নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাজিদ উল হক আবির

সাধু সাবধান ! ব্লগের মালিক বঙ্গালা সাহিত্যকে ধরিয়া বিশাল মাপের ঝাঁকি দিতে নিজেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রস্তুত করিতেছেন। সেই মর্মে তিনি এখন কিটো ডায়েটিং, ডন-বৈঠক ও ভারোত্তলন প্রশিক্ষণে ব্যস্ত। প্রকাশিত গ্রন্থঃ১। শেষ বসন্তের গল্প । (২০১৪)২। মিসিং পারসন - প্যাত্রিক মোদিয়ানো, ২০১৪ সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী (অনুবাদ, ২০১৫) ৩। আয়াজ আলীর ডানা (গল্পগ্রন্থ - ২০১৬ ৪। কোমা ও অন্যান্য গল্প(গল্প গ্রন্থ, ২০১৮) ৫। হেমন্তের মর্সিয়া (কবিতা, ২০১৮) ৬। কাঁচের দেয়াল (গল্পগ্রন্থ, ২০১৯) ৭।শহরনামা (উপন্যাস, মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), ৮। মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ, ২০২৩), ৯। নির্বাচিত দেবদূত(গল্পগ্রন্থ, ২০২৪), ১০। দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন/ফরটি রুলস অফ লাভ (অনুবাদ, ঐতিহ্য, ২০২৪)

সাজিদ উল হক আবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

রোদের রঙ যখন সোনালী ছিল

০১ লা অক্টোবর, ২০২০ রাত ৯:২৮

জীবনে প্রথমবারের মত সকালবেলা যেদিন বাড়ির বাইরে পা রাখলাম, সে দিনের প্রতিটি মুহূর্ত আজও স্পষ্ট আমার চোখের সামনে ভাসে। মায়ের বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকুরীর সূত্র ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের যে কলোনিতে আমার জন্ম, বড় হওয়া, সেখানে একদম কাচ্চাবাচ্চা আর অপেক্ষাকৃত মুরুব্বীমার্কা বাচ্চাদের আলাদা করার একটা সিস্টেম ছিল। কেবলি বাচ্চাকাচ্চা ক্যাটাগরির যারা, তারা শুধু বিকেল বেলাই বাইরে বের হতে পারতো। তাঁদের ঘরে ফিরে আসতে হত সন্ধ্যার আজানের সাথে সাথেই। আর যারা দ্বিতীয়গ্রুপের, তারা বিকেলের পাশাপাশি সকালেও বাড়ির বাইরে যাবার পারমিশন পেত। সন্ধ্যায় আজান পড়লে মাগরিবের নামাজ মসজিদে পড়ে হেলে দুলে আরও কিছু সময় নষ্ট করে বাসায় ফেরার সুযোগ পেতো।

স্কুলের গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলাকালীন সেই সকালটি, যেদিন আমাকে প্রথমবারের মত বাবা মা বাড়ির বাইরে বন্ধুদের সাথে খেলতে যাওয়ার পারমিশন দেয় - সেদিনের কথা আমার তাই স্পষ্ট মনে আছে। সেদিনের কথা মনে আছে, কারন সেদিন ছিল আমার কাচ্চাবাচ্চা থেকে আর একধাপ বড় হয়ে ওঠার দিন। সেদিনের কথা আমার মনে আছে, কারন, রোদের রঙ যে এত হলদে সোনালী বর্ণের হয়, সেই সকালের আগে আমি তা কখনো জানি নি। ঝাঁঝাঁ রোদও যে এত মিঠে কড়া হতে পারে তাও আমার জানা ছিল না। গাছের পাতার ওপর রোদ পড়লে তা যে অমন গাড় সবুজ লাগে, সেও সেদিন জীবনে প্রথমবারের মত আবিষ্কার করা। সঙ্গে সঙ্গে এও সেদিন প্রথমবারের মত আবিষ্কার করা যে - বিকেলবেলা অপরিচিত কারো ফ্ল্যাটের কলিংবেল টিপে দৌড় দিলে আলোছায়ার মাঝে সাঁঝের আঁধারে পালিয়ে যাওয়া যেমন সহজ, সকালে বেলা সেটা অতো সোজা নয়। ধরা পড়ে মার খাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় তিনগুন।

