নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
Disclaimer:
আলোচ্য ঐতিহাসিক চরিত্রের সাথে, সমসাময়িক বা অন্যকোন যুগের কোন চরিত্রের কোন ধরণের তুলনা এই লেখায় করা হয়নি। কেউ যদি এই ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের সাথে কোন সমসাময়িক ঘটনা প্রবাহের মিল খুঁজে পান, তবে সেই মিল একান্তই কাকতালীয়। এটির জন্য কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।
.........……………………………xxxxxxxxx………………………………………………xxxxxxx……………………………..
পাকিস্তানের ইতিহাসে সবথেকে সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে ধরা হয় আইয়ুব খানকে। পাকিস্তানের সিনিয়র সিটিজেনরা, যারা আইয়ুবের সময় তরুণ ছিলেন, এখনো পাকিস্তান কেমন ছিলো তা বোঝাতে আইয়ুবের উদাহরন টানেন। একটি সামরিক অভ্যুথানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতায় এসেছিলেন।দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে রেখে ১৯৬৯ সালে একটি প্রবল গনঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার পতন হয়। এরপর আরেক সামরিক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি চিরতরে রাজনীতি থেকে বিদায় নেন। যে গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুবের পতন হয়েছিলো, সেই অভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ, আর কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন মওলানা ভাসানি এবং জেলবন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমান।
আইয়ুব খান ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য একটি অদ্ভুত রাজনৈতিক ব্যাবস্থার প্রচলন করেছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন ‘Basic Democracy’ বা মৌলিক গণতন্ত্র। এটি একটি পরোক্ষ নির্বাচন ব্যাবস্থা যেখানে নির্বাচনে জনগণের সরাসরি ভোট দেওয়ার কোন অধিকার ছিলো না, জনগণ ভোট দিতেন Basic Democrats নির্বাচনে। Basic Democrats রা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিতেন। অনেকটা আমেরিকান electoral college স্টাইলের ভোটিং ব্যাবস্থা। দু’ পাকিস্তানে ৪০ হাজার করে সারা পাকিস্তানে ৮০ হাজার Basic Democrats ছিলেন যাদের নির্বাচিত করতেন সাধারণ জনগণ। এই নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে তিনি দুইবার ব্যাপক ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও নির্বাচন ব্যাবস্থা স্বচ্ছ আর অংশগ্রহণমূলক ছিলো না।
তো এই পরোক্ষ নির্বাচন ব্যাবস্থার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা। ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য এই ব্যবস্থার পাশাপাশি আইয়ুব খান ব্যাবহার করেছিলেন প্রশাসন, মিলিটারি এবং ব্যাবসায়ি-শিল্পপতি সমাজকে। প্রশাসনকে অবাধ ক্ষমতা, মিলিটারির বাজেট বৃদ্ধি করে সমাজের সবথেকে সুবিধাভোগী ক্লাসে পরিণত করা আর ব্যাবসায়ি-শিল্পপতিদের একচ্ছত্র বাণিজ্য করার সুবিধা দিয়ে এমন একটি নেক্সাস তিনি তৈরি করে ফেলেছিলেন যেটি ভাঙ্গা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু ইতিহাসে শেষ বলে একটা কথা থাকে— আইয়ুব খানেরও শেষ হয়েছিলো। এরকম প্রবল শক্তিশালী, আইরনম্যান খ্যাত একজন রাষ্ট্রনায়কের পতন হবে, তা বছর খানিক আগ পর্যন্ত কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি। কিন্তু সব হিসাব ওলট-পালট করে আইয়ুবের পতন হয়েছিলো। তবে তার জন্য সব থেকে বেশি মূল্য দিতে হয়েছিলো পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিকে। এক পাকিস্তান টিকে থাকার সম্ভাবনা এক অর্থে আইয়ুব খানই বিনষ্ট করে দিয়ে যান, পরিণতিতে তার প্রস্থানের ২ বছরের মাথায় শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং অভ্যুদয় হয় স্বাধীন বাংলাদেশের। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোয় মিলিটারি ইনভল্ভমেন্টের যে কালচার আইয়ুব তৈরি করে যান, তার ফল কিন্তু পাকিস্তানকে এখনো ভোগ করতে হচ্ছে।
তাহলে কেন পাকিস্তানে এখনো আইয়ুব খান একজন লিজেন্ডারি ফিগার, কেন তাকে দেখা হয় পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ শাসক হিসাবে?
