নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প - বিকিয়ে যাওয়া - নীরার সঙ্গে, নীরার জন্যে

৩১ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ১০:০০

রায়সাহেব বাজার মোড়, দীর্ঘদিন ধরে লোকমুখে যার প্রচলিত নাম রায়সাবাজার মোড়, তার নাক বরাবর দাঁড়িয়ে একবার বামে এবং একবার ডানে মোচড় নেয়ার পর আপনি যে জায়গায় এসে পৌঁছুবেন, তাকে স্থানীয় লোকেরা বলে ভিক্টোরিয়া পার্ক বাসস্ট্যান্ড। রাস্তার ঠিক এইখানটায় অনেকদিন বাদে এসে দাঁড়ানোর পর, যেমনটি আজ দাঁড়িয়ে আছে আমাদের যুবক শিক্ষক রাশেদ, আপনার মনে হবে যেন অতি পরিচিত একঝলক দমকা হাওয়া বর্ষায় টইটুম্বুর বুড়িগঙ্গা নদীর কোল থেকে উঠে এসে আপনাকে জড়িয়ে ধরে বরন করে নিচ্ছে। রোম্যান্টিক স্মৃতিকাতরতা মন্থন শেষে আমরা যদি আবার আমাদের মনোযোগ রাশেদের দিকে নিয়ে আসি তবে দেখবো যে সে এখন মনে মনে হিসেব করছে ঠিক কতদিন পর তার এখানে আসা হল। এই ভিক্টোরিয়া পার্ক - সদরঘাট - লক্ষ্মীবাজার এলাকায় জন্মের পর সব মিলিয়ে পঁচিশবার ষড়ঋতুর পালাবদল দেখেছে সে। আজ প্রায় বছর দুই কেটে গেছে তার পুরনো ঢাকার এই প্রাচীন পরিমণ্ডল ছেড়ে যাবার।

ক্ষণিকের জন্যে রাশেদ প্রায় ভুলেই যায় ঠিক কি উদ্দেশ্যে তার আজ এখানে আসা। সে আনমনে কিছুক্ষণ নিজের মত করে হেঁটে বেড়ায় লক্ষ্মীবাজার এবং তৎসংলগ্ন অলিগলি ধরে - যেখানে তার জন্ম, শীতের কোন এক প্রভাতে প্রথমবারের মত বিস্ময়ভরা চোখে বাড়ির চৌকাঠের বাইরে প্রথম পা ফেলা, দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা কৈশোর, আবেগে টালমাটাল তারুণ্য এবং সবমিলিয়ে পুর্নাঙ্গ এক মানুষরুপী আজকের সে। যদিও একটি চাকুরির দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পুর্নাঙ্গ মানুষ হিসেবে তার যে রুপান্তর, সেটা ঘটেছে লক্ষ্মীবাজারে তাদের পৈত্রিক বাড়িটি বিক্রি করে দিয়ে নতুন ঢাকায় থিতু হবার পর। ২০১৭তে ঢাকার বুকে একখণ্ড জমির দাম কেবল স্বর্ণের সঙ্গেই তুলনা করা চলে, তা সে নতুন ঢাকায় হোক বা পুরনো ঢাকায়। জমি তো জমি, তিনকাঠা জায়গার ওপর তাদের বাড়িশুদ্ধ রাশেদকে বিক্রি করে দিতে হয় বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ার পর। জমি সহ বাড়ি বিক্রয়ের সিদ্ধান্তটি কতটুকু সজ্ঞানে নেয়া আর কতটুকু নির্বোধের মত হয়েছে সে চুলচেরা বিশ্লেষণে আমরা যাবো না - এটা জানার পর যে, সিদ্ধান্তটি রাশেদ নিয়েছিল বাবার প্রতি সন্তানের একান্ত কর্তব্যবোধের জায়গা থেকে। বাবার এ রোগ ধরা পড়বার বছরখানেক আগে, রাশেদ যখন কেবলমাত্র কলেজের ছাত্র, তখন তার মা - ও একই রোগে বিছানাগত হয়। নগদ অর্থের বড় অভাব চলছিল তাদের, ছিল না প্রায় কিছুই এই একতলা বাড়িটি ছাড়া। মা, কিছু হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা আর কিছু ভেষজ কবিরাজি চিকিৎসা নিয়ে সংসার জীবনের শেষ ক'টি দিন চরম দুর্ভোগে কাটিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান রাশেদের পরিবারে তখন কেবল বাবা আর রাশেদ। কাজেই বাবারও যখন এই রোগ ধরা পড়লো তখন রাশেদের ভেতর একা হয়ে যাবার ভয় কাজ করা শুরু করলো মারাত্মকভাবে। সে কারো সাথে শলা পরামর্শ করার প্রয়োজন মাত্র মনে না করে দ্রুততর সময়ে তাদের বাড়িটি বিক্রি করে চিকিৎসার টাকা জোগাড় করে বাবার সঙ্গে চেন্নাই রওনা হয়। কিন্তু ভাগ্য যদি আড়ঠ্যাকা দিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, কি করার থাকে মানুষের? বাবাকে বাঁচানো সম্ভব হয় না। এমএ পরীক্ষা শেষ করতেও একটি বছর বেশী লেগে যায় এই সূত্রে, ফলাফলও বেশী ভালো হয় না।

