোমার কথাই ভাবতাছিলাম । আইছ ভালা করচ । কথাবার্তা যা হওনের আছে মুখামুখি হওন ভালা ।
আমি কিছু বুঝতাছিনা । বিষয় কী হুজুর ? ছমির টুলের উপর বসে দুহাতের মুঠোয় ছাতাখানি ধরে ডানে-বামে দোলাতে থাকে ।
ফজল তোমারে কিছু কয় নাই ! বিস্ময় নিয়ে দাড়ি চুলকায় কুতুব ।
হের লগে আমার মাথবুল নাই । হে আমারে কী কইব ?
ফজল আইছিল আমার কাছে । বেচারা ঠেকছে নাকি । সুপারি বাগানের লাগোয়া জমিটা বেচতে চায় । আমি আবার হক-হালাল চিনি, আল্লাহ্-রসুল মানি । তোমার মত কী? কুতুব টুপির উপর দিয়ে মাথা চুলকায় ।
বাপজান মরণেরকালে কইছিল সুপারি বাগানের লাগোয়া আধবিঘা জমি আমার ভাগে পরচে । মেলাদিন বাদে ফজল জোর খাটাইতেছে । আমি দাবী ছাড়ি নাই । হাতে কিছু টাকা আসলে মকদ্দমা করব ।নূরু মুন্সির লগে কথা কইয়া রাখছি । ছমিরালীর মুখে দুঃশ্চিন্তার ছায়া নেমে আসে ।
দেখ, ছমির তোমারে একটা ভালা বুদ্ধি দিই । ভাইয়ে ভাইয়ে ফ্যাসাদ না করি মিটমাট করি ফেল । জমিটা আমারে দিয়া দাও । নায্য দাম পাইবা । আমি নিয়ত করছি আল্লাহ্র রাস্তায় দিব । একটা মসজিদ বানাব । আমাদের পাড়ায় তো মসজিদ নাই ।
এতো ভালা কথা হুজুর । ভাইবা দেখি । ছমিরালী মাথা চুলকায়
কুতুব মুখে পানের খিলি গুঁজে দিয়ে পিরিচখানা ছমিরের দিকে টেলে দিল । লও মিয়া, পান লও । তারপর তর্জনীর ডগা থেকে দাঁত দিয়ে চুন টেনে নিল । তয় তোমার পোলাডা কেমুন আছে । হুনছিলাম হে নাকি আজগুবি কিসিমের কথাবার্তা কয় ।
ঠিকই হুনছেন । হে কয়, হে নাকি একদিন পাখির লাহান ওইড়া যাইব । খানাপিনা নাই । মর্জি হইলে খায়, নাইলে খায় না । একলা জঙ্গলে গিয়া বইয়া থাকে । ঘরে থাকলে খিড়কি দিয়া আসমান দেখে । আচানক পোলাডার হইল কি বুঝবার পারতাছিনা । আমি আইছি আপনের কাছে পোলাডার এলাজের লাইগ্যা ।
ছমিরালী আশাভরা দৃষ্টি নিয়ে কুতুব হুজুরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ।কুতুব পানের পিক ফেলে পিকদানীতে । তারপর দাড়িতে লেগে থাকা পানের রস মুছে নিল গামছা দিয়ে । বুঝলা মিয়া জ্বিন । তোমার পোলারে জ্বিনে পাইছে ।
কী কন হুজুর ! ছমিরালী উৎকন্ঠা চেপে রাখতে পারে না । তার চোখ দুটো বড় হয়।
হঅ, জ্বিন দুই কিসিমের। এক কিসিমের জ্বিন ভালা, আরেক কিসিমের জ্বিন আছে খারাব । ভালা জ্বিনে পাইলে ভালা । খারাব জ্বিনে পাইলেও অসুবিধা নাই । জ্বিন খেদানোর তরিকা আমার জানা আছে । তোমার পোলাডারে নিয়া আস ।দেখলে আমি কইতে পারব এইডা কোন কিসিমের জ্বিন ।
ছমিরালী হায় হায় করে ওঠল । আল্লাহ্ আমার পোলাডারে জ্বিনের হাত থেইক্যা বাঁচাও ।
কুতুব ধমক দিলেন । আরে মিয়া অস্থির হওনের কি আছে । তুমি জান না আগে এই গেরামে কত জ্বিন, পরী, ভূত-পেত্নী আচিল । রাতে একলা ঘর থেইক্যা বাহিরে যাইতে ডরাইত । কেউ কেউ আবার পথের বিঝখানে মূর্ছা গিয়া পইড়া থাকত । এই কুতুব হুজুর সবডারে খেদাইছি । কুতুব হুজুরের নাম হুনলে জ্বিনের বাদশা ও কাঁপে । যাও, হাবিবুলরে লইয়া আস । কুতুব দশ আঙুল দিয়ে হাতির পেটের মত ফুলে ওঠা ভুড়ি চুলকায়।