এর প্রধান কারণ ভুরাজনীতি এবং অর্থনীতি। স্নায়ু যুদ্ধের সেই চরম সময়ে আইয়ুব খানের কাছে লোভনীয় ভুরাজনৈতিক প্রস্তাবটি এসেছিলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র আফগানিস্তান সোভিয়েত আর আরেক প্রতিবেশী ভারত Non Aligned Movement এর সদস্য হওয়ায় আইয়ুব খানকে পেতে যুক্তরাষ্ট্র তার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলো ৭০ এর দশকে। আইয়ুব খানও বুঝেছিলেন এর গুরুত্ব। যুক্তরাষ্ট্র আর পাশ্চাত্যের জোট SEATO আর CENTO’র সদস্য হয়েছিলেন, পেয়েছিলেন ব্যাপক আর্থিক আর সামরিক সহযোগিতা যার মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছিলো। তৃতীয় বিশ্বের একজন অসাংবিধানিক সামরিক শাসক আইয়ুব খানকে পশ্চিমারা সেসময়ে কতটুকু সম্মানিত করেছিলো তার দুটি নমুনা দিলাম কমেন্টে। প্রথাগত প্রোটকল ভেঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির বিমানবন্দরে আইয়ুব খানকে রিসিভ করা এবং ব্রিটিশ কুইন এলিজাবেথের রাজকীয় সম্মাননা প্রমাণ করে পশ্চিমাদের কাছে আইয়ুব খানের গুরুত্ব। এরকম সম্মাননা দক্ষিণ এশিয়ার কোন নেতা আজ পর্যন্ত পাশ্চাত্য থেকে পাননি।
ভুরাজনৈতিক এই সুবিধার বলে পাকিস্তানের অর্থনীতিও এসময়ে দ্রুত গতিতে বিকশিত হতে থাকে। আইয়ুবের এই দশবছরে পাকিস্তান এশিয়ার Fastest Growing ইকোনমিতে পরিণত হয়, পাকিস্তানের এভারেজ জিডিপি গ্রোথ হয় ৫.৮% এর উপরে, সব থেকে বেশি গ্রোথ হয় ১৯৬০-৬৬ সালে, প্রায় ৭% করে। ফরেন ইনভেস্টমেন্টও ব্যাপক মাত্রায় আসতে থাকে, বিশেষ করে মার্কিন বিনিয়োগ। এমনকি পাকিস্তানের GNP গ্রোথ এবং পার কাপিটা ইনকামও ভারতকে ছাড়িয়ে যায়। প্রায় ১৫% GNP গ্রোথ করে দিয়ে যান আইয়ুব খান, যেটি পূর্ববর্তী শাসনের প্রায় ৩ গুন। মানে আইয়ুবের শেই ১০ বছরের শাসনে পাকিস্তানের অর্থনীতি ৩ গুন বৃদ্ধি পায়। একারণেই আইয়ুবের এ যুগকে পাকিস্তানে বলা হয়ে থকে “the Great Decade”.
