নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বসে আছি অন্ধকারে, \nআমাকে বুঝতে দাও \nমানুষ কেন আলোর \nপ্রত্যাশা করে!

আসোয়াদ লোদি

জীবন ও যন্ত্রণার মরুচরে আমি প্রপাতের ধারা ।

আসোয়াদ লোদি › বিস্তারিত পোস্টঃ

জোছনা রাতে শেফালি // ছোটগল্প

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ১:০৪


বৃষ্টি যেন আর থামতে চায় না ময়নার চর গ্রামে । বেশ কিছুদিন ধরে একটানা বৃষ্টিতে নদীর দুকূল প্লাবিত হয়ে ডুবে গেছে পথঘাট, ফসলের মাঠ। আষাঢ়ের একরোখা বৃষ্টিতে মানুষের জীবনে নেমে এসেছে হাহাকার ।

সুলতানের ঘরে মন টিকে না । তার ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে পানির নিচে। সেদিকে তাকিয়ে সুলতান দীর্ঘশ্বাস ফেলে । বুঝতে পারে এবার ঘরে আর ফসল তুলতে পারবে না । ফসল বলে তো আর কিছু রইল না । সব পানি আর পানি । তার অনেক ধার দেনা আছে ; সেগুলোই বা শোধ দিবে কীভাবে ? দুশ্চিন্তায় তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে ।

হঠাৎ দূরে কোথাও প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ল । সুলতানের মনে হল বাজ টা কাছে কোথাও পড়েছে । সে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল । কিন্তু আষাঢ়ের বৃষ্টি তো আর ছাতা মানে না । বিলুর চায়ের দোকান পর্যন্ত আসতেই সে কাকভেজা হয়ে গেল । ভাবল বৃষ্টি না কমা পর্যন্ত এক কাপ চা খেতে খেতে অপেক্ষা করবে ।

বিলুর চায়ের দোকান তেমন বড় নয় । ছোট একটি বেড়ার ঘর । কাস্টমার বসার জন্য কয়েকটি লম্বা টুল পাতা আছে । বিলু নিজেই চা বানায় । কাস্টমার সার্ভিসও নিজে সামলে নেয় ।

নেয়ামত টুলের উপর পা তুলে বসে চা খাচ্ছিল । সুলতান নেয়ামতের উল্টো দিকের টুলে বসে বিলুকে বলল, বিলু এককাপ চা দে ।

নেয়ামত জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে আইতেছ সুলতান ?

ক্ষেতের দিকে গেছিলাম । কোথায় আর ক্ষেত, পানি আর পানি । এইরকম বৃষ্টি বাপের জন্মে দেখি নাই । আমি তো এই বছর বরবাদ হয়ে গেলাম নেয়ামত।

সুলতান গামছা দিয়ে মাথার চুল মুছে । ছাতা খানা এক পাশে সরিয়ে রাখে ।

এত চিন্তা কিসের ? তোমার তো নিজের জমি ।

জমি নিজের । কিন্তু ধার কর্জও তো আছে ।

আমার তো দুইটা পুকুরের কোন চিহ্ন নাই । পুকুরের সব মাছ খালে বিলে । এই বছর এক লাখ টাকা জলে গেল ।

বিলু সুলতানের সামনে চায়ের কাপ রেখে বলল, সুলতান ভাই নাস্তা খাইবেন ?

সুলতান মাথা নাড়ে । না বিলু, এখন ঘরে গিয়া ভাত খাব ।

বৃষ্টির জোর আরো বাড়ে । বিলুর দোকানের চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে । সে একটা পুরনো বালতি এনে সেখানে বসিয়ে দেয় । বিলু স্বগতোক্তি করে । চালটা মেরামত করা দরকার । কিন্ত টাকার জন্য পারতেছিনা ।

তোমার তো বেচাকেনা ভালা । অভাব কিসের ? সুলতান বলে ।

কী যে কন সুলতান ভাই ! ঘরে বুড়া মা বাপ সহ খাওনের লোক দশ জন । আমার একার রোজগার । নিজেদের জায়গা জমি নাই । কোন রকমে সংসার চলে ।

নেয়ামত বলল, তোমার ভাইটিরে কোন কামে লাগাইয়া দাও না কেন ?

