নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বসে আছি অন্ধকারে, \nআমাকে বুঝতে দাও \nমানুষ কেন আলোর \nপ্রত্যাশা করে!

আসোয়াদ লোদি

জীবন ও যন্ত্রণার মরুচরে আমি প্রপাতের ধারা ।

আসোয়াদ লোদি › বিস্তারিত পোস্টঃ

শরণার্থী

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:৩৩


তুমব্রু সীমান্তের নো ম্যান্স ল্যান্ডে দশ বারোটা রোহিঙ্গা পরিবার দুদিন ধরে অপেক্ষা করছে। সুযোগ পাচ্ছে না বাংলাদেশে প্রবেশ করার। বিজিবি সদস্যরা আগের চেয়ে কড়াকড়ি অবস্থান নিয়েছে। ঢালাও ভাবে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। ইতিমধ্যে কুতুপালং ক্যাম্পে পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে শরণার্থীর সংখ্যা। প্রতিদিন কোন না কোন পথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার তারা। প্রাণ বাঁচাতে স্বদেশের মায়া ছেড়ে পালিয়ে আসছে বাংলাদেশে।
মর্জিনাদের পরিবারও আটকা পড়েছে নো ম্যান্স ল্যান্ডে। তার বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তারা চাচার সহায়তায় পালিয়ে এসে প্রাণে রক্ষা পেয়েছে। মর্জিনারা তিন বোন দুই ভাই। মর্জিনা সবার বড়। তার বয়স অনুমান করা কঠিন। ষোল আঠারো হবে নিশ্চয়। অসাধারণ রূপসী সে। তার মা আবার পোয়াতি হয়েছে। মাঝে মাঝে হাল্কা হাল্কা প্রসব ব্যাথা টের পাচ্ছে নূরজাহান। যে কোন মুহূর্তে তার প্রসব হতে পারে।
 
দুই দিন পার হয়ে গেল। নো ম্যান্স ল্যান্ডের ঘাসের উপর বসে আছে মর্জিনারা। মাথার উপর খোলা আকাশ। চোখে অনিশ্চিত জীবনের শঙ্কা। পেটে ক্ষিধে। সঙ্গে খাবার যা ছিল ইতিমধ্যে তা শেষ। ছোট ভাইবোনেরা ক্ষিধের যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। নূরজাহান একটা বস্তায় হেলান দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস টানছে। মর্জিনা তাকিয়ে আছে সীমান্তের দিকে। বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁসে বয়ে গেছে ছোট্ট একটি খাল। খালের পর ধানক্ষেত। মাঠের পর মাঠ সবুজ আর সবুজ। অবিরাম বাতাসের দোলায় কাঁপছে ধানগাছের পাতাগুলো। মর্জিনার কেন জানি ইচ্ছে করে সেই সবুজের মাঠে দৌড়াতে। তার কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়। প্রচন্ড কষ্টের মাঝেও তার সুখের আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে উঠে। এমন সময় প্রচন্ড আওয়াজ ভেসে আসে মিয়ানমার সীমান্তের দিক থেকে। সবাই উৎকণ্ঠিত মনে সেদিকে তাকায়।
 
আবদুল্লাহ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ঘাসের উপর বসে পড়ল। সে দুই দিন ধরে অনেক ছুটাছুটি করল দালালের পিছনে। কিন্তু কোন দালাল রাজী হলো না বর্ডার পার করিয়ে দিতে। সবারই একই কথা-‘এখন কড়াকড়ি, সবুর কর’। আবদুল্লাহ হতাশ হয়ে পড়েছে। কী উপায় হবে কোন কিছু বুঝতে পারছে না। সে বিড়ি ধরায়। জোরে জোরে বিড়িতে টান মারে। মর্জিনা সরে আসে আব্দুল্লাহর কাছে। জিজ্ঞেস করল- ‘কীসের আওয়াজ চাচা’ ?
‘মিয়ানমার সীমান্তে মাইন ফুটছে’। আবদুল্লাহ নির্বিকার ভাবে উত্তর দিল।
 
