![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
উনিশ শতকের শেষে এসে বিজ্ঞানীরা ভাবছিলেন যে, বিশ্বব্রাহ্মান্ডের (universe) সমস্তটা তাদের জানা হয়ে গেছে। তারা অনুমান করেছিলেন, সমস্ত বিশ্বচরাচর একটা অবিচ্ছিন্ন মাধ্যম (ether) এ পূর্ণ। আলোক রশ্মি এবং বেতার সংকেত এই মাধ্যমে ঠিক সেইভাবে চলাফেরা করে যেভাবে শব্দ-তরঙ্গ চলাচল করে বায়ুতে। তাদের এই তত্ত্বকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করার জন্য তাই প্রয়োজন হয়ে পড়ে ইথারের স্থিতিস্থাপক (elastic) বৈশিষ্ট্যের সঠিক মাপজোক। যদি তারা তা পারতেন তবে সবকিছু ঠিকঠাক খাপ খেয়ে যেত। যাইহোক, খুব অল্প সময়ে সর্বচরাচরব্যাপী পরিব্যপ্ত ইথারীয় ধারণায় সন্দেহ দেখা দেয়।
আপনি আশা করতে পারেন যে, আলো ইথারের মধ্য দিয়ে অবিচল বেগে (Fixed speed) ধাবিত হয়। অর্থাৎ, আপনি যদি আলোর বেগের দিকে যান তবে আলোর গতিবেগ আপনার নিকট অপেক্ষাকৃত কম মনে হবে। আর যদি আপনার যাত্রা হয় আলোর গতির বিপরীতে তবে আলোর বেগ আপনার কাছে অপেক্ষাকৃত দ্রুত হয়ে দেখা দেবে। কিন্তু অনেক রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও আলোর গতির এই অপেক্ষিকতা প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। এসব পরীক্ষার ভিতর সবচেয়ে একনিষ্ট পরীক্ষাটি করেন মাইকেলসন ও মর্লি (Albert Michelson & Edward Morley) ১৮৮৭ সালে। এঁরা ছিলেন ওহায়ো অঙ্গরাজ্যের ক্লিভল্যান্ড এলাকার ক্যাজ (Case) ইনস্টিটিউটের লোক। পরস্পর সমকোণে অবস্থিত দুটি আলোকাধার (beam)-এ আলোর গতির তুলনা করেন তারা। যেহেতু পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর আবর্তিত হতে হতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে সেহেতু অবশ্যই তা ইথারীয় পথের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ, এ দুটি আলোকাধারে আলোর গতি হবে ভিন্ন। কিন্তু দিন মাস বা বছর সব সময় লক্ষ্য করে তারা দেখলেন যে দুটি আলোকধারেই আলোর গতি অভিন্ন। অর্থাৎ, আপনি যেদিকে যেভাবেই চলেন না কেন আলোর গতি সব সময় আপনার কাছে সমান মনে হবে।
আইরিশ পদার্থবিদ ফিটজেরাল্ড (George Fitz Gerald) এবং ওলন্দাজ বিজ্ঞানী লরেঞ্জ (Hendrik Lorentz) প্রস্তাব করেন, ইথারীয় মাধ্যমে চলনশীল বস্তু সংকুচিত হয় এবং তাতে ঘড়ির কাটা অপেক্ষাকৃত আস্তে চলে। এই সংকোচন ও ধীরগমন এমন যে তাতে প্রত্যেকের পক্ষে আলোর অভিন্ন গতি পরিমাপ করা সম্ভব হবে তা তারা ইথারের সাপেক্ষে যত গতিতেই চলেন না কেন। তবু আরও কিছুদিন এ সমস্যা অমীমাংসিত রইল। এ সমস্যার সমাধান মিলল সুইজারল্যান্ডের বার্ন (Bern) এ সুইস পেটেন্ট অফিসের এক তরুণ করণিকের কাছে। তাঁর নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি ইথারের ধারণাটি পুরোপুরি বাতিল করে দেন। চিরদিনের জন্য আলোর গতির সমস্যাটির সমাধান করেন তিনি ১৯০৫ এ ৩টি প্রবন্ধ লিখে। এর প্রথমটি লেখা হয় জুন মাসে। এটি তাকে বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানীদের অন্যতম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। বাকি দুটি প্রবন্ধ দিয়ে তিনি বদলে দেন স্থান, সময় ও বাস্তবতা (space, time & reality) সম্পর্কে মানুষের ধারণা।