গেরামে তো এখন কাম কাজ নাই । মিঠু রে কইছিলাম শহরে গিয়া রিক্সা চালাইতে । ও রাজী হয় না ।

মিঠু কী করবার চায় ? শহরে তো অনেক রকমের কাম মিলে । সুলতান বলল ।

এমন সময় মিঠু হাফাতে হাফাতে দোকানে এসে ডুকল । সে ভিজে চুপসে গেছে । বলল, সুলতান ভাই হাসান মারা গেছে ।

মিঠুর কথা শুনে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল । সুলতান বলল, এরকম জোয়ান ছেলে হঠাৎ মারা গেল ! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না মিঠু ।

একটু আগে একটা বাজ পড়ল না । ওটা হাসানের গায়ে পড়েছে ।

হাসান তখন কোথায় ছিল ? নেয়ামত প্রশ্ন করে ।

বৃষ্টির পানি যাওয়ার জন্য সে উঠানে নালা কাটতেছিল নাকি ।

বিলু জিজ্ঞেস করে, জানাজার নামাজ কবে ?

বাদ জোহর । মিঠু জবাব দেয় ।

বড় ভাল ছেলে ছিল হাসান । চল যাই একবার দেখে আসি । সুলতান বলে ।

সুলতান ও নেয়ামত যখন হাসানের বাড়িতে এসে পৌঁছল তখন ঘরের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ আসছিল । হাসানের মা ও বোনেরা বিলাপ করে কাঁদছে । বারান্দায় চৌকির উপর বসে হাসানের বাপ রমজান আলী পুত্র শোকে চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে ।

এদিকে বৃষ্টি থামার কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না । মৌলভি শরীয়ত উল্লাহ তজবিহ জপতে জপতে অস্থির হয়ে উঠলেন । উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, শুন মিয়ারা, ব্জ্রপাত হচ্ছে আল্লাহর গজব। গেরামে আল্লাহ্র গজব আসছে । বেশি বেশি নামাজ কালাম পড়বা । আল্লাহর কাছে ফানা চাও । তিনি গফুরুর রাহিম ।

সুলতান শরীয়ত উল্লাহ্র কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল । হঠাৎ সে বলে উঠল, হুজুর হাসান তো ভাল ছেলে ছিল । পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত । কারো সাথে মন্দ ব্যবহার করত না । তো গজবটা তার উপর আসল কেন ?

শরীয়ত উল্লাহ তির্যক দৃষ্টিতে তাকালেন সুলতানের দিকে । গম্ভীর কন্ঠে বললেন, তুমি আল্লাহ্ রাসুল মান না ?

আমি আল্লাহ্ রাসুল মানি হুজুর । কিন্তু হাসানের উপর গজব আসছে কথাটা মানি না ।

সবি আল্লাহ্ ইচ্ছা । শরীয়ত উল্লাহ তজবিহ ঘুরালেন । বৃষ্টি থেমে আসলে বললেন, সবাই চল আর দেরী করা ঠিক হবে না ।

পাড়ার পিছনে কবরস্থান । খুব বেশি দূরে নয় । জায়গাটা বিভিন্ন প্রকার গাছগাছালিতে ভরা । সুলতান হাসানের দাফন শেষ করে ঘরে ফিরে আসে ।
মোমেনা জিজ্ঞেস করে, কোথাও গেছিলা নাকি ? এত দেরি করলা যে?

হাসান মারা গেছে । তার জানাজায় গেছিলাম ।

হায় আল্লাহ্ ! এমন জোয়ান ছেলেটা মরল কীভাবে ? মোমেনা আৎকে উঠে ।

গায়ে বাজ পড়ছে । জলদী ভাত দাও শেফালির মা । পেঠের মধ্যে আগুন জ্বলতাছে ।

মোমেনা তাড়াতাড়ি ভাত বেড়ে দিল । সুলতান মাদুরে বসে জিজ্ঞেস করল, শেফালি কই ? ও খাইব না ?

তোমার দেরি দেইখা ও খাইয়া ফেলাইছে । তুমি খাও ।

শেফালি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখতে হাসানের কথা ভাবছিল । হাসান খুব ভাল ছেলে ছিল । গ্রামের সবাই তার সুনাম করত । শেফালিও হাসানকে পছন্দ করত । দূর থেকে সে তাকে ভালোবাসত । কিন্তু কখনো সে হাসানকে ভালোবাসার কথা জানাতে পারেনি । তেমন সুযোগ হয়নি । জমাট বাঁধা মেঘের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে তার চোখের কোণ ভিজে এসেছে ।

রাতে শেফালি ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল । মোমেনা জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে শেফালি তোর কী শরীর খারাপ ?

