![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সমাজের প্রতেক মানুষ জানেন যে কিছু কিছু কাজ সামাজিক ভাবে ভালো আর কিছু কাজকে আমরা খারাপ চোখে দেখি। কোন কাজকে ভালো বা মন্দ ভাবার এই যে প্রবণতা তা আমরা সমাজ থেকে পেয়ে থাকি। অনেক সময় যা কিছু আসলে ভালো সামাজিকভাবে তা মন্দ বলে গণ্য হতে পারে। আবার অনেক মন্দ কাজকেও সমাজ ভালে বলে স্বীকৃতি দিতে পারে। এই স্বীকৃতি কোন কাগজ কলম বা দলিল দস্তাবেজ বা লিখিত কিছু নয়। এই স্বীকৃতি সমাজের সব মানুষের মেনে নেয়া। এমন একটা সময় ছিল যখন ভাবা হতো মেয়েদের আতœা নেই! আবার অতীতে অনৈতিকতাকে খারাপ চোখে দেখা হলেও আজকাল টাকা আয় করাটাই মুখ্য। ঘুষ না দুর্নীতি কিভাবে একজন মানুষ টাকা আয় করেন আজকাল সেটা নিয়ে না ভাবাটা অনেক সমাজে খুব সাধারন। আগে অন্যের দুঃখ কষ্টে এগিয়ে আসাটা ভালো কাজ ভাবা হতো। এখন কারও ভালো করতে যাওয়াটা অনেক ক্ষেত্রে দুঃচিন্তার ব্যাপার। কী জানি আবার কোন বিপদে পড়তে হয়!
এ হলো প্রতিদিনকার সামাজিক জীবনযাপনের আচার আচরণ ও ব্যবহারের রীতি-রেওয়াজ বা স্বীকৃতি। অনেক সময় এমন অনেক দাবী, স্বপ্ন বা বাস্তব সত্য থাকে সামাজিক জীবনে যা আমাদের মেনে নিতে হয়। অনেক সময় দেখা যায় যে দুটি বিপরীত স্বপ্ন বা আকাঙ্খা প্রবল হয়ে উঠেছে, তখন সংঘাতের আশংকা দেখা দেয়। অনেক সময় সেই সংঘাত বাস্তব জীবনে প্রবল আলোড়ন তোলে যা কোন রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গৃহ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। যেমন, দাস ব্যবস্থা নিয়ে ১৯ শতকে যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত যুদ্ধ।
আবার এমন হয় যে কোন সত্যকে সমাজের একদল মানুষ মেনে নিচ্ছেন কিন্তু আরেক দল তা মানতে পারছেন না। যদি সেটা হয় ধর্মীয় বিষয় হয় তবে নিজ নিজ বিশ্বাস নিয়ে পাশাপাশি বাস করাটা কোথাও স্বাভাবিক আবার কোথাও অসম্ভব। আবার অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা আছে যা নিয়ে তৈরি হয় বিভ্রাট! অনেকের কাছে অনেক ঐতিহাসিক ঘটনা সত্য, আবার অনেকের কাছে বানোয়াট। কেন মানুষ বা মানব সমাজ কোন কোন কাজ বিষয় সত্য বা স্বপ্নকে স্বীকৃতি দেয় এবং অন্য অনেক কাজকে স্বীকৃতি দেয়না? কেন অনেক কাজ সমাজে অননুমোদিত? আর কেনই বা দরকার সামাজিক স্বীকৃতির?
সমাজ যদি এক বা অল্প কিছু মানুষের সংগঠন হতো এবং প্রত্যেক মানুষ যদি স্বয়ংসম্পূর্ণ হত তাহলে সামাজিক স্বীকৃতির গুরুত্ব থাকতনা । সমাজ হচ্ছে অনেক মানুষের সংগঠন যার প্রত্যেক মানুষই কোন না কোন ভাবে অপর মানুষদের ওপর নির্ভরশীল। পারস্পরিক এই নির্ভরতাকে গতিশীল ও ঝামেলাহীন করার জন্য মানব সমাজে তৈরি হয়ে যায় আচরণ বিধি (Code of conduct) । এই আচরণ বিধি হচ্ছে সমাজের মানুষদের স্বীকৃতি যে কোন কাজটি ভালো কোনটি মন্দ আবার কোনটি করা যাবে আর কোনটি থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রয়োজন সাপেক্ষে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাই তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন আচরণবিধি। আবার রাষ্ট্রও তার সীমার ভিতর বসবাসকারীদের জন্য তৈরি করে নেয় অধিকার ও আচরণবিধি যেটি সংবিধান নামে পরিচিত। অন্যদিকে সমাজ এমনই এক সংগঠন যার কোন লিখিত বিধান নেই।
সমাজ কোথাও লিখে রাখেনা যে ‘এটা করো না’ অথবা, ‘এটা করা যাবে’। সমাজে তাই ‘ভালো’ বা ‘মন্দ’ কাজের স্বীকৃতি ঘটে কাজটির প্রতি মানুষের প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। কিছু দিন আগেও স্বুল পড়–য়াদের মারধোর করাটা স্বাভাবিক ছিলো। বর্তমানে তা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
