নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবু সিদ

আবু সিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ব্যর্থতম

০৪ ঠা আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:৫৫

আমি নৈরাশ্যের বাঁকে

সমাধিস্থ করেছি আমার স্বপ্নসকল।



খুব ভোরে ছবেদ যখন ঘর থেকে বের হলো চারদিক নিষ্ঠুর কুয়াশায় মোড়া। সে তার তালি দেয়া জুতোটা পথে নেমেই একবার পরখ করল। দেখল তার জামা-প্যান্ট-সোয়েটার। হ্যাঁ ঠিক আছে, চলবে। বুক ভরে শ্বাস নিলো সে। চার কি.মি. পথ পায়ে হেঁটে চলার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হলো, আর চলতে শুরু করল।



দশ হাত দূরের মানুষকেও স্পষ্ট দেখা যায় না। পথ দিয়ে গাড়িগুলো ঢিমেতালে চলেছে। ছবেদ রাস্তার এক কোণ দিয়ে একান্ত অনাবশ্যকের মতো, চলছে। মাঝে মাঝে গাড়ির হর্ন তার স্বপ্ন সম্ভাবনা পরিকল্পনা সব ভঙ্গ করছে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা! সকাল সাড়ে ছটার মধ্যে তার ছেঁড়া স্বপ্ন, ভাঙা সম্ভাবনা আর তালিমারা পরিকল্পনা নিয়ে সে রেল স্টেশনে পৌঁছল। তার পকেটে এখন কেবল ট্রেনের দু খানা টিকিট কাটার মতো পয়সা আছে। ‘তাও ভালো’ নিজেকে বোঝাল সে। তারপর পাশের যে চুল-কাটার খোলা সেলুনটা থেকে চুল আঁচড়ালো। আয়নায় নিজের জীর্ণ শরীর আর শীর্ণ মুখ দেখে তার আশঙ্কা হলো। বুড়োই কি হয়ে গেলাম! নাহ। এক কাপ চা হলে ভালো হতো! আফসোস করল সে। এতক্ষণে ট্রেন এসে গেল আর সেও দ্রুত টিকেট কেটে যথাসম্ভব শীতের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ট্রেনের কামরায় গিয়ে বসল।



সকাল নটায় পরিব্রাজক ট্রেন ছবেদের কাক্সিক্ষত স্টেশনে পৌঁছল। চারদিকে স্পন্দিত এই বিশ্বলোকে এখন যেন নতুন প্রাণ জেগেছে। ছবেদ ট্রেন থেকে নেমে তার অমার্জিত ব্যাগটা হাতড়ে দেখল। হ্যাঁ, সব ঠিক আছেÑ সব কাগজপত্র একেবারে ঠিক। তার ছেঁড়া স্বপ্নকে সে সৌভাগ্যের সম্ভাবনা দিয়ে সেলাই করল। এক বুক আশা আর এক মুখ গোপন-হাসি হেসে সে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে এগোল।



কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। সে যে সব প্রশ্নের ঠিক ঠিক জবাব দিলো তার কোনো মূল্য নেই। চাকরির প্রভুরা ছবেদের শীর্ণ মুখ আর জীর্ণ আশার কথা শুনে আঁতকে উঠলেন। তারা বললেন, হ্যাঁ, আমাদের বোকা বানানোর চেষ্টা? বুড়ো শয়তান। বয়স কতো তোর? তারা ছবেদের সার্টিফিকেট নিরীক্ষা করে গর্জে উঠল। বয়স বত্রিশ, এখন আবার চাকরি? তারা তাকে আইন-আদালত আর পুলিশের ভয় দেখাল। আল্লার দোহাই দিয়ে বলল যে, ওরকম একজন অথর্বকে তারা চাকরি দিতে পারবে না।



তার সব আশা এখন খুন হয়ে গেল। সে তার আশার শব কাঁধে করে অফিস থেকে বেরোল। কুয়াশার ভণ্ডামি কাটেনি এখনও। তবে পাণ্ডুর সূর্যটা তার ম্লান আলো ছড়িয়ে দিয়েছে পুরনো শহরের ওপর। ছবেদের ইচ্ছা হলো সে সূর্য এবং আলোকের সব উৎসকে ভয়ঙ্কর লাথিতে গুঁড়িয়ে দেবে। কিন্তু ওটা ইচ্ছাই কেবল। সে তার পা দুটো দিয়ে ভদ্র গতিতে হেঁটে গেল পথচলা আর সব মানুষের মতো।



এই শহরে তার এমন কোনো আত্মীয় নেই, এমন একজনও বন্ধু নেই যার কাছে গিয়ে সে সান্ত্বনা ধার করতে পারে। তাই সে হেঁটে হেঁটে আবারও স্টেশনের দিকে ফিরলÑ ‘সেখানে অন্তত বসবার জন্য জায়গা মিলবে!’

কোলাহল কম দেখে সে স্টেশনের একধারে গেল। সেখানকার দুটো বেঞ্চই বেদখল হয়ে আছে। একটাতে খালি গায়ের এক বুড়ো শুয়ে শুয়ে কাঁপছে। অন্যটাতে ছেঁড়া কাপড় পরা একজন মহিলা গুটিসুঁটি মেরে ঘুমাচ্ছে।



একবার তার ইচ্ছা হলো : ওই ‘জানোয়ার’ দুটোকে লাথি দিয়ে ফেলে দেবে। কিন্তু ওদের অভিশপ্ত আর অনুতপ্ত জীবন অনুভব করে বুকটা তার মুচড়ে উঠল। সে সোজা হেঁটে গিয়ে রেল লাইনের ওপরেই পা মেলে বসল।



সেখানে বসে নিজের সমস্ত অতীত একবার দেখে এল সে। তার মা-বাবা ছিলেন মধ্যবিত্ত। তারা ছিল চার ভাইবোন। বড় দুজন ভাই। তৃতীয়জন বোন। আর সে সবার ছোট। বড় ভাইবোনদের সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান আট-দশ বছরের। সে যখন স্কুলে যেতে শুরু করেছে তখন মা মরল তার। কিছুদিন পর বাপও। বড় ভাই দুজন দূরে কোথায় যেন চাকরি করত। তারা একবার দেখতেও এল না। বোনের সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। সে তার স্বামীর সঙ্গে এসে একমাত্র ছোট ভাইকে নিজের কাছে নিয়ে গেল।

বড় ভাইদের কোনো স্মৃতি স্মরণে নেই তার, তবে বোন তাকে খুব ভালোবাসত। তা আর ভালোবাসা দিয়ে হবে কী; সেই বোনও খুব শীঘ্রই মরল। তখন তার বোনজামাই আরেকটা বিয়ে করল। সেই নতুন বউ, তার নতুন বোন, তাকে আপন ভাইয়ের মতোই ভালোবাসত। সে তাকে সবসময় আগলে রাখত।



একসময় সেই বোনের দু-চারজন ছেলেমেয়ে হলো আর সেও বয়সে ও শরীরে বেড়ে উঠল। বোনজামাই হুঙ্কার দিলেন, আর না! বোন বলল, তোমার ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য একজন মাস্টার তো লাগবে। ছবেদ ঘরের মানুষ, লেখাপড়া জানা ছেলে! ছবেদ রয়ে গেল।



তার বুকের চিরগহিন গুহা থেকে একটা হিংস্র হতাশা, অত্যন্ত নিরীহ ভঙ্গিতে পৃথিবীর পথে পড়ল। ছবেদ অতীতের পাঁকে পাঁকে হেঁটে ফিরলÑ

তারপর? তারপর কত চেষ্টা একটা কাজের। কিছুতেই কিছু হলো না। ‘তাহলে কী করব এখন?’ সে ভাবল, ‘আর কতদিন তাদের কষ্ট দেয়া যায়।’



অনেক ভেবে তার মনে হলো যে, আসলে তার আর কিছু করার নেই। তার উচিত নয় অন্যের গলগ্রহ হওয়া, কর্মবিহীন জীবনযাপন করা।

সে সিদ্ধান্ত নিলো, চারটের সময় যে ট্রেনটা আসবে তার নিচে সে লাফিয়ে পড়বে। কথাটা ভাবার পরপরই বোনের কথা মনে হলো তার। ‘তাইলে একটা চিঠি লিইখা দিই!’ সে চিঠিতে লিখল যে, চাকরিটা পেয়েছে এবং তাকে খুব দ্রুত নিয়োগ দিয়ে এখনই অন্যত্র পাঠানো হচ্ছে বলে সে কারও সঙ্গে আর দেখা করতে পারছে না। তবে শীঘ্রি সে তাদের সঙ্গে দেখা করবে।



চিঠিটা পোস্ট করে ছবেদ আবারও স্টেশনে ফিরে এল। এতক্ষণে তীব্র ক্ষুধা অনুভূত হলো তার। কিন্তু সেটাকে সে আমল দিলো নাÑ এরকম কত দিন-রাত না খেয়ে কাটিয়েছে সে! ক্ষুধাকে আমল না দিয়ে সে একপেট পানি খেয়ে দেখল যে একটা বেঞ্চ খালি হয়েছে। কোনো চিন্তাভাবনা না করে ব্যাগটা মাথার তলে দিয়ে সে শুয়ে পড়ল।



তার ঘুম ভাঙল মানুষের হৈ-হট্টগোলে। চারটার ট্রেনের জন্য অপেক্ষমাণ মানুষেরা সব কথায় কলকল করছে। সে উঠে বসল। আত্মহত্যার পরিকল্পনাটা মনে পড়ল তার। মানুষের কোলাহলের মধ্য থেকেই ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। তার মনে হলো, এত মানুষের মধ্যে আত্মহত্যা করা কি ঠিক হবে? সে শিহরিত হলো যখন কল্পনায় দেখল যে তার মৃতদেহটা রেল স্টেশনে রীতিমতো একটা সমস্যার সৃষ্টি করেছে। লাশটা দেখতে কৌতূহলী মানুষেরা সব ভিড় করবে, মৃতদেহের পোস্টমর্টেম করতে হবে, পুলিশের দল এসে একটা হাঙ্গামা বাঁধাবে, আবার হয়তো ট্রেন ছাড়তে অনেক দেরিও হবে। শুধু শুধু আমার কারণে এতগুলো মানুষের কষ্ট! সে তার পরিকল্পনা বদলাল।



প্রতীক্ষমাণ যাত্রীদের নিয়ে ট্রেন চলে গেল। ফাঁকা স্টেশনে হেঁটে হেঁটে সে স্টেশন মাস্টারের কাছে এল। জিজ্ঞেস করল, নদীটা কত দূর? তার মতো একটা জীবন্ত উচ্ছিষ্টকে দেখে স্টেশন মাস্টার খেঁকিয়ে উঠল, আমার মাথায়।



ধমক খেয়ে ছবেদ আবার প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়াল। বাদামবিক্রেতা এক ছোকড়াকে জিজ্ঞেস করল, তুমি জানো সুরানা নদীটা কতদূর? ‘সুজা বরাবর যাইবেন, তারপর বাসে চইড়া যাইতে হয়।’ ছেলেটা বলল। ‘যদি হেঁটে যাই?’ ‘হাইটা গেলে চার-পাঁচ ঘণ্টা লাগব। তয় রেললাইন ধইরা বরাবর গেলে পৌঁছায় যাইবেন।’



ছবেদ পায়ে হেঁটে চলল সুরানা নদীর কাছে।



নদীটা বিক্ষুব্ধ উত্তাল। সোজা বয়ে চলেছে বঙ্গোপসাগরে। ‘এখানে কোনো আশঙ্কা নেই। আমার মৃতদেহ কারো ক্ষতি করবে না’, ছবেদ ভাবল। এখন রাত নয়টা। শীতের রাত বলে দোকানপাট প্রায় সব বন্ধ হয়ে গেছে, কেবল দু-একটা বড় দোকানে দেখা যাচ্ছে রাতের আলো।



নদীর ওপর রেলব্রিজে বসে ছবেদ। ফেলে আসার পথ ভাবতে ভাবতে মনে তার একটা শিহরণ জাগল : ‘এ জীবনে কারও ভালো তো করা হলো না। উপকার কত্তি পাল্লাম না কোনো মানষির। তাহলে জীবনটা সার্থক হলো কিসি?’ রেলব্রিজের ওপর দিয়ে টানা এক ঘণ্টা হেঁটে একটা বস্তিতে পৌঁছল সে। যাবার পথে এখানে একটা কিশোর ছেলেকে সে বই পড়তে দেখেছিল ।



চারদিক অন্ধকার থাকায় ছেলেটার ঘর সে কষ্ট করে চিনল। সে ঘরের জানালা নেই, ঘরটা মাটির। জানালার বদলে একটা বড় চৌক করে কাটা ফাঁকা জায়গাটা ছেঁড়া বস্তায় ঢাকা। ছবেদ সেই ফাঁকা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে তার সোয়েটার জুতো জামা সব খুলল। সেগুলোকে জানালার ফাঁক গলে ভিতরে রাখল। পকেট হাতড়ে অবশিষ্ট পয়সা আর হাতের ঘড়িটা খুলে সে সেগুলোকেও জামাকাপড়ের সঙ্গে রাখল। ভাবল, হয়তো এতে ছেলেটার উপকার হবে।



এরপর এই পৃথিবীর আর কোনো ভাবনা ভাবল না ছবেদ। সে তার মরণ-গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতেই শীতের তীব্রতা তাকে কাবু করে ফেলল। জোরে হেঁটেও শীতের হাত থেকে পরিত্রাণ পেল না সে। অবশেষে দৌড়াতে শুরু করল ছবেদ। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সময় সে খরস্রোতা সুরানার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল পরম ব্যাকুলতায়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.