না মা, এম্নি খাইতে ইচ্ছে করতেছে না । শেফালির এই কথায় কিন্তু মোমেনা সন্তুস্ট হতে পারেনি । মোমেনা ভাবছিল হঠাৎ মেয়েটার হল কী । কেমন মনমরা হয়ে গেছে ।

সারারাত মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে । স্বপ্নটা গভীর রাতেই দেখল শেফালি। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে হাসান তাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে । সাদা পাজামা পাঞ্জাবিতে তাকে রাজপুত্রের মত মনে হল শেফালির । হাসান দুহাত প্রসারিত করে শেফালিকে ডাকছে । শেফালি এসো, তুমি আমাকে ভালোবাস বলে আমি ফিরে এসেছি । শেফালি কাঁপতে কাঁপতে উঠোনে বেরিয়ে এলো । বৃষ্টিতে সে ভিজে যাচ্ছে । হাসান এখনও হাত বাড়িয়ে আছে । এক সময় শেফালি হাসানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল । এখানেই শেফালির ঘুম ভেঙ্গে যায় । সে দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলে বুকের উপর হাত রাখে । মনে হল এখনও হাসানের স্পর্শ তার বুকে লেগে আছে । তার আর ঘুম এলো না । বাইরে বৃষ্টির তেজও কমে এসেছে । ভোর হতে আর কত সময় বাকি কে জানে ।

স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে সারাদিন কেটে গেল শেফালির । সে বাগান থেকে ফুল তুলে মালা গেথেছে । কিন্তু মালাটা আর খোঁপায় পরা হয়নি। টেবিলে রেখে দিয়েছে । সারাদিন এটা ওটা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও হাসানের চিন্তা কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারে না । রাতে সে আবার স্বপ্ন দেখল । হাসানের কবরকে কারা যেন ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে । আর কবরের উপর শেফালি বধূ সেজে বসে আছে। হাসান ফুলের মালা হাতে কবর থেকে বেরিয়ে এসেছে । শেফালির গলায় মালা পরিয়ে বলল, আজ আমাদের বাসর । শেফালির চোখের পাতা কেঁপে উঠল । হাসান আলতো করে চুমু খেল তার ঠোঁটে । শেফালি জড়িয়ে ধরল হাসানকে ।

সকালে শেফালি ঘুম থেকে উঠে দেখে তার গলায় ফুলের মালা । সে খুব অবাক হল । কারণ সে তো মালা টেবিলে রেখেছিল । তার গলায় আসল কীভাবে ? তবে কি সত্যি হাসান তাকে মালা পড়িয়ে দিয়েছে ? সারাদিন শেফালি তার শরীরে হাসানের অস্থিত্ব অনুভব করতে থাকে । সন্ধ্যার পর সে চুপি চুপি হাসানের কবর দেখতে চলে আসে । সে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে । তার কেবল মনে হতে লাগল একটু পর হাসান কবর থেকে বেরিয়ে আসবে ।

শরীয়ত উল্লাহ এক লোককে সাথে নিয়ে কবরস্থানের পাশের রাস্তা ধরে হেঁটে আসছেন । হাসানের কবরের কাছাকাছি আসতেই শেফালি বলে উঠল, হাসান মরে নাই ! হাসান মরে নাই ! হাসান মরে নাই !

ঘটনার আকস্মিকতায় শরীয়ত উল্লাহ্র সাথে থাকা লোকটি ভয়ে ঊর্ধশ্বাসে দৌড় দিল । শরীয়ত উল্লাহও ঘাবড়ে গিয়ে লোকটির পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলেন । তিনি অনেক চেষ্টা করেও আয়াতুল কুরছি মনে করতে পারলেন না । ঘরে ফিরে সারারাত ভাবনায় অস্থির হয়ে কাটালেন । তার ষাট বছরের জীবনে কখনো কবর থেকে গায়েবি আওয়াজ হতে শুনেননি । তবে কি হাসান কোন সাধারণ ছেলে ছিল না ? সবাই তো তাকে ভাল ছেলে হিসেবেই জানত । শরীয়ত উল্লাহ আল্লাহর কাছে হাত তুলে বললেন, সবি তোমার ইচ্ছা ।

কবর থেকে গায়েবি আওয়াজ হওয়ার কথাটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল । দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসতে লাগল হাসানের কবর জিয়ারত করার জন্য । ধীরে ধীরে বিলুর ব্যবসাও বড় হতে লাগল । হাসানের কবর নিয়ে আরও অনেক কাহিনীর জন্ম হল । কেউ দেখেছে হাসানের কবরকে শুন্যে ঝুলে থাকতে । আবার কেউ হাসানকে কবরস্থানে হাঁটতে দেখেছে । এভাবে পাঁচ ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেল ।

শেফালি প্রায় ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে হাসানের কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে । তার ধারণা হাসান কোন না কোন সময় কবর থেকে বেরিয়ে আসবে । এরকম একটা বিশ্বাস তার মনে গভীর ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ।

আজ জোছনা রাত । শেফালি ফুল দিয়ে ঢেকে দিয়েছে হাসানের কবর । ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে সম্মোহিত হয়ে আছে কবরের দিকে । মিঠু এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ঝোপের আড়ালে শেফালিকে দেখে ফেলে । সে অবাক হয়ে গেল । বুঝতে পারলনা শেফালি এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন । সে ধীরে ধীরে হাসানের কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে এসে শেফালির সামনে দাঁড়াল ।

