নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবু সিদ

আবু সিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

একটি অপ্রিয় অভিবাদন

১২ ই জুন, ২০১৪ সকাল ৯:৩০



আজও ভোরে সুষমা এসে দাঁড়াল এই অশোকগাছের তলে। অশোকের গাছটা ফুলে পরিপূর্ণ। চারধারে উদ্যানে কত পাখি কত ফুলÑ জীবনের কত গান। সে অশোকের তলে দাঁড়িয়ে নাচল আজও। তার বাবা, এই উদ্যানের উদ্যানপাল, তাকে নাচের স্কুলে পাঠাতে নারাজ। প্রতিদিন ভোরে তাই সে এই আশোকের তলে আপন মনে নেচে যায়, যেন সে কোনো ময়ূর, কোনো কাকাতুয়া, কোনো প্রজাপতি! নাচতে নাচতে একসময় তার পায়ের তলে সূক্ষ্ম একটা কাঁটা বিঁধে গেল। সে থেমে গেল। দেখল তার পায়ের তলে একটা গোলাপ পিষ্ট হয়ে গেছেÑ সেই গোলাপের কাঁটা বিঁধেছে তার পায়ে। গোলাপটা হাত দিয়ে সরিয়ে আরেকটু নেচে আজকের মতো নাচ শেষ করল সে। মনে তার কোনো প্রশ্ন এল না, কোথাকার গোলাপ? কিভাবেই বা এল এখানে?



দ্বিতীয় দিন, তৃতীয় দিন এবং তার পরের দিনও যখন সে একই জায়গায় একটা টকটকে লাল আধোস্ফুট গোলাপ দেখতে পেল তখন সে সেটাকে দৈব বলে মানতে পারল না। তার মনে হলো, নিশ্চয়ই এ কোনো মানুষের কাজ। আর নিশ্চয় সে কোনো পুরুষমানুষ! সে এদিক- ওদিক তাকাল। না, কোথাও কেউ নেই। সে আপন মনে প্রতিদিনের মতো নেচে গেল।



এভাবে সে প্রতিদিন ভোরে একটা করে গোলাপ পাচ্ছে আর নাচছে। আর সেই গোলাপ তার আয়নার সামনে এনে সাজিয়ে রাখছে।



এভাবে দিন আর মাস পেরিয়ে গেল... সে গোলাপ সাজিয়ে গেল। একদিন তার বাবা তাকে বললেন যে, তারা বেড়াতে যাবেন। সতের দিনের জন্য গেলো তারা।



১৮তম দিনের ভোরে সুষমা সেই আশোকের নিচে দেখল আঠারটা গোলাপ পর পর সাজানো। প্রথম গোলাপটা ১৮ দিনের পুরনো, পরেরটা ১৭ দিনের..., এইভাবে শেষ গোলাপটা আজ শিশির-স্নাত ভোরের। সঙ্গে একটা চিরকুট :



তুমি আমার আত্মার ধ্বনি

অবিনশ্বর গান।



চারধারে কাউকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না সে। শুধু নীরব সেই উদ্যান, ফুল আর পাখি, আর মৃদুমন্দ বাতাস আপনভাবে বয়ে চলেছে। চিরকুটের কথাটা ভালো লাগল তার। সে নেচে চলল ...

নাচ শেষ হলে সে তার দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাসের তালে চিৎকার করে উঠল, কেউ কি আছেন? কেউ কি আছেন আশপাশে? চারদিকে দ্বিতীয় কোনো মানুষের সাড়াশব্দ নেই। সবই নীরব ও নিথর। কথা বলছে শুধু সেই ১৮টা গোলাপ আর চিরকুটে লেখা ভাব :

তুমি আমার আত্মার ধ্বনি

অবিনশ্বর গান।



আজও সুষমা গোলাপ পেল। নাচলো। আর নাচের পর তার বুকের ভিতর থেকে একটা চিরকুট বের করে রাখল সেই গোলাপের স্থানটায়। এমনভাবে সে রাখল যেন উদ্যানের ভিতর কোনো মানুষকে দেখিয়ে সে রাখছে আর বলছে, রইল এখানে, দেখে নিও। তারপর সে চলে গেল। ফেলে যাওয়া তার চিরকুটে সে লিখেছেÑ

আপনি যেই হোন দেখা দিন,

আমাকে উদ্বেগে রাখবেন না।



আজ ভোরে অনেক আশায় ও উদ্বেগে পরিপূর্ণ সুষমা এসে দেখল একটা গোলাপ আর একটা চিঠি। চিঠিটা খুলে পড়ল সে কম্পিত হাতেÑ



আমার আত্মার দেবী,

কি করে আমি অপূর্ণ রাখতে পারি তোমার ইচ্ছে? তুমিই সেই প্রথম মানুষ যাকে দেখে আমি দেখেছি সুন্দর। তুমি সেই অপ্সরা, যাকে চেতনায় পেয়ে জেনেছি প্রেম। পৃথিবীর সব ফুল সব পাখি সব হাসি একদিন আমার কাছে ছিল তুচ্ছ বিষণœ! তোমায় জানার পর জেনেছি তারা অপূর্ব, জেনেছি ঝরাপাতাগুলোও কী অদ্ভুত আশ্চর্য! আমার জীবনের আলো,



প্রস্ফুটিত তুমি ফুলের থেকেও,

আলোকিত তুমি আলোর চেয়েও!



তুমি দেখতে চেয়েছো আমায় কিন্তু এই পৃথিবীতে আমি অত্যন্ত অচ্ছুত। কুৎসিত আমি, কদাকার যে কোনো কিছুর থেকেও। এই ধরণীর এক অধম মানুষ আমি। এ আশা আমার নেই যে আমি পাব তোমার প্রেম। প্রত্যাশা করি না কখনও করতে পারব তোমায় জীবনের সাথী। তোমার কাছে আমার কেবল এই মিনতি যে, এখান থেকে চলে যাবার সময় তোমার হাত ধরে কেবল অশ্র“ বিসর্জন করতে দিও আমায়। সেই হবে আমার পরম প্রাপ্তি, সেই হবে আমার অমূল্য স্মৃতি। সেই স্মৃতি বুকে করে বাকি জীবন আমি পার করে দেব অবলীলায়।



তুমি আর দেখতে চেওনা আমায়, জানতে চেওনা কে আমি। শুধু তোমার যাবার বেলায় জানিওÑ তাতেই ধন্য জনম আমার, পূর্ণ জনম। আমি এত হীন আর তুমি উচ্চ এত বেশি যে, তোমার কাছে এ আমার আবেদন বা অনুরোধ বলে ভেবো না। জেনো তোমার কাছে এ আমার একান্ত মিনতি।



চিঠি শেষ করে বিষণœ লাগছে সুষমার। সে আজ ভোরে আর নাচতে পারল না। সে আপন মনে খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে বেড়াতে লাগল শিশিরভেজা ঘাসে ঘাসে।



এভাবে মাস আর বছর পেরোল। নাচের প্রতি সুষমার অখণ্ড মনোযোগ গেছে নষ্ট হয়ে। কী যেন এক অজানা বিষাদ ঘিরে ফেলে তাকে। একবার অনেক ভেবে সে লিখেছিল চিরকুট : আপনি যতই অসুন্দর হন দেখা দিন আমায়। চোখের দেখাই তো শেষ দেখা নয়। আত্মার আলো কি কিছু নয়? কিন্তু কোনো উত্তর আসেনি সেই অদেখা অজানা থেকে। এমনই অস্থির আজ যখন সুষমার প্রাণ, তখন বদলির অর্ডার পেলেন সুষমার বাবা। এখন জ্যৈষ্ঠ মাস। আকাশে আকাশে ঝড়ের আনাগোনা আর উড়োমেঘের ছড়াছড়ি। সুষমা চিরকুট লিখল : সামনের সোমবার আমরা চলে যাচ্ছি।



আজ ভোরে উত্তর এল লাল গোলাপের সঙ্গে : যদি আজ সন্ধ্যায় দেখা পাই তোমার, আমার প্রাণধন! তবে আক্ষেপ করার আর কিছু থাকবে না এ জীবনে।



সন্ধ্যায় আজ এসেছে সুষমা। কোথাও এখন নেই কেউ। চারধার ধরণী অন্ধকার। মেঘলা সারা আকাশ। সহসা যেন উষ্ণতা আর গুমোট চারধারে। সে আপন মনে বসে প্রতীক্ষা করছে ... ধীরে ধীরে উঠছে চাঁদের আলো। তবু মেঘের আবরণে ঢেকে গেল চাঁদ। সুষমা ভাবল, নাকি আসবে না সে? তখনই অশোকের পিছন থেকে ভেসে এল সঙ্গীতময় ধ্বনি : আমি এসেছি।



সুষমা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেল না কাউকে। উঠে গিয়ে অশোকের পিছনে গিয়ে দেখল, একজন মানুষ, মুখে তার বাচ্চাদের মুখোশ। এখনও দিনের অবশিষ্ট আলো আছে। সুষমা বলল, আপনাকে দেখতে দিন। মুখোশের মানুষ বলল, আমি অসহনীয়। তারা অশোকের বাঁধানো তটে বসল।



কারও মুখে কথা নেই। এরই মাঝে দিনের সকল আলো গেল ফুরিয়ে। চারদিকে এখন নিরবিচ্ছিন্ন না-দেখা। এবার তো খুলতে পারেন মুখোশ, সুষমা বলল। মুখোশ খুলে গেল তবু কিছু বোঝা গেল না। ‘এবার হাতটা ধরি?’ সেই সুরময় কণ্ঠ বলল। সুষমা তার হাত ধরল। মুখোশের মানুষ সেই হাতে চুমু খেল। হাতটা তার মুখে আর চোখে ছোঁয়াল। তারপর ডুকরে কেঁদে উঠল : ‘তোমাকে আমি কত ভালোবাসি। তোমাকে আমি কত ভালোবাসি। যেন এত ভালো আমি নিজেকেও বাসি না!’ সে তার আত্মার দেবীর হাত ধরে অশ্র“ বিসর্জন করে চলল।



ধীরে ধীরে কান্না থেমে গেল। শান্ত হয়ে এল সেই মানুষ। সুষমার কৌতূহল এখন গিয়ে পৌঁছল সপ্তমে। তার জন্য যে মানুষের এত প্রেম, কেমন দেখতে সে মানুষ? আগে থেকে সে একটা লাইটার এনেছিল সঙ্গে। এবার সেটা সে জ্বালাল। নিমেষে উজ্জ্বল হয়ে উঠল একটা মুখ। মুখটার এক চোখসহ পুরোটাই পোড়া, কেবল বাম চোখের দিকটা সুস্থ-সুন্দর অতি উজ্জ্বল। এই দৃশ্যে ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠল সুষমা। চারদিকে ধুলো আর বাতাস ধেয়ে ধেয়ে নেচে গেল, শুরু হলো কালবৈশাখী। আর কোথায় গেল প্রেমময় সেই প্রাণ?



সুষমার চিৎকারে ছুটে এল উদ্যানের বৃদ্ধ দারোয়ান। সে এই ঝড়ের মধ্যে এসে একনাগাড়ে বলতে লাগল, মা! মা! কী হয়েছে মা? তুমি এই অবেলায় কেন এখানে এসেছো মা? সে সুষমাকে বাড়ি নিয়ে গেল।



আজকের সকালে সবকিছু পরিচ্ছন্ন। সারা রাত ঝড়-বৃষ্টিতে উদ্যানের অনেক গাছ গেছে ভেঙে। বৃদ্ধ দারোয়ান উদ্যানের ভিতরে গুনে দেখলো ভাঙল কটা গাছ। সুষমা তার প্রতিদিনের অভ্যাসবশে এসে দাঁড়াল এই অশোকের তলায়। ঝড়ে অশোকের অনেক পুষ্পমঞ্জরি ঝরে পড়েছে নিচে কিন্তু কোনো গোলাপ আজ আর নেই এখানে। তার গত চার বছরের জীবনে এই প্রথম এমন হলো; সে আছে অথচ গোলাপ নেই!



হঠাৎ কী মনে হলো তার, সে বৃদ্ধ দারোয়ানকে বলল, আচ্ছা এখানে কয়জন কাজ করে? দারোয়ান বলল, এই আট-দশজন। কিন্তু কেন মা? না, এমনি। বৃদ্ধ বলল, তবে কাল রাতে একজন চলে গেছে। সুষমার বুকের ভিতর একটা দ্রিম শব্দ হলো। বৃদ্ধ বলে চলল, ওর নাম চন্দ্র। সম্ভবত লেখাপড়া জানা লোক। তবে সবসময় একটা কাপড় দিয়ে ওর মুখ ঢেকে রাখত। শুধু বাম চোখটা খোলা থাকত। বলত আগুনে নাকি পুড়ে গেছে। সে কথায় সুষমা কথা হারিয়ে ফেলল। সে তার বুকের ভিতর অসম্ভব কষ্টের ছুটোছুটি অনুভব করল। উদ্যানে সে আর দাঁড়াতে পারল না, ফিরে গেল ঘরে।



মালামাল সব বাঁধা হয়ে গেল। সুষমা সেই দারোয়ানের সঙ্গে দেখা করে বলল, এই যে আমাদের নতুন জায়গার ঠিকানা। তার মনে আশা, চন্দ্র যদি আবার কখনও ফেরে, অনুসন্ধান করে তার। সে বৃদ্ধকে বলল, সেই চন্দ্র না কী, তার কোনো ঠিকানা জানেন? বৃদ্ধ বলল, তা মা কিছুই জানি না। দেখো তো মাসের বেতনটাও না নিয়ে চলে গেল। সুষমার বাবা ডাকলেন গাড়ির হর্ন বাজিয়ে। সুষমার চোখে নেমে এল জল। সে গাড়িতে উঠে বসল। পিছনে ফিরে দেখল ক্রমাগত দূর থেকে দূরতর হয়ে যাচ্ছে সেই বাগান সেই অতীত যা গতকালও ছিল তার জীবনের অংশ।



মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১০:৫৭

বজ্রকান্ত বলেছেন: সুষমার এই অপ্রকাশ্য বেদনার নীল রঙ ভবিষ্যত জীবনে কোন পরিণতি আনবে কে জানে, তবুও সুষমাদের জীবনব্যাপী ঘটবে এমনই ঘটনা। লিখে যান---

২| ১২ ই জুন, ২০১৪ সকাল ১১:০৯

নাহিদ ইসলাম ৩৫০ বলেছেন: ভালো লাগলো।



আইডিয়া বাজ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.