সে যাই হোক, একাকীত্বের জীবনের সাথে বেশ ভালোই খাপ খাইয়ে নিয়েছে এখন সে। শহরতলীর একটি বেসরকারি কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে সম্প্রতি। কলেজটি ধানমণ্ডি এলাকায় হলেও, বিস্ময়করভাবে কলেজে চাকুরীরত সকলের স্যালারি অ্যাকাউন্ট খুলতে হয় এক বেসরকারি ব্যাংকের এই পুরনো ঢাকার একটি ব্রাঞ্চে এসে। এর কারন যে কি - তার সদুত্তর রাশেদ বা তার সহকর্মীদের কেউই জানে না। সে নিয়ে রাশেদের খুব মাথাব্যাথা আছে এমনটিও নয়। এই সূত্র ধরেই আজ প্রায় দেড় বছর পর তার জন্ম হয়েছে যে এলাকায় সেখানে ফিরে আসা।

একটু হাঁটলেই মীরাদের বাসাটা চোখে পড়ে। জ্বলজ্বলে নেইমপ্লেটে লেখা দেখা যায় - শান্তিনীড়। মীরার বাবার সাথে রাশেদের বাবার ছিল ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব। মীরা, ডাকসাইটে সুন্দরী মেয়েটি ছিল একদম রূপে গুণে অনন্যা। স্কুল জীবনে সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার্স স্কুল পরে ভিকারুন্নিসা নুন কলেজ হয়ে ঢাকা ভার্সিটির বিজনেস স্টাডিস ডিপার্টমেন্ট - ওর মত কৃতিত্ব কি সেই সময় এলাকার আর কেউ দেখাতে পেরেছিল? রাশেদ খুব সাংঘাতিকভাবেই প্রেমে পড়েছিল ওর, কিন্তু সে প্রেম বুকের গণ্ডি অতিক্রম করে মুখের চৌকাঠে বাঁধা পড়ে যাওয়ায় বাস্তবে কোন আঙ্গিক লাভ করতে পারে নি। অঙ্কুরে বিনষ্ট হবার সাথে সাথে ভয়ঙ্কর কালবোশেখির মত রাশেদকে একদম তছনছ করে দিয়ে যায় সেই আবেগ।

কত ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আজ রাশেদ - তার সদ্যপ্রাপ্ত শিক্ষকসত্ত্বাকে এমনিভাবে আঁকড়ে ধরেছে সে - যেন তার জ্যোতির আড়ালে সব অপ্রাপ্তি - সব হারানোর বেদনা ম্লান হয়ে হারিয়ে যায়।

বেলা বাড়ছিল দ্রুত, রাশেদকে স্মৃতিমন্থন থামিয়ে পা বাড়াতে হয় ব্যাংকের দিকে।

ব্যাংকের গেটে এসে দাঁড়ানো মাত্রই উর্দি পরা দারোয়ান রাশেদকে লম্বা সালাম ঠোকে এবং গেট খুলে দেয় ভেতরে ঢোকার জন্যে। পুরো অভিজ্ঞতাটাই রাশেদের জন্যে নতুন। এর আগে তাকে এভাবে কেউ সালাম করে সম্মানের সাথে দরজা খুলে দিয়ে অভ্যর্থনা জানায় নি। রাশেদের অহমে খানিকটা সুড়সুড়ি দিয়ে ওঠা মাত্রই রাশেদ সচেতনভাবে মন থেকে এই আত্মতৃপ্তিটুকু দূরে সরিয়ে রাখল। তার হিসেব সরল - শিক্ষক হিসেবে সে একজন আদর্শবান মানুষ, জগতের কোন পেশাকেই সে খাটো করে দেখবে না কখনো। জীবিকার মধ্যে ছোট-বড় নেই, নিজের মনের শান্তি বহুবার বিকিয়ে দেবার পর সে এই দর্শন সফলভাবে মনে গেঁথে নিতে পেরেছে। মানুষ - তাকে বেশ আগ্রহ নিয়ে মাষ্টরসাব বলে ডাকে এবং রাশেদ স্পষ্ট বোঝে, তাদের সে ডাকের সাথে যথেষ্ট পরিমাণ ব্যাঙ্গ- বিদ্রূপ মেশানো থাকে। শিক্ষকতা, তাদের কাছে খুবই অসহায় একটি পেশা। যার কোন গতি নেই সেই শিক্ষক হয় এমন একটা মনোভাব থেকে তাদের রাশেদের প্রতি এই শ্লেষাত্মক আচরণ। রাশেদের খুব অবাক লাগে। শিক্ষকদের যদি এইভাবে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা হয়, তবে তাদের হাতে নিজেদের সন্তানদের পড়াশোনার ভার তুলে দেবার সময়ই বা তারা কি আশা করে? নিজে বার বার রক্তাক্ত হয়ে পরে রাশেদ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে সে কখনোই কোন পেশাকে ছোট করে দেখবে না। মনের সাথে সেই বোঝাপড়াটুকু শেষ করেই সে হাসিমুখে দারোয়ানকে সালামের জবাব দেয় এবং ব্যাংকের ভেতরে প্রবেশ করে।