শেফালি তখনও ঘোরের মধ্যে । পারিপার্শ্বিক কোনকিছুই তার চেতনায় ব্যত্যয় ঘটাতে পারছেনা । তার মনে হল হাসান কবর থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সে হাসান বলে মিঠুকে জড়িয়ে ধরে । ধীরে ধীরে মিঠু নিজের ভেতর এক ভয়ঙ্কর রকমের পৌরুষ আবিষ্কার করে । তারপর সে ডুবে যেতে থাকে জোছনার ভেতর । এক সময় মিঠু ক্লান্ত হয়ে পড়ে । শেফালি শুয়ে আছে ঝোপের পাশে । এখনও তার ঘোর কাটেনি । মিঠু একবার শেফালির নগ্ন দেহের দিকে তাকিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে । কতক্ষণ শেফালি ঘোরের মধ্যে ছিল সে নিজেই জানে না । এক সময় তার ঘোর কেটে গেলে সে ফিরে আসে ঘরে ।

পরদিন সকালে মিঠু শহরে যাওয়ার বাস ধরল । উদ্দেশ্য একটা কাজের সন্ধান করা । পথিমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটল । বাস নদীতে পড়ে গিয়েছে । ঘটনাস্থলে এগার জন যাত্রীর মৃত্যু হল । এদের মধ্যে মিঠুর লাশও সনাক্ত হল ।

এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর ময়নার চর গ্রামে একজন নতুন লোকের আগমন হল । হাল্কা পাতলা গড়ন । থুতনিতে এক গোছা দাড়ি আছে । মাথায় গোল টুপি ও পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা জোব্বা পরেছে । কাঁধে হাজী রুমাল ঝোলানো । তিনি সোজা রমজান আলীর কাছে গিয়ে বললেন, আমি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছি হাসানের কবরটাতে মাজার নির্মাণ করে দেয়ার জন্য ।

রমজান বলল, আমি গরীব মানুষ । আমার করার সামর্থ্য নাই । না হলে আমিই কাজটা করতাম । আপনি যখন স্বপ্নে পাইছেন আপনাকে তো মানা করতে পারিনা ।

দেখতে দেখতেই হাসানের কবরের উপর মাজার শরীফ নির্মাণ হয়ে গেল । আগন্তুক লোকটি খাদেম হিসেবে নিয়োজিত হল । এদিকে আর এক ঘটনা ঘটল । শেফালির গর্ভবতী হওয়া নিয়ে সারা গ্রামে হৈচৈ পড়ে গেল । সুলতান ও মোমেনা অনেক চেষ্টা করেও শেফালির মুখ থেকে কোন কথা বের করতে পারল না ।

শরীয়ত উল্লাহ শালিশ ডাকলেন । ঘোষণা করলেন, গ্রামে ব্যভিচার চলতে পারে না । শেফালি ও তার সাথে ব্যভিচারে যে লোক জড়িত, উভয়কে দোররা মেরে শাস্তি প্রদান করা হবে ।

মাদ্রাসার মাঠে শালিশ বসল । মাঠে প্রচুর লোকের ভীড় । শেফালিকে আনা হল । শরীয়ত উল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, শেফালি বল তোমার গর্ভের সন্তানের বাপ কে ?

শেফালি ভাবলেশহীন ভাবে আকাশের দিকে তাকাল । তারপর দৃষ্টিকে জমিনের দিকে নিক্ষেপ করে বলল, হাসান ।

শরীয়ত উল্লাহ গর্জে উঠলেন । হাসন তো এক বছর আগে মারা গেছে । তুমি সত্য কথা বল ।

হুজুর এটাই সত্য কথা । আর মিথ্যা কথা বললে তো আমি আপনার নামও বলতে পারি ।

শরীয়ত উল্লাহ আগে ভাবেননি শালিশ ডেকে এরকম সমস্যায় পড়ে যাবেন । তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, সবাই যার যার বাড়ি চলে যাও । শেফালি পুণ্যবতী মাইয়া । তার জন্য তোমরা দোয়া করিও । সবি উপরওয়ালার ইচ্ছা । বৃষ্টি যেন আর থামতে চায় না ময়নার চর গ্রামে । বেশ কিছুদিন ধরে একটানা বৃষ্টিতে নদীর দুকূল প্লাবিত হয়ে ডুবে গেছে পথঘাট, ফসলের মাঠ। আষাঢ়ের একরোখা বৃষ্টিতে মানুষের জীবনে নেমে এসেছে হাহাকার ।