সেদিনের কথা আমার মনে আছে, কারন, এটা আবিষ্কার করা যে - রুখসানা সকালবেলায়ও তার বান্ধবীদের সাথে ব্যাডমিন্টন খেলতে বেরোয়।

রুখসানা ছিল আমার পরিবারের গণ্ডির বাইরে পরিচিত হওয়া জীবনের প্রথম বন্ধু। প্রথম মেয়ে। প্রথম মেয়ে বন্ধু।

বিকেলবেলা ফ্রক আর কেডস পরা ফুটফুটে একটা মেয়ে দুই বেণী দুলিয়ে ছোটাছুটি করে ব্যাডমিন্টন খেলে - দৃশ্যটা সেই বয়সেই আমার মনে ধরে গিয়েছিল। আমার বয়স কত তখন? ৫, বড়জোর ৬। ওকে ব্যাডমিন্টন খেলতে দেখার দিন দুইয়ের মধ্যেই আমি আব্বুকে ভজিয়ে ভাজিয়ে একটা ইয়াসাকি ব্র্যান্ডের র‍্যাকেট কিনে ফেলি। কিনে ফেলি সে আমলের হিসেবে ম্যালা টাকা খরচ করে। র‍্যাকেটটার সিলভার কালারের স্টেইনলেস ষ্টীল বডির ওপর ডার্ক ব্লু কালারের নেক, আর তারের ওপর সোনালি রঙ্গে ইয়াসাকি র‍্যাকেটের লোগো আঁকা ছিল। এই র‍্যাকেটটা দিয়েই আমি আজীবন ব্যাডমিন্টন খেলেছি। এই র‍্যাকেট নষ্ট হবার পর আমি আর কোন নতুন র‍্যাকেট কিনি নি।

বলছিলাম রুখসানার কথা। রুখসানাকে প্রথমবার দেখার দিনদুয়েকের মধ্যে আমার র‍্যাকেট কেনা হয়ে যায়। তার পরদিন বিকেলবেলা মহল্লার লোকজন একটি শিশুকে আবিষ্কার করে রুখসানা আর তার বান্ধবীদের ব্যাডমিন্টন কোর্টের পাশে নিজের ইয়াসাকি র‍্যাকেটটা কাঁধে ঝুলিয়ে অসহায়ের মত হাঁটাহাঁটি করতে। রুখসানা, ছোট হলেও, অথবা ছোট বলেই আমাকে দেখে দুহাত নাড়িয়ে বলেছিল - এসো... আমরা... খেলবো... (এই ডাকটার একটা রিদমিক প্যাটার্ন আছে, যেটা আমার মাথায় এখনও গেঁথে আছে, কিন্তু লেখায় সেটা ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। শৈশবে রুখসানা আর আমার এরপর থেকে বিকেলে দেখা হলেই আমরা এই ফ্রেজ দিয়ে একজন আরেকজনকে সম্ভাষণ করতাম)

সেই সকালবেলা, জীবনে প্রথমবারের মত যেদিন আমি বাড়ির বাইরে নেমে আসার পারমিশন পাই, আমি দেখি, রুখসানা তাঁর বান্ধবীদের সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলছে। আমি দেখি, সকালের সোনা ঝরা রোদে রুখসানার ফর্সা গাল ঘেমে লাল হয়ে গেছে। আমাকে দেখে রুখসানা তার দু বেণী দুলিয়ে লাফিয়ে উঠে বলে - "আবিইইইইইর ... এসো... আমরা... খেলবো ......" কিন্তু প্রথমবারের মত জীবনে সকালে বাড়ির বাইরে পা রাখার উত্তেজনায় আমি আর র‍্যাকেট নিয়ে বের হই নি সেদিন। বাড়িতে ফেরত গিয়ে র‍্যাকেট আনতেও সাহসে কুলাচ্ছিল না, পাছে আব্বু আর বের হতে না দেয় - 'একদিনের জন্যে যথেষ্ট হয়েছে খেলাধুলা' এই বলে।

জীবনে প্রথম যেদিন সকালে আমি বাড়ির বাইরে পা রাখি, সেদিনের কথা আমার মনে আছে, কারন আমার একমাত্র বন্ধু, আমার নিরপরাধ শৈশবের একমাত্র মেয়েবন্ধু রুখসানার আহবানের পরেও ওর সঙ্গে সেদিন আর ব্যাডমিন্টন খেলি নি।

