নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বসে আছি অন্ধকারে, \nআমাকে বুঝতে দাও \nমানুষ কেন আলোর \nপ্রত্যাশা করে!

আসোয়াদ লোদি

জীবন ও যন্ত্রণার মরুচরে আমি প্রপাতের ধারা ।

আসোয়াদ লোদি › বিস্তারিত পোস্টঃ

বৈদিক থেকে মধ্যযুগঃ দৃষ্টিপাত শিক্ষা ও মহাকাশ

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:৩০

পর্ব-২



প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ঐরাবতিয়ার লেখক ছিলেন ঐরাবত । মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন । মহাসিদ্ধান্ত গ্রন্থের লেখক যিনি দশম শতাব্দীতে জীবিত ছিলেন, তিনি ও ঐরাবতিয়ার লেখক একই ব্যাক্তি নন । তাদের একই রকম নামের কারণে হয়ত বিভ্রান্তির অবকাশ থেকে যায় । সুতরাং তাদের পৃথকভাবে চিহ্নিতকরনের সুবিধার্থে প্রথম ঐরাবত ও দ্বিতীয় ঐরাবত নামে ডাকা হয় । ১৯৭৫ খৃষ্টাব্দের ১৯ এপ্রিল ভারত মহাশূন্যে প্রথম উপগ্রহ (satellite) স্থাপন করে । প্রথম ঐরাবতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক এই উপগ্রহের নাম করন করা হয় ঐরাবত ওয়ান ।

ঐরাবত জন্মেছিলেন ৪৭৬ খৃঃ মার্চের ২১ তারিখ । তাঁর জন্মস্থানের নাম ছিল কুসুমপুর ( kusumapuram) । ঐরাবতিয়া গ্রন্থের শ্লোকে এই তথ্যের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে । প্রথম ভাস্কর যিনি ঐরাবত সম্পর্কে প্রথম সমালোচনা করেছিলেন । তাঁর মন্তব্য থেকে জানা যায়, কুসুমপুর হচ্ছে প্রাচীন মগধের পাটালিপুত্র (পাটনা)। তিনি ঐরাবতকে অস্মকা (Ashmaka) এলাকার বলে উল্লেখ করেছিলেন । সেই থেকে আমরা বিনা পরীক্ষায় ঐরাবতের জন্মস্থান অস্মকাদেশ (Ashmakadesa) বলে স্বীকার করে নিয়েছি । এ নিয়ে জোরালো বিতর্ক হতে পারে । কারণ অস্মকাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ ভারতে, যেটার অবস্থান সম্পূর্ণভাবে কেরালাতে । যা হোক, ঐরাবতের সমালোচকের সাফল্যের কারণ ছিল, সমস্ত কেরালাবাসীর সমর্থন । সম্ভবত এমন হওয়া অসম্ভব নয়, ঐরাবত অস্মকাদেশ থেকে পরবর্তীতে কুসুমপুর চলে গিয়েছিলেন।

ঐরাবতের ব্যাক্তিগত জীবন সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য জানা যায় না । ভাস্করের কাজ পর্যালোচনা করে জানা যায়, ঐরাবত পেশায় শিক্ষক ছিলেন । পান্দুরঙ্গস্বামী, লারাদেবন ও নিশঙ্কু ছিলেন তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বিখ্যাত । প্রাচীন ভারতবর্ষে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল মগধ । তৎকালে পৃথিবী খ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাটালিপুত্রে । পাটালিপুত্র হচ্ছে বর্তমানে পাটনা জেলা । নালন্দায় জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়নের জন্য বিশেষ সুবিধা ছিল । ঐরাবত তাঁর গ্রন্থে প্রায় কুলপতি (Kulapan) হিসেবে উল্লেখিত হয়েছেন । তৎকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কে কুলপতি বলা হত । গুপ্তযুগের রাজা বুদ্ধগুপ্ত তাঁকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুলপতি নিয়োগ করেছিলেন ।