তাঁর প্রথম প্রবন্ধে তিনি বলেন, ইথারীয় মাধ্যমে চলতে চলতেও যদি এটা জানা সম্ভব না হয় যে ইথার আদৌ আছে কী নেই তবে ইথারের সমস্ত ধারণাই বাতুলতা মাত্র! তিনি স্বতঃসিদ্ধ (postulate) হিসাবে ধরে নেন যে বিজ্ঞানের সূত্রগুলো প্রতেকের কাছে অভিন্ন বলে মনে হবে। অর্থাৎ, আলোর গতির পরিমাপ যেকোন গতিতে চলমান যে কারও কাছে সমান হবে। তার এই বক্তব্য সময় সম্পর্কে আমাদের প্রচলিত বিশ্বাসকে নষ্ট করে দেয়। সময় কোন মহাবৈশ্বিক উপাদান (universal quantity) নয় যার পরিমাপ আমরা ঘড়ি (clock) থেকে পাই। বরং প্রত্যেকের রয়েছে নিজ নিজ সময় (own personal time)। দু’জন মানুষের ঘড়ি একই সময় দেবে যদি তারা একে অন্যের সাপেক্ষে স্থির থাকেন। পরস্পরের সাপেক্ষে গতিশীল অবস্থায় এমনটা ঘটবেনা। এটি প্রমাণিত হয়েছে অনেক পরীক্ষায়। এসব পরীক্ষার একটিতে অত্যন্ত সঠিক (extremely accurate) একটি সময় নিরূপক (time piece) পৃথিবীর চারদিকে পরিক্রমণরত ছিল এবং আরেকটি স্থির রাখা ছিল এক স্থানে। আপনি যদি কিছুক্ষণ বেশি বাঁচতে চান তবে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে যেতে থাকুন যাতে আপনার বিমানের গতি পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতির সাথে সংয্ক্তু হতে পারে। এতে হয়ত সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় আপনি বেশি পাবেন!
আইনস্টাইনের স্বতঃসিদ্ধটি হলো, বিশ্বপ্রকৃতির নিয়মকানুনের সবকিছু প্রত্যেক( freely moving observer) এর কাছে সমান মনে হবে। এটি আপেক্ষিতকতা তত্ত্বেরও (theory of relativity) ভিত্তি। অর্থাৎ, আপেক্ষিক গতিই কেবল গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর এই বক্তব্যের সারল্য ও সৌন্দর্য অসংখ্য বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের নজর কাড়ে। অবশ্য বিরোধিতাও কম ছিল না। আইনস্টাইন নিজেও বিরোধিতা করেন। তিনি বিরোধী হন উনিশ শতকীয় বিজ্ঞানের পরম (absolute) ধারণার। পরম স্থিতি (Absolute Rest) এবং পরম সময় (Absolute or Universal Time) তিনি পরিত্যাগ করেন। অনেক মানুষ তখন প্রশ্ন করেন, তার মানে কি এই যে নৈতিকতার কোন পরম মানদন্ড (absolute moral standards) নেই আর সবকিছু আপেক্ষিক? এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকে ১৯২০ এবং ’৩০ এর দশক জুড়ে। ১৯২১ এ আইনস্টাইন নোবেল সম্মানে ভূষিত হন। ঘটনা হিসাবে তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যে কাজের জন্য তিনি তা পান সেটি তাঁর ১৯০৫ এর কাজের তুলনায় কিছুটা নিম্নমানের, অন্তত আইনস্টাইনীয় মানদন্ডে! সেখানে আপেক্ষিকতার মতো কোন বিতর্কিত বিষয় ছিল না। এখনও আমি সপ্তাহে দু’তিনটে চিঠি পাই যাতে লেখা থাকে আইনস্টাইন ভুল ছিলেন! এত বিরোধিতা সত্ত্বেও তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক সমাজে সাদরে গৃহীত হয়েছে এবং তার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে বাস্তবজীবনের অনেক কিছুতে।
আপেক্ষিকতার আলোচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হচ্ছে ভর (mass) এবং শক্তি (energy)-র মধ্যকার সম্পর্ক। আইনস্টাইন স্বতঃসিদ্ধান্ত হিসাবে আলোর অনাপেক্ষিক গতিকে গ্রহণ করেন। অর্থাৎ,আলোর গতি দর্শক নিরপেক্ষ। যার মানে, কোন গতিই আলোর চেয়ে দ্রুতগতি হতে পারে না। তাহলে কী ঘটে যখন শক্তি ব্যবহৃত হয় কোন বস্তু বা নভোযানকে গতিশীল করতে। বস্তুটির ভর বেড়ে যায় একে সজোরে গতিশীল করতে। বস্তুটিকে আলোর গতিতে গতিশীল করাটা অসম্ভব হবে কারন সেক্ষেত্রে অসীম শক্তির প্রয়োজন পড়বে। ভর ও শক্তির এই সম্পর্ক সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে আইনস্টাইনের বিখ্যাত সমীকরণ E= mc2 এ। এটি পদার্থ বিজ্ঞানের একমাত্র সমীকরণ যা ফুটপাতেও চোখে পড়ে। এই সূত্রের প্রায়োগিক ক্ষেত্রেগুলোর একটি হলো: একটি ইউরেনিয়াম অণুকে যদি এমনভাবে বিস্ফোরিত করা যায় যাতে তা দুই ভাগে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যেখানে তাদের ভরের সমষ্টি আগেকার ভরের থেকে সামান্য কিছু কম হবে তবে সেই বিস্ফোরণের মাধ্যমে অবিশ্বাস্য পরিমাণ শক্তির বিচ্ছুরণ হবে। এই সমীকরণের কার্যকারিতার বুঝতে পেরে ১৯৩৯ এ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে শুরুর পর, কয়েক জন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনকে বলেন আপাতত তার শান্তিকামী বিবেককে দমন করে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে চিঠি লিখতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিউক্লিয়ার গবেষণা শুরু করে দেয়। এখান থেকে ম্যানহাটান প্রকল্প (Manhattan Project) শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৫ এ হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। কিছু মানুষ পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য আইনস্টাইনকে দোষী মনে করেন কারণ ভর ও শক্তির ভিতকার সম্পর্কের আবিস্কারক ওই দোষী আইনস্টাইন! আকাশে কোন বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় নিউটনকে দায়ী করলে ব্যাপারটা যেরকম দাড়ায় এটা সেরকম একটা ব্যাপার! আইনস্টাইন ম্যানহাটান প্রকল্পে অংশ নেননি। উপরন্তু, পারমানবিক বিস্ফোরণেও তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বিদ্যুৎ ও চৌম্বক সম্পর্কিত সূত্রগুলোর সাথে খাপ খেলেও এটি নিউটনের অভিকর্ষক সূত্রের সাথে খাপ খায় না। এই তত্ত্বানুসারে, মহাবিশ্বের কোন একটি স্থান বিশেষের বস্তুরাজির বিন্যাস (distribution) যদি বদল করা হয় তবে সর্বচরাচরের অভিকর্ষক ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ তার প্রভাব অনুভূত হবে। এর অর্থ কেবল এই নয় যে আপনি কোন সংকেত (signal) আলোর চেয়ে দ্রুত পাঠাতে পারবেন, এর জন্যে সময়ের পরম ধারনার প্রয়োজন যেটিকে আপেক্ষিকতার তত্ত্ব পুরোপুরি বাতিল করে দেয়। ১৯০৭ এ বার্নের পেটেন্ট অফিসে থাকাকালীন তিনি বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। বিষয়টাকে তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে থাকেন ১৯১১ থেকে। এ সময় তিনি জার্মানীর প্রেগ বিশ্ব¦বিদ্যালয়ে যোগ দেন। তিনি উপলদ্ধি করেন যে বস্তুর ত্বরণ (acceleration) এবং অভিকর্ষকক্ষেত্রের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান।