মর্জিনা বুঝতে পারে নিশ্চয় কারো না কারো হাত-পা উড়ে গেছে মাইনের আঘাতে। মাইন যে কতো ভয়ঙ্কর তা সে ছোটবেলায় জেনেছিল। তার বয়স যখন দশ বছর, তখন একবার শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসেছিল সে। সীমান্ত পার হওয়ার সময় একটা বিকট শব্দে মাইন ফুটেছিল। অনেকের হাত-পা টুকরো টুকরো হয়ে মাটিতে পড়েছিল। সেদিন কী যে ভয় পেয়েছিল মর্জিনা তা আজো ভুলতে পারে না। এবারও মায়ানমার সেনাবাহিনী সীমান্তে মাইন পুঁতে রেখেছে, এরকম একটা কথা সে আগেই শুনতে পেয়েছিল লোকজনের মুখে। শুনেছে সোনামিয়া কুতুপালং ক্যাম্পে আছে। মাইনের আঘাতে তার একটা পা কাটা গেছে। প্রায় এক মাস আগে তারা নৌকা নিয়ে নাফ দরিয়া দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। সোনামিয়ার কথা মনে পড়তেই মর্জিনার মনটা হু হু করে উঠে। সোনামিয়া বলেছিল-আগামি বৈশাখে মর্জিনাকে বৌ সাজিয়ে ঘরে তুলবে। কিন্তু সবকিছু কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেল।মর্জিনা অনেক ভেবে-চিন্তে দেখেছে পঙ্গু সোনামিয়াকে বিয়ে করতে তার মন কিছুতেই সায় দেয় না। এই দুর্বিসহ জীবনের ভার সারাজীবন বয়ে বেড়াতে সে রাজী নয়। একদা সে সোনামিয়াকে ভালোবাসতো কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। অদৃশ্য নিয়তি তাদের মাঝে বিচ্ছেদের দেয়াল তোলে দিয়েছে। এই দেয়াল সে আর ভাঙ্গতে চায় না। ভাগ্যের সাথে যুদ্ধ করার শক্তি তার আর অবশিষ্ট নেই। এখন স্রোতে ভেসে যাওয়া শ্যাওলার মতো তার জীবন। কোন গন্তব্য নেই। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে সে। মর্জিনা আর কিছু ভাবতে পারে না। তার চোখের কোণ ভিজে আসে।
আবদুল্লাহ বলে উঠল-যাই, দেখি কিছু খাবার যোগাড় করতে পারি কিনা। শুনতেছি এনজিও এর লোকেরা নাকি ত্রাণ নিয়ে আসবে। আবদুল্লাহ উঠে হনহন করে হাঁটা দিল। এমন সময় প্রসব ব্যথায় ককিয়ে উঠে নূরজাহান। মাগো মাগো বলে হাত-পা ছুড়তে থাকে। মর্জিনা মায়ের কাছে ছুটে যায়।
 
সন্ধ্যা নাগাদ আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। হঠাৎ হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে গাছপালাকে প্রচন্ড নাড়িয়ে দিয়ে গেল। মাঝে মাঝে আকাশ ফর্সা করে বিজলীর আলো জ্বলে উঠছিল। রাত গভীর হতেই নূরজাহানের প্রসব ব্যথা তীব্র হয়ে উঠল। তখনই শুরু হল বৃষ্টি।
খোলা আকাশের নিচে প্রবল বৃষ্টিপাতের ভেতর নূরজাহান জন্ম দিল এক পুত্র সন্তান। বৃষ্টির শব্দ আর নবজাতকের কান্না একাকার হয়ে গেলেও খবরটা চাওর হয়ে গেল নো ম্যান্স ল্যান্ডে আটকে পড়া লোকদের মধ্যে। অনেকেই ছুটে এলো শিশুটিকে এক নজর দেখার জন্য। তখন একটা গুঞ্জনও শুনা গেল এই শিশুর নাগরিকত্ব নিয়ে। কেউ কেউ বলল-‘এই শিশুর দেশ হবে মিয়ানমার। কেউ কেউ দাবী করল বাংলাদেশ বলে। ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন বলে উঠল- এই শিশুর কোন দেশ নেই’। কথাটা মর্জিনার মনে প্রচন্ড এক ধাক্কা দিল। সত্যিই তো এই শিশুর কোন দেশ নেই ! আসলে রোহিঙ্গাদেরই তো কোন দেশ নেই। মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিকত্ব স্বীকার করেনা। বাংলাদেশে তারা শরণার্থী। তাহলে তাদের দেশ কোথায় ? এই প্রশ্ন মর্জিনার মনে বহুবার এসেছে। এই অস্তিত্বের সংকট থেকে পরিত্রাণের কোন উপায়ও তার জানা নেই। সে যখন দশ বছর বয়সে শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে এসেছিলো, তখন শুনেছিল এরকম অস্তিত্বের সংকটে নাকি এক সময় বাঙালিরাও পড়েছিল। মর্জিনা এই প্রথম শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছিলো। যিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন আর বাঙালিরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। অনেক রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ হয়েছে। মর্জিনা বুঝতে পারে রোহিঙ্গাদের মাঝে একজন শেখ মুজিবের আশু প্রয়োজন যার ডাকে তারা সংঘটিত হতে পারে। কিন্তু সেরকম নেতা তাদের কই, যিনি মুক্তির পথ দেখাতে পারেন। না, তেমন কেউ নেই। এক প্রকার হতাশার মাঝে ডুবে থাকে মর্জিনা।

