নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বসে আছি অন্ধকারে, \nআমাকে বুঝতে দাও \nমানুষ কেন আলোর \nপ্রত্যাশা করে!

আসোয়াদ লোদি

জীবন ও যন্ত্রণার মরুচরে আমি প্রপাতের ধারা ।

আসোয়াদ লোদি › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছায়া

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১১:৪৮



আমার মা কখনো ভূত দেখেনি, তবে ভূতে বিশ্বাস করে। ছোটবেলায় মায়ের মুখে অনেকগুলো ভূতের গল্প শুনেছি। মা এগুলোকে গল্প বলত না, বলত বাস্তব ঘটনা। কারণ মা যাদের মুখে এই গল্পগুলো শুনেছিল তাদের প্রত্যেকের ভূত দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে। ভূতের গল্প শুনতে শুনতে ছোটবেলায় আমারও ভূতে বিশ্বাস জন্মেছিল । রাতে একা ঘর থেকে বের হতে ভয় পেতাম। স্কুলের পাঠ্য বইয়ে শরৎচন্দ্র পড়ার পর আমার ভূতের ভয় ধীরে ধীরে উবে গেল। শ্রীকান্ত যখন সারা রাত শ্মশানে কাটিয়ে এল এবং কোন প্রকার ভূতের আগমন ঘটল না, তখন আমার বদ্ধমূল ধারণা হল ভূত বলে কিছু নেই। কারণ আমি শ্রীকান্তের শ্মশান গমনকে সত্য জ্ঞান করেছিলাম, এটি যে নিছক গল্প ছিল তা আমার মনে হয় নি।

মা বলত ভূতের ছায়া থাকে না। তাই দিনের বেলা অপরিচিত মানুষ দেখলে প্রথমে খেয়াল করতাম তার ছায়া আছে কিনা। ছায়া দেখে নিশ্চিত হতাম মানুষ। তবে কখনও ছায়াহীন কাউকে দেখিনি। “মধ্যদুপুর খুব আশ্চর্য সময় তখন মানুষের ছায়া পড়ে না ।” হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমুর মধ্যদুপুর’ বইয়ে এরকম একটি কথা আছে। তিনি লিখলেন-‘ এখন মধ্যদুপুর । আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমার হাতে দুপুরমণি গাছের চারা । অপেক্ষা করছি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের যখন আমার ছায়া পড়বে না এবং দুপুরমণি গাছে ফুল ফুটবে।”

মধ্যদুপুরে কি বস্তুর ছায়া পড়ে না ? অলৌকিক ব্যাপার নয় তো ? আমি বহুদিন ভেবেছি ছায়াহীন কায়া কেমন হতে পারে। ভাবতে ভাবতে কখন যে বিমূর্ত দুপুরে মনের আয়নাতে তোমার ছায়া পড়েছিল তা আজও রয়ে গেছে। কেবল তুমি নেই হয়ে গেছ বাংলাদেশের পুরানো নদীর মত। তবে ছায়াটুকু আছে বলেই এখনও ভাবতে ভাল লাগে তুমি আগের মতই আছ, শুধু বদলে গেছে পরিবেশ। যখন ছায়াস্বপ্নে বিভোর ছিলাম, হঠাৎ একটি সংবাদ আমার বিস্ময়কে উসকে দিল বহুগুণ। সংবাদে মক্কার কাবা শরীফের ছবি ট্যাগ করে বলা হল-মধ্যদুপুরে ছায়াহীন কাবা শরীফের ছবি। শুধু ভূত নয়, দুপুরে যে কাবা শরীফেরও ছায়া পড়ে না এটা জলজ্যান্ত প্রমাণ। অবাক করা বিষয় হল একটি নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীর একটি স্থানে বস্তুর ছায়া পড়ল না কিন্তু অন্য স্থানে একই সময়ে বস্তুর ছায়া পড়ল। বিষয়টা কৌতূহল উদ্দীপক।

ভাবছিলাম ছায়া কেন পড়ে ? আলোর ধর্ম হচ্ছে আলো সরল রেখায় গমন করে। আলো চলার পথে কোন বস্ত দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হলে বস্তুর বিপরীত দিকে তার ছায়া পড়ে। পৃথিবীর পৃষ্টদেশে সূর্য রশ্মি একই সরল রেখায় পতিত হয়। তাহলে ধরে নিতে হয় পৃথিবীর কোন স্থানে বস্তুর ছায়াহীন অবস্থার অন্য কোন কারণ আছে।