ভেতরে ঢুকে রাশেদ অবাকই হয়। ব্যাংকটা বাইরে থেকে জরাজীর্ণ মনে হলেও ভেতরে বেশ সুন্দর - পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। পুরো ব্যাংক এয়ার কন্ডিশনড, দেয়ালে ডিজিটাল স্ক্রিনে বড় বড় করে টোকেন নম্বর উঠে আছে। সব দেখে শুনে রাশেদ চমৎকৃত হয় এবং বোঝে যে বেশ সঙ্গতিপূর্ণ একটি ব্রাঞ্চ এটি।

খানিকক্ষণ এদিক ওদিক দিশেহারার মত তাকায় সে, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে - কোন ডেস্কে গিয়ে কার কাছে সাহায্য চাইবে তার স্যালারি অ্যাকাউন্ট খোলার ব্যাপারে। আজ সে প্রথম বারের মত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলছে ব্যাপারটা এমন নয়, তবে প্রত্যেকবার ব্যাংকে আসা মাত্রই তার সবকিছু গোলোকধাঁধাঁর মত লাগে। একদিকে বেশ কিছু কাউন্টার দেখা যায় - টাকা আদান প্রদানের মাঝারিমাপের লাইন প্রত্যেকটির সামনে। অ্যাকাউন্ট খোলার ফর্ম কি ঐ কাউন্টারগুলো থেকেই নিতে হবে, নাকি ডেস্কে বসে থাকা রাশভারী চেহারার লোকগুলোর সাথে গিয়ে কথা বলে দেখবে সে একবার?

- "স্যার আসছেন কি কাজে?" প্রশ্নটি ভেসে আসতেই রাশেদ বেশ চমকে উঠে পেছনে তাকায়।

- "অ্যাকাউন্ট ... অ্যাকাউন্ট খুলবো একটা।" সামনের লাইনগুলির দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে রাশেদ বলে - "ঐ লাইনে দাঁড়াতে হবে কি?" রাশেদের আমতা আমতা ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সিকিউরিটি গার্ডদের সাথে কথা বলতে সে কখনোই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে নি। কথা গুছিয়ে বলতে পারে না।

- "না। আপনে ঐ সামনের ডেস্কে গিয়া কথা বলেন।" এই বলে সিকিউরিটি গার্ড সামনে চার-পাঁচজন মানুষ ভিড় করে আছে এমন একটা টেবিল দেখিয়ে দেয়।

রাশেদ পায়ে পায়ে অগ্রসর হয়, সামনের ভিড় ঠেলে সরিয়ে টেবিলে ব্যাংকের যে স্টাফ বসা তার সাথে কথা বলার জন্যে। কিন্তু বেশী দূর আর এগোনো হয়ে ওঠে না তার। খানিকটা এগিয়ে যেতেই পুরো শরীরে বিদ্যুৎপৃষ্ঠ হবার অনুভূতি হয়, টেবিলের সামনে জমে থাকা মানুষের ভিড়ের ফোঁকর গলে যার চেহারা মূর্ত হয়ে ওঠে তাকে দেখে। মীরা বসে আছে ডেস্কে!

ছোটবেলায় সাইকেল চালাতে চালাতে মীরার ঠিক সামনে সাইকেল নিয়ে ধুম করে পড়ে গিয়ে, গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়ানোর সময় মীরাকে প্রথমবারের মত দেখার সময় যে অনুভূতিটা হয়েছিল আজও হুবহু সেই অনুভূতিটাই হয়। সূর্যের উল্টো দিকে দাঁড়িয়েছিল মীরা সেদিন। ঠিক স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না ওর চেহারা, সূর্যের আলোকচ্ছটায়, কিন্তু রাশেদ ঠিক বুঝেছিল আলোআঁধারিতে ঘেরা এই মুখটা তার স্পষ্ট করে দেখতেই হবে, একবারের জন্যে হলেও। আলোর দিকে মানুষের যে অকৃত্রিম আকর্ষণ, জন্মলগ্ন থেকেই, সেই অন্ধ আকর্ষণই কাজ করছিল রাশেদের ভেতরে। সেই আকর্ষণ কি আজও এড়িয়ে যেতে পেরেছে পুরোপুরি রাশেদ? একসাথে থাকা হয় নি হয়তো, তবুও? সেই মীরা আজ আবার তার সামনে দাঁড়িয়ে! কৈশোর থেকে নিয়ে যৌবনের প্রথম ঢেউ এসে রাশেদের শরীর মনে ধাক্কা দেবার উত্তাল সময়টুকুকে যে আরও উন্মাতাল করে তুলেছিল ক্রমাগত, সেই মীরা! যাকে প্রতিদিন অন্তত একবার স্বচক্ষে না দেখলে রাতে দু'চোখ একত্র করতে সমস্যা হত রাশেদের। জীবনে যার থেকে বড় করে, বেশী করে কাউকে চায়নি রাশেদ - সেই মীরা! জীবনের নির্মম রসিকতায় খুব কষ্ট করে যার অধ্যায়কে মাটিচাপা দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে সামনে - সেই মীরা!