শিশুটি সারাক্ষণ কাঁদছে। বৃষ্টির তোড় কমে এলোও একেবারে থেমে যায়নি। মর্জিনা পুরানো চাদর দিয়ে শিশুটিকে মুড়িয়ে রেখেছে, যাতে বৃষ্টির হাত থেকে শিশুটি রক্ষা পায়। আবদুল্লাহ বাঁশের খুঁটি গেড়ে পুরানো কাপড় দিয়ে একটা তাঁবু বানানোর চেষ্টা করছে। শিশুটির একটা আশ্রয় দরকার। এভাবে বৃষ্টিতে ভিজলে শিশুটির জীবন বিপন্ন হতে পারে। নূরজাহান শিশুটিকে কোলে তুলে নেয়। শিশুটি চোখ বন্ধ করে স্তন টানে। মর্জিনা মায়ের মুখে কিছু শুকনো খাবার তুলে দেয়। বাচ্চা প্রসবের পর থেকে মুখে কোন দানাপানি পড়ে নাই। প্রসবের ধকল সয়ে শরীর অনেক দুর্বল হয়ে গেছে নূরজাহানের। এখন তার পর্যাপ্ত খাবার দরকার, বিশ্রাম দরকার। মর্জিনা অসহায়ের মতো মায়ের দিকে তাকায়। নূরজাহানের গলা শুকিয়ে আসে। সে পানি চায় মেয়ের কাছে।
‘পানি দে মর্জিনা, পানি খাব।’
মর্জিনা বোতলে বৃষ্টির পানি জমিয়েছিল। সেখান থেকে একটি বোতল মায়ের দিকে এগিয়ে দেয়। ‘লও পানি খাও।’
আব্দুল্লাহ এসে বলল-‘ভাবী কাপড় দিয়া ছোট একটা ঘর বানাইলাম। তুমি পোলাটারে লইয়া সেখানে ডুইক্যা পড়। আবার বৃষ্টি হইতে পারে। মেঘ কাটে নাই’।
 
নূরজাহান শিশুটিকে নিয়ে তাবুর মধ্যে ঢুকে পড়লো। এতক্ষণ পর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। যাক একটা আড়াল পাওয়া গেছে। ঠান্ডায় শিশুটি কাঁপতেছিল। মনে হচ্ছে জ্বর এসেছে। শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে রাখে নূরজাহান। আজ স্বামীর কথা খুব মনে পড়ছে তার। এতদিন স্বামীর মৃত্যু শোক চাপা দিয়ে রেখেছিল। আজ সব বাঁধা ভেঙ্গে তার দু’চোখ ভরে উঠলো জলে। কী নির্মমভাবে হত্যা করেছে তার স্বামীকে। একজন জ্যান্ত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে মারার মতো বীভৎসতা আর কী হতে পারে ! তাদের বসতবাটী আগুনে পুড়িয়ে শ্মশান বানিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সহায় সম্বল বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা করেছে। সবচেয়ে বেশি ভয় তার মর্জিনাকে নিয়ে। যুবতী মেয়ে কখন কোন বিপদে পড়ে যায়, এরকম একটা শংকা সবসময় তার মনে ঘুরতে থাকে।