প্রায় বাইশ বছর পর গতকাল শেষরাতে হুট করে ঘুম ভাঙ্গার পর আমার সাথে আমার স্মৃতি আশ্চর্য এক ছেলেখেলা করে। অক্টোবর মাসের ভোরের হিমেল বাতাস রুম ঘিরে ঘুরপাক খায়, আমি নিস্পলক চোখে সিলিঙে বনবন করে ঘুরতে থাকা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকি, আর আমার ছেলেবেলার সেই সকালটা, প্রবল মিঠে কড়া হলুদ বর্ণের রোদে ভেসে যাওয়া এক আশ্চর্য সকালটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমার শরীর যখন আর কে মিশন রোডের এক ফ্ল্যাটে আটকে পড়ে ছটফট করতে থাকে, আমার মন তখন নব্বই দশকের প্রবল আলোকিত এক সকালে ছুটে বেড়াতে থাকে। আর আমি অনুভব করি - আমার অনাগত সন্তানকে ঢাকা শহরের এই মরে পচে গন্ধ হয়ে যাওয়া ফ্ল্যাট কালচার থেকে বের করে এনে আমার শৈশবের মত আশ্চর্য সুন্দর একটা শৈশব উপহার দেওয়াটাই হবে আমার পরবর্তী জীবনের প্রধানতম এক যুদ্ধ।

(লেখাটি আমার ডায়রির পাতা থেকে নেয়া। আজ বিকেলে, বহুদিন পর স্ত্রীর সঙ্গে বেড়াতে বের হলাম। ও বলল রিকশায় ঘোরা হয়না বহু দিন। আমি বললাম, চলো আজ বৃষ্টিস্নাত এই বিকেলে রিকশা করেই ঢাকা শহরে বেড়ানো যাক। ঘুরতে ঘুরতে রিকশা এসে থামল আমার, আমাদের প্রেমের তীর্থস্থান, ধানমণ্ডি ১৫'র ম্যাডশেফ রেস্টুরেন্টে। দুজন দুজনের পছন্দের ডিশ অর্ডার করে বসে আছি, এমন সময় নাফিসা আমাকে বলল, তোমাকে ধন্যবাদ, বিয়ের আগের দিনগুলোর মত হুট করে আজ ডেটে বেরিয়ে পড়বার জন্যে। একটু পর বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে, আমাকে অবাক করে দিয়ে, ওর ব্যাগ থেকে বের করে আমার সামনে ধরল আমার পুরনো একটা ডায়রি। ২০১৮ সালে বাড়ি বদলে নিজেদের বাড়িতে ওঠার পর এই ডায়রি আর খুঁজে পাচ্ছিলাম না। নাফিসা খুঁজে পেয়েছে কোথা থেকে যেন সেটা (এটা অবশ্য বড় ব্যাপার না। স্ত্রীরা ম্যাজিক জানে। যে জিনিস আপনি কখনোই খুঁজে বের করতে পারবেন না, আপনার স্ত্রী সেটা মুহূর্তে খুঁজে বের করে দিয়ে আপনাকে তাক লাগিয়ে দেবে।)। খুঁজে পাওয়ার পর আমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যে সে একটা উপলক্ষের খোঁজে ছিল। সন্ধ্যায়, ডিনারের ফাঁকে ফাঁকে চলতে থাকে পুরাতন ডায়রির পাতা উল্টানো, একএকটা কাহিনী পড়া, আমার পুরাতন প্রেমিকাদের হারানোর বেদনায় লিখিত কান্নাকাটি নিয়ে খোঁচানো, হাসিতে একে অন্যের ওপর ভেঙ্গে পড়া। ডায়রির বিবিধ লেখার মধ্যে উপরের লেখাটা মনে ধরে গেলো বিধায় শেয়ার করলাম। শহরের আরবান জাঙ্গল কালচার আমি কতটা ঘৃণা করি, বলে বোঝানো সম্ভব না। পুরনো ঢাকায় যে শৈশব কাটিয়ে এসেছি আমি, আমার মনে আছে, আমাদের কলোনিতে দিনের বেলা দরজা লাগানো হত না বেশীর ভাগ ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাট, এবং মনের দরোজা খোলা রেখে কাটানো শৈশব, কৈশোরের অমূল্য দিনগুলির একদম বিপ্রতীপে ছিল মহানগরী ঢাকার ভাড়ার এপার্টমেন্ট ফ্ল্যাটে। এখন অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন।

