নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বসে আছি অন্ধকারে, \nআমাকে বুঝতে দাও \nমানুষ কেন আলোর \nপ্রত্যাশা করে!

আসোয়াদ লোদি

জীবন ও যন্ত্রণার মরুচরে আমি প্রপাতের ধারা ।

আসোয়াদ লোদি › বিস্তারিত পোস্টঃ

মাসউদ শাফিঃ স্বরূপে মূর্তুজ ছায়ালোকে

১৩ ই মে, ২০১৪ বিকাল ৪:৩৮

প্রকৃতির শ্বাস্বত সত্য জন্মমৃত্যু। প্রতিটি মানুষ স্বজ্ঞানের বদৌলতে এই দর্শন জ্ঞাত। এই একটি বিষয়ে উপলব্ধির আনুপাতিক ভিন্নতা নেই মানুষের মধ্যে। ‘জন্মিলে মরিতে হবে’ এই প্রচলিত প্রবাদ মানুষ তার স্বভাব সিদ্ধতায় আত্মস্থ করে নিয়েছে। মানুষ ইন্দ্রিয়ানুভুতি প্রবণ প্রাণী। প্রতিটি শিশুর ভুমিস্ট যেমন মানুষকে আনন্দিত করে তেম্নি মৃত্যুতে তারা বিপরীত ক্রিয়া প্রকাশ করে। কারণ মানুষ তার সংবেদনশীল মনোধর্ম দ্বারা উপলব্ধি করেছে মৃত্যু বেদনাদায়ক। ফলত মৃত্যু মানুষকে ভীষণ ভাবে পীড়িত করে। আপনজনের মৃত্যুতে তারা হয়ে পড়ে আরও বেশি বিমর্ষকাতর।

মৃত্যুর কোন কালজ্ঞান নেই। কেউ বার্ধক্যে মৃত্যুর স্বাদ পান আবার কেউ কেউ হন অকাল প্রয়াত। অনেক শিশু মাতৃগর্ভ থেকে মৃত্যুর স্বাদ নিয়ে পৃথিবীতে আসে। অর্থাৎ মৃত্যুর কোন শৃঙ্খলা নেই। এই শৃঙ্খলহীন মৃত্যুর আগ্রাসি থাবায় পৃথিবী থেকে অকালে হারিয়ে গেল আমার এক প্রিয় সতীর্থ মাসউদ শাফি। এটি তার লেখক নাম। ভাল নাম শফিউল আলম মাসউদ। মূলত সাহিত্য জগতে কবিতার চারণভূমিতে ছিল তার বিচরণ। কবিতায় তার সম্ভাবনাও ছিল প্রচুর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রিয়ভাজন মানিক বৈরাগির স্ট্যাটাসে প্রথম মাসউদের গুরুতর অসুস্থতার খবর জানতে পারি। এর একদিন পর তার মৃত্যু সংবাদ পাই।

মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে যখন মাসউদ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিল আমার কেন জানি বারবার সুকান্তের কথাই মনে পড়ছিল এবং মনে পড়ছিল ইংরেজ কবি জন কীটস কে। তারা সবাই অকাল প্রয়াত হয়ত বা তাই। সুকান্ত মাত্র ২১ বছরে পৃথিবী থেকে গত হয়েছিলেন আর কীটস সময় পেয়েছিলেন ২৫ বছর। কবিতার বিশাল ভুবনে এই স্বল্প সময় তেমন কিছু নয়। মাসউদ তার জীবনের নাতিদীর্ঘ সময়ে কোন গ্রন্থ প্রকাশের অবকাশ পায়নি। তবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তার লেখা থেকে তাকে ফ্রেমবন্দী করা যায়।

কবির এক হৃদয়ে বহু সত্ত্বা বসত করে। দ্রোহ, প্রেম, প্রকৃতি ও মানবতার জয়গান তাই কবিতার প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠে। মাসউদের কবিতায়ও দেখি এসব উপাদান স্বমহিমায় অস্থিত্বমান। তার ছোট্ট একটি কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।

“শেখ মুজিবুর তুমি শস্য শ্যামল এ বাংলায়

এক মহীরূহ

বেজন্মা বাঙালি ঘাতক পনের আগস্ট

কাল রাতে ভুলে বাংলা বুলি

চালাতে তোমার বুকে গুলি, ছিল কি

তাদের রূহ ?”



