![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
[গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২) ইংরেজী সতের শতকে মহাকাশে এমন কিছু গ্রহ উপগ্রহ দেখেন যা তার আগে কেউ দেখেনি। তিনি এসব দেখতে পান তার উদ্ভাবিত দূরবীন দিয়ে। তিনি তার পূর্বসুরী কোর্পানিকাসের (Nicolas Copernicus) মতো বলেন যে সূর্য আমাদের সৌরজগতের কেন্দ্র। এর হাজার বছরের বেশি আগে এরিস্টটল আর টলেমী (Ptolemy) মহাকাশকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, পৃথিবী সৌরমন্ডলের কেন্দ্র। তাদের হাতে ছিলো কেবল পর্যবেক্ষণ (observation)। গ্যালিলিও বিজ্ঞানের জগতে পরীক্ষণ পদ্ধতির (experimentation) বহুল প্রয়োগ ঘটান। তিনি নিজে যা দেখেছিলেন অন্যদেরকেও তা দেখতে অণুপ্রাণিত করেন।
জ্ঞান ও বিজ্ঞান চর্চায় বিমুখ এরিস্টটল ও টলেমীপন্থীরা তার বিরোধিতায় নামেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের একাংশ এবং যাজক স¤প্রদায় পুরোপুরি তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা শাসক স¤প্রদায়কে উস্কে দেন এই বলে যে গ্যালিলিও বাইবেলের বিরোধীতা করছেন, তিনি ধর্মদ্রোহী। গ্যালিলিও এই ভুলের আপোষমূলক সমাধানের চেষ্ঠা করেন।
১৬১৩ সালের শেষ দিকে তার প্রিয় ছাত্র এবং পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের প্রধান ক্যাস্টেলি (Benedetto Castelli, ১৫৭৮-১৬৪৩) টুসকানির শাসক সম্প্রদায়ের দেয়া একটি ভোজ সভায় অংশ নেন। সেখানে তিনি মহাবিশ্ব সম্পর্কে গ্যালিলিওর মতামত যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু বিদুষকেরা টুসকানির গ্রান্ড ডাচেস (Grand Duchess of Tuscany) ক্রিস্টিনাকে ক্যাস্টেলির কথার ভুল ব্যাখ্যা করে। ভোজসভা থেকে ফিরে ক্যাস্টেলি এ বিষয়ে গ্যালিলিওকে অবহিত করেন। এই চিঠির উত্তরে ১৬১৩ সালের ২১ ডিসেম্বর গ্যালিলিও ক্যাস্টেলিকে একটি চিঠি লিখেন। এই চিঠিতে গ্যালিলিও যা লেখেন তা আরও বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়ে গ্রান্ড ডাচেস ক্রিস্টিনাকে তিনি চিঠি লেখেন ১৬১৫ সালে।
ক্যাস্টেলিকে লেখা গ্যালিলিওর চিঠি এর মধ্যে বিরোধীদের হাতে পড়ে। তারা এর একটা কপি রোমে পোপের অফিসে পাঠায়। এটাকে তারা গ্যালিলিওর ধর্মদ্রোহীতার প্রমাণ স্বরূপ হাজির করে ১৬১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। পরিণতিতে ১৬১৬ সালে চার্চ কোর্পানিকাসের তত্ত্বের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তারা গ্যালিলিওকে রোমে ডেকে পাঠায় এবং এ বিষয়ে পাড়ানো বা আলোচনা করতে নিষেধ করে। এখানে উপস্থাপন করা হয়েছে গ্রান্ড ডাচেস ক্রিস্টিনাকে লেখা গ্যালিলিওর সেই চিঠির অনুবাদ।]
(Exploring the Cosmos: An Introduction to the History of Astronomy. Department of History, University of California, Irvine)
হে পবিত্র ও উচ্চ! আপনি জানেন যে বছর কয় আগে আমি নভোমন্ডলে এমন কিছু উদ্ঘাটন করেছি এর আগে যা কেউ করেনি। এই জিনিসগুলোর অস্তিত্ব এবং ক্রিয়াকর্ম দার্শনিকদের প্রাতিষ্ঠানিক মতাদর্শের থেকে আলাদা। এ কারণে তাদের অনেকে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছেন। তারা এমন ভাব করছেন যেন ওই বস্তুগুলো আমি নিজের হাতে আকাশে স্থাপন করেছি। আর তা করে বিশ্বপ্রকৃতি ও বিজ্ঞানকে উল্টে দিতে চাইছি। হয়ত তারা ভুলে গেছেন যে নতুন নতুন জ্ঞান আমাদের উন্নতি ও কল্যাণকে নিরুৎসাহিত বা ধ্বংস করে না। এসব আমাদেরকে উৎসাহিত ও উন্নত করে।
সত্যের থেকে তাদের নিজ মতের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে তারা এই নতুন বস্তুরাজিকে উপেক্ষা ও অপ্রমাণের চেষ্টা করেছেন। যদি তারা আগ্রহী হয়ে নিজের চোখে সেসব দেখার চেষ্টা করতেন তাহলে তারা বুঝতেন। এই অবস্থায় তারা ঝাঁপিয়ে পড়লেন আমার বিরোধিতায়। প্রকাশ করলেন অযুক্তিতে ভরা অজস্র লেখা। একাজে তারা একটা বড় ভুল করেছেন। তারা বাইবেল থেকে এমন সব উদ্ধৃতি দিয়েছেন যা অপ্রাসঙ্গিক। এমনকি এগুলো তারা ঠিকমতো বুঝতেও পারেননি ।
এসব ভুল তাদের হতো না যদি এ বিষয়ে সন্ত আগস্টিনের (Saint Augastine) মতাদর্শটা তারা জানতেন। অনেক দুর্বোধ্য বিষয়ে তিনি লিখেছেন। তাঁর কথা কেবল যুক্তি দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। গ্রহ-নক্ষত্রের বিষয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এখন থেকে সন্দেহপূর্ণ বিষয়ে আমাদের ধারণা বদল করতে সব সময় গভীর শ্রদ্ধার পরিচয় দিয়ে হবে। অপ্রসাঙ্গিকভাবে কিছু বিশ্বাস করা যাবে না। তা না করলে ভুল বশত আমরা সত্যের বিরোধী হয়ে পড়ব, প্রথাগত বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরব। এর ফলে সত্য এমন কিছু প্রকাশ করতে পারে যা বাইবেলের পুরাতন ও নতুন নিয়মের বিপরীত।’ যাইহোক, যে সত্যের কথা এখানে বলা হচ্ছে সময় সেই সত্যকে সবার সামনে প্রকাশ করে দিয়েছে। এছাড়া যারা পক্ষপাতহীন হয়ে আমার আবিস্কার অস্বীকার করেছিলেন, আর যারা আবেগে বেপরোয়া হয়ে আমাকে অবিশ্বাস করেছিলেন তাদের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে গেছে। তবে যারা জ্যোর্তিবিজ্ঞান এবং বস্তুলোক সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা রাখেন আমার কথা তারা প্রথম থেকে বোঝার চেষ্টা করেছেন।
এর বাইরেও কিছু মানুষ আছেন। এরা তাদের অ™ভুত চরিত্র এবং বুঝতে না পারার কারনে সত্যকে অস্বীকার করেছিলেন বা সন্দেহের মধ্যে ছিলেন। এরা কিছুটা হলেও বিশ্বাস অর্জন করেছেন। আমি জানি, এর বাইরেও অনেকে আছেন যারা ভুল বুঝলেও যেসব বস্তুর কথা আমি বলেছি সেসবের প্রতি নয় বরং তাদের উদ্ঘাটকের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ। এসব বস্তুর সত্যতা দীর্ঘদিন অস্বীকার করতে না পেরে আজ তারা নীরবতার আশ্রয় নিয়েছেন। যে কারনে অন্য বিরোধীরা নীরব হয়ে গেছেন সেই একই কারণে তারা উত্তেজিত হয়েছেন সব থেকে বেশি। এ কারনে আমার ক্ষতি করার জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছেন।