শিশুটি আবার কেঁদে উঠে। কিছুতেই স্তন টানতে চাচ্ছে না। জোরে শ্বাস নিচ্ছে। জ্বর আগের চেয়ে বেড়েছে। মনে হচ্ছে নিউমোনিয়া। নূরজাহান মর্জিনাকে ডাক দেয়। ‘অ মর্জিনা, এদিকে আয়।’
মর্জিনা এসে তাঁবুতে উঁকি দিল। বলে, ‘কী জন্যে ডাকছ’ ?
‘আব্দুল্লাহকে বল ছেলেটার জন্য অষুধ যোগাড় করতে। খুব জ্বর !’

মর্জিনা দ্রুত ছুটতে থাকে লোকজনের ভিড়ের দিকে। খুঁজতে খুঁজতে একসময় চাচাকে পেয়ে যায়। আব্দুল্লাহ তখন একজন লোকের সঙ্গে তর্কাতর্কিতে লিপ্ত ছিল। দুজনেই খুব উত্তেজিত, মারমুখি অবস্থা। তবে কী নিয়ে ঝগড়া মর্জিনা বুঝতে পারে না। তার খুব ভয় হয়। সে নীরবে তাকিয়ে থাকে চাচার দিকে। আব্দুল্লাহ মর্জিনাকে দেখে ঝগড়া থামায়, এগিয়ে আসে মর্জিনার দিকে। মর্জিনা বলল-‘ছোট ভাইয়ের খুব জ্বর। মা বলছে অসুধ যোগাড় করতে’।
‘এখানে অসুধ কোথায় পাব ? তেল মালিশ করতে বল।’ আব্দুল্লাহকে তখনও উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। মর্জিনা তাঁবুতে ফিরে এসে শিশুটির শরীরে তেল মালিশ করতে লাগল। শিশুটি ঘুমাচ্ছে। মর্জিনার খুব মায়া লাগে। ইচ্ছে করছে কোলে তোলে নিয়ে আদর করতে কিন্তু ঘুম ভেঙ্গে যাবে বলে সে তার ইচ্ছেটাকে নিবৃত্ত করল। একটু পর আব্দুল্লাহ এলো। সে একজন মৌলভীর কাছ থেকে এক বোতল পানিপরা ও একটি তাবিজ এনেছে শিশুরটির জন্যে। মর্জিনাকে বলল- ‘ধর, তাবিজটা হাতে বেঁধে দে আর পানিপরা খাওয়াতে থাক। হুজুর গ্যারান্টি দিছে দুই দিনের মধ্যে জ্বর সেরে যাবে’। মর্জিনা শিশুর হাতে তাবিজ বেঁধে দেয় আর চামশ দিয়ে একটু একটু করে পানিপরা খাওয়াতে থাকে।
দুই দিনের মধ্যে নো ম্যান্স ল্যান্ডে প্রায় দশ হাজার লোকের জমায়েত হল। খুবই মানবেতর অবস্থায় দিন পার করছিল তারা। ইতিমধ্যে গুঞ্জন শুনা গেল কাল পরশুর মধ্যে বর্ডার খুলে দিতে পারে বিজিবি। খবরটা শুনে মর্জিনা কিছুটা স্বস্থি পেল। সে খালের পারে এসে বসে। ছোট্ট খাল। কোমর সমান জল। জল স্বচ্ছ নয়, ঘোলাটে। খালটি পার হলেই বাংলাদেশ। খেয়া নৌকা আছে। কোমর সমান জল, হেঁটেও পার হওয়া যায়। মর্জিনা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ থেকে আর ফিরে আসবে না মিয়ানমার। নিজের দেশকে তার অভিশপ্ত মনে হয়। যেখানে নেই কোন মানবাধিকার। নেই বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র অধিকার। কী দুর্বিষহ জীবন রোহিঙ্গাদের! শিক্ষা নেই, চিকিৎসা নেই ; এমন কী নেই কোন প্রকার সামাজিক উন্নয়ন। এক অর্থহীন জীবন বয়ে বেড়ানো ছাড়া এই জীবনের আর কিবা অর্থ আছে ?এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা মর্জিনারও আছে। কে চায় স্বদেশের মাটি ছেড়ে যেতে ? যে মাটিতে জন্ম, বেড়ে উঠা তাকে ত্যাগ করা সহজ নয়। কিন্তু মর্জিনা নিরুপায়। তার সামনে নেই কোন আশা ও উদয়। তাই সে সমস্ত আবেগ দমন করে পালাতে চায়। খুঁজে নিতে চায় আপন পথ। ভাগ্য তাকে কোথায় টেনে নিয়ে যাবে জানে না। তার দুচোখ জুড়ে জেগে আছে বাংলাদেশ। চিরসবুজের এই দেশ তাকে স্বপ্ন দেখায়। এই দেশ থেকে শুরু হবে তার নতুন পথ চলা। এই পথ যত বন্ধুর হোক তাকে পাড়ি দিতে হবেই। এই প্রত্যয়ে মর্জিনা তাকিয়ে থাকে বাংলাদেশের দিকে।