(কবিতা- মহীরূহ, প্রকাশ- ছোটকাগজ মুল্যায়ন, সম্পাদক- অমিত চৌধুরী, ১৫ আগস্ট ২০১২, কক্সবাজার-চট্টগ্রাম) ।



আপাত দৃষ্টিতে কবিতাটি ছোট হলেও এর আবেদন কিন্তু বিশাল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে মাসউদ এক পঙতিতে চিত্রিত করেছেন। এরপর তাঁকে নিয়ে আর কিছু বলার অবকাশ থাকে না। যদি আরও কিছু বর্ণনা যোগ করার প্রয়াসী হতেন সেটা স্থুল বাহুল্যকে প্রশ্রয় দেয়া হত এবং একটি পরিশুদ্ধ কবিতার উৎকর্ষ মারাত্মক ভাবে বিগ্নিত হত। এই সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি ভাল কবিতা রচনার জন্য খুবই জরুরী। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনকের নির্মম হত্যাকান্ড ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। এরকম কাপুরুষোচিত হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটিও নেই। এই বর্বরতার ইতিহাস মানবতার চরম অবক্ষয় ছাড়া আর কিছু নয়।

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্নের ঘোরে মাসউদের প্রলেতারিয়েত হৃদয়ে জাতির জনকের প্রতি অকুন্ঠ ভালোবাসার যে দীপ্ত উচ্চারণ দেখি, সেই সাথে দেখি ঘাতক চক্রের বিরুদ্ধে চরম ঘৃণার উম্মিলিত রক্তচক্ষু। এভাবে ইতিহাসের একটি বিশেষ অধ্যায় কবিতার অনুষঙ্গে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। এ কবিতায় শব্দ প্রয়োগের দক্ষতা পাঠককে নিঃসন্দেহে চমকিত করে। মহীরূহ, বেজন্মা, বুলি,গুলি,রূহ প্রভৃতি শব্দগুলো কবিতাকে দিয়েছে নান্দনিক অবয়ব। ঘাতককে বেজন্মা ও শেখ মুজিবুরের উপমায় মহীরূহ শব্দের প্রয়োগ যথাযত বলে আমার মনে হয়েছে।

ঘর পলাতক বাউলের মত অতি সাধারণ জীবনযাত্রায় অভ্যস্থ ছিল মাসউদ। চরম অর্থ সংকট অক্টোপাসের মত তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। অনেক খ্যাতিমান কবিও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। ক্ষুধার্ত সুকান্ত পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি ভেবেছিলেন আর নজরুলের ছিল দ্বিধাহীন স্বীকারোক্তি ‘দারিদ্র তুমি মোরে করেছ মহান’। মধ্যবিত্ত পিতার সন্তান জন কীটসও অর্থের অভাবে ভাল স্কুলে ভর্তি হতে পারেনি। তাঁকে সাধারণ স্কুলে বিদ্যাশিক্ষা শুরু করতে হয়েছিল।

যত অর্থ সংকটই হোক মাসউদ কিন্তু বিচলিত নয়। কবিতাকে জীবনের ব্রত হিসাবে লালন ও সমাজতন্ত্রের মতাদর্শের রাজনীতিকে আত্মস্থ করে স্বীয় গতিপথে সে ছিল অবিচল পথিক। কবি নজরুলের মত এক ঝাঁক বাবরি চুল নিয়ে সে আমার মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসলেও তার জীবনে রাজনীতি ও কবিতা এ দুয়ের বিভাজন রেখা চিত্রিত করা কঠিন বৈকি। তবুও তাকে কিছুটা হলেও বুঝতে পারি। তাকে খুব কাছ থেকে আমি দেখেছি। নিপীড়িত মানুষের পক্ষে ছিল তার লেখনি। ‘Stop the Genocide’ তার একটি অতি মানবিক আবেদন সম্বলিত কবিতা। কবিতাটির শুরুটা এরকম।

“ ফিলিস্তিনের পাঁজর-ভাঙ্গা যন্ত্রণায় পুড়ে

-এ আত্মা

-জাগো মানুষ, জাগো মানবিকতা, জাগো বিশ্বসত্তা



রুখো এই জালেমী দানবিকতা ।”



(কবিতা- Stop the Genocide, প্রকাশ-সাহিত্যকন্ঠ, দৈনিক আপনকন্ঠ, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯, কক্সবাজার) ।



কয়েক দশকের সংগ্রামী জীবন ফিলিস্তিনিদের। ইসরাইল নামক দানবী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্বীয় ভূখণ্ড রক্ষার লড়াইয়ে তারা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উপর যখন ইসরাইলী বাহিনী বর্বরোচিত হত্যাকান্ড চালায় তখন বিশ্ব মানবতা ডীপ ফ্রিজারের হিম চেম্বারে নিদ্রিত থাকে। ফিলিস্তিনিদের আত্মার আর্তনাদ তাদের কর্ণ পর্যন্ত আর পৌঁছায় না। এক্ষেত্রে মাসউদের মধ্যে দেখি এক ব্যতিক্রম মানবিক কবিসত্তার বহিঃপ্রকাশ। এখানে ফিলিস্তিন জনগণের যন্ত্রণার সাথে মাসউদের কবিমন একাত্ম হয়ে যায়। ফলত তার আত্মা নিরন্তর দগ্ধ হতে থাকে। এখানেই কিন্তু মাসউদ থেমে যায়নি। তিনি স্বীয় স্কন্ধে দায়িত্ব নিয়ে উদাত্ত কন্ঠে বিশ্ববাসীকে জাগানোরও চেষ্টা করেছেন,ইসরাইলিদের দানবিকতাকে রুখে দেয়ার জন্য। একই কবিতায় মানবিকতার প্রতি তার হৃদয়মথিত উদাত্ত আকুতির প্রকাশ দেখি আরও কয়েকটি পংতির মধ্যে।



“মানবিকতারে...