অতীতে যারা আমার বিরোধিতা করেছিলেন আর আজ যারা করছেন তাদের পিছনে মনোযোগ দেয়াটা অনুচিত। তাদের জন্য সব সময় করুণা হয় আমার। আমার ধারনা, আমার থেকে নিজেদের বেশি বিজ্ঞ প্রমাণ করার প্রতিযোগিতায় তারা নিন্দা ও নিপীড়ণের আশ্রয় নিয়েছেন। আমার বিরুদ্ধে তারা এত বেশি দোষারোপ করেছেন যে আমার কাছে তা মৃত্যুর থেকে বেশি কষ্টের। এটা ভেবে আমার অশান্তি লাগে যে যেসব মানুষ এই বিরোধীদের বা আমার সাথে সম্পৃক্ত তারা ছাড়াও আরও অনেকে বিষয়টা জেনেছেন। জ্যোর্তিবিজ্ঞান এবং দর্শনের প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি জানার পরও এরা আমাকে এবং আমার সবকিছুকে বিনষ্ট করতে বদ্ধ পরিকর। এই বিশ্বলোকের গঠন সম্পর্কে আমার ধারণা তারা জানেন। আমি মনে করি, মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য। পৃথিবী আর অন্য গ্রহগুলো আবর্তিত হচ্ছে তাকে কেন্দ্র করে।
তারা আরও জানেন যে নিছক টলেমি আর এরিস্টটলের বিরোধিতা করার জন্য আমি এসব বলছি না। আমি উপস্থাপন করেছি যথাযথ যুক্তি যা বস্তুলোকের বিষয়ে অন্য কোনভাবে উপস্থাপন করা যেতনা। এছাড়া এমন অনেক যুক্তি আমি দিয়েছি যা আমার নতুন আবিস্কার থেকে নেয়া। এগুলো খুব সহজে টলেমির ভুলগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আমার জ্ঞান ও প্রমাণের ফলে দর্শন নিয়ে তাদের ধারণা আজ আর সঠিক থাকছে না। এ কারণে নিজেদের পদ ও মর্যাদা রক্ষা করতে তারা নানান ছলে ধর্ম ও বাইবেলের ছায়ায় আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন। যেসব যুক্তি তারা বোঝেননি তা বোঝার বা খন্ডন করার চেষ্টা না করে অজস্র মিথ্যা বিশ্বাস তারা আঁকড়ে ধরে আছেন।
আমার বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা বলছেন যে আমার বক্তব্য বাইবেল বিরোধী। এজন্য সেসব নিন্দনীয় এবং ধর্মদ্রোহের শামিল। তারা জানেন অন্যায়ভাবেও যখন মানুষ অন্যকে নিপীড়ন করে তখনও সে নিজের পক্ষে যুক্তি খুঁজে নেয়। এক্ষেত্রে ন্যায় তাদের অনুপ্রাণিত করে না। এক্ষেত্রেও তারা এমন অনেককে পেয়ে গেলেন যারা তাদের অবস্থান থেকে নিন্দা ও কুৎসা রটাবেন। এভাবে অধর্মাচরণ আর অবিবেচনা দিয়ে তারা কেবল একটা মতাদর্শ আর তার অনুসারীদের নয় উপরন্তু সমস্ত গণিত এবং গণিতজ্ঞদের ক্ষতি করলেন। এসব বকধার্মিকের দল গুজব ছড়াতে লাগলেন যে আমার মতাদর্শ অনেক আগেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিন্দিত হয়েছে। এটা তারা জানতেন যে প্রতিষ্ঠানিক নিন্দা কেবল আমার প্রস্তাবনাকে নয় উপরন্তু জ্যোর্তিবিজ্ঞান ও বস্তু লোকের যেসব পর্যবেক্ষণের সাথে এর যোগ আছে তার সব কিছুকে আহত করে।
তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে তারা এমন কাজ করলেন যাতে সাধারণ জনগণের অন্তত মনে হয় যে এই ধারণাটা একেবারে নতুন। আর আমি একাই তা লালন করি। এই মতাদর্শের উদগাতা কোপার্নিকাসকে তারা না চেনার ভান করলেন। অথচ তিনি ছিলেন একজন ক্যাথলিক, যাজক এবং ধর্মসঙ্ঘের এক সম্মানিত ব্যক্তি। গির্জার কাছে তিনি এতটা সম্মানিত ছিলেন যে দশম লিও (Leo X) এর অধীনে ল্যাটেরান কাউন্সিল (Lateran Council) ক্যালেন্ডারের সংস্কারের ভার কোর্পানিকাসের ওপর অর্পণ করেন। এ জন্য কোর্পানিকাসকে জার্মানীর দুর্গম একটি অঞ্চল থেকে রোমে আসতে হয়। সে সময় দিনপঞ্জিকায় বছরের হিসাব সঠিক ছিলনা এবং চন্দ্র মাসের হিসাবেও ভুল ছিল। তখন একাজের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ক্যুমের বিশপ (The Bishop of Culm)। মহাজাগতিক বস্তুরাজির সঠিক হিসাব নিকাশের জন্য পঠন পাঠন ও পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব তিনি কোপার্নিকাসকে দেন। এ কাজে তিনি কঠোর সাধনায় নিয়োজিত হয়ে পড়েন। এতে জ্যোর্তিবিজ্ঞান এবং মহাজাগতিক বস্তুর গতিবিধি সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান যথেষ্ট উন্নত হয়। তিনি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন একজন জ্যোর্তিবিজ্ঞানী হিসাবে। তখন থেকে কেবল বর্ষপঞ্জী বা ক্যালেন্ডার নয় গ্রহরাজির গতিবিধির পরিমন্ডলেও তাঁর পদ্ধতি অনুসরন করা হচ্ছে।
পরবর্তীতে ক্যাপুয়ার কার্ডিনাল (Cardinal of Capua) এবং ক্যুম এর বিশপের অনুরোধে তাঁর এ কাজকে তিনি প্রকাশ করেন ’অন দ্য সেলেস্টিয়াল রেভ্যুলেশনস’ (On the Celestial Revolutions) বা ’মহাজাগতিক আবর্তনের বিষয়ে’ নামক বইয়ে। বইটি তিনি তৃতীয় পোপ পলকে (Pope Paul III) উৎসর্গ করেন। পোপের আদেশে এ বিষয়ক দায়িত্ব তাঁর ওপর ন্যস্ত থাকে। মুদ্রিত হবার পর বইটি পবিত্র গীর্জার দ্বারা গৃহীত হয়। তখন থেকে বইটি পঠিত হয়ে আসছে। এর আদর্শ বা শিক্ষার বিপক্ষে কেউ কখনও টু শব্দটিও করেননি। যদিও কোপার্নিকাসের শিক্ষা ও আদর্শের পক্ষে যথাযথ অভিজ্ঞতা এবং প্রয়োজনীয় প্রমাণ রয়েছে তবু এমন মানুষ রয়েছেন যারা একজন লেখকের সুনাম নষ্ট করতে চান তার লেখা বই ভালোভাবে না পড়ে। তারা তাকে বলতে চান, ধর্মদ্রোহী! স্রেফ নিজেদের অসৎ ইচ্ছা চরিতার্থ করতে তারা আমার বিরোধিতা করছেন। তারা বলছেন যে আমি কোপার্নিকাসের শিক্ষা ভিন্ন অন্যকিছু প্রমাণ করতে উদ্যোগী নই।
অন্যায়ভাবে তারা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়াচ্ছেন। সবার সামনে নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার গুরুভার তাই আমার ওপর এসে পড়েছে। তাদের ধর্মীয় মতামত এবং সম্মানকে আমি শ্রদ্ধা করি। এসব কারণে সেসব বিষয়ে আমাকে এখন বলতে হচ্ছে যা দিয়ে তারা আমার তত্ত্ব এবং মতামতকে কুরুচিপূর্ণ আর ধর্মদ্রোহের শামিল বলছেন। তারা তাদের চারপাশে ধর্মীয় আবেগের একটি কপট আবরণ তৈরি করে নিয়েছেন। তারা বাইবেল প্রচারণার নামে নিজেদের বিদ্বেষপূর্ণ উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। আমার ভুল হয়ে না হয়ে থাকলে, তারা বাইবেলের শিক্ষার বিপরীত এবং পবিত্র ধর্মগুরুদের ইচ্ছার বিপক্ষে গিয়ে এমন সব বিষয়ে চেচামেচি করছেন যার সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের কোন যোগ নেই। যুক্তি এবং বিবেচনাকে উপেক্ষা করে তারা আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করছেন বাইবেলের সেসব অংশের দিকে যার ভিতর ভিন্ন অর্থ আছে।