সুলতানের ঘরে মন টিকে না । তার ফসলের ক্ষেত তলিয়ে গেছে পানির নিচে। সেদিকে তাকিয়ে সুলতান দীর্ঘশ্বাস ফেলে । বুঝতে পারে এবার ঘরে আর ফসল তুলতে পারবে না । ফসল বলে তো আর কিছু রইল না । সব পানি আর পানি । তার অনেক ধার দেনা আছে ; সেগুলোই বা শোধ দিবে কীভাবে ? দুশ্চিন্তায় তার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠে ।

হঠাৎ দূরে কোথাও প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ল । সুলতানের মনে হল বাজ টা কাছে কোথাও পড়েছে । সে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল । কিন্তু আষাঢ়ের বৃষ্টি তো আর ছাতা মানে না । বিলুর চায়ের দোকান পর্যন্ত আসতেই সে কাকভেজা হয়ে গেল । ভাবল বৃষ্টি না কমা পর্যন্ত এক কাপ চা খেতে খেতে অপেক্ষা করবে ।

বিলুর চায়ের দোকান তেমন বড় নয় । ছোট একটি বেড়ার ঘর । কাস্টমার বসার জন্য কয়েকটি লম্বা টুল পাতা আছে । বিলু নিজেই চা বানায় । কাস্টমার সার্ভিসও নিজে সামলে নেয় ।

নেয়ামত টুলের উপর পা তুলে বসে চা খাচ্ছিল । সুলতান নেয়ামতের উল্টো দিকের টুলে বসে বিলুকে বলল, বিলু এককাপ চা দে ।

নেয়ামত জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে আইতেছ সুলতান ?

ক্ষেতের দিকে গেছিলাম । কোথায় আর ক্ষেত, পানি আর পানি । এইরকম বৃষ্টি বাপের জন্মে দেখি নাই । আমি তো এই বছর বরবাদ হয়ে গেলাম নেয়ামত।

সুলতান গামছা দিয়ে মাথার চুল মুছে । ছাতা খানা এক পাশে সরিয়ে রাখে ।

এত চিন্তা কিসের ? তোমার তো নিজের জমি ।

জমি নিজের । কিন্তু ধার কর্জও তো আছে ।

আমার তো দুইটা পুকুরের কোন চিহ্ন নাই । পুকুরের সব মাছ খালে বিলে । এই বছর এক লাখ টাকা জলে গেল ।

বিলু সুলতানের সামনে চায়ের কাপ রেখে বলল, সুলতান ভাই নাস্তা খাইবেন ?

সুলতান মাথা নাড়ে । না বিলু, এখন ঘরে গিয়া ভাত খাব ।

বৃষ্টির জোর আরো বাড়ে । বিলুর দোকানের চাল দিয়ে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে । সে একটা পুরনো বালতি এনে সেখানে বসিয়ে দেয় । বিলু স্বগতোক্তি করে । চালটা মেরামত করা দরকার । কিন্ত টাকার জন্য পারতেছিনা ।

তোমার তো বেচাকেনা ভালা । অভাব কিসের ? সুলতান বলে ।

কী যে কন সুলতান ভাই ! ঘরে বুড়া মা বাপ সহ খাওনের লোক দশ জন । আমার একার রোজগার । নিজেদের জায়গা জমি নাই । কোন রকমে সংসার চলে ।

নেয়ামত বলল, তোমার ভাইটিরে কোন কামে লাগাইয়া দাও না কেন ?

গেরামে তো এখন কাম কাজ নাই । মিঠু রে কইছিলাম শহরে গিয়া রিক্সা চালাইতে । ও রাজী হয় না ।

মিঠু কী করবার চায় ? শহরে তো অনেক রকমের কাম মিলে । সুলতান বলল ।

এমন সময় মিঠু হাফাতে হাফাতে দোকানে এসে ডুকল । সে ভিজে চুপসে গেছে । বলল, সুলতান ভাই হাসান মারা গেছে ।

মিঠুর কথা শুনে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেল । সুলতান বলল, এরকম জোয়ান ছেলে হঠাৎ মারা গেল ! আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না মিঠু ।

একটু আগে একটা বাজ পড়ল না । ওটা হাসানের গায়ে পড়েছে ।

হাসান তখন কোথায় ছিল ? নেয়ামত প্রশ্ন করে ।

বৃষ্টির পানি যাওয়ার জন্য সে উঠানে নালা কাটতেছিল নাকি ।

বিলু জিজ্ঞেস করে, জানাজার নামাজ কবে ?