হুট করে চার-পাঁচজন মানুষকে ঠেলেঠুলে গিয়ে হাজির হবে মীরার সামনে এটা রাশেদ তার দূরতম স্বপ্নতেও কল্পনা করতে পারে না। রাশেদ সিদ্ধান্ত নেয় কিছুটা সময় নেবার। সোফায় বসে অ্যাকাউন্ট খুলতে যে সমস্ত কাগজপত্র লাগতে পারে - সেগুলি গুছিয়ে নেয়। মীরার মুখোমুখি হবার আগে তার চিন্তাধারাকে একটু গড়েপিটে প্রস্তুত করে নেয়া প্রয়োজন।

সময় গড়িয়ে যায়। মীরার ডেস্কের সামনের ভিড় ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। নিয়তির খুব নির্মম পরিহাসের মত করেই মীরার মুখোমুখি হতে হয় রাশেদকে।

-" রাশেদ ভাই!"
মীরার চোখে রাজ্যের বিস্ময় দেখতে পেয়ে রাশেদ খানিকটা আশ্বস্ত হয়। এখনও সে মীরার জন্যে বিস্ময় উদ্রেককারী - এই চিন্তা তাকে আনন্দ দেয়। রাশেদ আবিষ্কার করে, বিস্ময়ের ভাব কেটে গিয়ে আস্তে আস্তে মীরার চেহারা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে স্নিগ্ধ স্মিত হাসি। মীরার এই স্নিগ্ধ হাসির অধিকারী কি যারা যারা এখানে অ্যাকাউন্ট খুলতে আসে তারা সবাই, নাকি শুধুই রাশেদকে লক্ষ্য করে? রাশেদ উত্তর খোঁজে মনে মনে, স্থির কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না।

- "এতদিন পর রাশেদ ভাই! কি মনে করে?"

হাসির সেই স্নিগ্ধতা বজায় রেখেই কি সুন্দর করে প্রশ্ন করে মীরা! রাশেদ অবাক হয়ে যায়।

প্রত্যেক মানুষের মনের ভেতর এক অতিনাটুকে সত্ত্বা বাস করে, যা মনে মনে আশার বেসাতি বেঁধে বসে থাকে প্রতিনিয়ত খুব নাটকীয় কিছু ঘটবার, ঘটাবার। সেই সত্ত্বাটাই রাশেদের ভেতর নড়াচড়া দিয়ে ওঠে। রাশেদের খুব বলতে ইচ্ছে করে - 'তোমাকে দেখতে এসেছি মীরা! তোমার জন্যেই এসেছি!'

কিন্তু সে কথা আর বলা হয়ে ওঠে না।

পৃথিবীর সবচে অপ্রয়োজনীয় একটি বাক্য উচ্চারন করবার মত করেই সে বলে -

-"ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে এসেছি মীরা"
.
মুহূর্তের জন্যে স্থিরদৃষ্টিতে রাশেদের দিকে তাকিয়ে থেকে মীরা উচ্চকিত খিলখিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে।

-"ওহ রাশেদ ভাই! শেষমেশ আপনিও এই ভুল করলেন!"

রাশেদ বুঝতে পারে, কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। রাশেদের ভুল ভাঙ্গতে সময় নেয় না। ডেস্কে বসা মেয়েটি খুব সুন্দর করে রাশেদকে স্মরণ করিয়ে দেয়, সে মীরার দু' বছরের ছোটবোন নীরা। ইদানিং তাদের দু'বোনের চেহারার মধ্যে এত অদ্ভুত মিল চলে এসেছে যে তাদের বাবা মাও মাঝেমাঝে কনফিউজড হয়ে যায় আজকাল। রাশেদের ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট করতে হয়। আসলেই সে নীরা? মীরার পিঠাপিঠি ছোটবোন?

-"সে যাক রাশেদ ভাই" - হাসতে হাসতেই বলল নীরা, "অ্যাকাউন্ট খুলতে এতদূর?"
- "অফিসের অ্যাকাউন্টস থেকে বলল, তাই।"
- "ওহ! আপনি স্যালারি অ্যাকাউন্ট খুলতে এসেছেন! বলবেন না রাশেদ ভাই? আমি তো ভেবেছি আপনি হয়তো নরমাল সেভিংস অ্যাকাউন্ট খুলতে এসেছেন।" পরমুহূর্তেই উচ্ছ্বসিত হয়ে আবার জিজ্ঞেস করে নীরা -
-"কোথায় জয়েন করলেন রাশেদ ভাই? কবে জয়েন করলেন? কিছুই জানালেন না আমাদের! কংগ্রাচুলেশনস!"

মধ্যে বছরখানেকের গ্যাপ, এর মধ্যেই সবসময় মীরার পেছনে মুখ লুকিয়ে থাকা মীরার ছোটবোনটি কথায়-কাজে এত পটু হয়ে উঠেছে কিভাবে? পড়াশোনা শেষ করে আবার কোন ফাঁকে এই ব্যাংকেও জয়েন করে ফেলেছে। এই নিয়ে আরও খানিকক্ষন অবাক হয়ে চিন্তাভাবনা করা যেত, যদি না রাশেদের মনের মধ্যে অন্য এক বিষয় নিয়ে খচখচানো শুরু হয়ে যেত এর মধ্যেই। রাশেদের এখন নীরাকে তার চাকরী বাকরির কথা বিস্তারিতভাবে খুলে বলতে হবে। শুধু তাই না, অ্যাকাউন্ট ফর্ম ফিলাপের কাগজে তার স্যালারি ডিটেলসও দিতে হবে। ভাগ্যের নির্মমতার কাছে রাশেদের নিজেকে এক অসহায় ফুটবলের মত মনে হয়, যার কাজ কেবল লাথি খেয়ে মাঠের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে দৌড়নো।

-"একটা কলেজে ইংরেজি পড়ানো শুরু করেছি নীরা। এই মাসেই জয়েন করলাম।"
-"আপনার তো বোধয় পড়াশোনায় খানিকটা গ্যাপ পড়ে গিয়েছিল তাই না, আঙ্কেলের চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরে গিয়ে? আঙ্কেল কেমন আছেন এখন?"
-" বাঁচানো যায় নি।"
- "ওহ!"
নীরার মুখ থেকে বেদনা - সমবেদনা মাখা অস্ফুট এক শব্দ বেরিয়ে আসে। রাশেদ চুপ করে থাকে।
-"চেন্নাই যাবার খবর পেয়েছিলাম। তারপর কি হয়েছিল, কিছুই জানতাম না। বাড়ি বিক্রি করে কই যে চলে গেলেন আপনারা!"
-"ঢাকায় ই আছি। চাকরী তো এখানেই।"
-"ঢাকায় আছেন, অথচ যোগাযোগ রাখার কোন প্রয়োজনই মনে করলেন না রাশেদ ভাই!"

রাশেদ অবাক চোখে নীরার দিকে তাকায়। মীরার চেহারার স্পষ্ট ছাপ ওর মধ্যে। আলাদা করা যায় না যেন। রপ্ত করে ফেলেছে বড়বোনের কথা বলার, আগ্রহ ভরে খোঁজ নেবার ভঙ্গী। রাশেদের খুব বিশ্বাস করতে মন চায় যে - নীরা সত্যসত্যই খুব অভিমান করেছে আর যোগাযোগ না রাখায়। কিন্তু, সে ঢাকার কোথায় থাকে, কি করে - এটা একটা প্রয়োজনীয় তথ্য হতে যাবে কেন আর নীরার জন্যে, যার খবর রাখবার কথা, সেই মীরাই যেখানে নিজ থেকে আর কোন আগ্রহ দেখায়নি রাশেদের সাথে যোগাযোগ রাখবার?

-"মীরা? মীরা কেমন আছে?"

প্রশ্নটি পূর্ব-পর কথাবার্তার সাথে কোন সাযুজ্য না রেখেই করে ফেলে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায় যেন রাশেদ। কিন্তু নীরার হাবেভাবে মনে হয় না যে সে খুব একটা অবাক হয়েছে। বরং সে যেন প্রস্তুত হয়েই ছিল এই প্রশ্নের জন্যে, এমন একটা ভঙ্গীতে নীরা বলে ওঠে -

- "আপার তো বিয়ে হয়ে গেল রাশেদ ভাই! সেও এক দারুণ মজার কাহিনী!"

এই বলে রাশেদকে নীরা তার বোনের বিয়ের মজার গল্প শোনানো শুরু করে। রাশেদের চিন্তাচেতনা, সমস্ত ইন্দ্রিয় মীরার বিয়ের খবর শোনা মাত্রই স্তব্ধ হয়ে যায়। সময়ের স্থির ফ্রেমে আরব্য রজনীর আঙ্গিকে নীরা তার গল্পের পসরা খুলে বসে। রাশেদ মনেপ্রাণে কামনা করে যে আরও কিছু ক্লায়েন্ট আসুক, নীরার গল্পে ছেদ পড়ুক। কিন্তু তা ঘটলে তো! মিষ্টি রিনরিনে কণ্ঠে শেল হাঁকিয়ে যেতে লাগলো রাশেদের হৃদয় বরাবর। নীরার বড়বোন এবং রাশেদের দীর্ঘদিনের প্রেমিকা মীরা তার সম্মতির বিরুদ্ধেই বুড়ো এক লোককে বিয়ে করে কানাডা প্রবাসী হয়। কানাডা নিবাসী সে বুড়ো পাত্রের ধনসম্পত্তির বিবরন, বিয়েতে কৃত খরচের বহর ইত্যাদি থেমে থেমে রাশেদের গালে চড় কসাতে থাকে। নিজের প্রিয় মানুষটিকে চিরতরে হারানোর একটা ভোঁতা বেদনা, নিজের অযোগ্যতা, অসহায়ত্ব, অর্থহীন ক্রোধ - সবকিছু কালো মেঘের মত জমতে থাকে রাশেদের চেহারায়। কিন্তু নীরা তার গল্প থামায় না। কোন দৈবের বলে, কে জানে - ব্যাংকের কোন ক্লায়েন্টও আর আসে না এ টেবিলে। নীরার গল্প গিয়ে থামে মীরার সন্তানসম্ভবা হওয়া পর্যন্ত এসে।

রাশেদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ভাবে, কোনটা আসল নীরা? কিছুক্ষণ আগে যে গভীর অনুযোগের সুরে এতদিন খোঁজ খবর রাখেনি বলে রাশেদকে দোষারোপ করেছিল সে, নাকি এতক্ষণ অত্যন্ত নির্মমভাবে রাশেদকে তার দীর্ঘদিনের প্রেমিকার বিয়ে- সন্তান সম্ভবা হবার খবর দিয়ে গেল যে সে? আর এত কথা রাশেদকে শোনানোর প্রয়োজনই বা কি ছিল নীরার? মীরার সাথে রাশেদের বিয়ের কথা তো অনেকটা পারিবারিকভাবেই ঠিক হয়ে ছিল। তার পেছনে ভূমিকা ছিল রাশেদ - মীরার আশৈশব প্রণয়োপাখ্যানের। রাশেদ আর বেশী কিছু চিন্তা করতে পারে না।

-"বাহ! তাহলে তো বেশ সুখেই আছে মীরা।" মৃদুস্বরে বলে সে।

-"আপু যে সুখে আছে তা স্কাইপেতে ওর সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায় রাশেদ ভাই! সারাক্ষণ মুখ আনন্দে ঝলমল করতে থাকে!"

রাশেদের মন চায় নীরাকে ধরে একটা শক্ত ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞেস করতে যে - স্কাইপের স্ক্রিনে হাজার মাইল দূরে বসে থাকা তোমার বোনের ঘোলাটে চেহারা দেখে তার সুখের কথা বুঝতে পারো, আর আমি মানুষটা যে তোমার প্রতিটি কথা শুনে একটু একটু করে মারা যাচ্ছি - সেটা তুমি টের পাচ্ছ না?

ছোটবেলা থেকেই রাশেদের বেশী স্নায়বিক চাপ নেবার ক্ষমতা নেই। খুব বেশী অপমান, খুব বেশী নিষ্ঠুরতা নির্বিকার চিত্তে মেনে নিতে গেলে রাশেদ নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে নিজের ওপর। তাই দ্রুত একটা ডিফেন্স মেকানিজম খুঁজতে থাকে সে। খুঁজে পেতে খুব একটা সময়ও অবশ্য লাগে না তার। তার প্রধান পরিচয় - সে এখন একজন শিক্ষক। এই পেশাতে প্রবেশের প্রথম দিন থেকেই ত্যাগতিতিক্ষাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতে শিখেছে সে। সে জানে, কখনোই সে খুব বেশী অর্থ সম্পত্তির মালিক হতে পারবে না; কিন্তু একটা সৎ পেশা, মানুষ গড়ার পেশার সাথে যুক্ত হবার যে অহংকার - তার মূল্যায়ন কখনো অর্থকড়ি দিয়ে হতে পারে না। সমাজের প্রচলিত যে মাপকাঠি - সফলতা পরিমাপের, সেটাকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছে রাশেদ, কিন্তু মীরা অথবা মীরার বাবা মাকে ব্যাপারটা বোঝাতে সক্ষম হয় নি সে। এ নিয়ে রাশেদ আফসোস করতে পারে না। করা উচিৎ ও নয়। বরং এবার রাশেদের পক্ষে সম্ভব হয় খানিকটা করুনার দৃষ্টিতে নীরার চোখে চোখ রেখে তাকানোর। নীরাকে কেমন যেন কুঁকড়ে যাওয়া ছোট একটি মানুষ মনে হয় রাশেদের নিজের সামনে।

এই চিন্তাভাবনার ফাঁকেতালেই হঠাৎ প্রচণ্ড হইচইয়ের আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে উঠলো ব্যাংকের ভেতরটা। সবার মনোযোগ দ্রুত সেদিকে চলে এলো, কারন ব্যাংকের পরিবেশ চিন্তা করলে এটা খুবই ব্যতিক্রম একটা ঘটনা। নীরাকেও দেখা যায় ঘাড় উঁচু করে হইচইয়ের উৎস খুঁজতে ডানে বামে তাকাতে। তবে নীরাকে বেশী সময় ধরে খোঁজখবর করা লাগে না, আওয়াজের উৎস নিজেই এসে হাজির হয় তার টেবিলে।

-"আফা ট্যাকা তুলুম!" - এই বলে নীরার টেবিলের সামনে যে লোকটি বসে পড়ে তাকে ঘুণাক্ষরেও সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দাদের একজন বলে মনে হয় না। স্রেফ একটা সাদা লুঙ্গী আর পাঞ্জাবী গায়ে, কালো কুচকুচে গাত্রবর্ণ, পাঞ্জাবীর নীচে সাদা স্যান্ডোগেঞ্জি ধবধব করছে। গলায় সোনালি বর্ণের চেইনের ঝিলিক। কথায় ও গ্রাম্যতার ছাপ স্পষ্ট। নীরাকেও যথেষ্ট বিরক্ত লাগে। তার নাকের ওপর ঝুলিয়ে রাখা চেকটা সরিয়ে দিয়ে সে বলল -

- "টাকা তুলতে হলে পাশের ঐ কাউন্টারে গিয়ে লাইনে দাঁড়ান।

-"কিন্তু হ্যারা ই তো আমারে আপনের কাছে পাঠাইল।" লোকটির কণ্ঠস্বরে অসহিষ্ণুতার ছাপ স্পষ্ট। আর সে অসহিষ্ণুতা ঢেকে রাখার কোন চেষ্টাও তার ভেতর নেই।

হম্বিতম্বি করনেওয়ালা লোকটার সাথে যে দারোয়ান এসেছিল সে বলল -

- "অ্যাকাউন্ট যার নামে, সিগনেচার তার না ম্যাডাম"
- "আরে হোটেল হইল গিয়া আমার, অ্যাকাউন্ট হালায় যার বাপের নামেই থাউক, তাতে কি আহে যায় অ্যাঁ?" লোকটা তারস্বরে চিৎকার করে উঠলো আবার।

রাশেদের খুব বিরক্ত লাগে লোকটার অভব্য আচরণে। কিন্তু, সে অবাক হয়ে দেখে নীরা খুব শান্ত ভঙ্গীতে কথা বলে চলছে লোকটির সঙ্গে।

-"দেখুন, নিয়ম যেটা সেটা তো সবার জন্যেই এক। দোকানের মালিক আপনি হলে আরেকজনের নামে অ্যাকাউন্ট খুলেছেন কেন?"
-"আরে আমার ভাইস্তার নামে অ্যাকাউন্ট! ভাইয়ের পোলার সিগনেচার কি দরকার চাচায় নিজে হাজির থাকলে? বালের নিয়ম আপনেগো!"

কথার ধাক্কায় রাশেদের পুরো মুখ ঝাঁঝাঁ করে ওঠে। লোকটা নিজেই কিছুক্ষণ পর শান্ত হয়। বলে,

-"আনাইতাছি ভাইস্তার সিগনেচার। মাঙ্গের পুত নিজে আইয়া সিগনেচার করবো এহানে। রাস্তার ঐ পারেই আমার দোকান। খারান, ফোন লাগাইতাচি।"

লোকটি তার ভ্রাতস্পুত্রকে ফোন করে পুনরায় খিস্তি খেঁউড়ের লহমা বইয়ে দেয়। রাশেদের গা ঘিনঘিনিয়ে ওঠে। বিশেষত নীরার মত সুন্দরী, ভদ্রঘরের একটি মেয়ের সামনে এই ধরনের উচ্চকিত কণ্ঠে খিস্তি মেনে নিতে তার কষ্ট হয়।

-"হোটেল গ্রামবাংলা, এটা আপনার রেস্টুরেন্টের নাম?" লোকটি ফোন রাখার পর নীরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রশ্ন করে।

-"হ। ভাতভর্তার দোকান। হেল্লাইগাই তো কইলাম, মালিক আমি নিজে, আমি থাকতে আবার ঐ ফইড়া পোলার দস্তখত লাগবো কিল্লাইগা?"

রাশেদ মনে মনে একটা তীক্ষ্ণ জবাব আশা করে নীরার কাছে। কিন্তু অবাক হয় নীরার স্বাভাবিক আচরণে। রাশেদের ফর্মের কাজ করতে করতেই নীরা হাসিমুখে উত্তর দেয়,

-"নিয়ম সবার জন্যেই একরকম, বুঝলেন। আপনার সাথে কেউ কোন জবরদস্তি করছে না।"

কথা শেষ হবার আগেই লোকটার ফোন আবার বেজে ওঠে। লোকটি উচ্চকিত কণ্ঠে ঢাকাইয়া খিস্তি খেঁউড় শুরু করল আবার। ব্যাংকের নীরবতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো চারিদিকে। রাশেদের ধৈর্যের বাঁধ ও ভেঙ্গে পড়ে পড়ে। তার শিক্ষকসুলভ সংযম আর কাজ করতে চায় না। লোকটা টাকা পয়সার লেনদেন নিয়ে কথা বলে। শীঘ্রই সে টাকার অঙ্ক লাখের ঘর ছাড়িয়ে কোটি স্পর্শ করে।