ঐরাবতিয়া গ্রন্থ থেকে জানা যায় এর লেখক একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী । ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এটি জ্যোতিঃশাস্ত্রের উপর একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল । তাঁর তিরোধান ভারতে মহাকাশ গবেষণায় ক্রমপতনের সুচনা করেছিল ।

পঞ্চসিদ্ধান্তিকা জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে অধিকতর শক্তিশালী ছিল । কিন্তু তবুও এটি সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ কিংবা শাসনের ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে নি । যেমন চন্দ্রসূর্যের গ্রহণ, গ্রহগুলোর অবস্থানের পূর্বাভাস দিতে পারেনি । এমন কী অনেক বিষয়ের ভুল ব্যাখ্যাও দিয়েছিল । ঐরাবত ভারতে জ্যোতির্বিদ্যাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল এবং বিজ্ঞানের অধিকতর ছক বাঁধা কাজে পরিণত করেছিল । বলা হয়ে থাকে তিনিই একমাত্র বিজ্ঞানী, যিনি তাঁর গ্রন্থে ‘ঐর মিটার’ লিখেছিলেন । তিনি প্রথম সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে পৃথিবী গোলাকার এবং ইহা অক্ষরেখায় ঘূর্ণনের কারণে দিনরাত্রি সংঘটিত হয় । তিনি আরও বলেন, চাঁদের আলো সূর্যরশ্নির প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছু নয় । তিনি চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের সঠিক ব্যাখা দিয়েছলেন ।

সূর্য ও নক্ষত্রের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে গতিকে তিনি পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে চক্রাকারে ঘুরার কারণ বলে অভিহিত করেছিলেন । তিনি পৃথিবী থেকেই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কিছু গ্রহের অনিয়মিত গতি এবং বৃহত্তর বৃত্তের পরিধির ওপরে বৃত্তের কেন্দ্র একটু একটু সরে যায় (epicycles) ।তাঁর এই যুগান্তকারি ধারণা মহাকাশ গবেষণার অগ্রযাত্রায় দারুণ ভুমিকা রেখেছিল । ঐরাবত পৃথিবী থেকেই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন মহাবিশ্বের ভূ-কেন্দ্রিক ধারনাটি । তিনি মহাকাশ গবেষণায় অধিকতর যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন বলে তাকে ভারতের জ্যোতির্বিদ্যার জনক বলা হয় ।

ঐরাবতিয়া গ্রন্থে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত ১২১ টি স্তবক আছে । যেগুলো চারটি অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত আছে । প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘গীতিকা পড়ম’ । এখানে গ্রহ নক্ষত্র সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ন ধ্রুবক তথ্য এবং ত্রিকোণমিতি সুত্রের তালিকা ছিল । দ্বিতীয় অধ্যায়ে ছিল গণিত । যেটার নাম ছিল ‘গণিতাপড়ম’ । এই অধ্যায়ে জ্যামিতির ক্ষেত্র ও বর্ণনা, পরিমাপের সূত্র, সূর্যঘড়ির ছায়া সমস্যা, ধারা, বীজগণিতের সমীকরণ, সাধারণ যুগপৎ ঘটমান, দ্বিঘাত সমীকরণ এবং আরও অনেক অনির্ধারিত বিষয়ের উল্লেখ আছে । অধিকন্তু সংখ্যার বর্গমূল ও ঘনমূলের নিয়ম, অনুপাতের বৈপরীত্য নিয়ম, ত্রিকোণমিতি সুত্রের তালিকা তৈরি এবং π এর মুল্যামানের উপর আলোকপাত দেখা যায় ।

তৃতীয় আধ্যায় ‘কালক্রিয়াপড়ম’ । সময়ের বিভিন্ন পরিমাণ, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহগুলোর সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করন, বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে দিন, মাস ও বছরের হিসাব বর্ণনা, সময়ের চক্রগতির উৎপত্তির সংজ্ঞা, চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহগুলোর গতির বর্ণনা , দ্রাঘিমা ইত্যাদির স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে । চতুর্থ অধ্যায়ের নাম ‘গোলপড়” । এই অধ্যায়ে গ্রহ নক্ষত্রের গোলাকৃতির বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে । উত্তর ও দক্ষিণ মেরু থেকে গ্রহগুলোর গতি, সূর্য ও চাঁদের চক্রগতির প্রকৃতি অনুমান, বিষুবরেখার অবস্থান সনাক্তকরণ , গ্রহগুলোর দৃষ্টিগোচরতা ইত্যাদি এই অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে ।