বাদ জোহর । মিঠু জবাব দেয় ।

বড় ভাল ছেলে ছিল হাসান । চল যাই একবার দেখে আসি । সুলতান বলে ।

সুলতান ও নেয়ামত যখন হাসানের বাড়িতে এসে পৌঁছল তখন ঘরের ভেতর থেকে কান্নার শব্দ আসছিল । হাসানের মা ও বোনেরা বিলাপ করে কাঁদছে । বারান্দায় চৌকির উপর বসে হাসানের বাপ রমজান আলী পুত্র শোকে চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে ।

এদিকে বৃষ্টি থামার কোন আলামত দেখা যাচ্ছে না । মৌলভি শরীয়ত উল্লাহ তজবিহ জপতে জপতে অস্থির হয়ে উঠলেন । উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, শুন মিয়ারা, ব্জ্রপাত হচ্ছে আল্লাহর গজব। গেরামে আল্লাহ্র গজব আসছে । বেশি বেশি নামাজ কালাম পড়বা । আল্লাহর কাছে ফানা চাও । তিনি গফুরুর রাহিম ।

সুলতান শরীয়ত উল্লাহ্র কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিল । হঠাৎ সে বলে উঠল, হুজুর হাসান তো ভাল ছেলে ছিল । পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত । কারো সাথে মন্দ ব্যবহার করত না । তো গজবটা তার উপর আসল কেন ?

শরীয়ত উল্লাহ তির্যক দৃষ্টিতে তাকালেন সুলতানের দিকে । গম্ভীর কন্ঠে বললেন, তুমি আল্লাহ্ রাসুল মান না ?

আমি আল্লাহ্ রাসুল মানি হুজুর । কিন্তু হাসানের উপর গজব আসছে কথাটা মানি না ।

সবি আল্লাহ্ ইচ্ছা । শরীয়ত উল্লাহ তজবিহ ঘুরালেন । বৃষ্টি থেমে আসলে বললেন, সবাই চল আর দেরী করা ঠিক হবে না ।

পাড়ার পিছনে কবরস্থান । খুব বেশি দূরে নয় । জায়গাটা বিভিন্ন প্রকার গাছগাছালিতে ভরা । সুলতান হাসানের দাফন শেষ করে ঘরে ফিরে আসে ।
মোমেনা জিজ্ঞেস করে, কোথাও গেছিলা নাকি ? এত দেরি করলা যে?

হাসান মারা গেছে । তার জানাজায় গেছিলাম ।

হায় আল্লাহ্ ! এমন জোয়ান ছেলেটা মরল কীভাবে ? মোমেনা আৎকে উঠে ।

গায়ে বাজ পড়ছে । জলদী ভাত দাও শেফালির মা । পেঠের মধ্যে আগুন জ্বলতাছে ।

মোমেনা তাড়াতাড়ি ভাত বেড়ে দিল । সুলতান মাদুরে বসে জিজ্ঞেস করল, শেফালি কই ? ও খাইব না ?

তোমার দেরি দেইখা ও খাইয়া ফেলাইছে । তুমি খাও ।

শেফালি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে দেখতে হাসানের কথা ভাবছিল । হাসান খুব ভাল ছেলে ছিল । গ্রামের সবাই তার সুনাম করত । শেফালিও হাসানকে পছন্দ করত । দূর থেকে সে তাকে ভালোবাসত । কিন্তু কখনো সে হাসানকে ভালোবাসার কথা জানাতে পারেনি । তেমন সুযোগ হয়নি । জমাট বাঁধা মেঘের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে তার চোখের কোণ ভিজে এসেছে ।

রাতে শেফালি ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল । মোমেনা জিজ্ঞেস করেছিল, কিরে শেফালি তোর কী শরীর খারাপ ?

না মা, এম্নি খাইতে ইচ্ছে করতেছে না । শেফালির এই কথায় কিন্তু মোমেনা সন্তুস্ট হতে পারেনি । মোমেনা ভাবছিল হঠাৎ মেয়েটার হল কী । কেমন মনমরা হয়ে গেছে ।

সারারাত মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে । স্বপ্নটা গভীর রাতেই দেখল শেফালি। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে হাসান তাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে । সাদা পাজামা পাঞ্জাবিতে তাকে রাজপুত্রের মত মনে হল শেফালির । হাসান দুহাত প্রসারিত করে শেফালিকে ডাকছে । শেফালি এসো, তুমি আমাকে ভালোবাস বলে আমি ফিরে এসেছি । শেফালি কাঁপতে কাঁপতে উঠোনে বেরিয়ে এলো । বৃষ্টিতে সে ভিজে যাচ্ছে । হাসান এখনও হাত বাড়িয়ে আছে । এক সময় শেফালি হাসানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল । এখানেই শেফালির ঘুম ভেঙ্গে যায় । সে দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলে বুকের উপর হাত রাখে । মনে হল এখনও হাসানের স্পর্শ তার বুকে লেগে আছে । তার আর ঘুম এলো না । বাইরে বৃষ্টির তেজও কমে এসেছে । ভোর হতে আর কত সময় বাকি কে জানে ।