ছমিরালী পথে নামে । ছিপচিপে শরীর নিয়ে লম্বা পা ফেলে । সূর্য মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছে । ছমিরালী একবার আকাশের দিকে তাকায় । বগল থেকে ছাতা নিয়ে সূর্যকে আড়াল দেয় । পথের দুইপাশে ধানক্ষেত । বাতাসে ধানপাতাগুলো কাঁপছে । তার জোত-জমি বেশি নেই । যা আছে তা দিয়ে অভাবে পড়তে হয়না । তার মনের ভেতর দুশ্চিন্তাটা আবার ফিরে আসে । তার ভাগের জমি ফজল বেচে দিতে চায় । ভাই হইয়া ভাইয়ের সর্বনাশ । এর একটা বিহিত করতেই হবে ।
দুপুরে হাবিবুল কিছুতেই ভাত খাবে না । ফজিলার চেষ্টার কমতি নেই । কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ । হাবিবুলের এক কথা বুক নাই মা ।
ফজিলা ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকে । তার চোখ অস্থিরভাবে নড়াচড়া করে । সে আবার অনুনয় করল, খা বাজান । চাইরডা মুখে দে ।
কইলাম তো মা বুক নাই । হাবিবুল চোখ উল্টায়, মাথা নাড়ে ।
বাজান তোর কী হইছে ? দিন দিন কেমুন হইয়া যাইতেছস । আমারে কঅ বাজান ! ফজিলার চোখে বাষ্প জমে ওঠে ।
আমার কিছু হয় নাই । তুমি আমারে এক গেলাস পানি দাও মা । পানি খামু ।
ফজিলা মাটির কলসি থেকে পানি ঢালে । কিছু পানি গেলাস উপচে মাটিতে গড়িয়ে যায় । হাবিবুল এক নিঃশ্বাসে গেলাস খালি করে ফেলল । তারপর হাই তুলে বলল, আমার ঘুম পাইতেছ মা । আমি ঘুমাব ।
হাবিবুল ঘুমিয়ে পড়লে ফজিলা ঘরের কাজে মনোযোগ দেয় ।ঘর-গেরস্তালির কাজ সে একাই সামাল দেয় । প্রতিদিন কত গোছগাছ করে, তবুও অনেক কাজ জমা হয়ে থাকে ।সে খাবারের থালাবাটি উঠিয়ে রাখে,জলচৌকি সরিয়ে রাখে, নাটাই-ঘুড়ি তাকের উপর তুলে রাখে । তারপর কোমর বাঁকা করে ঘর ঝাড়ু দিতে থাকে । এমন সময় উঠান থেকে হাঁসেরা ভেক ভেক করে ডেকে উঠে । ফজিলার মনে পড়ে হাঁসদের খাবার দেয়া হয়নি ।ওদেরও ভুক লেগেছে মনে হয় । আইতাছি,আইতাছি বলে সেদিকে ছুটে যায় । হাঁসদের খাবার দিতে দিতে ফজিলা হাবিবুলের অসুখ নিয়ে ভাবে ।
হাবিবুল ঘুমে অবিশ্বাস্য এক স্বপ্ন দেখতে পেল । মেঘের ওপাশ থেকে কে যেন ওড়ে আসছে । চাঁদের মত গোল চেহারা । পিঠে রূপালী জোছনার দুটি পাখা । বাতাসে পাখা দুটি কাঁপছে । পুরো শরীর থেকে চাঁদের মত জোছনা ছড়িয়ে পড়ছে । আকাশে অনেকগুলো ফুলের বাগান । আগন্তুক প্রতিটি বাগান পার হয়ে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে আসছে। যেন চোখের পলকে আগন্তুক হাবিবুলদের পুকুরপারে তালগাছের উপর এসে দাঁড়াল । তারপর টিনের চালের দিকে তাকিয়ে হেঁসে ডাক দিল তিনবার-হাবিবুল! হাবিবুল! হাবিবুল !