ঐরাবত সঠিকভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন π এর মুল্যমান হবে π = ৩.১৪১৬ (ফোর্থ ডেসিমেল) । এমন কী আজ অবধি আমারা এটিই ব্যবহার করে আসছি । ঐরাবত বর্ণনা করেছিলেন যে, এটি ছিল π এর কাছাকাছি মুল্যমান । ঐরাবতের পূর্ববর্তী গণিতজ্ঞদের হিসাবটা ছিল π = ১০ ।

ঐরাবতই প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানী যিনি সুত্রের পার্থক্যের তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন । তিনি এই তালিকা তৈরি করতে বহু পদ্ধতির ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন । তিনি 90°(π/2) ফর্মুলাকে সুনির্দিষ্ট ভাবে সুত্রায়িত করেছিলেন । ঐরাবতের ফর্মুলা ছিল এরকম –

Sin (π/2 + q) = sin π/2 – Ver sin 0

Sin (π + 0) = sin π/2 – Ver sin π/2 – sin 0

Sin (3 π/2 + 0) = Sin π/2 - Ver sin π/2 – sin π/2 + Ver sin 0

ঐরাবত আবার অনির্দিষ্ট সমীকরণ সমাধান করেছিলেন এভাবে –

• N= ax + b = cy + d = ez + f ……………….

• (ax + c ) /b = an integer

ঐরাবতের সময়ের হিসাবটা ছিল নিম্নরূপঃ

১ কল্প = ১৪ মনু বা ১০০৮ যুগ

১ মনু = ৭২ যুগ

১ যুগ = ৪৩,২০,০০০ বছর

আবার ১ যুগ ৪টি সমান ভাগে বিভক্ত ছিল । সর্বব্যাপী প্রচলিত সময়ের অযৌক্তিক বিভাগকে তিনি বিজ্ঞান ভিত্তিক সংশোধন করেছিলেন । বহু ধারণা অনুযায়ী বর্তমান কলিযুগের সুচনা হয়েছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি ৩১০২ (খৃঃ পূঃ ), শুক্রবার । ঐরাবত কখনও বিশ্বাস করতেন না মহাবিশ্ব একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে । তাঁর বিশ্বাস মহাবিশ্ব অনন্ত ।

তাঁর সময়ে সাধারণ বিশ্বাস প্রচলিত ছিল পৃথিবী স্থির এবং ইহা মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত । মহাবিশ্বটি হচ্ছে একটি দৈব কাঠামো এবং সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। এই ধরনার বিরুদ্ধে তিনি তাঁর জোরালো মতবাদ তুলে ধরেন । তিনি বলেন পৃথিবী স্বীয় কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান এবং নক্ষত্রগুলো স্বীয় অবস্থানে স্থির । তিনি হিসাব নির্ণয় করে দেখিয়েছেন, ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪.১ সেকেন্ডে পৃথিবী একবার কক্ষপথ পরিভ্রমণ করে । তাঁর এই হিসাবটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য এবং এটি আমাদের দারুণ ভাবে বিস্মিত করে । কারণ বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানীদের হিসাবটি হচ্ছে ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪.০৯১ সেকেন্ড ।

শত শত বছর যাবৎ জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়নের জন্য ঐরাবতিয়া একটি প্রথম শ্রেণীর মৌলিক গ্রন্থ হিসাবে সমাদৃত হয়ে আসছে । মহাকাশ গবেষণার জন্য ইহা একটি আদর্শ পদ্ধতি স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল । যারা তাঁর এই নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করেছে, সবাই নিজেদের ‘ঐরাবতের শিশ্য’ হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেছে। এসব জ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রথম ভাস্কর ।

প্রথম ভাস্কর ছিলেন ব্রহ্মগুপ্তের সমসাময়িক । অনেকের ধারণা তিনি ৫৫০ খৃঃ থেকে ৬২৮ খৃঃ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন । তিনি শুধু ‘ঐরাবতিয়া’র সমালোচক ছিলেন না, জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত ৩টি মুল্যবান গ্রন্থও রচনা করেছিলেন । ‘মহাভাস্করিয়া’ ও ‘লঘুভাস্করিয়া’ ও ‘ঐরাবতিয়া ভাষ্য’, যেখানে তিনি ঐরাবতের নীতিগুলোরও ব্যাখ্যা করেছিলেন । ‘মহাভাস্করিয়া’র কিছু অধ্যায়ে ‘ঐরাবতিয়া’ সম্পর্কিত বর্ণনা পাওয়া যায় । একই সময়ে ইহা স্বীয় অভিমতও তুলে ধরে ।‘লঘুভাস্করিয়া’ গ্রন্থটি ছিল ‘মহাভাস্করিয়া’র সারসংক্ষেপ ।‘ঐরাবতিয়া’ সম্পর্কে অত্যধিক বিস্তারিত মতামত ও বহুল প্রমানাদি জ্যোতিঃশাস্ত্রে ভাস্করের গভীর জ্ঞানেরই পরিচায়ক ।

‘ঐরাবতিয়া’র অন্যান্য সমালোচকদের মধ্যে যারা উল্লেখযোগ্য ছিলেন তাঁরা হলেন, সোমেস্বরাম, সুরিয়াদেব (১১৯১ খৃঃ, চোলাদেশ), প্রমেশ্বরাম (১৩৮০-১৪৫০ খৃঃ, কেরালা), যল্লায়াম (১৪৮০ খৃঃ, অন্ধ্রপ্রদেশ ), নীলাকান্ত (১৫০০ খৃঃ, কেরালা), রঘুনাথরাজা (১৫৯৭ খৃঃ, অন্ধ্রপ্রদেশ), ভীরুপাকশ , সোন মাধব (অন্ধ্রপ্রদেশ), ঘদিগোপা (কেরালা), ভুথিবিষ্ণু , কোড়ন্দরাম, (অন্ধ্রপ্রদেশ), কৃষ্ণ (কেরালা), কৃষ্ণদাস (১৭৫৬ খৃঃ, কেরালা) প্রমুখ । এসব প্রখ্যাত ব্যাক্তিগণ ‘ঐরাবতিয়া’ গ্রন্থের উপর যেসব সমালোচনা মূলক গ্রন্থ রচনা করেছিল, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- মহাভাস্করিয়া , লঘুভাস্করিয়া , হরিদত্তের (কেরালা) গ্রহচরনিবন্ধনরিয়া (৬৮৩ খৃঃ), দেবে’র করনারত্নম (৬৮৯ খৃঃ), দামোদরের বাতাতুল্য (১৪১৭ খৃঃ), পুথমান সোমায়াজির (কেরালা) করনাপাথথি (১৭৩২ খৃঃ) এবং শঙ্করভার্মা’র সাথনাত্নমালা (১৮২৩ খৃঃ) ।

ঐরাবতের আরও একটি গৌরবোজ্জল কাজ হচ্ছে ঐরাবতসিদ্ধান্ত । সপ্তম শতাব্দীতে তাঁর কাজ ভারতে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ।ঐরাবতিয়া’র বহুল বিস্তার লাভ সত্ত্বেও এই গ্রন্থের অবিচল ও অনুমানসিদ্ধ ধারণা ছিল ব্যতিক্রম । বর্তমানে ‘ঐরাবতসিদ্ধান্ত’ গ্রন্থটি দুষ্প্রাপ্য । কিন্তু ব্রহ্মগুপ্তের ‘খন্ডখাদ্যক’ গ্রন্থটি হচ্ছে ‘ঐরাবতসিদ্ধান্তে’র সারমর্ম।

প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ঐরাবতিয়ার লেখক ছিলেন ঐরাবত । মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন । মহাসিদ্ধান্ত গ্রন্থের লেখক যিনি দশম শতাব্দীতে জীবিত ছিলেন, তিনি ও ঐরাবতিয়ার লেখক একই ব্যাক্তি নন । তাদের একই রকম নামের কারণে হয়ত বিভ্রান্তির অবকাশ থেকে যায় । সুতরাং তাদের পৃথকভাবে চিহ্নিতকরনের সুবিধার্থে প্রথম ঐরাবত ও দ্বিতীয় ঐরাবত নামে ডাকা হয় । ১৯৭৫ খৃষ্টাব্দের ১৯ এপ্রিল ভারত মহাশূন্যে প্রথম উপগ্রহ (satellite) স্থাপন করে । প্রথম ঐরাবতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনপূর্বক এই উপগ্রহের নাম করন করা হয় ঐরাবত ওয়ান ।

ঐরাবত জন্মেছিলেন ৪৭৬ খৃঃ মার্চের ২১ তারিখ । তাঁর জন্মস্থানের নাম ছিল কুসুমপুর ( kusumapuram) । ঐরাবতিয়া গ্রন্থের শ্লোকে এই তথ্যের সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে । প্রথম ভাস্কর যিনি ঐরাবত সম্পর্কে প্রথম সমালোচনা করেছিলেন । তাঁর মন্তব্য থেকে জানা যায়, কুসুমপুর হচ্ছে প্রাচীন মগধের পাটালিপুত্র (পাটনা)। তিনি ঐরাবতকে অস্মকা (Ashmaka) এলাকার বলে উল্লেখ করেছিলেন । সেই থেকে আমরা বিনা পরীক্ষায় ঐরাবতের জন্মস্থান অস্মকাদেশ (Ashmakadesa) বলে স্বীকার করে নিয়েছি । এ নিয়ে জোরালো বিতর্ক হতে পারে । কারণ অস্মকাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ ভারতে, যেটার অবস্থান সম্পূর্ণভাবে কেরালাতে । যা হোক, ঐরাবতের সমালোচকের সাফল্যের কারণ ছিল, সমস্ত কেরালাবাসীর সমর্থন । সম্ভবত এমন হওয়া অসম্ভব নয়, ঐরাবত অস্মকাদেশ থেকে পরবর্তীতে কুসুমপুর চলে গিয়েছিলেন।

ঐরাবতের ব্যাক্তিগত জীবন সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য জানা যায় না । ভাস্করের কাজ পর্যালোচনা করে জানা যায়, ঐরাবত পেশায় শিক্ষক ছিলেন । পান্দুরঙ্গস্বামী, লারাদেবন ও নিশঙ্কু ছিলেন তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বিখ্যাত । প্রাচীন ভারতবর্ষে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র ছিল মগধ । তৎকালে পৃথিবী খ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাটালিপুত্রে । পাটালিপুত্র হচ্ছে বর্তমানে পাটনা জেলা । নালন্দায় জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়নের জন্য বিশেষ সুবিধা ছিল । ঐরাবত তাঁর গ্রন্থে প্রায় কুলপতি (Kulapan) হিসেবে উল্লেখিত হয়েছেন । তৎকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কে কুলপতি বলা হত । গুপ্তযুগের রাজা বুদ্ধগুপ্ত তাঁকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুলপতি নিয়োগ করেছিলেন ।

ঐরাবতিয়া গ্রন্থ থেকে জানা যায় এর লেখক একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী । ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত এটি জ্যোতিঃশাস্ত্রের উপর একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল । তাঁর তিরোধান ভারতে মহাকাশ গবেষণায় ক্রমপতনের সুচনা করেছিল ।

পঞ্চসিদ্ধান্তিকা জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে অধিকতর শক্তিশালী ছিল । কিন্তু তবুও এটি সম্পূর্ণ বিশ্লেষণ কিংবা শাসনের ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে নি । যেমন চন্দ্রসূর্যের গ্রহণ, গ্রহগুলোর অবস্থানের পূর্বাভাস দিতে পারেনি । এমন কী অনেক বিষয়ের ভুল ব্যাখ্যাও দিয়েছিল । ঐরাবত ভারতে জ্যোতির্বিদ্যাকে পুনরুজ্জীবিত করেছিল এবং বিজ্ঞানের অধিকতর ছক বাঁধা কাজে পরিণত করেছিল । বলা হয়ে থাকে তিনিই একমাত্র বিজ্ঞানী, যিনি তাঁর গ্রন্থে ‘ঐর মিটার’ লিখেছিলেন । তিনি প্রথম সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন যে পৃথিবী গোলাকার এবং ইহা অক্ষরেখায় ঘূর্ণনের কারণে দিনরাত্রি সংঘটিত হয় । তিনি আরও বলেন, চাঁদের আলো সূর্যরশ্নির প্রতিবিম্ব ছাড়া আর কিছু নয় । তিনি চন্দ্র ও সূর্য গ্রহণের সঠিক ব্যাখা দিয়েছলেন ।

সূর্য ও নক্ষত্রের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে গতিকে তিনি পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে চক্রাকারে ঘুরার কারণ বলে অভিহিত করেছিলেন । তিনি পৃথিবী থেকেই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন কিছু গ্রহের অনিয়মিত গতি এবং বৃহত্তর বৃত্তের পরিধির ওপরে বৃত্তের কেন্দ্র একটু একটু সরে যায় (epicycles) ।তাঁর এই যুগান্তকারি ধারণা মহাকাশ গবেষণার অগ্রযাত্রায় দারুণ ভুমিকা রেখেছিল । ঐরাবত পৃথিবী থেকেই পর্যবেক্ষণ করেছিলেন মহাবিশ্বের ভূ-কেন্দ্রিক ধারনাটি । তিনি মহাকাশ গবেষণায় অধিকতর যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন বলে তাকে ভারতের জ্যোতির্বিদ্যার জনক বলা হয় ।

ঐরাবতিয়া গ্রন্থে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত ১২১ টি স্তবক আছে । যেগুলো চারটি অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত আছে । প্রথম অধ্যায়ের নাম ‘গীতিকা পড়ম’ । এখানে গ্রহ নক্ষত্র সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ন ধ্রুবক তথ্য এবং ত্রিকোণমিতি সুত্রের তালিকা ছিল । দ্বিতীয় অধ্যায়ে ছিল গণিত । যেটার নাম ছিল ‘গণিতাপড়ম’ । এই অধ্যায়ে জ্যামিতির ক্ষেত্র ও বর্ণনা, পরিমাপের সূত্র, সূর্যঘড়ির ছায়া সমস্যা, ধারা, বীজগণিতের সমীকরণ, সাধারণ যুগপৎ ঘটমান, দ্বিঘাত সমীকরণ এবং আরও অনেক অনির্ধারিত বিষয়ের উল্লেখ আছে । অধিকন্তু সংখ্যার বর্গমূল ও ঘনমূলের নিয়ম, অনুপাতের বৈপরীত্য নিয়ম, ত্রিকোণমিতি সুত্রের তালিকা তৈরি এবং π এর মুল্যামানের উপর আলোকপাত দেখা যায় ।

তৃতীয় আধ্যায় ‘কালক্রিয়াপড়ম’ । সময়ের বিভিন্ন পরিমাণ, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহগুলোর সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করন, বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে দিন, মাস ও বছরের হিসাব বর্ণনা, সময়ের চক্রগতির উৎপত্তির সংজ্ঞা, চন্দ্র, সূর্য ও গ্রহগুলোর গতির বর্ণনা , দ্রাঘিমা ইত্যাদির স্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে । চতুর্থ অধ্যায়ের নাম ‘গোলপড়” । এই অধ্যায়ে গ্রহ নক্ষত্রের গোলাকৃতির বর্ণনা লিপিবদ্ধ আছে । উত্তর ও দক্ষিণ মেরু থেকে গ্রহগুলোর গতি, সূর্য ও চাঁদের চক্রগতির প্রকৃতি অনুমান, বিষুবরেখার অবস্থান সনাক্তকরণ , গ্রহগুলোর দৃষ্টিগোচরতা ইত্যাদি এই অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে ।