রাশেদ সচকিত হয়ে নীরার দিকে তাকায়, লক্ষ্য করে যে - নীরার মুখে বিরক্তির সকল চিহ্ন মুখে গিয়ে তাতে প্রবল একটা ঔৎসুক্য ফুটে উঠছে। তা কি ঐ লোকের টাকা পয়সার কথা শুনেই? রাশেদের মনে প্রবল খটকা তৈরি হয়।

লোকটি ফোন রাখতেই নীরা নিজে থেকে কথা শুরু করে,

-"এত এত রেস্টুরেন্টের মালিক আমাদের ক্লায়েন্ট, অথচ এখনও আমাদের খাবার কিনে খেতে হয়। কেমন ব্যাপার বলুন তো!"

-"হেহে! আপনারাই তো ডাইকা ডাইকা অ্যাকাউন্ট খুলান আমগো। টেকা থাকলে নাকি ব্যাংকের অভাব আবার! হেহে!"
লোকটার প্রতিউত্তরে অপমানের ঝাঁঝ রাশেদকে ভেতর থেকে নাড়া দেয়। কিন্তু নীরা যেন তা গায়েই মাখে না।

-"যাউজ্ঞা" লোকটি বলে - "তা আইছি যখন ব্যাংকে, অ্যাকাউন্টে কত টেকা আছে সেইতা জানবার পারুম না?"

-"রেস্টুরেন্ট যখন আপনার, তখন বলাই যায়।" নীরা উত্তর দেয় - "আপনার অ্যাকাউন্ট নম্বর বলুন"

লোকটার অ্যাকাউন্টস চেক করবে এখন নীরা? দেখে জানাবে যে তার অ্যাকাউন্টে কত টাকা আছে? কত টাকা থাকতে পারে তার অ্যাকাউন্টে? লাখখানেক? নাকি কোটিপতি সে? নাকি তারও বেশী কিছু? দেখে তো মনে হয় না তার অত টাকা থাকার কথা! একটা লুঙ্গী আর পাঞ্জাবী পড়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষের আর কত টাকাই বা থাকতে পারে? কিন্তু যদি থাকে অত টাকা? কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা? এর অসভ্যের মত যত আচরণ, সব অভব্যতা - সবকিছু জায়েজ হয়ে যাবে? মুহূর্তের মধ্যে সে হয়ে যাবে নিষ্কলঙ্ক, নিষ্পাপ? নীরার মত সুন্দরী মেয়ে তার সব অপমান ভুলে গিয়ে ক্ষমা করে দেবে তাকে?

রাশেদ আবার তার শিক্ষকতার চেতনা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করে। সে শিক্ষক! টাকা পয়সা দিয়ে মাপার মত মানুষ রাশেদ নয়! সমাজের প্রচলিত মাপকাঠিতে... মাপকাঠিতে... রাশেদ আর চিন্তা করতে পারে না! সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়! সে আবিষ্কার করে, অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে, মনেপ্রাণে, সর্বান্তকরণে সে প্রার্থনা করছে -

"হে ঈশ্বর! এই লোকের ব্যাংক ব্যাল্যান্স তুমি কমিয়ে দাও! কমিয়ে দাও! কমিয়ে দাও! এতটা কমিয়ে দাও যাতে নীরার সামনে আমার মাথা হেট না হয়!"


মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৩৪

কালীদাস বলেছেন: হা হা হা, ফিনিশিংটা মজার :)

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:০৭

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: পাঠে ধন্যবাদ। :)

২| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:২৪

জেন রসি বলেছেন: অর্থই সবকিছুকে অর্থবহ করে ফেলে। অর্থ এবং ক্ষমতা হচ্ছে সুশীল মানুষের ওপেন সিক্রেট কামনা। ;)

ভালো লেগেছে।













০২ রা জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১০:২০

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: মন্তব্যে ধন্যবাদ, জেন রসি। :)
রাশেদরা খুব অসহায় প্রকৃতির মানুষ, সুশীল লেভেলে ঠিক উঠে সারতে পারে নি এখনও।
শুভেচ্ছা।

৩| ০৩ রা জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১১:১৩

অলওয়েজ ড্রিম বলেছেন: শুরুর দিকে পাঠককে চরিত্র করে ভবিষ্যত কালের ক্রিয়ায় যে বর্ণনাভঙ্গিটা ছিল, আমার খুব পছন্দের।
গল্পটা এমন জায়গাতে শেষ করেছেন যে মনের ভিতর "শেষ হইয়াও হইল না শেষ" এর বাঁশীর সুর শুনতে পাচ্ছি।

০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১০:৫৩

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: আপনার মননশীল মন্তব্যে বিশেষ ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.