হাবিবুল লক্ষ করল আগন্তুকের হাসি থেকে মুক্তোদানা ছড়িয়ে পড়ছে তাদের পুকুরের জলে । সে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এসে দাঁড়াল পুকুরপারে । আগন্তুক বলল, আপনি পাখির মত উড়তে চেয়েছিলেন না । আল্লাহ্ আপনার মনোবাসনা পূর্ণ করেছেন । আমি আদিষ্ট হয়েছি আপনাকে উড়াল শিখানোর জন্য ।
হাবিবুল মোটেও ভয় পেলনা । জিজ্ঞেস করল, তুমি কেডা ?
আগন্তুক বলল, আল্লাহ্ আমাকে ফেরেস্তা জিব্রিল বলে ডাকেন । হাবিবুলের ওস্তাদজির কথা মনে পড়ল । মক্তবে পড়ার সময় ওস্তাসজি বলতেন, ফেরেস্তারা আল্লাহ্র আদেশে সব কাজ করতে পারেন । আনন্দে তার চোখ চকচক করে উঠল । বলল, আমি তো তালগাছ বাইতে পারিনা । কেমনে তোমার কাছে যামু ?
তার চোখের পলক ও পড়ল না দেখল ফেরেস্তা তার সামনে দাঁড়ানো । বলল, আমার দুই পাখার মাঝখানে উঠে বসেন ।
হাবিবুল ফেরেস্তার নির্দেশ পালন করল । তার মনে হল যেন এক বিরাট সূর্যমুখী ফুলের মাঝখানে বসে আছে । ফেরেস্তা উড়ে চলল আকাশের দিকে । আকাশ যেন অনেক দূর । পথ আর ফুরাতে চায় না । হাবিবুল যখন মেঘের দেশে এসে পৌছাল, ঠান্ডায় তার শরীর কাঁপছিল । মেঘের দেশ পার হলে সে বিরাট বিরাট তারা দেখতে পেল । মনে হল তারাগুলো যেন তার দিকে ছুটে আসছে । সে ভয়ে চোখ বন্ধ করল । কতক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখেছিল তার মনে নেই । যখন চোখ খুলল, দেখে কোথাও ফেরেস্তা নেই । সে একা একাই আকশে উড়ছে । আকাশে চক্কর দিতে দিতে সে তাদের পুকুরপারে এসে নামল । অম্নি তার ঘুম ভেঙ্গে গেল । দেখে,সে বিছানা থেকে মাটিতে পড়ে গিয়ে মা মা করে ডাকছে।
হাবিবুল খোয়াবের কথা চেপে গেল । মার কাছে একবার শুনেছিল, খোয়াবের কথা কাউকে বললে তা আর সত্য হয়না । ফজিলা বলল, তুই কী খোয়াব দেখিছস বাপ ? হাবিবুল উত্তর দিল না । বাতাসে উড়ন্ত পতাকার মত মাথা দোলাল ।
ছমিরালী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল, কঅ বাজান তুই কী খারাব খোয়াব দেখিচস ? ভূত,পরী এইসব?
হাবিবুল পূর্বের মত মাথা নাড়ে । ফজিলা স্বামীর দিকে তাকায় । তুমি তো হুজুরের কাছে গেছিলা । হুজুর কী কইছে ?
ছমিরালী জোরে দম ছাড়ে । জ্বিনের আছর । ওরে নিবার লাইগ্যা কইছে । না দেইখ্যা এলাজ নাই ।
ফজিলার মনে হল স্বামীর নিঃশ্বাসে যেন ঘর ভর্তি হয়ে গেল । তার মনটা ভারী হয়ে এল । আমারও তাই মুনে অয় । জ্বিনের আলামত । কবে নিবা ?
ছমিরালী ফজিলার দিকে তাকাল । কাইল বিয়ান বেলা ।
কুতুব হুজুরের দিকে হাবিবুল ড্যাব ড্যাব করে থাকিয়ে রইল । তার চোখ ছিল গোল গোল পাখির ডিমের মত । কুতুব তাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে করতে দাড়িতে হাত বুলাচ্ছিলেন । তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, হাবিবুল তুমি যে একলা জঙ্গলে বইয়া থাক তোমার ডর করে না ?