ঐরাবত সঠিকভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন π এর মুল্যমান হবে π = ৩.১৪১৬ (ফোর্থ ডেসিমেল) । এমন কী আজ অবধি আমারা এটিই ব্যবহার করে আসছি । ঐরাবত বর্ণনা করেছিলেন যে, এটি ছিল π এর কাছাকাছি মুল্যমান । ঐরাবতের পূর্ববর্তী গণিতজ্ঞদের হিসাবটা ছিল π = ১০ ।

ঐরাবতই প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানী যিনি সুত্রের পার্থক্যের তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন । তিনি এই তালিকা তৈরি করতে বহু পদ্ধতির ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন । তিনি 90°(π/2) ফর্মুলাকে সুনির্দিষ্ট ভাবে সুত্রায়িত করেছিলেন । ঐরাবতের ফর্মুলা ছিল এরকম –

Sin (π/2 + q) = sin π/2 – Ver sin 0

Sin (π + 0) = sin π/2 – Ver sin π/2 – sin 0

Sin (3 π/2 + 0) = Sin π/2 - Ver sin π/2 – sin π/2 + Ver sin 0

ঐরাবত আবার অনির্দিষ্ট সমীকরণ সমাধান করেছিলেন এভাবে –

• N= ax + b = cy + d = ez + f ……………….

• (ax + c ) /b = an integer

ঐরাবতের সময়ের হিসাবটা ছিল নিম্নরূপঃ

১ কল্প = ১৪ মনু বা ১০০৮ যুগ

১ মনু = ৭২ যুগ

১ যুগ = ৪৩,২০,০০০ বছর

আবার ১ যুগ ৪টি সমান ভাগে বিভক্ত ছিল । সর্বব্যাপী প্রচলিত সময়ের অযৌক্তিক বিভাগকে তিনি বিজ্ঞান ভিত্তিক সংশোধন করেছিলেন । বহু ধারণা অনুযায়ী বর্তমান কলিযুগের সুচনা হয়েছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি ৩১০২ (খৃঃ পূঃ ), শুক্রবার । ঐরাবত কখনও বিশ্বাস করতেন না মহাবিশ্ব একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে । তাঁর বিশ্বাস মহাবিশ্ব অনন্ত ।

তাঁর সময়ে সাধারণ বিশ্বাস প্রচলিত ছিল পৃথিবী স্থির এবং ইহা মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত । মহাবিশ্বটি হচ্ছে একটি দৈব কাঠামো এবং সূর্য পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। এই ধরনার বিরুদ্ধে তিনি তাঁর জোরালো মতবাদ তুলে ধরেন । তিনি বলেন পৃথিবী স্বীয় কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান এবং নক্ষত্রগুলো স্বীয় অবস্থানে স্থির । তিনি হিসাব নির্ণয় করে দেখিয়েছেন, ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪.১ সেকেন্ডে পৃথিবী একবার কক্ষপথ পরিভ্রমণ করে । তাঁর এই হিসাবটি সবিশেষ উল্লেখযোগ্য এবং এটি আমাদের দারুণ ভাবে বিস্মিত করে । কারণ বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানীদের হিসাবটি হচ্ছে ২৩ ঘণ্টা ৫৬ মিনিট ৪.০৯১ সেকেন্ড ।

শত শত বছর যাবৎ জ্যোতির্বিদ্যা অধ্যয়নের জন্য ঐরাবতিয়া একটি প্রথম শ্রেণীর মৌলিক গ্রন্থ হিসাবে সমাদৃত হয়ে আসছে । মহাকাশ গবেষণার জন্য ইহা একটি আদর্শ পদ্ধতি স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল । যারা তাঁর এই নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করেছে, সবাই নিজেদের ‘ঐরাবতের শিশ্য’ হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেছে। এসব জ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন প্রথম ভাস্কর ।