মহাবিশ্বের তুলনায় পৃথিবীকে অতি ক্ষুদ্র জগত বলা যায় । খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে আলেকজান্দ্রিয়ার বিজ্ঞানীরা প্রথম ছায়াহীন ব্যাপারটি আবিষ্কারটি করেন। সে সময়ে এরাটোসথেনেস নামক এক ব্যক্তি আলেকজান্দ্রিয়ায় বাস করতেন। তাঁর সমসাময়িক একজন ব্যক্তিত্ব তাঁকে বিটা ( β ) বলে ডাকতেন। বিটা গ্রীক বর্ণমালার দ্বিতীয় বর্ণ । তিনি বলেছিলেন- এরাটোসথেনেস পৃথিবীতে সর্ব বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ। কিন্তু তাঁর কর্ম এ কথাই মনে করিয়ে দেয়, এরাটোসথেনেস ছিলেন সর্ব বিষয়ে আলফা ( α ) অর্থাৎ প্রথম। তিনি ছিলেন একাধারে জ্যোতির্বিদ, ভূগোলবিদ, দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, ইতিহাসবিদ, কবি ও নাট্য-সমালোচক। এস্ট্রোনমি, পেইন, অন ফ্রিডম ছিল তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এক সময় তিনি বিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরীর পরিচালকের দায়িত্বও পালন করেন। একদিন তিনি একটি প্যাপিরাসের পুস্তকে পড়লেন যে, সায়েন এর দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্তের বসতিতে, নীল নদের প্রথম খাড়া জলপ্রপাতের কাছে, ২১ জুনের এক মধ্যদুপুরে একটি উলম্ব লাঠির কোন ছায়া পাওয়া যায় না। উত্তরায়ণের দিনে যা বছরের দীর্ঘতম দিন, যখন সময় নিঃশব্দে এগিয়ে যায় মধ্য দিবসের দিকে, মন্দিরের ছায়া সমূহ হয়ে আসে হ্রস্ব। মধ্যদুপুরে এরা সম্পূর্ণভাবে মিলিয়ে যায়। তখন প্রতিফলিত সূর্যকে দেখা যেত একটি গভীর কূপের তলদেশে। সূর্য তখন থাকত মাথার উপরে খাড়া।
এই ঘটনা সাধারণ বিষয় মনে করে অনেকে হয়ত উপেক্ষা করে যেত। লাঠি, ছায়া, কূপের মধ্যে প্রতিফলন, সূর্যের অবস্থান- এইসব দৈনন্দিন সাধারণ বিষয়ের কি এমন সম্ভাব্য গুরুত্ব থাকতে পারে ? কিন্তু এরাটোসথেনেস ছিলেন একজন বিজ্ঞানী। এইসব সাধারণ বিষয়ের উপর তাঁর গভীর ভাবনা পাল্টে দিল পৃথিবীকে। অর্থাৎ পৃথিবীকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিল। সত্যিকার অর্থে এরাটোসথেনেস একটা পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলেন যে, আলেকজান্দ্রিয়াতে ২১ জুনের মধ্যদুপুরে একটি উলম্ব লাঠি ছায়া প্রদান করে কিনা। পরীক্ষার পর তিনি আবিষ্কার করলেন, লাঠি ছায়া দিচ্ছে।
এরাটোসথেনেস নিজেকে প্রশ্ন করলেন কীভাবে, একই সময়ে সায়েনে একটি লাঠি ছায়া প্রতিফলিত করছে না এবং অনেক উত্তরের দিকে অবস্থিত আলেকজান্দ্রিয়াতে লাঠি সুস্পষ্ট ছায়া প্রতিফলিত করছে। প্রাচীন মিশরের একটি মানচিত্র বিবেচনা করুন, যেখানে থাকবে দু’টি সমদৈর্ঘ্যের উলম্ব লাঠি, একটি স্থাপিত হল আলেকজান্দ্রিয়াতে এবং অপরটি সায়েনে। মনে করুন, একটি বিশেষ মুহূর্তে কোন লাঠিই কোন ছায়া প্রক্ষিপ্ত করছে না। এটি সহজে বোধগম্য হত যদি ভূপৃষ্ট সমতল হত। তখন সূর্য থাকত খাড়া মাথার উপরে। যদি দু’টি লাঠি সমদৈর্ঘ্যের ছায়া প্রদান করত, সেটিও একটি সমতল ভূপৃষ্টের ধারণাকে প্রকাশ করত। তখন সূর্য-রশ্মি দু’টি লাঠিতেই আনত থাকত সমান কোণে। কিন্তু এটি কি করে ঘটল যে, একই সময়ে সায়েনে কোন ছায়া পাওয়া গেল না, অথচ আলেকজান্দ্রিয়াতে পাওয়া গেল যথেষ্ট উল্লেখযোগ্য ছায়া