অন্য সব কিছুর মতো সামাজিক স্বীকৃতিরও বদল ঘটে। বদলায় সামাজিক আচার বিচার ব্যবস্থা। হাজার হাজার বছর ধরে তাই সমাজের উত্তরণ ও অধঃপতন ঘটেছে। জ্ঞান বিজ্ঞান সভ্যতা ও শান্তি একস্থান থেকে অন্য স্থানে এক সমাজ থেকে অপর সমাজে স্থানান্তরিত হয়েছে। একই ভাবে দারিদ্র অজ্ঞতা ব্যধি বা অশিক্ষা শিকড় গেড়ে বসে নেই কোথাও।
একথা ঠিক যে রাষ্ট্র কর আদায় করতে পারে, প্রবর্তন করতে পারে নানান নিয়মের। কিন্তু মানুষের মনোবৃত্তি বদলের ক্ষমতা আছে কেবল সমাজের। সামাজিক স্বীকৃতি যখন ভালোর দিকে থাকে তখন মানুষের জীবন হয়ে ওঠে উন্নত, সমাজ থাকে স্থিতিশীল। আর সমাজ যদি মন্দ কাজকে মেনে নেয় তখন অনাচার প্রতিষ্ঠিত হয়, মানবজীবন হয়ে ওঠে অস্থিতিশীল। এই অস্থিতিশীলতা এত বেশি হতে পারে যে তা রাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী সংগঠনকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলতে পারে।
মন্দ কাজের স্বীকৃতি যদি এতটা অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে তবে কেন সমাজ মন্দ কাজকে স্বীকৃতি বা গ্রহণযোগ্য বলে মেনে নেয়?
সমাজ কোন বিমূর্ত (abstract) ধারণা নয়। সমাজ মানুষের মতৈক্য দিয়ে গঠিত একটি অদৃশ্য প্রতিষ্ঠান যার সুনির্দিষ্ট কোন প্রধান নেই। সমাজে তবে কার গ্রহণযোগ্যতা? কার দ্বারাই বা সমাজ প্রভাবিত? এর উত্তর আছে মানুষের মনোজাগতিক ক্রিয়াকান্ডের সাথে। অধিকাংশ মানুষ জ্ঞানময় ধনবান ক্ষমতাবান মানুষকে মেনে নেয়। গণমানুষ তাদের সমস্যা সংকটে এসব মানুষদের আদর্শ বা পরামর্শ গ্রহণ করে। যেমন একজন নব্যধনী চেষ্টা করেন তার এলাকার পুরাতন ধনীদের মতো হয়ে উঠতে। কেমন হবে নতুন জমিদারের আচরণ তার উত্তরণ ও আদর্শ নিহিত পুরনো জমিদারদের জীবনাযাপনের মধ্যে।
প্রভাবশালী মানুষদের স্বীকৃতি তাই সামাজিক স্বীকৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কিন্তু তারও সীমা আছে। প্রভাবশালী মানুষদের দ্বারা অন্যায় অবিচার যদি ঘটতেই থাকে তবে সেটি সামাজিক বিপর্যয়ের আলামত। স্বৈরশাসক আর তার মদদদাতারা অনেক বড় সমাজপতি হওয়ার পরও পৃথিবীর সব দেশেই তাদেরকে বিপর্যয় মেনে নিতে হয়েছে। অর্থাৎ, সব বা বেশির ভাগ মানুষের ভালো করতে পারে যে কাজ তাই সামাজিক ভাবে স্বীকৃত হওয়া উচিত। যদি তা না হয় অর্থাৎ, বিশেষ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে যদি ভালো ও মন্দের সামাজিক স্বীকৃতি নির্ভর করে তবে মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় যে কোনটা ভালো আর কোনটা মন্দ। অনেক সময় ভালো কাজকে তাই মন্দ আর মন্দ কাজে ভালো ভেবে আমরা তা করতে থাকি। এতে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র মানুষ যাদের পক্ষে বলার লোক খুব কম।
এসব মানুষ যখন বঞ্চনার জীবন যাপন করেন তখন ক্ষতিটা কেবল তার একার নয়, তা পুরো সমাজের। কষ্টটা তারাই ভোগ করছেন কিন্তু সমাজ বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিভাবান ও মেধাবী মানুষদের থেকে। তা না হলে হয়ত কৃষির উৎপাদন বেড়ে যেত, শিক্ষকের শিক্ষাদান হয়ে উঠত আরও বেশি কার্যকর। ডাক্তার গ্রামের মানুষদের সেবা করাটাকে ভাবতেন সম্মানজনক। মোটকথা, সব মানুষকে সব পেশাকে সম্মান করা গেলে, টাকার মাপকাঠিতে বড় -ছোট বা উঁচু-নীচু মাপা না হলে সব মানুষের মানবিক অধিকার অর্জন করাটা অসম্ভব নয়। আমরা বিশ্বময় ‘মানবতা’ বলে যত চেচামেচি করি তারও দরকার হবে না।
©somewhere in net ltd.