সীমান্ত খুলে দেওয়ার দিন সকালে শিশুটি মারা গেল। মৌলভীর দেওয়া তাবিজ-পানিপরা কোন কাজে আসল না। যারা শিশুটির নাগরিকত্ব নিয়ে বিতর্ক তুলেছিল তারা একদম চুপ হয়ে গেল। হয়ত কোন কোন মৃত্যু সহজ সমাধান নিয়ে আসে। এই শিশুর মৃত্যুও ছিল তাই। আব্দুল্লাহ কয়েকজন লোকের সহায়তায় নো ম্যান্স ল্যান্ডের একটা ছোট ঝোপের আড়ালে শিশুটিকে কবর দিল।
উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে মর্জিনারা যখন এসে পৌছাল তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সারাটা পথ নূরজাহান পুত্র শোকে মুহ্যমান ছিল। মর্জিনার চোখও ভিজে যাচ্ছিল বারবার। ক্যাম্পে নতুন লোক আসলে পুরানো লোকেরা উৎসুক্য হয়ে খুঁজতে থাকে তাদের আত্মীয়স্বজন কিংবা পরিচিতদের। এরকম খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে মর্জিনা দূর থেকে দেখতে পায় সোনামিয়াকে। সোনামিয়া ক্রাচে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছে। মনে হচ্ছে সে কাউকে খুঁজছে। তৎক্ষনাৎ মর্জিনা মানুষের ভিড়ের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নেয়। সে কিছুতেই সোনামিয়ার মুখোমুখি হতে চায় না। নতুন কোন ঝামেলায় জড়াতে চায় না সে।
ক্যাম্পে এসে কিছুদিনের মধ্যে আব্দুল্লাহ অন্য মানুষ হয়ে গেল। জড়িয়ে পড়ল একটা দালাল গ্রুপের সঙ্গে, যারা মালয়েশিয়ায় লোক পাচার করে। আব্দুল্লাহর প্রথম টার্গেট মর্জিনা। তাকে পাচার করতে পারলে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে। মর্জিনাকে সে মালয়েশিয়ার গল্প শুনায়। উন্নত জীবনের লোভ দেখায়। বলে, ‘সেখানে সুখ আর সুখ। অনেক টাকা কামাতে পারবি। তোর অনেক টাকা হবে’।
 
আব্দুল্লাহর পাতা ফাঁদে পা দেয় মর্জিনা। কিন্তু তার দু’চোখ জুড়ে স্বপ্ন। সে চিন্তা করে এটাই তার জন্যে সুযোগ নিজের ভাগ্যকে বদলানোর। একদিন রাতের অন্ধকারে খুব সন্তর্পণে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসে মর্জিনা।
 
 


মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:০২

রাজীব নুর বলেছেন: শরনার্থীদের জীবন কষ্টের জীবন।
এই জীবন যেন আল্লাহ কে কেউ না দেয়।
শরনার্থীদের জীবন নিয়ে একদল ব্যবসা করে।

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৯ সকাল ৮:০২

আসোয়াদ লোদি বলেছেন: আসলে তাই সীমাহীন দুর্ভোগ এই জীবনে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.