তাদের থেকে অধিক ধর্মানুরাগের সাথে আমি বলছি যে আমি বাইবেলের বিরোধিতা করছি না। বরং এটি যথাযথভাবে এবং বারবার পাঠ না করে যে উপায়ে তারা কথা বলছেন আমি শুধু সেসবের বিরোধী। কোপার্নিকাস কখনো ধর্ম বা বিশ্বাসের ব্যাপারে আলোচনা করেননি। এ জাতীয় কোন লেখাকে তিনি ব্যবহার করেননি পাছে তাঁর ব্যাখ্যা ভুল হয়। তিনি সব সময় গ্রহলোকের গতিবিধির ব্যাখ্যায় জ্যোর্তিবিজ্ঞান এবং জ্যামিতির আশ্রয় নিয়েছেন। আবার বাইবেলকে তিনি উপেক্ষাও করেননি। তিনি বুঝতেন যে তাঁর মতামত যদি সঠিক হয় এবং ধর্মীয় বাণী যদি ঠিক মতো বোঝা যায় তবে তারা একে অন্যের বিরোধী হবে না। এ কারনে তিনি বইটি পোপকে উৎসর্গ করে লেখেন,
“যদি কোন মূর্খ গণিতবিদ আমার এসব প্রস্তাবনা এবং বক্তব্যের বিপক্ষে ব্যাখ্যা দেন, এবং ধর্মের উল্লেখ করে এগুলোকে প্রত্যাখান করেন তবে তাদের কথাকে আমি মূল্যহীন বলে প্রত্যাখান করব।” এ প্রসঙ্গে লাকটানটিয়াস (Lactanius) নামের একজন গণিতবিদের নাম এসেছে। যদিও তিনি অন্য বিষয়ে একজন যোগ্য লেখক, পৃথিবীর আকার সম্বন্ধে অতি শিশুসুলভ বক্তব্য দিয়েছেন। যারা পৃথিবীকে বৃত্তাকার বলেন তিনি তাদের ব্যঙ্গ করেছেন। কাজেই এ জাতীয় লোকেরা যদি আমাকে উপহাস করেন তবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অবশ্য যদি আমি ভুল করে না থাকি তবে গণিতবিদেরা গণিতের ক্ষেত্রে আমার অবদান গ্রহণ করবেন ঠিক যেভাবে আপনার অধীনস্ত পবিত্র গীর্জা এটিকে গ্রহণ করেছে।”
এরা হচ্ছেন সেইসব মানুষ যারা আমাদের পিছু নেন এবং ঠিকমতো না জেনে কোপার্নিকাসের মতো মানুষ ও লেখকের নিন্দা করেন। এরা বাইবেল, ধর্মতত্ত্ববিদ এবং চার্চ কাউন্সিল থেকে যথেষ্ট বক্তব্য জোগাড় করেন। এরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে তারা শুধু সঠিকই নন উপরন্তু তাদের এই বিরোধীতাও প্রশংসনীয়। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আমি সর্বোচ্চ বলে বিশ্বাস করি, তাদের বিরোধিতা করাকে হঠকারিতা বলে মনে করি যতক্ষণ পর্যন্ত গীর্জার আচরণবিধি মেনে ঠিক মতো মেনে চলা হয়।
তারপরও গীর্জার আদর্শের বাইরে গিয়ে কিছু মানুষ যখন ব্যক্তিগত লাভের উদ্দেশ্যে এসব প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে চান তখন তাদের বিপক্ষে বলা কোনো ভুল নয়। এ কারণে এই প্রবন্ধে আমি নিজেকে সেসব ভুলের থেকে দূরে রাখতে চাই যা ধর্ম-বিষয়ে আমার না জানার কারণে ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে কারও সাথে কোন বিতর্কিত বিষয়েও আমি তর্কে যেতে চাই না । এখানে আমার একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে আমার পেশার বাইরের এসব ভুলের ভিতর যদি এমন কিছু থাকে যা কোপার্নিকাসের নিয়মের বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে পবিত্র গীর্জার কাজে আসবে তবে নির্দ্ধিধায় তারা গ্রহণ এবং ব্যবহার করতে পারেন। আর যদি তা না হয় তবে তারা এটিকে ছিড়ে টকুরো টুকরো করতে পারেন বা আগুনে জ্বালাতে পারেন। এমন অনেক জিনিস যা আমি নিজ কানে শুনেছি তা পুণপ্রমাণ করব। এটাই যদি তাদের ইচ্ছা হয় তবে আমি আমার ভুল স্বীকার করব। কাজেই আমি যে উত্তর দিচ্ছি তা কেবল তাদের উদ্দেশ্যে নয় উপরন্তু যে কেউ এ ধারণা পোষণ করেন তাদের সবার উদ্দেশ্যে।
আমার কথা বাতিল করতে তারা বাইবেলের সেসব বাণী ব্যবহার করছেন যাতে রয়েছে স্থির পৃথিবীর সাপেক্ষে সূর্য ঘূর্ণায়মান। যেহেতু বাইবেল ভুল করতে পারে না তাই যিনি সূর্যের সাপেক্ষে পৃথিবীকে ঘূর্ণায়মান বলছেন তিনি ভুল করছেন। তার এই ভুল ধর্মদ্রোহিতার শামিল। এর প্রেক্ষিতে আমি বলব, পবিত্র বাইবেল যে কখনও অসত্য বলেনা সেটা খুব ধার্মিক এবং বিবেচনার কথা। তবে যে সত্যের কথা সেখানে বলা হচ্ছে সেই সত্যটাকেও ঠিক মতো বোঝা দরকার। এ প্রসঙ্গে বলব, বাইবেলে অনেক গূঢ় কথা রয়েছে যার অর্থ কথাটার সাধারন অর্থের থেকে আলাদা। অর্থাৎ, কেউ যদি কেবল ব্যাকরণভিত্তিক বিশ্লেষণ দিয়ে বাইবেল ব্যাখ্যা করতে যান তবে তিনি ভুল করবেন। এতে আমরা সত্যের থেকে দূরে সরে যাব এবং বিপথগামী হয়ে পড়ব। আর এটা বোকার মতো কাজ। কাজেই আমাদের উচিত নিজের নিজের শরীর, মন এবং অতীত-ভবিষ্যত ভুলে গিয়ে একনিবিষ্ট হয়ে ঈশ্বরের নিকট সমার্পণ করা। সর্বসাধারণের জন্য সব কিছু বলা হয়েছে বাইবেলে। তবে যারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে পারেন না তাদের জন্য বিশেষ ব্যাখ্যাও দরকার। এই মতামতটি ধর্মবিদদের এত বেশি জানা আছে যে এর প্রমাণ দেয়াটা বাড়াবাড়ি হবে।
যেখানে বাইবেলের বক্তব্য দুর্বোধ্য এবং কঠিন সেসব ক্ষেত্রে সাধারণের কাছে সুবোধ্য করে তোলার চেষ্টা করতে হবে। তা না হলে তাদের সন্দেহ তাদেরকে বেশি বেশি একগুয়ে করে তুলবে। বাইবেলের অতিগুরুত্বপূর্ণ কিছু কথাও, সাধারণ বিচারে, দুর্বোধ্য। যেমন, ঈশ্বরের এমন কিছু গুণাবলীর কথা এখানে বলা হয়েছে যা কোন ক্রমে ঐশ্বরিক নয়। এমনকি কখনও কখনও তা অনৈশ্বরিক। তাহলে এসব বিষয়ে কারা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে? কারা বলবে যে জল স্থল পৃথিবী সূর্য এবং সৃষ্ট সব বিষয়ে বাইবেলের বক্তব্য এবং ঈশ্বর-বিষয়ক বক্তব্যের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট সীমারেখা রয়েছে? এসব কথা বাইবেলের প্রধান বিষয় ঈশ্বর ও আতœার মুক্তির বিষয় থেকে দূরে রয়েছে। অবশ্য এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষ মোটেও চিন্তা করেন না।