হাবিবুল মাথা নাড়ল ।
আইচ্ছা, তুমি কুনো সময় জঙ্গলে বকরী-টকরী দেখছনি ?
হাবিবুল উচ্ছ্বাস নিয়ে কথা বলে উঠল । হঅ দেখছি, গাছের পাতা খাইতাছে । কুতুব আড়চোখে তাকাল ছমিরালীর দিকে । আর কিছু দেখচনি ?
পাখি দেখছি, সাপ দেখছি ব্যাঙ গিলতাছে ।
কুতুব চোখ বন্ধ করে রইল। তার ঠোঁট বিড়বিড় করে কাঁপছে । মনে হচ্ছে কোরআন শরীফের আয়াত পাঠ করছেন । কিছুক্ষণ পর তার ঠোঁটের কম্পন থেমে গেলে তিনি গম্ভীর হয়ে তাকালেন ছমিরালির দিকে । ছমির কিছু বুঝে উঠতে পারল না । বিহবল হয়ে তাকিয়ে রইল ।
জ্বিন ছুরত বদল করতে পারে, ইনসান পারেনা । হাবিবুলের চোখে জ্বিনের মাইয়ারা নৃত্য করে । একটা দুইটা না অনেকগুলা । তার চোখ কেমুন ডাগর ডাগর দেখচনি। জ্বিন বকরীর ছুরত নিয়া আসে, কখনও পাখি আবার কখনও সাপ ।
কুতুব হুজুর থামে । একবার হাবিবুলের দিকে তাকায় । আবার বলতে শুরু করে। এরা খোয়াবের মধ্যেও দেখা দেয় । নানান কিসিমের কেরামতি দেখায় ।
হঠাৎ হাবিবুল বলে উঠল, বাবা খোয়াবে যেটা দেখছি ওটা জ্বিন না । আমারে কইলো....। হাবিবুল থেমে যায় । কথা শেষ করে না । তার মনে পড়ল খোয়াবের কথা বলতে নেই ।
ছমির কৌতুহলী হয়ে তাগাদা দিল, কঅ বাজান, কঅ খোয়াবে কী দেখছস ? হাবিবুল চুপ করে থকল । ঠোঁটে ঠোঁট পিষে রাখল ।
কুতুব হুজুর ঊরুসন্ধি চুকাতে চুলকাতে বললেন, হঅ বুঝতে পারছি অ আর একটি কথাও কইব না । জ্বিন বাঁধা দিতাছে । বড় খতরনাক জ্বিন ।
কুতুব উঠানের কোণের ভেরেন্ডা গাছ থেকে পাতা ছিড়ে নিলেন কয়েকটা । হাবিবুলের শরীরে ভেরান্ডা পাতা দিয়ে ঝাড়ফুক দিলেন । গলায়, কোমরে , বাহুতে তাবিজ বেঁধে দিলেন । খাবার জন্য দিলেন দুই লিটার বোতলে পানিপরা । কোরআনের আয়াত তেলাওয়াত করে জোরে জোরে ফু দিলেন । এমন জোরে ফু দিলেন তার মুখের থুথু হাবিবুলের গায়ে ছিটিয়ে পড়ল । তারপর ঘুরে ছমিরের দিকে ফিরলেন । পোলারে লইয়া এবার বাড়িত যাও । কাম অহনো খতম হয় নাই । তোমারে আরও একখান কাম করতে হইব ।
ছমির হুজুরের ঘোলা ঘোলা চোখের দিকে তাকায় । কী কাম হুজুর ?
কাইল মুয়াজ্জিন যখন ফজরের আজান দিব, তুমি লগে লগে একটা কলাগাছ কাটবা । দায়ের এক কোপে কাটবা । যদি এক কোপে কাটতে না পার তাইলে তিন কোপে কাটবা । খবরদার, দুই অথবা তিনের বেশি কোপে কাটবা না । সামনের শুত্রুবার জুমার আগে একটা বকরী ছদগা দিবা । মনে রখবা বকরী যাতে কালা রঙের হয় ।
ছমির মাথা নেড়ে বলল, আইচ্ছা হুজুর ।
কুতুব নিতম্ব চুলকালেন দুইবার । আর শুন, কুনো অসুবিধা হইলে আমারে খবর দিবা ।
হাবিবুল গলার তাবিজ আঙুল দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে আর বাপের পিছে পিছে হাঁটে । কিছুদূর যেতেই তার দৃষ্টি আকাশের দিকে চলে যায় । আকশের নির্জনে একটি চিল উড়ছে । চিলের ওড়া দেখতে দেখতে হাবিবুলের গতি শ্লথ হয় । ছমির শিরীষ গাছটির নিচে এসে বুঝতে পারে হাবিবুল তার সাথে নেই । পেছনে ফিরে দেখে অনেক দূরে । তার বুক কেঁপে উঠল । নিশ্চয় জ্বিন হাবিবুলরে পথ ভোলাতে চায় । দৌড়ে গেল ছেলের কাছে। ছমির লক্ষ করল, হাবিবুল আকাশে একটা চিলের দিকে তাকিয়ে আছে । ছমির বলল, বাজান ওদিকে তাকাইস না । ওটা চিল না চিলের ছুরতে জ্বিন উড়তাছে ।
হাবিবুল বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, জ্বিন কী বাবা ?
জ্বিন, জ্বিন হইল গিয়া ..। ছমির থেমে যায় । বুঝতে পারল জ্বিন সম্পর্কে তার তেমন ধারণা নেই । সে তো কখন ও জ্বিন দেখে নাই । হুজুরের কাছে শুনেছে জ্বিন ছুরত বদল করতে পারে । এতটুকুই তার জ্ঞান । জ্বিন হইল গিয়া অদের নিজের ছুরত নাই । নিজের ছুরতে অদের দেখা যায় না । বুঝছস ।
হাবিবুল মাথা নাড়ে আর ভাবে জ্বিন হইতে পারলে খুব মজা হত । তাকে কেউ দেখতে পেত না । সে বন্ধুদের ভয় দেখাতে পারত । বাবা মানুষ কী জ্বিন হইতে পারে ?
ছমির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল ছেলের দিকে । জ্বিনের নাম মুখে আনিস না । জলদী চল ।
ফজিলা রান্নাবান্না শেষ করে অপেক্ষা করছিল স্বামী ও ছেলের জন্য । সে আজ আলু দিয়ে মুরগির মাংশ রান্না করেছে । হাঁসের ডিম সিদ্ধ করে তেলে কড়া করে ভেজেছে । ছমির ও হাবিবুল এসেই খাবার খেতে বসে গেল । ফজিলা ছেলের পাতে মুরগির বড় টুকরা তুলে দিল, সবচে বড় ডিমটিও তার পাতে দিল । হাবিবুল কোন বাহানা করল না । চুপচাপ গোগ্রাসে খেতে লাগল । ফজিলা আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকায় ।ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসি । তার বুকের গভীর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছমিরের গায়ে গিয়ে লাগে ।
হাবিবুল প্রতিরাতে খোয়াবটা খেতে লাগল এবং এতেই সে খুশি ।সে শালগাছের গুড়ির উপর বসে খোয়াবের কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে গেল । কিছুক্ষণ পর তার মনে হল সে আকাশে ওড়ছে । মেঘ পেরিয়ে যাচ্ছে,তারাগুলো হাত দিয়ে ছুঁতে পারতেছে । যখন তার তন্ময়তা কেটে গেল তার ভেতর একটা উত্তেজনা এসে জমা হল । কারণ তার ধারণা শুধু খোয়াবে নয়, সে এখন ইচ্ছে করলেই আকাশে উড়তে পারে । কথাটা এবার বন্ধুদের জানাতে হয় । হাবিবুল মাঠে এসে মতিকে পেয়ে গেল । এই মতি শুন, তরে একটা কথা কই । কারো কবিনা কিন্তু ।
মতি নাটাই হাতে হাবিবুলের দিকে ফিরে তাকায় । আইচ্ছা কমু না । কী কথা ? হাবিবুল উড়ন্ত ঘুড়ির দিকে তাকাল । আমি একটু আগে আকাশে চক্কর দিয়া আইলাম । হাত দিয়া একটা তারাও ছুঁইয়া দেখছি ।
মতির হাতে নাটাই থেমে গেল । মতি এমন অবাক হল যেন তার চোখ দুটো জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে আসবে । হাঁচা কইতাচস !