আর কতোকাল ঘুমাবে বলে জেগে জেগে ?

এবার দাঁড়াও-মানবিক আবেগে

কোন এক নিরেট সাহসী স্রোতবেগে।”



মাসউদকে আমি বহুবার দেখেছি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন ঝাউবনে চুপচাপ বসে থাকতে। তখন বিষয়টি আমার কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি। কেননা সমুদ্র দর্শনে তো অনেকেই গমন করে। কিন্তু যখন তার ‘সমুদ্র ও আমি’ কবিতাটি প্রকাশ পেল, আমার কাছে তার সমুদ্র দর্শনের তাৎপর্য উপলব্ধি সহজবোধ্য হল। সমুদ্রের মাঝেই সে নিজেকে আবিষ্কার করতে চেয়েছে। বোধের অনুভবের যাদু দিয়ে সে আবিষ্কার করেছে সমুদ্রের অন্তরদহন। যে দহনে সমুদ্র নিরন্তর পুড়ছে,অবিকল মাসউদও পুড়ে যাচ্ছে সমান্তরাল। তবে একান্ত গোপনে। পার্থিব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান ও ভাবের পরিমিত রসায়ন ‘সমুদ্র ও আমি’ কবিতাটি। এর কাব্যভাষা চিত্রিত করেছেন এভাবে-



‘সমুদ্র পোড়ে যে অন্তরদহনে

আমিও পুড়ি সম সন্তর্পণে।’



(কবিতা-সমুদ্র ও আমি, প্রকাশ-প্রথমস্বর, প্রথম দশকে পরিব্যপ্ত ও বিকশিত কবিদের নির্বাচিত কবিতা, একুশে বইমেলা ২০১০, লেখালেখি প্রকাশনী, ঢাকা। সম্পাদনায়- মনির ইউসুফ ও নির্ঝর নৈঃশব্দ্য)।



মাসউদের ‘মানুষ ও কবি’ কবিতার উপর খানিকটা আলোকপাত করে আলোচনার যবনিকা টানতে চাই। এটি প্রকাশ হয়েছিল ‘ধূলোর প্রবাল’ (কবি তৌহিদুল আলম’র ৪৫ বর্ষপূর্তি প্রকাশনা) এ। মানিক বৈরাগী, নিলয় রফিক, মাসউদ শাফি, কালাম আজাদ,নোমান মাহমুদ ইবনে আলতাফ, নিধু ঋষি প্রমুখ ‘ধূলোর প্রবাল’ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। মাসউদের কবিতাটি ছিল মূলত দিগন্ত সৈকত নামক জনৈক কবির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ। যথাযত শব্দ প্রয়োগ ও সাবলীল কাব্যভাষায় একজন মানুষ ও কবির চিত্র অংকনে তিনি মুন্সিয়ানার স্বাক্ষর রেখেছেন। মাসউদের কাব্যভাষার কয়েকটি পঙতির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক।



‘অমোঘ প্রলেতারিয়েত নিঃসঙ্গ প্রাণজ-কাঠামো দেখেই যে লোক

এঁকে দেয়-তার ভেতরের মর্মারতোনাদের বিদগ্ধ কন্ঠস্বর,অসময়ে

মুমূর্শের মুখে যে দেয় তুলে জল আর শিখায় মাটির সত্যতা

সূত্র মোতাবেক আঁকড়ে ধরার মগ্ন বন্দনা, সে লোক-দিগন্ত সৈকত।’

(মানুষ ও কবি)



চূড়ান্ত ভাবে মাসউদ আত্মধ্যানী কবি। মূর্তজ ছায়ালোকে তিনি নিজেকে আবিষ্কার করেন। কোন রূপসী প্রিয়তমা কিংবা ত্রিমাত্রিক বিষয়াবলী এখানে উপেক্ষিত। পারিপার্শ্বিক হাজার কোলাহলের ভিড়ে তিনি নিজের স্বরূপ দর্শনে হয়ে পড়েন বিমর্ষ। স্বীয় মতাদর্শের মাপকাঠিতে অপরাপর বস্তুর বিচার করতে গিয়ে তিনি দারুণ ভাবে হতাশ হন। আর এই হতাশা তার জীবন ও কবিতায় হেমন্তের কুয়াশার মত বিন্দু বিন্দু ছড়িয়ে পড়ে। এর থেকে উত্তরণের সিঁড়ির সন্ধান হয়ত তার জানা ছিল না। ‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরি’র মত মাসউদেরও নিজের উপর বিতৃষ্ণা জন্মেছিল। তাই তাকে বলতে শুনি-



‘নিজের উপর যত অভিমান

করে যে করি অপমান।’







মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.