প্রথম ভাস্কর ছিলেন ব্রহ্মগুপ্তের সমসাময়িক । অনেকের ধারণা তিনি ৫৫০ খৃঃ থেকে ৬২৮ খৃঃ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন । তিনি শুধু ‘ঐরাবতিয়া’র সমালোচক ছিলেন না, জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কিত ৩টি মুল্যবান গ্রন্থও রচনা করেছিলেন । ‘মহাভাস্করিয়া’ ও ‘লঘুভাস্করিয়া’ ও ‘ঐরাবতিয়া ভাষ্য’, যেখানে তিনি ঐরাবতের নীতিগুলোরও ব্যাখ্যা করেছিলেন । ‘মহাভাস্করিয়া’র কিছু অধ্যায়ে ‘ঐরাবতিয়া’ সম্পর্কিত বর্ণনা পাওয়া যায় । একই সময়ে ইহা স্বীয় অভিমতও তুলে ধরে ।‘লঘুভাস্করিয়া’ গ্রন্থটি ছিল ‘মহাভাস্করিয়া’র সারসংক্ষেপ ।‘ঐরাবতিয়া’ সম্পর্কে অত্যধিক বিস্তারিত মতামত ও বহুল প্রমানাদি জ্যোতিঃশাস্ত্রে ভাস্করের গভীর জ্ঞানেরই পরিচায়ক ।

‘ঐরাবতিয়া’র অন্যান্য সমালোচকদের মধ্যে যারা উল্লেখযোগ্য ছিলেন তাঁরা হলেন, সোমেস্বরাম, সুরিয়াদেব (১১৯১ খৃঃ, চোলাদেশ), প্রমেশ্বরাম (১৩৮০-১৪৫০ খৃঃ, কেরালা), যল্লায়াম (১৪৮০ খৃঃ, অন্ধ্রপ্রদেশ ), নীলাকান্ত (১৫০০ খৃঃ, কেরালা), রঘুনাথরাজা (১৫৯৭ খৃঃ, অন্ধ্রপ্রদেশ), ভীরুপাকশ , সোন মাধব (অন্ধ্রপ্রদেশ), ঘদিগোপা (কেরালা), ভুথিবিষ্ণু , কোড়ন্দরাম, (অন্ধ্রপ্রদেশ), কৃষ্ণ (কেরালা), কৃষ্ণদাস (১৭৫৬ খৃঃ, কেরালা) প্রমুখ । এসব প্রখ্যাত ব্যাক্তিগণ ‘ঐরাবতিয়া’ গ্রন্থের উপর যেসব সমালোচনা মূলক গ্রন্থ রচনা করেছিল, এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- মহাভাস্করিয়া , লঘুভাস্করিয়া , হরিদত্তের (কেরালা) গ্রহচরনিবন্ধনরিয়া (৬৮৩ খৃঃ), দেবে’র করনারত্নম (৬৮৯ খৃঃ), দামোদরের বাতাতুল্য (১৪১৭ খৃঃ), পুথমান সোমায়াজির (কেরালা) করনাপাথথি (১৭৩২ খৃঃ) এবং শঙ্করভার্মা’র সাথনাত্নমালা (১৮২৩ খৃঃ) ।

ঐরাবতের আরও একটি গৌরবোজ্জল কাজ হচ্ছে ঐরাবতসিদ্ধান্ত । সপ্তম শতাব্দীতে তাঁর কাজ ভারতে খুব জনপ্রিয় হয়েছিল ।ঐরাবতিয়া’র বহুল বিস্তার লাভ সত্ত্বেও এই গ্রন্থের অবিচল ও অনুমানসিদ্ধ ধারণা ছিল ব্যতিক্রম । বর্তমানে ‘ঐরাবতসিদ্ধান্ত’ গ্রন্থটি দুষ্প্রাপ্য । কিন্তু ব্রহ্মগুপ্তের ‘খন্ডখাদ্যক’ গ্রন্থটি হচ্ছে ‘ঐরাবতসিদ্ধান্তে’র সারমর্ম।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.