তিল থেকে তাল হয় না, কিন্তু তিল থেকে সম্ভবত বড় বড় কথার জন্ম হয় । পরদিন সারা দোলনা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল হাবিবুলের উড়ার কাহিনী । এ নিয়ে গ্রামবাসীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল ।তারা দুই দলে ভাগ হয়ে গেল । এক দল বিশ্বাসী অপর দল অবিশ্বাসী । বিশ্বাসী দলের দাবী মতি নিজ চোখে দেখেছে হাবিবুলকে উড়তে । বিশ্বাসী দলের আরও একজন দাবী করল, সেও দেখেছে হাবিবুল তিন মাইল দূরে উড়ে গিয়ে চৌধূরীদের আমবাগান থেকে আম পেড়ে এনেছে । হাবিবুলের উড়ার কাহিনী দ্রুত আশপাশের দশ গ্রামে ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে লোকজন আসতে লাগল দোলনা গ্রামে হাবিবুলকে এক নজর দেখের জন্য ।
অবিশ্বাসীরা চ্যালেঞ্জ করল, মানুষ কিছুতেই উড়তে পারে না । সব বাখোয়াজ । শুরু হল তর্ক-বিতর্ক, হাতাহাতি,মারামারি । অবশেষে সাব্যস্ত হল ফয়সালার জন্য উভয় দল কুতুব হুজুরের কাছে যাবে ।
কুতুব হুজুর উভয় দলের বক্তব্য শুনে চোখ বন্ধ করে সুরা নাস তেলাওয়াত করলেন তিনবার । তিনি ধীরে ধীরে চোখ খুলে বললেন, কী মিয়ারা কিছু বুঝলা ? উপস্থিত জনতা চুপ করে রইল । তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া অন্যকোন শব্দ শুনা গেল না ।
অবিশ্বাসীদের একজন দাঁড়িয়ে বলল, আমরা তো আরবির মানে বুঝি না ।
কুতুব হুজুর গর্জে উঠলেন, বুঝবা কেমনে নিজের মধ্যে তো এলেম নাই । তোমরা জান না বাদশা সোলাইমান আকাশে ওড়তে পারত ? রানী বিলকিস যে জ্বিনের মাইয়া আচিল হেই কথাও কী তোমারা ভুইলা গেছ ? আমাদের গেরামের পোলা আকাশে ওড়ছে, এতে অসুবিধা কোথায় ? সবিই আল্লাহ্র ইচ্ছা । এখন যাও । হাবিবুলের জন্য দোয়া করিও আল্লাহ্ যাতে তারে সহিসালামতে রাখে ।
মাগরিবের নামাজের পর কুতুব হুজুর ডাক দিলেন, ওঅ ছমির বাড়িত আছনি ? ছমির হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসল । আহেন হুজুর আহেন ।
তয় হাবিবুল কেমুন আছে ? কুতুব চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ।
আল্লাহ্র রহমতে ভালা হুজুর । মনে হয় একটু ঘাবড়াইয়া গেছে । প্রতিদিন মেলা লোকজন তারে দেখবার লাইগা আইতাছে । আমি আর একেলা সামাল দিতে পারতাছিনা । আমার অন্য কাজকাম বন হইয়া যাইতাছে ।
কুতুব বললেন, বড় চিন্তার বিষয় । ভাইবো না, সব ঠিক হইয়া যাইব । তোমার লগে একখান কথা আছিল ।
কী কথা কন হুজুর ? আরে মিয়া সবকথা সবখানে বলা যায় না । একটু আড়ালে চল ।
ছমিরদের বাড়ির পিছনে ছোট্ট পুকুর । পুকুরপারে সারি সারি কলা বাগান । জায়গাটা বেশ নির্জন । সন্ধ্যার পর এদিকে কেউ আসে না । ছমির হুজুরকে নিয়ে পুকুরপারে এল । কুতুব লক্ষ করল, একটি কলাগাছ কাঁটা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে । কুতুবের মুখে হাসি ফুটল । অন্ধকারে তা বুঝা গেল না । কিন্তু কুতুব বুঝতে পারল তার সামনে উজ্জ্বল সম্ভাবনা ।