এই “Great Decade” এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো মেগা প্রকল্প। উন্নয়ন শোকেসিং করার জন্য আইয়ুব খান একাধিক মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। তার মধ্যে সবথেকে বড় প্রকল্প ছিলো নতুন রাজধানী ইসলামাবাদ নির্মাণ প্রকল্প যার জন্য সেসময়ে খরচ করেছিলেন বিলিয়ন ডলারের অধিক মুদ্রা। এছাড়া সারা পশ্চিম পাকিস্তান জুড়ে ন্যাশনাল ফ্রিওয়েজ নির্মাণ; ৩টি বৃহৎ জল বিদ্যুতকেন্দ্র, যার দুইটি পশ্চিম পাকিস্তানে আর একটি চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে; ২ টি পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প, যার একটি করাচীতে অন্যটি আমাদের রুপপুরে— যেটির জায়গা অধিগ্রহণ ছাড়া নির্মাণ করা আর সম্ভব হয়নি, ৬০ বছর পর এখন আমরা করতে যাচ্ছি; একগুচ্ছ ইউনিভার্সিটি, সমুদ্রবন্দর, ব্যাপক সংখ্যক সেতু, সামরিক অস্ত্র নির্মাণ কারখানা এখনো— তার এই দশ বছরের উন্নয়নের সাক্ষী হয়ে আছে। এযুগেই মিলিটারি মর্মডানাইজেশনের অংশ হিসাবে পাকিস্তান প্রথমবারের মত সাবমেরিন এবং এফ-৮৬ ও এফ-১৬ ফাইটার বিমান যুক্ত করেছিলো তার বহরে।
এই প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগ অর্থায়ন এসেছিলো পশ্চিমা রাষ্ট্র এবং দাতা সংস্থাগুলো থেকে, যেটি পাকিস্তানকে পরিশোধ করতে হয়েছে কয়েক যুগ ধরে। তবে সাধারণ মানুষজন বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষজন কিন্তু আইয়ুব খানের এই উন্নয়নের ম্যাজিকে তেমনভাবে উপকৃত হয়নি। তার কারণ উন্নয়নের সিংহভাগ সুবিধাভোগী ছিলো সমাজের একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠী।
ভুরাজনীতির সুবিধা নিয়ে আইয়ুব খান যে ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন সেই ম্যাজিকের মূল বেনিফিসিয়ারি ছিলো আসলে ৩টি পক্ষ— আইয়ুব অনুগত প্রশাসন, মিলিটারি আর ব্যাবসায়ি সমাজ। এরমধ্যে আর্থিকভাবে সবথেকে বেনিইফিসিয়ারি ছিলো একটি অতিক্ষুদ্র ব্যাবসায়িকগোষ্ঠী- ইতিহাস যাদেরকে আইয়ুব খানের ২২ পরিবার নাম দিয়েছে। মূলতঃ পাঞ্জাবকেন্দ্রিক এই বড় বড় ব্যাবসায়িক-শিল্পপতি পরিবারগুলো লুটেছিলো উন্নয়নের প্রফিট। এরা এতোটাই শক্তিশালী হয়েগেছিলো যে একসময় পাকিস্তানের টোটাল ব্যাংকিং এবং ইনস্যুরেন্স এসেটের ৮০% শতাংশই ছিলো তাদের দখলে, সমগ্রদেশের ৬৬% শিল্পকারখানার মালিক বনে গেছিলো এই ২২ টি পরিবার। নিত্যপণ্য বাজারের সরবরাহের দখলও তাদের। এক অর্থে তারাই ব্যাংকের মালিক, তারাই শিল্প উদ্যোগতা, তারাই আমদানিকারক, তারাই বাজারে পণ্য সরবরাহকারি— দুই পাকিস্তানের অর্থনীতির মূল চাবিকাঠি এই ২২টি পরিবারের দখলে। এই ২২ পরিবারের মধ্যে থাকা কিছু নাম নিশ্চয়ই আমরা সবাই শুনেছি। যেমন আদমজী, বাওয়ানি— যাদের বিশাল বিশাল পাটকল ছিলো, ইস্পাহানী— যারা এখনো বাংলাদেশে ব্যাবসায় আছে, হাবিব, ক্রিসেন্ট, দাউদ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু এই ২২ পরিবারের মধ্যে কোন বাঙ্গালি পরিবার ছিলোনা, অথচ পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদের সিংহভাগ দখলদারি ছিলো তাদের হাতে। বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের পাট, চা, টেক্সটাইল, চিনিকলসহ সবধরনের ব্যাবসাপাতি চলতো তাদের পরিচালনায়।এই একচ্ছত্র অধিপত্যবাদের বিরোধিতা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রাহমান, ৬ দফার মাধ্যমে দিয়েছিলেন অর্থনৈতিক সমাধকারের দাবী, যেই দাবীতে মূলত শুরু হয় আইয়ুবের পতন।
(বাকিটা ২য় পর্বে)
১৮ ই জুলাই, ২০২৪ রাত ১:০০
আসিফ বাশার বলেছেন: ধন্যবাদ। কালকে লিখবো।
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯
শেরজা তপন বলেছেন: পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম...