নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কখনও আমি অথবা আমার মন অথবা আমরা দুজন মিলে অনুসন্ধান করে বেড়াই সত্য ও সুন্দরের; যা শুধু গুটিকয় মানুষের স্বার্থের জন্য নয়, বরঞ্চ এই সমগ্র মানবতার জন্য।

আবীরের ঘোড়া

আবীরের ঘোড়া › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রতিবেশি

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৯:৪১

তত্ত্বীয় সংজ্ঞাঃ
ইনভায়রনমেন্ট মানে পরিবেশ। আর ইকোসিস্টেমকে আমি প্রতিবেশ বলতেই পছন্দ করি। এর কারণটা এর সংজ্ঞাঃ একটা ন্যূনতম সমষ্টি (জড় এবং জীব) যারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে এক উন্নতর জীবন যাপনে সংযুক্ত সেটাকেই প্রতিবেশ বলে। আর এই ন্যূনতম সমষ্টির প্রত্যেকেই একে অন্যের প্রতিবেশি। এই সংজ্ঞাটা আমার কাছে যথার্থ মনে হয়। তাই পাশের হাসনাহেনা, খেলার মাঠ, মাঠের ওপাশের আসমাদের বাড়ি এবং বাড়ির মানুষ সবাই আমাদের প্রতিবেশি। এই মিথস্ক্রিয়াটা টিকে থাকে প্রয়োজনে এবং ভালোবাসায়। যখন এই দুইটা জিনিসেরই অভাব হয়, তখন টিকে থাকে না কোন প্রতিবেশ; কেউ হতে পারে না কারও প্রতিবেশি।

তত্ত্ব ছেড়ে গল্পেঃ আমাদের এবারের জীবনগল্পের নাম-প্রতিবেশীর গল্প। দুটি ভিন্ন দেশের দুটি ভিন্ন গল্প।

প্রতিবেশির গল্প ১
সুইডেনের ছোট্ট একটি শহর নাম ফালুন। ছোট্ট শহরগুলাতে মাঝবয়সি আর বৃদ্ধ লোকের সংখ্যাটাই বেশি। যুবকরা চলে যায় হয় পড়াশুনা করতে অথবা চাকরি নিয়ে বড় বড় শহরগুলাতে। মিশেল নামের এক বৃদ্ধ থাকতো সেই শহর থেকে ৫ কি মি দূরের একটা ছোট্ট জনপদে। যার পাশেই ছিল বিশাল এক লেক। এই দেশের নদীগুলা বাংলাদেশের খালের মতন, আর লেকগুলা দেখতে আমাদের দেশের নদীর মতন। সুইডেনে একক দেশ হিসাবে রয়েছে পৃথিবীর সর্বাধিক লেক। একটা মাঝারি আকারের লেকের পাশেই ছিল গোটা ৫০ বাড়ির একটা পুরান শহর। বাড়িগুলাতে তেমন একটা কেউ থাকতো না। তাই অধিকাংশ বাড়িগুলাই ছিল খালি, শুধুমাত্র গ্রীষ্মের একটা সময় এসে বাড়ির মালিকেরা সপ্তাহ ৬-৭ থেকে যেত। এই জনপদের মাঝে থাকতেন মিশেল। তার স্বামী মারা গেছে বছর পাঁচেক। মিশেলের বয়স হবে ৮৩ বছর। এই বয়সে তিনি গাড়ি চালিয়ে শহর থেকে মাসের বাজার করে নিয়ে আসেন। বাড়ির বাইরে তাদের পোস্টবক্স। প্রতিদিন দুপুরের দিকে সে বের হয় হাঁটতে, মাঝে মাঝে প্রতিবেশীদের সাথে দেখা হয়, মাঝে মাঝে হয় না। মিশেলের কোন সন্তান ছিল না। স্বামী মারা যাবার পর, ইদানিং সে একটু একাকীত্ব অনুভব করছে। অসুখ হলে পাশের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কল করলেই নার্স এসে দেখে যায়। আর ঘর খুব নোংরা হলে একটা ক্লিনিং কোম্পানিকে ফোন করলে ওরা এসে পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। রান্নাবান্না আর কাপড়চোপড় এখনও নিজেই মেশিনে ঢুকিয়ে করে ফেলতে পারেন। মিশেল পত্রিকাতে বিজ্ঞাপন দিয়েছে, বিনামূল্যে কোন ছাত্র চাইলে তার এখানে থাকতে পারে, তবে সেই ছাত্রকে কমপক্ষে ১ ঘণ্টা সময় মিশেলের সাথে ব্যয় করতে হবে। প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে, এখন পর্যন্ত কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। ছোট্ট শহরে ছাত্রসংখ্যাও কম। আর যারা আছে তারাও ভার্সিটির পাশের স্টুডেন্ট হোস্টেল গুলাতে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। মিশেল সকালে উঠে নাস্তা করে পত্রিকা পড়ে, তারপর দুপুরের খাবার তৈরি করে ২-৩ দিনের জন্য। ফ্রিজে খাবার না থাকলে রান্না করে নচেৎ গরম করেই সেরে ফেলে দুপুরের খাবার। খাবার শেষে বিশ্রাম নেয়ার অভ্যাসটা এসব দেশে নাই। তাই দুপুর দুপুরই বেরিয়ে যায় হাঁটতে। ঘন্টাখানেক হাঁটা হলে ফিরে আসে বাড়িতে। আগে ভাগে বের না হলে খুব সমস্যা। ৩ টার দিকে সন্ধ্যা হয়ে যায় শীতের সময়, আর গ্রীষ্মের সময় সন্ধ্যা হয় রাত ১০ টায়। বিকেল ৫ তার দিকে ডিনার করে হয় টিভি দেখা নতুবা, জানলার দিয়ে তাকিয়ে থাকে কখনও লেক কখনওবা রাস্তার দিকে। চোখগুলা খুব উচ্ছল হয়ে উঠে নতুন কিছু দেখতে পেলে। মানুষ কিংবা পাখি অথবা পানির ভেতর বিশাল চাঁদের খেলা। স্বামী মারা যাবার পর থেকে তাঁর খুব অতীতকালের কথা মনে পড়ে। বেশিরভাগ সময়ই তাঁর অতীত নিয়েই কাটে। তাদের আসলে এক পালিত পুত্র ছিল। সেই পুত্র এখন আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছে। বেশ ভালো একটা জব করে সেখানে। স্বামী মারা যাবার খবর শুনে সপ্তাহখানেক বাদে এসেছিল। সেই ছেলের সাথে মাসে একবার কথা হয় ফোনে। ইদানিং তাঁর খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে, কিন্তু না ডাকলে যে এখানে পাশের বাড়িতেও যেতে নেই। প্রতিবেশির খোঁজখবর নেয়াটা এখানে কোন দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে না।

বাইরের পোস্টবক্সের পোস্টগুলা উপচে পড়ছে নিচে, জানলার পর্দাটাও টানা। ভেতরে কেউ আছে কিনা নিশ্চিত নয় রাসেল নামের এই ছেলেটি। সপ্তাহখানেক ধরে ফোন দিয়ে না পেয়ে চলে এসেছে সশরীরে। অনেকক্ষণ কলিং বেল টিপেও ভেতর থেকে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে ফিরে যায় সে। পত্রিকা অফিসে ফোন দিয়ে জানতে চায় বাড়িটা এখনও ফাঁকা আছে কিনা, কেননা সে ফোনে এবং বাড়িতে গিয়েও কাউকে পায় নি। পত্রিকা অফিস থেকে ওরাও চেষ্টা করলো। এমার সাথে কথা হয়েছিল মিশেলের বিজ্ঞাপন যখন দেয়, তাই এমাকে জিজ্ঞেস করলে তার একটু সন্দেহ হলো। এমা পুলিশকে ফোন করে তার কোন হদিস পাওয়া যাচ্ছে না বলে জানালো। পুলিশ দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকতেই একটা উটকো পচা গন্ধ এসে নাকে ঢুকল। ততক্ষণে প্রতিবেশি কয়েকজন বাড়ির বাইরে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ভেতরে কি হচ্ছে। একটা এম্বুলেন্সের গাড়ি এসে লাশটাকে নিয়ে চলে গেলো দ্রুত। বাড়িটাতে নোটিশ টাঙ্গিয়ে পুলিশও চলে গেলো ততক্ষণে। প্রতিবেশিরা আবার যে যার মতন চলে যায়।

এমাকে পুলিশ দুদিন বাদে ফোন দিয়ে জানালো মিশেলের লাশ পাওয়া গেছে। সে সপ্তাহ তিনেক আগে মারা গিয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল। পুলিশ এমাকে ধন্যবাদ জানালো তার সহযোগিতা এবং উদারতার জন্য। এমা এবার ফোন করে রাসেলকে বলল, তোমার আর আপাতত ফ্রি থাকার ব্যবস্থা হচ্ছে না। কারণ মিশেল মারা গেছে, তবে ভবিষ্যতে আবার যদি এরকম বিজ্ঞাপন আসে তবে তাঁকে সে জানাবে। রাসেল অপেক্ষায় থাকে একদিন এমা তাঁকে ফোন দিবে।

প্রতিবেশির গল্প ২
আমাদের বাড়ির পাশে ছিল অনেকগুলা পুকুর। পুকুরের পাশেই একটা মাঠ। বিকেলে সবাই ওখানে খেলে, আর কেউবা গল্প করে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলা এই এলাকাতে এসে অন্তত খেলার একটা মাঠ পেয়েছে। বিকেলে সবাই যখন মাঠে আসে, তখন একটা নিয়মিত আপডেট পাওয়া যায় সবার সংসারের। কার ঘরে আজ চুলা জ্বলেনি অথবা কার ঘরে আজ মেহমান এলো... এমন হাজারো বিষয়। আমাদের এই মফস্বল এলাকাতে বিদ্যুতের সংযোগ তখনও সব বাড়িতে আসেনি। আর ফোন সেও হাতে গোনা কয়েক বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে তাঁর মধ্যে একটা। আমাদের পাড়ার প্রবাসীরা আমাদের বাসায় ফোন দিত, তাই সবসময় সন্ধ্যার পর একটা জমজমাট ভাব থাকতো। বসার রুমে। মা তখন আমাদের প্রতিবেশি খালা চাচীদের সাথে বেশ জমিয়ে আড্ডা দিত। আর ফোন করার সুবাদে কেউ যখন দেশে আসতো তখন আমাদের জন্য চকলেট খেলনা নিয়ে আসতো। এতে আমাদের খুব আনন্দ।

পিঠা খাওয়ার দাওয়াতে আমার খালারা এলো। খালাতো ভাইয়ের একটার বয়স ছিল ৫ বছর। নাম সামি। সে বেচারা অত্যাধিক দুষ্ট। তাঁকে কিছুতেই ঘরে বন্দি রাখা যেতো না। তাই আমাদের বাসায় এলে আমার ফুল টাইম ডিউটি থাকতো তাঁকে পাহারা দেয়া। সেবার শীতের পিঠার দাওয়াত চলছিলো। সকালে মা আমাকে বলল, সুমন বাবা যা তো তোর আজিজ দাদাকে দুইটা পিঠে দিয়ে আয়। আজিজ দাদা আমাদের আপন কেউ না। সে আসলে বেশ গরীব, খুব কষ্টে থাকেন গরীব ছেলের সংসারে। তাই আমার মা সময় সুযোগ পেলে তাঁকে খাবার পাঠায়। আমি সামিকে নিয়ে দাদুর বাড়ির দিকে যেতে যেতে সামির হাজারো প্রশ্ন ভাইয়া এইটা কি, ঐটা কেন। আজিজ দাদাকে ডাকছি কিন্তু তিনি শুনছেন না, উনি আবার কানেও কম শুনেন। সম্ভবত বাড়িতে কেউ নাই, তাই ঘরের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম দাদু ঘুমাচ্ছেন লেপ মুড়ি দিয়ে। আমি বললাম দাদু তোমার জন্য মা ভাপা পিঠা পাঠিয়েছে মা, খেয়ে নিও গরম গরম। দাদু বলল, ঠিক আছে দাদা ভাই, ঠাণ্ডা একটু কমলেই খাইয়া নিমুনি। ঘর থেকে বেরিয়েই দেখি সামি নেই। এইমাত্র ওকে বারান্দায় রেখে আমি ঢুকলাম আর এর মধ্যেই গায়েব। আমি দৌড়ে পুকুরের পাড়ে চলে এসে ভয়ে আমার শরীর শীতল, সামি পুকুরে হাবুডুবু খাচ্ছে, আমি চিৎকার দিতেই বিকাশ দা যাচ্ছিল কাজে সে ঐ অবস্থায়ই ঝাঁপ দিয়ে উঠিয়ে আনলো সামিকে। আমি তখনও সাঁতার শিখিনি । সে যাত্রায় বিকাশ দা´ না থাকলে ঐ সাতসকালে হয়তো আমার ভাইটাকে বাঁচানো যেতো না। আমাদের এলাকার পাশেই বিকাশদার বাড়ি, পেশায় স্বর্ণকার। আমাদের সাথে বিকেলে ফুটবলও খেলেন। বেশ ভালো গোলকিপার।

সামি এখন মস্ত বড় ডাক্তার। মাসে একদিন এই অচেনা শহরে আসে, বিনে পয়সায় চিকিৎসা দিতে। নতুন করে বেঁচে থাকার ঋণ শোধ করতে। বিকাশ দা অবশ্য কি এক রোগে মারা গিয়েছিলেন আরও বছর দশেক আগে। সামির খুব আক্ষেপ বিকাশ দা´কে যদি ও একটু সেবা করতে পারতো!

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.