নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একটি সময় ছিলো যখন এদেশে বংশীয় মর্যাদার একটি ব্যাপক কদর ছিলো। বিয়ে-সাদি, চাকুরি-বাকরি, অর্থনৈতিক লেনদেনসহ এমনকি গৃহ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও ব্যক্তির বংশ এবং সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি বিবেচিত হতো। প্রাচীন যুগে এই বংশ মর্যাদার ভিত্তি গড়ে উঠেছিলো ধর্মীয় শ্রেণিবিন্যাসের মাধ্যমে। সে যুগে হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদ আর মুসলিম সমাজে আশ্রাফ-আত্রাফে পরিচিত হতো সমাজের কৌলীন্যতা। মুসলিম নামের আগে সৈয়দ আর উচ্চ বংশীয় হিন্দু নামের আগে ব্রাহ্মন্যবাদি উপাধি দ্বারা উচ্চ বংশের সংশ্লিষ্ঠাতা জাহির করা হতো।কালের বিবর্তনে ব্রিটিশ যুগে সেই বংশ মর্যাদায় যুক্ত হয়েছিলো শিক্ষা আর ব্রিটিশ অনুগত্যের মাপকাঠি। ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত বাবু শ্রেণী পেয়েছিলো ‘ভদ্রলোক’ নামের সামাজিক তকমাটি। শহুরে ও ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী এ গোষ্ঠী ছাপিয়ে গেছিলো ধর্মীয় বংশ পরম্পরায় কৌলীন্যতা বজায় রাখা একটি গোষ্ঠীকে। এই শিক্ষিত গোষ্ঠীই পরবর্তীতে এ অঞ্চলের সমাজ পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দ্বায়িত্ব পালন করে আসছিলো।এ ধারা চলেছে আরো বেশ কিছুদিন, এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম যুগ পর্যন্ত।
কিন্তু গত ২০-৩০ বছরে এই উচ্চ বংশ মর্যাদার কদরের ব্যাপক পতন হয়েছে। নব্য ধনিকশ্রেণী আর আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়াদের দোউরাত্বে উচ্চ বংশীয় মানুষজনের কৌলীন্যতা বিবর্ণ হয়ে পরেছে। যেখানে ক্ষমতার সন্নিকটে থেকে এক প্রজন্মে হাজার কোটি টাকা বানিয়ে ফেলা লোকজন হাতে রোলেক্স ঘড়ি পড়ে জানান দিচ্ছে নিজের সামাজিক মর্যাদা, সেখানে তিন-চার প্রজন্মের শিক্ষিত উচ্চবংশীয় মানুষ মুখ লুকিয়ে টিকে আছে কোন ক্রমে।
এবারের কোরবানির ঈদে যে বিষয়টি প্রথমারের মতো সারা জাতিকে নাড়া দিয়েছিলো তা হল উচ্চ বংশীয় গরু-ছাগলের অভাবনীয় একটি তত্ত্ব। সাদিক এগ্রোর এই চটকদারি মার্কেটিং ফর্মুলা সাধারণ মানুষজন ভালোভাবে না নিলেও, থেমে থাকেনি উচ্চ বংশীয় পশু বিক্রির প্রচেষ্টা। ছাগল, গরু – ২টিই অস্বাভাবিক দামে প্রায় বিক্রি হয়ে গেছিলো। প্রথমবারের মতো মানুষ জানতে পারলো উচ্চ বংশীয় গরু বলে একটি ব্যাপার আছে যার বাংলাদেশে বাজার মূল্য ১ কোটি টাকাও হতে পারে!