স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে সারাদিন কেটে গেল শেফালির । সে বাগান থেকে ফুল তুলে মালা গেথেছে । কিন্তু মালাটা আর খোঁপায় পরা হয়নি। টেবিলে রেখে দিয়েছে । সারাদিন এটা ওটা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও হাসানের চিন্তা কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারে না । রাতে সে আবার স্বপ্ন দেখল । হাসানের কবরকে কারা যেন ফুল দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছে । আর কবরের উপর শেফালি বধূ সেজে বসে আছে। হাসান ফুলের মালা হাতে কবর থেকে বেরিয়ে এসেছে । শেফালির গলায় মালা পরিয়ে বলল, আজ আমাদের বাসর । শেফালির চোখের পাতা কেঁপে উঠল । হাসান আলতো করে চুমু খেল তার ঠোঁটে । শেফালি জড়িয়ে ধরল হাসানকে ।

সকালে শেফালি ঘুম থেকে উঠে দেখে তার গলায় ফুলের মালা । সে খুব অবাক হল । কারণ সে তো মালা টেবিলে রেখেছিল । তার গলায় আসল কীভাবে ? তবে কি সত্যি হাসান তাকে মালা পড়িয়ে দিয়েছে ? সারাদিন শেফালি তার শরীরে হাসানের অস্থিত্ব অনুভব করতে থাকে । সন্ধ্যার পর সে চুপি চুপি হাসানের কবর দেখতে চলে আসে । সে ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে । তার কেবল মনে হতে লাগল একটু পর হাসান কবর থেকে বেরিয়ে আসবে ।

শরীয়ত উল্লাহ এক লোককে সাথে নিয়ে কবরস্থানের পাশের রাস্তা ধরে হেঁটে আসছেন । হাসানের কবরের কাছাকাছি আসতেই শেফালি বলে উঠল, হাসান মরে নাই ! হাসান মরে নাই ! হাসান মরে নাই !

ঘটনার আকস্মিকতায় শরীয়ত উল্লাহ্র সাথে থাকা লোকটি ভয়ে ঊর্ধশ্বাসে দৌড় দিল । শরীয়ত উল্লাহও ঘাবড়ে গিয়ে লোকটির পিছু পিছু দৌড়াতে লাগলেন । তিনি অনেক চেষ্টা করেও আয়াতুল কুরছি মনে করতে পারলেন না । ঘরে ফিরে সারারাত ভাবনায় অস্থির হয়ে কাটালেন । তার ষাট বছরের জীবনে কখনো কবর থেকে গায়েবি আওয়াজ হতে শুনেননি । তবে কি হাসান কোন সাধারণ ছেলে ছিল না ? সবাই তো তাকে ভাল ছেলে হিসেবেই জানত । শরীয়ত উল্লাহ আল্লাহর কাছে হাত তুলে বললেন, সবি তোমার ইচ্ছা ।

কবর থেকে গায়েবি আওয়াজ হওয়ার কথাটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল । দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসতে লাগল হাসানের কবর জিয়ারত করার জন্য । ধীরে ধীরে বিলুর ব্যবসাও বড় হতে লাগল । হাসানের কবর নিয়ে আরও অনেক কাহিনীর জন্ম হল । কেউ দেখেছে হাসানের কবরকে শুন্যে ঝুলে থাকতে । আবার কেউ হাসানকে কবরস্থানে হাঁটতে দেখেছে । এভাবে পাঁচ ছয় মাস অতিবাহিত হয়ে গেল ।

শেফালি প্রায় ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে হাসানের কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে । তার ধারণা হাসান কোন না কোন সময় কবর থেকে বেরিয়ে আসবে । এরকম একটা বিশ্বাস তার মনে গভীর ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে ।

আজ জোছনা রাত । শেফালি ফুল দিয়ে ঢেকে দিয়েছে হাসানের কবর । ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সে সম্মোহিত হয়ে আছে কবরের দিকে । মিঠু এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ঝোপের আড়ালে শেফালিকে দেখে ফেলে । সে অবাক হয়ে গেল । বুঝতে পারলনা শেফালি এত রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন । সে ধীরে ধীরে হাসানের কবরের পাশ দিয়ে হেঁটে এসে শেফালির সামনে দাঁড়াল ।