আধবিঘা জমির দাবী ফজল ছেড়ে দিল । দিনে দিনে সেখানে ঘর তোলা হল । পুকুর কাঁটা হল । কুতুব হুজুর ঘরের নাম রাখলেন জ্বিনের বাড়ি ।
হাবিবুলকে এনে রাখা হল জ্বিনের বড়িতে । দরজায় লাগানো হল তালা। তালাকে আড়াল করার জন্য ঝোলানো হল লাল পর্দা । দর্শনার্থীরা বিশেষ ব্যবস্থায় জানালা দিয়ে হাবিবুলকে দেখতে পারে । ছালবাকল, লতাপাতা, শিকড় , পানিপরার জন্য দিন দিন মানুষের লাইন দীর্ঘ হতে লাগল জ্বিনের বাড়তে । চারদিকে রটে গেল হাবিবুলের নির্দেশে জ্বিন এসব অসুধের যোগান দেয় ।
কিছুদিনের মধ্যে হাবিবুল হাঁপিয়ে উঠে । বদ্ধ জীবন তার ভাল লাগে না ।এ জীবন বড় কষ্টের । এ রকম বিপদ হবে জানলে সে আকাশে ওড়ার কথা কাউকে বলত না। সে মনে মনে বাইরে যাওয়ার ফন্দি আঁটে ।
আজ জুমাবার । গ্রামের লোকজন সবাই মসজিদ মুখী । দরজার বাইরে রবিউল একা । দরজার চাবি তার কাছেই থাকে । হাবিবুলের কোন কিছু দরকার পড়লে সে এনে দেয় । হাবিবুল জানালা দিয়ে রবিউলকে ডাকল । রবিউল !
কী ? কিছু লাগব ? রবিউল সাড়া দিল ।
মাথা নাড়ল হাবিবুল ।
তয় কী চাও ? রবিউল ঘাড় বাঁকা করে জিজ্ঞেস করল ।
ডিম !
হাবিবুল চোখ গোল করল । ওঅ ডিম খাইবার চাও ?
হাবিবুল আবার মাথা নাড়ে ।
তয় ডিম কইলা যে ?
সোনার ডিম !
কুনাই ? রবিউলের চোখ গোল হল ।
হাবিবুল ফিসফিস করল । জঙ্গলে । জ্বিন কইলো অহন না নিলে আর মিলবো না। তালাটা খুইলা দাও । ডিম আনলে তোমারে একটা দিমু । কারো কইবা না কিন্তু ।
সোনার ডিমের লোভে রবিউলের চোখ চকচক করে উঠল । সে তাড়াতাড়ি তালা খুলে দিয়ে বলল, যাও, জলদী যাও । আবার জলদী ফিইরা আইস ।
জ্বিনের বাড়ি থেকে মুক্ত হয়ে হাবিবুল দৌড় দিল জঙ্গলের দিকে । রবিউল দরজায় তালা দিয়ে টুলের উপর বসে ঝিমোতে লাগল । অনেকদিন পর মুক্ত হয়ে হাবিবুলের আনন্দের সীমা রইল না । সে শালগাছের নিচে বসে আবার পাখির মত উড়ার কথা ভাবতে লাগল । ভাবতে ভাবতে কখন যে সে শালগাছে চড়ে বসেছে বুঝতেই পারল না । সে যখন গাছের ডাল থেকে পাখির মত উড়াল দিতে চাইল অমনি মাটিতে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারাল ।
জুমা শেষ হলে মুসল্লিরা দলে দলে আসতে লাগল জ্বিনের বাড়িতে হাবিবুলকে এক নজর দেখার জন্য । দর্শনার্থীরা ঘরে কাউকে দেখতে না পেলে হৈ চৈ পড়ে গেল । কোথায় হাবিবুল ? উম্মাদের মত ছুটে এলেন কুতুব হুজুর । ধমকালেন রবিউলকে । ভয়ে রবিউল আসল কথা চেপে গেল । বলল, আমি কিছু জানিনা । ঘরে তালা দেয়া আচিল । কুতুব তালা খুলে দেখেন, ঘর শূণ্য । চারদিকে রটে গেল জ্বিন হাবিবুল কে বদ্ধ ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে ।
কুতুব হাবিবুলকে খুঁজতে লোকজন নিয়ে জঙ্গলে প্রবেশ করলেন । দেখতে পেলেন শালগাছের নিচে হাবিবুল উপুড় হয়ে পড়ে আছে ।কুতুব হাবিবুলকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলেন । বুঝতে পারলেন হাবিবুল মরে নাই । তার মুখে আবার সম্ভাবনার হাসি । বললেন, বড় খতরনাক জ্বিন ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.