বদ্ধ বাক্সের ভিতর বসে থাকা কোন মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় যে তিনি পৃথিবীর অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের কোথাও স্থির বসে আছেন নাকি তাকে বয়ে নিয়ে একটি নভোযান মহাশূণ্যে প্রদক্ষিণ করছে। যদি পৃথিবী সমতল হতো তবে যে কেউ নিউটনের মাথায় আপেল পড়া নিয়ে বলতে পারতেন যে, এটা ঘটেছে অভিকর্ষকের কারণে অথবা নিউটনের মাথা-ই আঘাত করেছে আপেলটাকে কারন পৃথিবী এবং তার উপরিতল নিউটনকে সমেত উর্ধ্বগামী ত্বরণে ছিল। অবশ্য বর্তুলাকার পৃথিবীর ক্ষেত্রে আর এরকম থাকেনা। এক্ষেত্রে পৃথিবীর অপর প্রান্তে বর্তমান কোন মানুষ আমাদের থেকে একই দূরত্বে থেকেই ত্বরণের মধ্যে থাকতে পারবেন।
১৯১২তে আইনস্টাইন চিন্তিত মনে জুরিখ (Zurich) ফেরেন। তিনি অনুধাবন করেন যে অভিকর্ষজ বল এবং ত্বরণের ভিতরকার সাম্য বজায় রাখা সম্ভব বাস্তব বিশ্বের গড়নের সাথে কিছু ধারণার আদান-প্রদান বা গ্রহণ- বর্জনের মাধ্যমে। কি ঘটবে স্থানের ত্রিমাত্রিক অবস্থার সাথে সময়ের একমাত্রা যোগ করলে, যেখানে স্থান সমতল নয় বরং বর্তুলাকার। তাঁর ধারণা ছিল যে, ভর ও শক্তি স্থান-সময়কে কোন না কোনভাবে বিকৃত করে দেবে যা তখনও পর্যন্ত উদ্ঘাটিত হয়নি। আপেল বা গ্রহের মতো বস্তুরা স্থান-সময় এর ভিতর দিয়ে সরল রেখায় চলতে চেষ্টা করে কিন্তু অভিকর্ষজ ক্ষেত্রের কারণে তাদের গতিপথ বেঁকে যায়। এ কারণে স্থান-সময় এর চর্তুমাত্রিক অবস্থানকে বাঁকানো বলে মনে হয়। বক্র স্থান ও উপরিতল (surface) সম্পর্কিত রাইম্যান (Bernhard Riemann) এর তাত্ত্বিক গণিত তিনি ভালোভাবে পড়েন। এ কাজে তাকে সাহায্য করেন তার বন্ধু গ্রসম্যান (Marcel Grossmann)। ১৯১৩ তে আইনস্টাইন ও গ্রসম্যান একটা প্রবন্ধ লেখেন যাতে স্থান-সময়ের বক্রতাকে অভিকর্ষজ বলের একটা ফসল হিসাবে দেখানো হয়। তবে আইনস্টাইনের একটি ভুলের কারণে স্থান-সময়ের বক্রতাকে ভর-শক্তির সাথে একই সমীকরণে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি।
১৯১৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত আইনস্টাইন সঠিক সমীকরণ খুঁজে পেতে জার্মানীতে বসে একনিষ্ঠ সাধনা করেন। সেসময় (প্রথম মহাযুদ্ধের কারণে) তাঁর দেশের ভিতর শুরু হয়েছিল নৈরাজ্য। এ সময় তিনি গটিনগেন (Gottingen) বিশ্ববিদ্যালয় সফর করেন। সেখানকার গণিতের শিক্ষক ডেভিড হিলবার্টের (David Hilbert) সাথে তার ধারণাগুলো নিয়ে আলাপ হয় তার। অবশ্য হিলবার্ট একাই এ সমস্যার সমাধান করেন আইনস্টাইনের দিন কয় আগে। তবু এর কৃতিত্ব জোটে আইনস্টাইনের কপালে, এবং তা হিলবার্টের সম্মতিক্রমে। অভিকর্ষকে স্থান-সময়ের বক্রতার সাথে জুড়ে দেয়ার ধারণাটি তার। আমি বলব যে এর কৃতিত্ব সভ্য জার্মান জাতিরও। সেটা ছিল যুদ্ধের সময়। তারপরও এসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোচনা ও মত বিনিময় নির্বিঘেœ চলতে পেরেছে সেখানে। অথচ মাত্র ২০ বছর পর সেই পরিবেশ একেবারে বদলে গেল।