পূর্বে কখনো কোন ব্লগ পোস্ট কাউকে উৎসর্গ করেছি, এমনটা আমার স্মৃতির রাডারে ধরা পড়ছে না। এই লেখাটি উৎসর্গ করছি আজ থেকে সাত বছর আগে যখন আমার ব্লগে যাত্রা শুরু হয়, তখন যিনি সবার সামনে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন৪ ঘন্টা ৩৭ মিনিটে ৬১ টি পোস্ট- একজন নতুন ব্লগার শীর্ষক নিজের একটি ব্লগ পোস্ট দ্বারা, সেই ব্লগার খেয়াঘাট/ আরিফ মাহমুদ ভাইকে, এবং স্মৃতিকাতর ও শভেনিস্ট সিনিয়র ব্লগার পদ্মপুকুর ভাইকে, স্মৃতিকাতরতাজনিত একটি পোস্ট উৎসর্গ করার জন্যে তারচে উত্তম মানুষ আর কে ই বা হতে পারে।

আমার শৈশবের স্মৃতিসমূহকে নিয়ে লেখা, সুর দেয়া গান শুনতে পারেন এই লিঙ্কে গিয়ে - শৈশবের গান

গানটি আমার বোন মৌমিতা হক সেঁজুতির গাওয়া।)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:২৮

মনিরা সুলতানা বলেছেন: চমৎকার স্মৃতিচারণ !!
সাথে স্মৃতির ভাণ্ডার সেই ডায়রি খুঁজে পাওয়ার গল্প ও বেশ রোমান্টিক। উৎসর্গে যাদের নাম উল্লেখ করেছন দুজনই ব্লগের ভীষণ প্রিয় মুখ। অরিফ অবশ্য বহুদিন হয় ব্লগে তেমন ভাবে নিয়মিত না।

শুভ কামনা।

০১ লা অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:৩৮

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: শুকরিয়া আপা! আরিফ ভাইকে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই পছন্দ করতাম। ফেসবুকে সংযুক্ত থাকার দিনগুলোতে , মনে পড়ে, তাঁর মানবিক এক একটি পোস্ট শত শত, হাজার হাজার বার শেয়ার হত। এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় নেই বলে ওনার কোন আপডেট পাই না। আপনি ভালো থাকবেন। শুভকামনা আপনার জন্যেও।

২| ০১ লা অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:৪২

রাজীব নুর বলেছেন: রুখসানা। নামটা সুন্দর।
গান টা শুনলাম, ভালো লাগলো।

০১ লা অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:৪৪

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: শুকরিয়া রাজীব ভাই! : )

৩| ০১ লা অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:৪৩

মনিরা সুলতানা বলেছেন: আরিফ / খেয়াঘাট পছন্দ করার মতোই একজন ব্যক্তিত্ব ! এই করোনা কালে ও আরিফ কিছু লিখলেই সেটা শতশত শেয়ার হয়। তবে এখন বেশি শেয়ার হয় সংগৃহীত নামে। আমি আরিফের নাম দিয়েছি কালেক্টেড ভাই। যদিও ইদানীং ফেসবুকে ও বেশি দেখা যাচ্ছে না

০২ রা অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৩:৪৮

সাজিদ উল হক আবির বলেছেন: অবশ্যই। নিজের লেখা সংগৃহীত/ কালেক্টেড শিরোনামে শেয়ার হতে দেখলে কষ্ট লাগাটাই স্বাভাবিক। জানি না আরিফ ভাই এগুলো কীভাবে ডিল করেন, বা আদৌ আমলে নেন কিনা। আমার ধারণা উনি ঋষি পর্যায়ের মানুষ। ওনার উত্তম চিন্তাগুলো ওনার লেখার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে পুরোপুরি প্রবেশ করলে তো সমাজ বদলে যেতো এক ঝটকায়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.