এরাটোসথেনেস বুঝতে পারলেন, এর একমাত্র সম্ভাব্য উত্তর হল এই যে, পৃথিবীর পৃষ্টটি বক্র। শুধু তাই নয় বক্রতা যত বেশি হবে, ছায়ার দৈর্ঘ্যের পার্থক্যও তত বেশি হবে। সূর্য পৃথিবী থেকে এত দূরে অবস্থিত যে, যখন এর রশ্মিসমূহ ভূপৃষ্টে এসে পৌঁছায়, তখন তা সমান্তরাল থাকে।

সূর্য রশ্মির সাথে বিভিন্ন কোণে স্থাপিত লাঠিসমূহ বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের ছায়া প্রক্ষিপ্ত করে। ছায়ার দৈর্ঘ্যে পর্যবেক্ষণকৃত পার্থক্যের জন্য, ভূ-পৃষ্ট বরাবর আলেকজান্দ্রিয়া ও সায়েনের মধ্যে কৌণিক দূরত্ব সাত ডিগ্রী হতে হবে ; অর্থাৎ আপনি যদি লাঠিসমূহকে ভূ-কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত বলে কল্পনা করেন, তবে তারা সেখানে সাত ডিগ্রী কোণে পরস্পরকে ছেদ করবে।

সাত ডিগ্রী, পৃথিবীর পরিধি, তিনশ ষাট ডিগ্রী-এর মোটামুটি ভাবে একপঞ্চমাংশ। এরাটোসথেনেস জানতেন আলেকজান্দ্রিয়া ও সায়েনের মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৮০০ কিলোমিটার। তিনি পূর্বেই দূরত্ব পরিমাপের জন্য একজন লোক নিয়োগ করেছিলেন। ৮০০ কিলোমিটারকে ৫০ দ্বারা গুণ করলে ৪০০০০ কিলোমিটার হয় ; সুতরাং অবশ্যই এটি হবে পৃথিবীর পরিধি। কি অবাক কান্ড ! এরাটোসথেনেস লাঠির সাহায্যে পরীক্ষা করেই বের করে ফেললেন পৃথিবীর পরিধি। অবশ্য তাকে সাহায্য করেছিল তাঁর চোখ, হাত-পা ও মস্তিষ্ক এবং পরীক্ষণের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ। তাঁর এই আবিষ্কারে ত্রুটির পরিমাণ ছিল মাত্র কয়েক শতাংশ । ২২০০ বছর পূর্বে এটি ছিল এক উল্লেখযোগ্য অর্জন। কোন গ্রহের আকৃতি সঠিক ভাবে পরিমাপ করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন প্রথম ব্যক্তি।

পূর্বেই বলেছি ছায়া ও ছায়াহীনতা অলৌকিক কোন বিষয় নয় । ভূ-পৃষ্টের বক্রতা এর জন্য দায়ী । ২১ জুন মধ্যদুপুরে মিশরের সায়েনের ছায়াহীন মন্দির ও আরবের মক্কার ছায়াহীন কাবা শরীফের ঘটনার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই । তবে ছায়া বিম্বিত হওয়া ভাল । কারণ ছায়া মানুষের জন্য উপকারী । ক্লান্তির বিশ্রামের জন্য মানুষ সামান্যতম ছায়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়ে । আর ছায়া আছে বলেই নিজেকে মানুষ বলে মনে হয় ; অন্যথায় নিজেকে ভূত ভেবে চমকে উঠতাম । আর মনের আয়নাতে যদি কারো ছায়া পড়ে, সে দাগ হয় চিরন্তন । তাই ফেরদৌসি রহমানের গানে গানে বলে যাই- যার ছায়া পড়েছে, মনের অ আয়নাতে / সে কি তুমি নও ?
-----------
সূত্র- কসমস / কার্ল সাগান

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১২:২৯

ফয়সাল রকি বলেছেন: মন্দ বলেননি। ছায়া না থাকলে নিজেকে দেখে ভূত বলে সন্দেহ হতেও পারে!

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:০৩

আসোয়াদ লোদি বলেছেন: তাই তো মানুষকে বলতে শুনি আমাকে ভূতের মতো লাগতেছে, এই জাতিয় কথা।

২| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৮:০০

জুল ভার্ন বলেছেন: খুব কঠিন কঠিন লেখা - মাথার উপ্রে দিয়া গেল! +

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৫৫

আসোয়াদ লোদি বলেছেন: বিজ্ঞান আমারও কঠিন লাগে

৩| ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৪৬

রাজীব নুর বলেছেন: আমি একজন আধুনিক মানুষ। কোনো কুসংস্কারে আমার বিশ্বাস নেই।
তবে আমি ভূত বিশ্বাস করি। ভূত থাকলে থাকুক। সে তো কোনো ক্ষতি করছে না।

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৫৭

আসোয়াদ লোদি বলেছেন: মানুষ থাকলে ভূতও থাকবে। মানুষের অতৃপ্ত আত্মা নাকি ভূত হয়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.