এই উদ্ঘাটনের ফলে আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব (Special Theory of Relativity) বা মুলতত্ত্বের সাথে অভিকর্ষজের ধারনা যুক্ত হলো। সূচনা হলো আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের (General Theory of Relativity)। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বের অর্থাৎ অভিকর্ষজের সাথে স্থান-সময়ের বক্রতার সম্পর্কের প্রমাণ মিলল ১৯১৯ সালে। এ সময় একদল ব্রিটিশ অভিযাত্রী পশ্চিম আফ্রিকায় সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের নিকটবর্তী তারকার অবস্থানের কিছুটা বিচ্যুতি লক্ষ্য করেন। তারার আলো, আইনস্টাইন বলেন, সূর্যকে অতিক্রম করতে গিয়ে কিছুটা বাঁকা পথে গেছে। এটা ছিল স্থান-সময়ের বক্রতার বড় ও বাস্তব নিদর্শন। এটা ইউক্লিডের (Euclid) এলিমেন্টস (The Elements) লেখার সময় আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ হতে আজ পর্যন্ত বিশ্বজগত সম্পর্কে ধারনার সবচেয়ে বড় বদল। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব বিশ্বচরাচর জুড়ে স্থান ও সময়ের নিষ্ক্রিয় ভূমিকাকে অন্য রূপ দেয়। এটি এমন এক জটিলতার সৃষ্টি করে যা বিশ শতকের শেষে এসেও রইল অমীমাংসিত।
এই বিশ্বচরাচর অজস্র ঘটনায় পূর্ণ। এখানে প্রতিটি ঘটনা স্থান-সময়ের বক্রতার ভিতর নিপতিত হয় এবং ফুরিয়ে যায়। কিন্তু আইনস্টাইন ভেবেছিলেন চির অপরিবর্তনীয় এক বিশ্বমন্ডলের কথা যা তার সমীকরণে ছিল অনুপস্থিত। তিনি পারতেন চির স্থিতিশীল বিশ্বমালার ধারণা বদল করতে যা ছিল সে-সময়ের (প্রায়) সব মানুষের বিশ্বাস। তা না করে তিনি তার সমীকরণে একটা গোঁজামিল দেন। সেখানে একটি নভোমন্ডলীয় ধ্রবক (cosmological constant) জুড়ে দেন যার কারণে স্থান-সময়ের বক্র নিবেশনে সকল অস্তিত্ব নিজের মতো গতিশীল (move apart) হয়। নভোমন্ডলীয় ধ্রুবকের অপ্রীতিকর দিক হলো এটি সব ঘটনার আর্কষণ শক্তির ভারসাম্য তৈরি করে যা এই বিশ্বমালার চিরস্থায়ীত্বের কথা বলে। এটার পরিণতি এই হয় যে, এটি তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানকে উন্নয়নের অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। আইনস্টাইন যদি তার মূল সমীকরণে অবিচল থাকতেন এবং যৌক্তিকভাবে এগিয়ে যেতেন তাহলে মহাবিশ্ব যে ক্রমস¤প্রসারণশীল অথবা সংকোচনশীল তা তাঁর চোখেই ধরা পড়ত। সময়-নির্ভর বিশ্বমালার কথা গুরুত্বের সাথে ভাবা শুরু হয় ১৯২০ এর দশকে যখন উইলসন পর্বত (Mount Wilson) শিখরে ১০০ ইঞ্চি দীর্ঘ দূরবীক্ষণ দিয়ে নভোমন্ডলের পর্যবেক্ষণ শুরু হয়। এখান থেকে আমরা জানতে পারি, যে-তারকামন্ডল (Galaxy) আমাদের থেকে যত বেশি দূরে সেটি তত দ্রুত আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ, মহাবিশ্ব ক্রম স¤প্রসারণশীল। সময়ের সাথে যেকোন দুটি তারকামন্ডলের মধ্যকার দূরত্ব বাড়ছে। আইনস্টাইন অবশ্য এই নভোমন্ডলীর ধ্রবককে তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হিসাবে আখ্যায়িত করেন।
সাধারণ আপেক্ষিকতা (general relativity) বিশ্ব মালার উৎপত্তি ও পরিণতি সম্পর্কিত পূর্বের ধারণাকে বদলে দেয়। পূর্বের ধারণাটি ছিল স্থির ও চিরস্থায়ী এক বিশ্বমালার যা যুগে যুগে একইরূপে বিরাজমান। অন্যপক্ষে, যদি তারকামন্ডলগুলো ক্রমস¤প্রসারণশীল হয় তাহলে নিশ্চয় আগে এসময় তারা একে অন্যের খুব কাছাকাছি ছিল। প্রায় ১৫শ কোটি বছর আগে তারা একে অন্যের ওপর নিপতিত ছিল এবং তাদের ঘনত্ব ছিল অসীম। আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বানুসারে, মহাবিস্ফোরণ (Big Bang) থেকে শুরু হয় সময়ের এবং মহাবিশ্বের। সাধারণ আপেক্ষিকতা আরও ব্যাখ্যা করে যে সময় সমাপ্ত হয়ে যাবে কৃষ্ণগহ্বর (black hole) এর মাঝে। স্থান-সময়ের ব্যাপ্তি এতটাই বক্র যে আলোও মুক্ত হতে পারবেনা ওই দশা থেকে। কিন্তু সময়ের শুরু আর শেষের ওপাশে যা কিছু হওয়া সম্ভব তার ব্যাখ্যা দিতে পারে না সাধারণ আপেক্ষিকতা। অর্থাৎ, মহাবিস্ফোরণের ঘটনা প্রবাহের ব্যাখ্যা এটি দিতে পারে না। অনেকে মনে করেন এটি একান্ত পরম বিধাতার নিজের ইচ্ছা যে কখন ও কিভাবে এই বিশ্ব চরাচরকে তিনি গুছিয়ে নেবেন। অন্যেরা (আমি নিজেও এ দলভুক্ত) অনুভব করেন, বিশ্বচরাচরে নিয়ন্ত্রিত হবে সেইসব নিয়মের দ্বারা যে নিয়ম অন্যান্য সময়ে নিজেকে প্রকাশ করে। এই মতামতের পক্ষে কিছুটা অগ্রগতি আমরা করতে পেরেছি কিন্তু বিশ্বচরাচরের উৎপত্তিকে আমরা এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।
যে কারণে সাধারণ আপেক্ষিকতা মহাবিস্ফোরণের কাছে এসে থেমে যায় তা হলো কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে এর বিরোধপূর্ণ অবস্থান। কোয়ান্টাম তত্ত্ব ২০ শতকের গোড়ার দিকের একটি তত্ত্বীয় ধারণা। এ তত্ত্বের প্রথম পদক্ষেপের সূচনা হয় ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্লাঙ্কের (Max Planck) হাতে। এ সময় বার্লিনে গবেষণারত অবস্থায় তিনি পর্যবেক্ষণ করেন যে কোন উত্তপ্ত জ্বলন্ত বস্তু থেকে আলোকের বিচ্ছুরণ ছোট ছোট প্যাকেটের আকারে ঘটে। ছোট এসব প্যাকেটকে তিনি বলেন কোয়ান্টাম (Quantam) । অর্থাৎ, বিচ্ছুরণ (radiation) কিনা ছোট ছোট চিনির প্যাকেটের আকারে হয়। আর বাজার থেকে তো আপনি ইচ্ছামত খোলা চিনি কিনতে পারবেন না, আপনাকে ১ পাউন্ড ওজনের প্যাক নিতে হবে।
প্রেটেন্ট অফিসে থাকাকালীন ১৯০৫-এ তিনি বলেছিলেন, প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম অনুমিতি (hypothesis) দিয়ে আলোকতড়িৎ (photoelectric) প্রভাব ব্যাখ্যা করা যায়। কিছু কিছু ধাতবের ওপর আলো পতিত হলে ধাতবগুলো ইলেক্ট্রনের বিচ্ছূরণ ঘটায়। এটাই আজকের দিনের আলো নিরূপক (light detector) ও টিভি ক্যামেরার কার্যপদ্ধতির মূল কথা। এ কাজের জন্য আইনস্টাইনকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল দেয়া হয় ১৯২১ সালে।