আমি মনে করি, বস্তুলোকের সমস্যার ক্ষেত্রে ধর্মগ্রন্থের বক্তব্য থেকে শুরু না করে শুরু করা উচিত মানুষের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি প্রয়োগের ওপর। কারন পবিত্র বাইবেল হচ্ছে পবিত্রাত্মার বাণী। আর প্রাকৃতিক নিয়মাবলী সৃষ্টিকর্তার কর্ম ও কার্যাদেশ। সব মানুষের কাছে পৌঁছানোর জ্ন্য বাইবেলে সহজ কথায় অনেক কিছু বোঝাবার চেষ্টা করা হয়েছে। এগুলো অনেক সময় পরম সত্য (absolute truth) থেকে আলাদা। অন্যদিকে প্রকৃতি অপ্রতিরোধ্য এবং অপরির্তনীয়। প্রকৃতি সব সময় তার নিয়মে চলে। তার কাজের কারন মানুষ জানুক বা না জানুক তার পরোয়া সে করে না। এ কারণে আমাদের বিবেচনা এবং বাইবেলের বক্তব্য অনেক সময় আলাদা মনে হয়। অবশ্য বাইবেলের যে কোন কথার গভীরে অন্য অনেক অর্থ থাকতে পারে। এছাড়া বাইবেলের বক্তব্য সব সময় এতটা নিয়মতান্ত্রিক নয় যতটা নিয়মতান্ত্রিক প্রকৃতির নিয়ম। আমি এটা বলছি না যে বাইবেলের বক্তব্য কম মহিমান্বিত। টেরতুলিনের (Tertullian) কথায়, “সৃষ্টিকর্তার প্রথম প্রকাশ প্রকৃতির ভিতর তার কাজের মধ্যে। অত:পর তিনি প্রকাশিত তার পাঠানো বাণীতে।” এ কথায় কেউ যেন মনে না করেন যে পবিত্র গ্রন্থের প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা নেই। আমি মনেকরি, পদার্থবিজ্ঞানে উদ্ঘাটিত সত্য বাইবেলে প্রকাশিত বক্তব্যের ব্যাখ্যায় যেন সহায়ক হতে পারে সেভাবে আমাদের চেষ্টা করা উচিত। কারন উভয়ই সত্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। বাইবেলের বিষয়ে আমি বলব যে এটা মানুষকে সেসব বিবেচনার দিকে নিয়ে যায় যা বিজ্ঞান বা অন্য কোন যুক্তিতে আমরা পাই না। কেবল পবিত্র সত্ত্বার (Holy Spirit) বাণীতে আমরা তা পেয়ে থাকি।
যেসব বিষয় বিশ্বাসের অংশ নয় এবং যা যুক্তিদ্বারা সমর্থিত সেসবকে আমরা যার পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ নেই তার ওপর স্থান দিতে পারি। এ কথা ঠিক যে দিব্যজ্ঞান (divine wisdom) মানুষের বিবেচনা ও অনুমানের ওপারে। নীতিগতভাবে আমি কখনো মনে করি না যে ঈশ্বর আমাদেরকে অনুভব, যুক্তি ও মেধা দিয়েছেন এসবের ব্যবহার থেকে আমাদেরকে বিরত রাখার জন্য। এবং এও নয় যে, সেসব ব্যবহার করে জ্ঞান অর্জন করার চাইতে তিনি আমাদেরকে অন্য কোন উপায়ে জ্ঞান দিতে আগ্রহী। আমাদের চোখ ও মনের সামনে বিরাজমান বিশ্বের অনুসন্ধানে যুক্তিবোধ ও ইন্দ্রিয়ের প্রয়োগ থেকে রিবত থাকতে তিনি আমাদেরকে বলেননি । কথাটা বিজ্ঞানের সেসব শাখার জন্য আরো বেশি সত্য যেগুলোর সম্বন্ধে বাইবেলে সামান্য বলা আছে। উদাহরন হিসাবে জ্যোর্তিবিজ্ঞানের কথা বলা যায়। এক্ষেত্রে গ্রহগুলোর মধ্যে কেবল শুক্রের (Venus) নাম আছে কয়েকবার তাও লুসাইফার (Lucifer) নামে।
ঐশি বাণীর কাজ যদি মহাবিশ্বের বিন্যাস ও বিস্তার সম্পর্কে মানুষকে জ্ঞান দেয়া হতো অথবা বাইবেল থেকে সে জ্ঞান মানুষ অর্জন করবে এমন উদ্দেশ্য থাকত তাহলে, আমার মতে,অন্য অনেক বিষয়ের তুলনায় এ বিষয়ে খুব কম সেখানে বলা হয়েছে। বাইবেল প্রণেতারা এ বিষয়ে অবশ্যই অবগত ছিলেন। কিন্তু তারপরও তারা মহাকাশ, নক্ষত্ররাজি বা এদের আকার আকৃতি বা দূরত্বের বিষয়ে কিছু শেখাবার ছল করেননি। এই মতামত সর্বাধিক শিক্ষিত এবং পবিত্র পোপ বা যাজকদেরও। এ প্রসঙ্গে সন্ত অগাস্টিন বলেন,
বাইবেল অনুসারে মহাবিশ্বের গঠন নিয়ে আমাদের কী বিশ্বাস করা উচিত তা নিয়ে অনেকে তর্ক করেন। আমাদের লেখকেরা পরম সহিষ্ণুতার সাথে এ বিষয়ে বলা থেকে বিরত থেকেছেন। তারা ধর্মীয় জীবনের সাথে এটাকে গুলিয়ে ফেলেননি। এক্ষেত্রে তারা ধর্মীয় বিবেচনার পিছনেও সময় ব্যয় করতে বলেননি। আমার কাছে এটা কি কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে পৃথিবী বিশ্বব্রহ্মান্ডের কেন্দ্র হয়ে বিরাজ করছে নাকি তা একটা চ্যাপ্টা থালার মতো আবর্তিত হচ্ছে? পক্ষান্তরে, পবিত্র গ্রন্থে আস্থার কথা এ কারণে বলা হয়েছে যেন ঐশ্বী বাণীতে অজ্ঞতার কারণে বাইবেল থেকে উদ্ধৃত কোন বিষয় যখন সুসুই প্রমাণের বিপক্ষে যাচ্ছে বলে মনে হয় তখন যেন তা আমাদেরকে সত্য-কে সন্দেহ করতে প্ররোচিত না করে-তা শেখানো জানানো বা অন্য কোন ফলপ্রসূ কাজে হোক। সুতরাং সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলি যে মহাবিশ্বের বিষয়ে আমাদের লেখকেরা অনেক সত্য জানেন কিন্তু মানবাত্মার মু্িক্তর সাথে সম্পৃক্ত নয় এমন বিষয়ে নিয়ে মানুষকে জানানোটা পবিত্রাতœা তার কর্ম বা উচিত বলে মনে করেন না।
বিশ্বাসের বিষয়ে পবিত্র লেখকেরা যখন মহাবিশ্ব নিয়ে লেখেন তখন তার পরের অধ্যায়েও সন্ত আগস্টিন তাদেরকে অগ্রাহ্য করেন। এ-প্রশ্ন যখন আসে যে এ বিশ্বলোক স্থির না বিচরণশীল তখন তিনি লেখেন,
আমাদের কোন কোন ভাই মহাবিশ্বের গতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন যে এটি স্থির না বিচরণশীল। যদি এটি বিচরণশীল হয় তবে কিভাবে চন্দ্র সূর্য সমেত সমস্ত আকাশকে স্থির মনে হয়? আবার যদি এটি স্থির হয় তবে কিভাবে তারাগুলো পূর্বে পশ্চিমে স্থান বদল করে? একটা তারা যত বেশি উত্তরে অবস্থিত উত্তর গোলার্ধের সাপেক্ষে এটি তত কম দূরত্ব অতিক্রম করে। এর কারণে নভোমন্ডলকে কোন অক্ষের (axis) ওপর বিবরণশীল বলে মনে হয় নাকি কোন চাকতির মতো এটি ঘূর্ণনশীল বলে মেনে যায়? এর উত্তরে আমি বলব যে এসব বিষয় যথাযথ জানবার জন্য অনেক সূক্ষè ও সুনির্দিষ্ট জ্ঞানের প্রয়োজন। কিন্তু সেসব জ্ঞানালোচনার যথেষ্ট সময় আমার নেই। এবং তা করার দায়িত্ব আমার নয়। বরং আমি তাদের নাজাতের (salvation) সহজ উপায় নিয়ে বলতে পারি যা পবিত্র গীর্জার উপকারে আসবে।
অগাস্টিনের এসব কথা থেকে বলতে পারি যে পবিত্র আত্মা আমাদেরকে নভোমন্ডল স্থির না বিচরণশীল তা জানাতে আগ্রহী নয়।
এর আকার বর্র্তূল (spherical) না গোল নাকি সমতল, পৃথিবী বিশ্বমন্ডলের কেন্দ্রে নাকি একপ্রান্তে এ বিষয়গুলো নিয়ে খুব কম আমরা সেখান থেকে জানতে পারি। এছাড়া পৃথিবী ও সূর্যের গতি এবং তাদের অবস্থান ওপরের বিষয়গুলোর সাথে এত নিবিড় ভাবে জড়িত যে এদের একটাকে অজানা রেখে অন্যটাকে জানা সম্ভব নয়। এখনব পবিত্র আত্মা উদ্দেশ্যমূলকভাবে আমাদেরকে এসব বিষয়, যা আমাদের নাজাত বা চূড়ান্ত লক্ষ্যের সাথে কোনভাবে জড়িত নয়, জানানোকে উপেক্ষা করে যান। এক্ষেত্রে একজন মানুষ কিভাবে বলতে পারেন যে এসব বিষয়ে পক্ষ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা আদৌ রয়েছে? কিভাবে এ কথা বলা যায় যে, মহাবিশ্ব নিয়ে এই এই বিশ্বাস থাকাটা ধর্ম বিশ্বাসের জন্য আবশ্যক এবং এই এই বিশ্বাস ভুল? কোন মতামত যদি আত্মার মুক্তির বিষয় না হয় তবে কিভাবে তা ধর্মদ্রোহী মতামত হবে? আর এমন কি হতে পারে যে একটা বিষয় নাজাতের জন্য আবশ্যক কিন্তু পবিত্র আত্মা আমাদেরকে তা জানানো থেকে বিরত আছেন? এখানে আমি একজন পাদ্রীর কাছে শোনা একটা কথা বলছি। তিনি বলেছিলেন, “পবিত্র আত্মা আমাদের জানাতে চান স্বর্গে বা বেহেস্তে যাবার পথ কিন্তু স্বর্গলোক বা মহাকাশ কোন পথে আবর্তিত হয় তা জানানোটা তার উদ্দেশ্য নয়।”
তারপরও পরীক্ষণ এবং পর্যবেক্ষণ দ্বারা অর্জিত জ্ঞান কতটা নির্ভরযোগ্য সে বিষয়ে পবিত্র ও জ্ঞানময় ধর্মবিদ্যা বিশারদদের (Theologians) কিছু উক্তি তুলে ধরছি:
মোজেস (বা মুসা আঃ)-এর আদর্শ নিয়ে কথা বলার ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। কারন, যদি কোন কিছু পরীক্ষিত প্রমাণ বা বিজ্ঞান বা দার্শনিক যুক্তির বিপক্ষে যায় তবে সে বিষয়ে দৃঢ়তার সাথে আমরা কিছু বলতে পারব না। কারণ প্রতিটি সত্য অন্য সব সত্যের সাথে এক তারে বাঁধা। বাইবেল বা ঐশী বাণীর (Holy Writ) সত্য কখনও যুক্তি এবং মানব জ্ঞানের বিরোধী হতে পারে না।
এবার সন্ত অগাস্টিনের দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। অগাস্টিন বলছেন, “যদি কেউ বাইবেলের কোন বক্তব্যের বিপরীতে পরিষ্কার ও সুস্পষ্ট প্রমাণ হাজির করেন তবে তার মানে এটা নয় যে তিনি বাইবেলে প্রকাশিত সত্য যা তার বোধগম্য নয় তার বিরোধিতা করছেন। বরং এটা তার নিজস্ব ব্যাখ্যা যা তিনি তার কাজ ও কল্পনার মধ্যে পেয়েছেন। বাইবেলে যা আছে এটি তা নয়।”
তবে এটা সত্যি যে দুটি সত্য কখনও একে অন্যের বিরোধী নয়। এটা ব্যাখ্যাকারের কাজ যে তিনি ধর্মগ্রন্থের যথাযথ ব্যাখ্যা দাঁড় করাবেন। সেই ব্যাখ্যা প্রশ্নাতীতভাবে আমাদের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ দ্বারা অর্জিত ধারণার সাথে খাপ খেয়ে যাবে। এখন বাইবেলের দিকে তাকালে দেখা যায় অনেক স্থানে বাইবেলের ব্যাখ্যা আমাদের প্রস্তাবিত যুক্তির থেকে আলাদা। উপরন্তু এটা নিশ্চিত যে বাইবেলের ব্যাখ্যাকারদের প্রত্যেকে ঐশী অনুপ্রেরণা থেকে লেখেননি। তা হলে একের ব্যাখ্যার সাথে অন্যের ব্যাখ্যার কোন পার্থক্য হত না। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, এটা পরিণামদর্শিতা হবে যদি ধর্মগ্রন্থ জোর পূর্বক মহাবিশ্ব সম্পর্কে কোন উপসংহার আসার সুযোগ কোন মানুষকে না দেয়। কারন ভবিষ্যেতর পরীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ বা যুক্তি তাদের কথার বিপরীত কিছু প্রকাশ করতে পারে। কে মানুষের উদ্ভাবনী শক্তিকে বাঁধতে পারে? এই নিশ্চয়তা কে দিতে পারে যে এই মহাবিশ্বে জানা সম্ভব এমন সব কিছু জানা হয়ে গেছে? তার চেয়ে বরং আমরা এটা স্বীকার করে নিই যে “আমাদের অজ্ঞতার তুলনায় যা কিছু আমরা জানি তা খুবই সামান্য।”
পবিত্র আত্মার কাছ থেকে আমরা জানি যে ঈশ্বর এই পৃথিবীতে মত-বিরোধ সৃষ্টির সুযোগ করে দিয়েছেন যেন মানুষ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তার সেই কাজকে উদ্ঘাটন করতে না পারে। আমার মতে, যদি সব কিছু জানা হয়ে যায় তবে কারও উচিত নয় সেই মতাদর্শের বিরোধিতা করে স্বাধীন দার্শনিক মতামত প্রকাশে বাঁধা দেয়। আবার যদি তা সর্বসাধারণের মতামতের বিপক্ষে যায় তবে তাকে হঠকারী বলাটাও ঠিক হবে না। বস্তুলোক নিয়ে কোন মতামত যা অনেকের মতের সাথে মেলেনা তার জন্য কোন মানুষ নিন্দিত হতে পারেন না। এসব বিষয়ে দার্শনিকেরা হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বির্তক করে আসছেন। এরকম একটি বিষয় হচ্ছে, সূর্য স্থির এবং পৃথিবী বিচরণশীল। এ মতাদর্শ বিশ্বাস করতেন পিথাগোরাস (Pythagoras) ও তার অনুসারীরা, হেরাক্লিডাস(Heracleides of Pontus), ফাইলোলাস (Philolaus) যিনি প্লেটোর শিক্ষক ছিলেন এবং (এরিস্টটলের ভাষ্যমতে) প্লেটো স্বয়ং। প্লুটার্ক (Plutarch) তার নুমার জীবনী (Life of Numa) বইতে জানাচ্ছেন যে পরিণত বয়সে প্লেটো বলেছেন যে, এর অন্যথা অর্থাৎ, পৃথিবী স্থির ও সূর্য বিচরণশীল, বিশ্বাস করাটাই অযৌক্তিক। আর্কিমিডিসের (Archimedes) মতে, একই মত প্রকাশ করেছেন সামোস এর এরিসটারকাস (Aristarchus of Samus) । সিসেরো (Cierro) এবং আরও অনেকের মতে, এই মত গণিতজ্ঞ সেল্যুকাস (Seleucus) ও দার্শনিক নিকেটাসেরও (Nicetas) । পরিশেষে এই মতামতকে অনেক পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের পর বিশদ ও সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের সামনে হাজির করেন নিকোলাস কোপারনিকাস। উপরন্তু, দার্শনিক সেনেকা (Seneca) ধূমকেতুর ওপর লিখতে গিয়ে বলেছেন, আমাদের ধৈর্য্য ও পরিশ্রমের মাধ্যমে এটা উদ্ঘাটন করতে হবে যে পৃথিবীর আহ্নিক গতি [যে গতির কারণে পৃথিবী প্রতি ২৪ ঘন্টায় যে একবার নিজ অক্ষে প্রদক্ষিণ করে সেই গতি] কী পৃথিবীতে আছে নাকি তা আকাশে।
আমার মতে, আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন কোন বিষয় বা আদর্শ যদি সুনির্দিষ্ট হয় তবে তার বিরোধিতা বা তা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা থেকে আমরা বিরত থাকব। কোন একজন বা একদল মানুষের অনুরোধে তেমন কিছু করাটা অযৌক্তিক। এই মানুষেরা যেমন ঐশী আদেশে এসব করছেন না তেমনি বস্তজগকে জানার জন্য যতটা বোঝাপড়া দরকার তা তাদের নেই। এমনকি পরীক্ষণ (Demonstration) যা বিজ্ঞানের যে কোন সিদ্ধান্তে আসতে একান্ত আবশ্যক তাও তাদের অজানা।
খোলাখুলিভাবে বললে, অনভিজ্ঞ বা হীন মানসিকতার লেখকরা যখন বাইবেলের বিভিন্ন বক্তব্যের মনগড়া ব্যাখ্যা তৈরি করেন তখন তা প্রতিহত করাটা এক ধরনের শিষ্টাচার। এরা উদ্ভট কথা দিয়ে তাদের লেখাগুলো সাজিয়ে মানুষের সামনে হাজির করেন। এ ধরণের অপকর্মের অজস্র উদাহারণ দেয়া যেতে পারে। এই লেখায় আমি কেবল দুটো উদাহরণ দেব যা জ্যোর্তিবিজ্ঞানের সাথে মেলে। প্রথমত, আমি বলব সেইসব লেখার কথা যেগুলো আমার বইগুলোর বিরোধিতা করে লেখা। সেখানে পবিত্র গ্রন্থ থেকে অনেক উদ্ধৃতি ব্যবহার করা হয়েছে। যখন সবাই এই বইগুলো দেখেছেন আমি জানতে চাইব, আমার বিরোধীরা কি যুক্তি দেবেন নিজেদের অজ্ঞতাকে মেনে নিতে! অন্য উদাহরণটি এমন একজন মানুষের যার লেখা তুলনামূলক পরে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি জ্যোর্তিবিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের বিরোধিতা করে বলছেন যে চাঁদ সূর্যের আলোয় আলোকিত নয় বরং সে তার আপন আলোয় উজ্জ্বল। এই কথার সমর্থনে তিনি বাইবেলের শুষ্কসূর্য (Sundry) বিষয়ক অংশ থেকে উদ্ধৃতি দেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে বাইবেলের এই অংশটুকু ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না যদি তার তত্ত্বকে সত্য বলে স্বীকার করা না হয়। যদিও চঁাঁদ নিজে যে অন্ধকার তা দিবালোকের মত পরিষ্কার।
এখন এটা পরিষ্কার যে যুক্তি এবং বোধ যত স্পষ্ট হোক না কেন এই ধরণের লেখকদের যদি কোন ক্ষমতা থাকত তবে তারা বাইবেলের অর্থ না বুঝে অন্যদের ওপর তা চাপিয়ে দিতেন। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন এসব বিষয় মেনে নেয়া থেকে। তা না হলে খুব শিঘ্রি জ্ঞান বিজ্ঞানের দুয়ার বন্ধ করে দিতে হবে। বাইবেল ও বিজ্ঞান দুটোই বোঝেন এমন লোকের সংখ্যা এ দুটো বোঝেন না এমন লোকের তুলনায় অনেক কম। যারা জানেন না তারা বাইবেলের ওপর ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে নিজেদের নিয়োজিত করেন পদার্থবিজ্ঞানের প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর দিতে। এক্ষেত্রে তারা ভুল বুঝে সেইসব শব্দ ব্যবহার করেন যা ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। জানা লোকের সংখ্যা যেহেতু অল্প তাই না-জানা লোকদের সাথে তারা পেরে ওঠেন না। লেখাপড়া ও পরিশ্রম না করে জ্ঞানীর পরিচয় পাওয়াটা অনেক মধুর। এ কারণে তাদের অনুসারীর সংখ্যাও হয় বিপুল। মহান সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে এ জাতীয় বিপদ থেকে তিনি আমাদের রক্ষা করেছেন। তিনি এ জাতীয় লোককে সর্বক্ষমতার অধিকারী করেননি। তাদের আলোচনা বা সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাও দিয়েছেন সামান্য। সর্বোচ্চ জ্ঞান এবং মঙ্গলের দায়ভার যা বিজ্ঞ যাজকেরা পবিত্রাত্মার (Holy Ghost) তত্ত্বাবধানে করে থাকেন তার নির্দেশাবলীও তাদের অধীন নয়। এ ধরণের অগভীর চিন্তার মানুষদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি দেয়ার দরকার নেই। মৃত্যু এবং পবিত্র লেখকদের (Holy Authors) অভিশাপ তাদের ওপর। বাইবেলের উদ্ধৃতি দিয়ে সেইন্ট জেরম (St. Jerome) এ বিষয়ে বলছেন,
“বিষয়গুলো কঠিন হয়ে উঠেছে বাচাল বুড়ি, বিপথগামী বুড়ো এবং সোফিস্টদের (Sophist) বাজে কথার কারনে। কোনো কিছু ভালোভাবে শেখার আগে তারা অন্যদের শেখাতে চান। অন্যেরা আবার জটিল সব শব্দ এবং দার্শনিক কথা দিয়ে নারী সমাজে ঐশীবাণী প্রচার করতে চান। আর কিছু লোক আছেন যারা নিজেরা না বুঝলেও এসব ব্যাখ্যা করেন। আমি যে পেশায় নিয়োজিত (অর্থাৎ, শিক্ষকতা) এ পেশার লোকদের প্রতি সহনশীল হয়েও বলছি, তারা এমনভাবে সবার সামনে বাইবেলের কথা হাজির করেন যাতে মনে হয় যে তাদের সব কথাই আমাদের ঐশ্বরের আদেশ বলে মানতে হবে। নবী রসুলেরা যা বলেছেন তারা তোয়াক্কা না করে তারা মনগড়া কথা বলেন। তারা এমনভাবে তা করেন যাতে বোঝা যায় না যে বাইবেল বা তার অংশবিশেষ তারা বিকৃত করে চলেছেন। বরং তা সবার কাছে সঠিক বলেই মনে হয়।”
এসব লেখকদের আমি সেসব ধর্মতাত্ত্বিকদের সাথে এক করে দেখতে চাইনা যারা শিক্ষা এবং সততার কারণে আমার মনে মর্যাদার আসন লাভ করেছেন। তারপরও আমি একটু অস্বস্তি অনুভব করি যখন তারা ঐশী আদেশের দোহাই দিয়ে জাগতিক বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিতে মানুষকে বাধ্য করেন। তারা বলেন যে তাদের কথা বাইবেলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ । বস্তজগতের যেসব যুক্তি ও অভিজ্ঞতার সাথে বাইবেলের অমিল সে বিষয়ে বলাও যে তাদের দায়িত্ব এটা তারা স্বীকার করেন না। এক্ষেত্রে তাদের মতামত হলো, ধর্মবিজ্ঞান সব বিজ্ঞানের রাণী। ধর্মবিজ্ঞানকে তাই তার অধীনস্ত অন্য কোন বিজ্ঞানের অনুসারী হবে না। বরং, জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্য ধারাগুলো ধর্মতত্ত্বের অনুগামী হবে। তারা বলেন, যদি পরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণের ফলে এমন কিছু জানা যায় যা বাইবেলের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে তবে তা ত্যাগ করতে হবে। ধর্মতাত্ত্বিকদের বিরক্ত না করে তাদের স্বীকার করতে হবে যে তাদের পর্যবেক্ষণবা উদ্ঘাটন ভুল। ধর্মতত্ত্ব কখনও এর অধীনস্ত বিজ্ঞানের কাছে নতজানু হবে না। সত্য নির্ধারণে এবং কোন সমাধানে পৌঁছানোর অধিকার কেবলমাত্র তার রয়েছে। ধর্মতত্ত্ব কখনও ভুল করে না।
তারা বলেন যে মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে ঐশী বাণীতে। সেখানে যা লেখা আছে তার বাইরে কোন ব্যাখ্যা থেকে বিরত থাকতে হবে। পবিত্র বাইবেল যেভাবে বলে এবং পুণ্যবান পিতারা (Holy Fathers) যেভাবে তা বলেন তা সবাইকে মেনে নিতে হবে। মহাবিশ্ব নিয়ে কিছু চিন্তা করার সুযোগ আমার হয়েছিল। এখানে আমি সেগুলো নিয়ে কিছু বলছি এ আশায় যে যারা বিষয়গুলো আমার থেকে ভালো বোঝেন আমি ভুল করলে তারা তা সংশোধন করে দিতে পারেন।
আমার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্মতত্ত্বকে জ্ঞানের ‘রাণী’ উপাধি দেয়াটাকে কি একধরণের বাকচাতুরী নয়? সেই শাস্ত্র এই উপাধি পেতে পারে যার ভিতর সব ধরণের বিজ্ঞান এবং এর প্রতিটা বিষয়ের যথার্থ ও সুনির্দিষ্ট জ্ঞান এবং তা জানার উপায় রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বলতে পারি, তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ এবং তার রেকর্ড রাখার জন্য পাটীগণিত এবং ইউক্লিডের জ্যামিতি জরিপকারী এবং একাউন্স্যান্টদের থেকে উৎকৃষ্ট। অবশ্য ধর্মতত্ত্ব রাণীর মর্যাদা পেতে পারে এ কারণে যে তা মহিমার দিক থেকে অন্য সব বিজ্ঞানকে ছাড়িয়ে যায়। এছাড়া তার শিক্ষা ও প্রকাশভঙ্গী অন্য জ্ঞানের থেকে অনেক বেশি মহিমান্বিত।
যদি আমি ধরেও নিই যে ধর্মতত্ত্ব জ্ঞানের রাণী তবু যেসব ধর্মতাত্ত্বিকদের জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্য শাখায় দক্ষতা রয়েছে তারা এটা মেনে নিতে পারবেন না। এদের একজনও একথা বলতে পারবেন না যে জ্যামিতি, জ্যোর্তিবিদ্যা, সঙ্গীত, চিকিৎসাবিজ্ঞান এসব আর্কিমিডিস, টলেমী, বয়েথাস, এবং গ্যালেনের বইয়ের থেকে বাইবেলে বেশি ভালোভাবে বর্ণিত হয়েছে। এরপরও ধর্মতত্ত্বকে রাজকীয় শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া যেতে পারে হয়ত এ কারণে যে তা মানুষের ঐশী বাণী লাভ এবং পরলোক নিয়ে কথা বলে যা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