অপরদিকে ‘অতি উন্নত জাতের’ ছাগল বিক্রির রেশে ঘটে গেলো লঙ্কা কাণ্ড। এনবিআর কর্মকর্তা মতিউরের গুণধর ছেলে বাবাকে খুশি করার জন্য ১২ লক্ষ টাকায় যে ছাগলটি কিনতে চেয়েছিল, সেই ছাগলটিই হলো তার বাবার পতনের কাল। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হওয়ার মতো ছাগল কিনতে গিয়ে বের হয়ে এলো একজন সরকারি চাকুরীজীবীর কোটিপতি জীবনের মুখরোচক কাহিনী। নিকট অতীতে পৃথিবীর কোন দেশের ইতিহাসে একটি ‘উচ্চ বংশীয় ছাগল’ এভাবে একজন কোটিপতির সামাজিক ‘বেইজ্জতি’ কখনো করেছিলো কিনা তা আমার জানা নেই। সম্ভবত গিনেজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্থান পাওয়ার মতো একটি ঘটনা ঘটে গেছে এবারের ঈদে।
অতি সম্প্রতি এসেছে আরেক উচ্চ বংশীয় ড্রাইভারের কুকীর্তির খবর। এ ড্রাইভার সৈয়দ বংশীয়, নাম সৈয়দ আবেদ আলি। পি এস সির সাবেক চেয়ারম্যানের ড্রাইভার হিসাবে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সাথে হাত মিলিয়ে কামিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। চোখের অন্তরালে এক যুগের বেশি সময় ধরে বিসিএসসহ ৩০টি ক্যাডার ও নন–ক্যাডার পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করে বেড়ালেও কোন রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা নজরে পড়েননি কখনো। অনুসন্ধিতস্যু সাংবাদিকতার অনুসন্ধানে ধরা পড়েছেন সবে মাত্র। কিন্তু ততদিনে উচ্চ বংশীয় সামাজিক স্বীকৃতির যা যা প্রয়োজন তার সবই করে ফেলেছেন জাদুর কাঠির বলে। মাত্র আড়াই বছরে গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নে ১০ একরের বেশি জমি কিনে ফেলেছেন, প্রায় ১ একর জমির ওপর বানিয়েছেন তিন তলাবিশিষ্ট বিলাসবহুল বাড়ি। বাড়ির পাশেই করেছেন মসজিদ, আমবাগান, গরুর খামার ও মার্কেট। ঢাকায় করেছেন গাড়ি-বাড়ি; কুয়াকাটায় কিনেছেন হোটেলের শেয়ার। আলাদীনের চেরাগ পাওয়ার মতো রাতারাতি ‘উচ্চ বংশীয় ড্রাইভারে’ পরিণত হওয়ার এ ঘটনা পৃথিবীতে বিরল।
ক্ষমতার সন্নিকটে থেকে হঠাৎ কোটিপতি বনে যাওয়া মতিউর, আবেদ আলি এবং তাঁদের সহযোদ্ধারা এ যুগের কৌলীন্যতাবাদের নতুন সংযোজন। এ কৌলীন্যতাবাদে শিক্ষা বা ধর্মীয় বংশ মর্যাদার কোন গুরুত্ব নেই। আছে চৌর্যবিদ্যার দক্ষতা আর দলীয় আনুগত্যবাদের প্রভাব। লুটতরাজে পটু এ নব্য গোষ্ঠী বাংলাদেশকে মনে করে সরকারি সম্পত্তি। সরকারি চাকুরীর লাইসেন্সের বদৌলতে আচমকা পেয়ে যাওয়া সামাজিক কৌলীন্যতার উপর ভর করে এরা বনে যান সমাজের নতুন আইডল; কেউ কেউ পান রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচারের প্রত্যয়ন পত্র।
প্রশ্ন হল, উচ্চ বংশীয় ছাগল-গরু কিনতে পারা, কিংবা কানাডার বেগম পাড়ায় অট্টালিকা তৈরি করার মতো কৌলীন্যতা এ নব্য শ্রেণী পেলো কি করে? কি করে দৃশ্যমান আভিজাত্যতা দেখানো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী কিংবা পাতি নেতারা লোকচক্ষুর আলোচনার বাইরে রয়ে গেলো এতদিন ধরে? কিভাবে শিক্ষিত-মার্জিত বংশ পরম্পরায় আভিজাত্যতা বজায় রাখা মানুষগুলো হারিয়ে গেলো সমাজের প্রতিটা স্তর থেকে?
উত্তর খুঁজতে গেলে মুল সমস্যাটা পাওয়া যাবে সেই শিক্ষায়। একটি প্রগতিশীল সমাজের প্রতিটা স্তরে উন্নয়নের মাপকাঠি হিসাবে প্রকৃত শিক্ষা-জ্ঞানকে যেভাবে ছাঁকনযন্ত্র হিসাবে ব্যাবহার করা হয় সামাজিক বিকাশে, তা আমাদের সমাজে আজ আর বলবত নেই। একসময় এ দেশে বোর্ড স্ট্যান্ড করা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে মাতামাতি হতো। অথচ এখন ডিগ্রি অর্জন, শিক্ষা অর্জনের থেকেও সহজলভ্য।লক্ষ লক্ষ জিপিএ ফাইভ, ভুরি ভুরি পিএইচডি। সংখ্যায় বিস্ফোরণ ঘটলেও মানের দিক থেকে এ শিক্ষা দক্ষিণ এশিয়ার তলানিতে। এই শিক্ষায় নৈতিকতার কোন বালাই নেই। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে নকলবাজি আর মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি বা চাকুরীর পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের সুবিধা নেওয়া একটি বৃহৎ শিক্ষিত সমাজ আজ পেয়ে বসছে কৌলীন্যতার সার্টিফিকেট। পরিণতিতে, বাজারে উচ্চ বংশের ছাগলের কদর বাড়ছে, আর সেই ছাগল কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নিম্নবর্গের নব্য অভিজাত শ্রেণী।
©somewhere in net ltd.