১৯২০ এর পুরো দশক জুড়ে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম চিন্তায় মগ্ন থাকেন। এসময় তাঁর চিন্তা ব্যাহত হয় কয়েকজন বিজ্ঞানীর চিন্তার দ্বারা। এসব বিজ্ঞানীরা হলেন কোপেনহেগেনের হাইজেনবার্গ (Werner Heisnberg), কেমি¦্রজের পল দিরাক (Paul Dirac) এবং জুরিখের শ্রোয়েডনার (Erwin Schrodinger)। এরা বাস্তব জগতের এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরেন। এসব ক্রমে বিস্তার লাভ করে কোয়ান্টাম মেকানিক্স (quantum mechanics) নামে। তারা বলেন, পর্দাথের অতিসূক্ষè কণিকাগুলোর সুনির্দিষ্ট অবস্থান ও গতি সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, যত সঠিকভাবে কোনো বস্তুকণার অবস্থান নির্ণয় করা হবে তার গতির নির্ণয় ঠিক ততটাই ভুল হবে। এবং গতির নির্ণয় সঠিক হলে অবস্থান নির্ণয় হবে ভুল। আইনস্টাইন এরকম একটা তত্ত্বে অস্বস্তি অনুভব করেন এবং কখনো এটাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর এই অনুভূতি তিনি প্রকাশ করেন ঈশ্বর পাশা খেলেন না (God does not play dice) নামের একটি নিবন্ধে। অবশ্য সেসময়ের অধিকাংশ বিজ্ঞানী এটাকে সাদরে গ্রহণ করেন কারণ এর সাহায্যে অব্যাখাত অনেক কিছুর ব্যাখ্যা প্রদান সহজ ও সম্ভবপর হয়। ক্রমে এটি হয়ে ওঠে আধুনিক রসায়ন অনুজীব বিজ্ঞান, তড়িৎ পদার্থ বিদ্যা এবং প্রযুক্তিকৌশল (technology)-এর একান্ত আবশ্যক উপাদান। আর এসবই গত ৫০ বছরে আমাদের পৃথিবীকে সবচেয়ে বেশি বদলে দিয়েছে।
১৯৩৩-এ নাজিরা (Nazis) জার্মানীর রাষ্টক্ষমতায় আসে। এ সময় আইনস্টাইন জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন । জীবনের বাকি ২২ বছর তিনি কাটান নিউজার্সিতে। এখানকার প্রিন্সটনে তিনি ইনস্টিট্যুট ফর অ্যাডভান্ড স্টাডিতে কর্মরত ছিলেন। নাজিরা ’ইহুদি বিজ্ঞান’ এর বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান শুরু করে যার লক্ষ্য ছিলেন ইহুদী বিজ্ঞানীরা (এসব বিজ্ঞানীদের দেশত্যাগের কারণে সম্ভবত জার্মানী পারমাণবিক বোমা তৈরী করতে সমর্থ হয়নি)। আইনস্টাইন এবং তাঁর আপেক্ষিকতা ছিল এই অভিযানের মূললক্ষ্য। এসময় ১০০ জন লেখক আইনস্টাইনের বিরোধিতা করে একট বই ছাপেন। ব্যাপারটার দিকে তার মনোযোগ আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, একশ জন কোন প্রয়োজনে? যদি আমি ভুল করে থাকি তবে তা উদ্ঘাটনে একজনই যথেষ্ট।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষে তিনি সব জাতির সমন্বয়ে একটি বিশ্ব সরকার প্রতিষ্ঠার কথা বলেন যেটি আণবিক বোমা নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। ১৯৫২ সালে তাকে নবগঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্রের কর্ণধার হবার আহবান জানান হয়। স্বভাবত তিনি তা উপেক্ষা করেন। এ বিষয়ে তিনি একবার লেখেন ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা ক্ষণকালীন মোহ, অথচ একটা সমীকরণ চিরকালের সত্য!’ আপেক্ষিকতার সাধারণ সমীকরণ তাঁর শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। মহাবিশ্বের সমান আয়ু তাদের।
পৃথিবী বিগত সকল শতাব্দীতে যতটা বদলেছে তার চেয়ে অনেক বেশি বদল হয়েছে তার গত একশ বছরে। কোন রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারনে এ বদল সম্ভব হয়নি। এর পিছনে রয়েছে প্রযুক্তি যেটি এসেছে বিজ্ঞানের উৎসধারা থেকে। স্পষ্টত বিজ্ঞানের সে জগতে অবদানের ক্ষেত্রে আইনস্টাইন সব থেকে এগিয়ে।
[অনুবাদ: আবু সিদ]
©somewhere in net ltd.