তাহলে মেনে নেয়া যাক যে ধর্মতত্ত্ব আধ্যাত্মিক আরধনার বিষয়ে গভীর জ্ঞান সম্পন্ন। এ কারণে সে জ্ঞান-বিশ্বের রাজ তখতে আসীন। এখন যদি সে তার অধীনস্ত জ্ঞান বিজ্ঞানকে এ কারণে পর্যবেক্ষণ না করে যে তারা আধ্যাত্মবাদ নিয়ে চিন্তিত নয়, তাহলে ধর্মতাত্ত্বিকদেরও এই অধিকার নেই যে যেসব বিষয় তারা জানেন না তা নিয়ে বির্তক উঠলে তারা এর সমাধানে এগিয়ে আসবেন। যখন তারা এটা করেন তখন মনে হয় যে কোন একজন স্বৈরাচারী যিনি ডাক্তার নন তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের তত্ত্বাবধায়ক, কিংবা যিনি স্থপতি নন তার অধীনে কোন বাড়ি নির্মিত হচ্ছে। এরকম স্বৈরাচীর অবশ্যই তার রোগীর মৃত্যু ঘটাবেন বা নির্মিয়মান বাড়িটি ধ্বংস করবেন।
এছাড়া জ্যোর্তিবিজ্ঞানের অধ্যাপকদের তাদের পর্যবেক্ষণ ও প্রমাণের (observations and proofs) ক্রটি খুঁজে বের করতে আদেশ দেয়ার অর্থ দাড়ায় এমন আদেশ জারি করা যেন কখনও তারা তাদের কাজ ভালোভাবে শেষ করতে না পারেন। এ আদেশের মানে, জ্যোর্তিবিজ্ঞানীরা যেন দেখেও না দেখেন বুঝেও না বোঝেন। তারা যা অনুসন্ধান করছেন কেবল যেন তার উল্টোটা বলেন। এসবের আগে এটা তাদেরকে শেখাতে হবে যে কিভাবে আমাদের কল্পনা ও ইচ্ছাকে বাধ্য করা যায়। কিভাবে আমাদের বোধ ও বিবেক যা বলে তার উল্টোটা বিশ্বাস করতে হবে। আমার এই কথা বস্তুলোক বিষয়ে এবং ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে নয়।
বিজ্ঞ যাজকদের আমি সবিনয় অনুরোধ করব যেন তারা প্রমাণ-নির্ভর এবং মতামত-নির্ভর বিষয়ের পার্থক্য আন্তরিক ভাবে বিবেচনা করেন। তারা যদি অবরোহী যুক্তি (deductions) মেনে নেন তবে বুঝতে পারবেন যে প্রমাণ-নির্ভর বিজ্ঞানের কোন অধ্যাপক ইচ্ছমতো তার মতামত বদলাতে পারবেন না। একজন গণিতজ্ঞ বা দার্শনিককে প্রভাবিত করা এবং একজন আইনজীবি বা ব্যবসায়িকে প্রভাবিত করার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। বিশ্বলোকের ক্রিয়াকানুন যা প্রমাণের সাহায্যে আমরা বুঝতে পারি সেসব সহজে বদলানো যায় না যতটা সহজে কোন একটা বিল, লেনা-দেনা বা চুক্তিকে আইনসিদ্ধ বা বে-আইনী বলা সম্ভব। এই পার্থক্য শিক্ষিত এবং পবিত্র যাজকেরা বুঝতেন বলে তাদের কাছে দার্শনিক বিষয়ের বিরোধিতা করা ছিল বেদনাদায়ক। তাদের কেউ কেউ প্রকাশ্যেই তা স্বীকার করেছেন। সুনির্দিষ্ট করে বললে সেন্ট অগাস্টিনের বক্তব্য তুলে ধরা যেতে পারে,
“ এই সত্য আমাদের মেনে নিতে হবে যে মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞানী মানুষদের পর্যবেক্ষণ কখনও বাইবেলের বিরোধী নয়। তবে কেউ যদি ঐশী বাণীর বিরোধীতা করে কিছু লেখেন তবে তা পরিত্যাগ করতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বজ্ঞানময় পরমঈশ্বরের প্রতি আমাদের আস্থা অবিচল রাখতে হবে। আমরা যেন শব্দ বাহুল্যে ভরা ভুয়ো দর্শন (false philosophy) বা অপবিশ্বাসে ভরা ধর্মের প্রতারণায় ভীত না হই।”
ওপরের কথা থেকে এটা বলা যায় যে সাধু ব্যক্তিদের লেখা বইয়ে মহাবিশ্ব নিয়ে কিছু বিষয়ের চমৎকার বর্ণনা আছে আর কিছু বিষয়ের কেবল উল্লেখ আছে।
যে বিষয়ের বর্ণনা এসব বই-এ আছে সেগুলো বাইবেলের বিপরীতে কিছু বলছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব বিজ্ঞ ধর্মীয় পুরুষদের। পরীক্ষণের মাধ্যমে আমরা যে জাগতিক জ্ঞান অর্জন করি তা বাইবেলের অধীনস্ত হবার দরকার নেই। উপরন্তু ধর্মগ্রন্থের উচিত নয় এসব পার্থিব জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা। যারা এসব জ্ঞানের নিন্দা করেন তারা যথেষ্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই তা করেন। আর এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত তাদের যারা এসব স্বীকার না করে বরং সমালোচনা করেন। আমার মতে, এটাই যুক্তি-সঙ্গত। কারণ যারা কোন একটা যুক্তিকে ভুল মনে করেন তারা ওই যুক্তিটাকে সঠিক ভাবেন এমন মানুষদের থেকে সহজে এর ক্রটি খুঁজে পান।
কার্যত, কোন একটি বিষয়ে যারা বিশ্বাসী হন তারা বার বার পড়াশোনা, যুক্তিগুলোর পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে নিশ্চিত হন। আর পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গণিতজ্ঞের কথা হে মহানুভব, আপনি জানেন, যিনি কেবল কোপার্নিকাসের পদ্ধতিকে ভুল প্রমাণ করতে নিজে এ বিষয়ে কাজ করতে শুরু করেন। পর্যায়ক্রমে পড়াশুনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি এর সত্যতা বুঝতে পারেন। তখন তিনি এর একজন সমালোচক থেকে সমঝদারে পরিণত হন। আমি এমন আরও অনেক গণিতবিদের নাম জানি যারা আমার সাম্প্রতিক আবিষ্কার থেকে অণুপ্রাণিত হয়েছেন। তারা মেনে নিয়েছেন যে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করার পুরনো নিয়ম আর টিকে থাকতে পারে না।
একজন মানুষের মুখ বন্ধ করার মাধ্যমে যদি একটি মতবাদকে পৃথিবী থেকে বিদায় করা যেত তাহলে কাজটা আসলে সহজ ছিলো। যেসব মানুষ এরকম ভাবেন তাদের ধারণা এই মতবাদের আর কোন অনুসারী পাওয়া কঠিন হবে। অবশ্য বাস্তবতা এখানে ভিন্ন। তাদের এই পরীক্ষা বাস্তবায়িত করতে হলে কোপার্নিকাসের সব বই বাজেয়াপ্ত করতে হবে। অন্য সব লেখক যারা একই মতামত পোষণ করেন তাদের বইও নিষিদ্ধ করতে হবে। এক কথায়, সমস্ত জ্যোর্তিবিজ্ঞান বা মহাকাশ বিজ্ঞানকে নিষিদ্ধ করতে হবে। এছাড়া আকাশের দিকে তাকানোর ব্যাপারে মানুষকে নিষেধ করতে হবে। যাতে তারা মঙ্গল ও শুক্র গ্রহকে দেখতে না পায়। এই গ্রহ দুটি কখনো পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে আবার কখনো দূরে সরে যায়। এই কাছে আসা এবং দূরে যাওয়ার মধ্যে দূরত্ব এতটা বেশি যে বুধের ক্ষেত্রে তা চল্লিশ গুণ আর শুক্রের ক্ষেত্রে ষাট গুণ। শুক্রকেও কখনও গোলাকার আর কখনও দ্বি-খন্ডিত হতে দেয়া যাবেনা। এছাড়া মহাকাশ জুড়ে এমন অনেক বস্তু আছে যা টলেমীর কথার সাথে মেলেনা। তা কোপার্নিকাসের পক্ষে কথা চলে। প্রতিদিন আমরা আরও এমন অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করছি যা কোপার্নিকাসের মতবাদকে সমর্থন করে। শিক্ষিত মানুষজন তা উপলদ্ধি করতে পারছেন।