শেফালি তখনও ঘোরের মধ্যে । পারিপার্শ্বিক কোনকিছুই তার চেতনায় ব্যত্যয় ঘটাতে পারছেনা । তার মনে হল হাসান কবর থেকে বেরিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । সে হাসান বলে মিঠুকে জড়িয়ে ধরে । ধীরে ধীরে মিঠু নিজের ভেতর এক ভয়ঙ্কর রকমের পৌরুষ আবিষ্কার করে । তারপর সে ডুবে যেতে থাকে জোছনার ভেতর । এক সময় মিঠু ক্লান্ত হয়ে পড়ে । শেফালি শুয়ে আছে ঝোপের পাশে । এখনও তার ঘোর কাটেনি । মিঠু একবার শেফালির নগ্ন দেহের দিকে তাকিয়ে দ্রুত সটকে পড়ে । কতক্ষণ শেফালি ঘোরের মধ্যে ছিল সে নিজেই জানে না । এক সময় তার ঘোর কেটে গেলে সে ফিরে আসে ঘরে ।

পরদিন সকালে মিঠু শহরে যাওয়ার বাস ধরল । উদ্দেশ্য একটা কাজের সন্ধান করা । পথিমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটল । বাস নদীতে পড়ে গিয়েছে । ঘটনাস্থলে এগার জন যাত্রীর মৃত্যু হল । এদের মধ্যে মিঠুর লাশও সনাক্ত হল ।

এই ঘটনার বেশ কিছুদিন পর ময়নার চর গ্রামে একজন নতুন লোকের আগমন হল । হাল্কা পাতলা গড়ন । থুতনিতে এক গোছা দাড়ি আছে । মাথায় গোল টুপি ও পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা জোব্বা পরেছে । কাঁধে হাজী রুমাল ঝোলানো । তিনি সোজা রমজান আলীর কাছে গিয়ে বললেন, আমি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছি হাসানের কবরটাতে মাজার নির্মাণ করে দেয়ার জন্য ।

রমজান বলল, আমি গরীব মানুষ । আমার করার সামর্থ্য নাই । না হলে আমিই কাজটা করতাম । আপনি যখন স্বপ্নে পাইছেন আপনাকে তো মানা করতে পারিনা ।

দেখতে দেখতেই হাসানের কবরের উপর মাজার শরীফ নির্মাণ হয়ে গেল । আগন্তুক লোকটি খাদেম হিসেবে নিয়োজিত হল । এদিকে আর এক ঘটনা ঘটল । শেফালির গর্ভবতী হওয়া নিয়ে সারা গ্রামে হৈচৈ পড়ে গেল । সুলতান ও মোমেনা অনেক চেষ্টা করেও শেফালির মুখ থেকে কোন কথা বের করতে পারল না ।

শরীয়ত উল্লাহ শালিশ ডাকলেন । ঘোষণা করলেন, গ্রামে ব্যভিচার চলতে পারে না । শেফালি ও তার সাথে ব্যভিচারে যে লোক জড়িত, উভয়কে দোররা মেরে শাস্তি প্রদান করা হবে ।

মাদ্রাসার মাঠে শালিশ বসল । মাঠে প্রচুর লোকের ভীড় । শেফালিকে আনা হল । শরীয়ত উল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, শেফালি বল তোমার গর্ভের সন্তানের বাপ কে ?

শেফালি ভাবলেশহীন ভাবে আকাশের দিকে তাকাল । তারপর দৃষ্টিকে জমিনের দিকে নিক্ষেপ করে বলল, হাসান ।

শরীয়ত উল্লাহ গর্জে উঠলেন । হাসন তো এক বছর আগে মারা গেছে । তুমি সত্য কথা বল ।

হুজুর এটাই সত্য কথা । আর মিথ্যা কথা বললে তো আমি আপনার নামও বলতে পারি ।

শরীয়ত উল্লাহ আগে ভাবেননি শালিশ ডেকে এরকম সমস্যায় পড়ে যাবেন । তিনি উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, সবাই যার যার বাড়ি চলে যাও । শেফালি পুণ্যবতী মাইয়া । তার জন্য তোমরা দোয়া করিও । সবি উপরওয়ালার ইচ্ছা ।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ ভোর ৫:১৪

অপ্রতীয়মান বলেছেন: গ্রাম্য কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা আর ধর্মান্ধ মানুষের জীবন ঘটনা। এইভাবেই এইসব কুসংস্কার কাজে লাগিয়ে এগিয়ে চলছে মাজার ব্যবসায়ীরা। আর এর সাথে জারিয়ে থাকছে এমন কতশত ঘটনা।

চমৎকার ভাবেই সব তুলে নিয়ে এসেছেন।
শুভ কামনা জানবেন।

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৪ বিকাল ৫:৪৪

আসোয়াদ লোদি বলেছেন: আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যে খুব বেশি অনুপ্রাণিত হলাম । অনেক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা রইল । সুন্দর থাকুন সবসময় ।

২| ০৫ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:০২

কালাম আজাদ কক্সবাজার বলেছেন: খুব সুন্দর লাগলো।

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৩৭

আসোয়াদ লোদি বলেছেন: তোমাকে ব্লগে পাচ্ছি না। এসে যাও।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.