এত বছর ধরে এই মতবাদটি কেবল মেনে নেয়া হয়েছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা পর্যবেক্ষণ করে দেখা হয়নি। আমার মতে এটা সত্যের বরখেলাপ। আর যখন কোপার্নিকাসের মতবাদ পরিষ্কারভাবে সবার সামনে উপস্থিত তখন তাকে গোপন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আমার মতে, তার বই পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করার থেকে সেখানকার বিশেষ কোনো বক্তব্য (proposition) ভুল ও নিন্দনীয় বলাটা বেশি ক্ষতিকর। কারন এতে তারা বুঝতে পারবেন যে একটা প্রমাণিত বিষয়কে মেনে নেয়াটাকে ধর্মদ্রোহিতা বলা হচ্ছে। আর বিজ্ঞানকে নিষিদ্ধ করা হলো পবিত্রগ্রন্থের শ’খানেক প্যারা নিষিদ্ধ করার সমান যেখানে মহান সৃষ্টিকর্তার সেইসব মহত্ত্ব ও বড়ত্ত্বের কথা বলা হয়েছে যা তার কাজের মাঝে বিশ্বচারচর জুড়ে বিস্তৃত। কেউ যেন এটা মনে না করেন যে বিজ্ঞানের এই বইগুলো অনর্থক, এগুলো কেবল সূর্য ও তারার উদয় অস্তের বিবরণ যা লেখা যে কারও পক্ষে সম্ভব। বরং এর মধ্যে আছে মহৎ সব ধারণা আর রহস্যময় বাস্তবতা যা শত শত মেধাবী মানুষের হাজার হাজার বছরের পর্যবেক্ষণ, সাধনা ও জ্ঞান-অন্বেষার ফল। উদাহরণ হিসাবে বলতে পারি মানব শরীরের কথা। একজন সাধারণ মানুষের কাছে তা কেবল মানব শরীর কিন্তু একজন শব-বিশ্লেষক (anatomist) সেখান থেকে হাড়,পেশী, স্নায়ু এসব পর্যবেক্ষণ করে উদ্ঘাটন করেন শরীর-বিদ্যার অসাধারণ সব তত্ত্ব ও তথ্য।
অথবা বলতে পারি, হার্টের কার্যক্রম শরীরের প্রধান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, স্নায়ুবিক ক্রিয়াকান্ড এসব পর্যবেক্ষণ করে একজন শরীরতত্ত্ববিদ বের করতে পারেন কিভাবে মানুষের কল্পনা, স্মৃতি এবং বোঝার বিষয়গুলো কাজ করে। একইভাবে, খালি চোখে যা দেখা যায় তার ভিতর থেকে দক্ষ ও শিক্ষিত মানুষ সুদীর্ঘ ও সঠিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে উদ্ঘাটন করেন মহাজগতের সব বিস্ময়কর সত্য।
হে মহিয়সী, এসব উদাহরণের দ্বারা আপনি বুঝতে পারছেন যে এ জগতের বিষয়ের মতবিরোধের সমাধান করতে গিয়ে তারা কিভাবে আধ্যাত্ম জগতের বিষয়গুলো টেনে এনেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা ভুল করেছেন। আধ্যাত্মজগত বা ধর্মীয় গ্রন্থের বিষয়ে তারা ধরে নিয়েছেন যে, বির্তক করতে গিয়ে তারা যে সিদ্ধান্ত নেন না কেন তার সত্য সমর্থন তারা এখান থেকে পাবেন। এভাবে বিরোধী পক্ষের সাথে যুক্তিতর্কের ক্ষেত্রে তারা অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে যান। তাদের কাছে রয়েছে গল্প কথা, অলীক কল্পনা আর কথার মারপেচ। অন্যদিকে, যারা অসত্যের বিরোধী তাদের হাতে রয়েছে পর্যবেক্ষণের জ্ঞান ও তার প্রমাণ। বিষয়টা ভালোভাবে বোঝার পরও তারা নিয়ম-নির্ভর মতামত উচ্ছেদ করতে ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দারের মতো কেন নামেন?
খোলাখুলিভাবে বললে, আমার বিশ্বাস এ যুদ্ধে তারা নিজেরাই কুপোকাত হয়েছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন যে তাদের বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে দাড়াবার অবস্থান তাদের নেই। এখন তারা বলতে পারেন যে যুক্তি ও কারণ ব্যবহার করা যাবে না। সৃষ্টিকর্তা যা কিছু আমাদের দিয়েছেন তার ব্যবহার থেকেও বিরত থাকতে হবে। এমনকি পবিত্র গ্রন্থের মহিমাকেও তারা খর্ব করতে পারেন। ধর্মতত্ত্ববিদদের সাধারণ মতামত হচ্ছে, যথাযথ পরীক্ষণ বা পর্যবেক্ষণ দোষের কিছু নয়। আমি যদি ঠিক বুঝে থাকি তাহলে তাদের অজ্ঞতার কারণে বুঝতে-না-পারা তত্ত্ব বুঝতে তারা কখনও বাইবেলের কাছে যাবেন না। আমি জানি এসব যুক্তি, তর্ক বা তত্ত্বের বিরোধীতা করে চার্চ কোনো ফতোয়া দেননি। তারা আন্তরিক হলে নিজেদের অযোগ্যতা মেনে নিতেন এবং নীরবে এসব থেকে দূরে সরে যেতেন। আমার অবস্থান ভুল হলেও তা বলার মতো প্রমাণ তাদের হাতে নেই। কোনো জিনিস কাট-ছাট বা সেন্সর করার কথা চার্চ কাউন্সিল বা পোপ বলতে পারেন।
বড় কথা হলো, কোন বক্তব্য একই সাথে সত্য এবং মিথ্যা হতে পারে না। এক্ষেত্রে যা করা যায় তা হলো বক্তব্য বা প্রতিজ্ঞাটাকে (proposition) ভুল প্রমাণ করা। এতে যদি বিষয়টা ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে তা আর নিষিদ্ধ করার দরকার নেই। কারন কেউ আর সেটা অনুসরণ করবেন না। তার মানে, কোর্পানিকাস ও অন্যদের যুক্তিগুলো তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হবে। যুক্তিগুলো ভুল বা ধর্মবিরোধী কিনা শুধু তা ভাবলে তাদের চলবেনা। সতর্ক ও বিজ্ঞ যাজক বা নির্ভুল ও জ্ঞানময় মানুষের কাছে তারা হঠকারী সিদ্ধান্ত আশা করতে পারেন না। কোন মতামত যা সরাসরি ধর্মবিশ্বাসের যাথে সম্পৃক্ত এমন বিষয়ে পবিত্র পোপ অনুমোদন দেয়া বা না দেয়ার অধিকার রাখেন কিন্তু কোন অস্তিত্বের অনুমোদন দেয়ার এখতিয়ার তার নেই। কারণ, প্রতিটি বস্তু বা অস্তিত্ব তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য নিয়ে টিকে থাকে।
আমার মতে, সব মানুষের উচিত সত্য ও বাস্তবতাকে মেনে নেয়া। কারন, এর ওপর মানুষের কোন হাত নেই। যদি কোন বিষয়ে আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান না থাকে তবে তার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এছাড়া যে বিষয় এখনও বিবেচনাধীন তা ব্যবহার করে একজন মানুষের কর্মক্ষমতা কেড়ে না নেয়াটা বুদ্ধির পরিচয়। যে বিষয়ের সত্য পরিচয় এখনও পরিষ্কার নয় তা নিয়ে কাউকে ধর্মদ্রোহী বলাটা সময়ের অপচয়। আমার বিরোধীরা সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন নিয়ে এখনও গোলমাল করে চলেছেন। অথচ সেটা মিথ্যা কী না তা কোনো পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তারা প্রমাণ করেত পারেননি।
২| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:১৯
জেন রসি বলেছেন: যদি কোন বিষয়ে আমাদের নিশ্চিত জ্ঞান না থাকে তবে তার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ না করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
পরম সত্য বলে কিছু নেই।
৩| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:৪৮
আবু সিদ বলেছেন: আপনাদের মতামতের জন্য ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:০৭
হরিণা-১৯৭১ বলেছেন: ভালো