নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবু সিদ

আবু সিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

চিরায়ত সাহিত্য

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৫১

মানুষ বা মানুষের কোন কাজ চিরকালকে দেখতে পায় না। মানুষ ও মানুষের কাজ দেখতে পায় শুধু দীর্ঘ/সুদীর্ঘ ক্ষণকালকে। তবু চিরকালের কথা ভাবি আমরা, অনন্তের কল্পনা জেগে ওঠে আমাদের মনে। আমরা অমরত্বের মহিমা দিতে চাই মরণশীল অনেক কিছুকে। সাহিত্যের চিরকালীনতা বা চিরায়ত সাহিত্যও সে হিসেবে ক্ষণস্থায়ী। তবে যে সাহিত্য টিকে থাকে দীর্ঘকাল তাকে আমরা বলি চিরায়ত বা চিরকালের সাহিত্য।



কোন ধরনের সাহিত্য চিরায়ত সাহিত্য? কোন সাহিত্য টিকে থাকে দীর্ঘকাল? যে সাহিত্য ভাবাতে পারে মানুষকে, যা রেখে যেতে পারে কালের ও অনাগত কালের মানুষের জন্য এক বা একাধিক, বিশেষ বা নির্বিশেষে কোন সংবাদ (message)। যা কিছু ভাবাতে পারে মানুষকে তারই থাকে টিকে থাকার সম্ভাবনা। শুধু ভাবনার উদ্রেককারী বা সংবাদ প্রদানকারী সাহিত্যই টিকে থাকে এমন নয়। হয়ত সেখানে জীবনের বিশেষ কোন বোধের কথা বলা হচ্ছে বা জীবনের কোন বোধকে উদ্ঘাটিত করা হচ্ছে Ñ তার মাঝেও জন্মায় টিকে থাকবার শক্তি, সুদীর্ঘ জীবন। যেমন, আমরা যদি বলি ঈশপের উপকথাগুলোর কথা যা দু’হাজার বছরেরও বেশি সময় টিকে আছে তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না যে বাহিনীগুলোর টিকে থাকবার অব্যাহত শক্তি ওগুলোকে করেছে অমর। তাঁর কাহিনীগুলো ছোট ছোট ঘটনার দ্বারা বর্ণিত। কখনো কখনো সেগুলো উপদেশধর্মী, কখনও বা শুধু সত্য উন্মোচনকারী। যেমন, একজন কৃষককে বলা হলো যে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তুমি যতটুকু জমিতে ঘুরে আসতে পারবে তার সবটা তোমার। একথা শুনে সেই কৃষক বিরাম ও বিশ্রামহীন হাঁটলেন দিনভর, অবশেষে সূর্যাস্তের শেষে তাকে মৃত দেখা গেল।



এখানে ঈশপ উন্মোচন করছেন জীবনের একটি নিগূঢ় সত্য। মানব মনস্তত্বের এই সত্যটি হলো, মানুষ স্বভাবত আশা করে কিন্তু সীমাহীন লোভের ফল সব সময়ই খারাপ। কোন পাঠক এটাকে সত্য উন্মোচনকারী সাহিত্য রূপে দেখতে পারেন, আবার কেউ এখান থেকে গ্রহণ করতে পারেন উপদেশ বা পরামর্শ।



আবার ধরাযাক, ক্রিস্টিয়ান হ্যানস এন্ডারসন (১৮০৫-১৮৭৫)-এর রূপকথাগুলোর কথা। তিনি আমাদের কল্পনার জমকালো পথ দিয়ে নিয়ে যেতে যেতে চমকালো বক্তব্য পেশ করেন। যেমন, ‘কুৎসিত হাঁস’ রূপকথাটিতে তিনি এমন একটি হাঁসের বাচ্চার জীবনের কথা বলেছেন যে ছোটবেলায় দেখতে ছিল কুশ্রী। সবাই তাকে এজন্য উপহাস অবজ্ঞা করতো, এমনকি খেলতেও নিতনা। শেষে দেখা গেল সেই বাচ্চা হাঁস একদিন বড় হয়ে তার সুন্দর পালক আর চমৎকার ডানা দিয়ে সবার প্রশংসা কুড়াচ্ছে। সবাই যখন তার প্রশংসায় অভিভূত তখন তার মনে পড়ে নিংসঙ্গ শৈশব যখন তাকে সবাই দূর দূর করে তাড়াত। যখন আমরা কাহিনীটি পড়ি তখন মনে হয় কোন মানুষের জীবনের কথাই যেন পড়ছি। পড়তে পড়তে উপলদ্ধি করি জীবনের এক চিরায়ত সত্য: ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা!



আবার যদি বলি ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১২২)-এর রূবাইয়্যাতের কথা তখন অনুভব করি তাঁর কবিতাগুলো কী আশ্চর্য শক্তিময়! আমাদের চেতনায় জ্বলতে থাকা চিন্তার প্রদীপকে সেই কাব্যশক্তি এক বিপুল অগ্নিকুন্ডে পরিণত করে। আমরা হাজার বছর পরেও আবৃত্তি করি রুবাইগুলো। দিই তাকে চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা। যেমন,

পান্থশালার দুয়ার থেকে ডাকছে কে যে ভোরে,

পূর্ণকরে পাত্র-খানা বেকুফ বন্ধু পদাপিয়াসী ওরে।

ভাগ্যদেবীর নিমন্ত্রণে জীবন-পাত্র পূর্ণ হওয়ার আগে

ভোগ করে নাও জীবনটাকে কানায় কানায় ভরে।

[মূল: ‘ওরম খৈয়াম’- হ্যারল্ড ল্যাম্বকৃত উপন্যাস। বাংলা অনুবাদ: আব্দুল হাফিজ]

অথবা,

আমার কাছে শোন উপদেশ- কাউকে কভু বলিসনে-

মিথ্যা ধরায় কাউকে প্রাণের বন্ধু মেনে চলিসনে।

দুঃখ ব্যথায় চলিসনে তুই, খুঁজিসনে তার প্রতিষেধ,

চাসনে ব্যথার সামব্যথী, শির উঁচু রাখ ঢলিসনে।

[ অনুবাদঃ কাজী নজরুল ইসলাম]



আবার চিন্তার তীব্র শক্তি নেই, বোধের উদ্ঘাটন নেই; আছে স্বপ্নের পথে যাত্রা। তাও হতে পারে চিরায়ত সাহিত্য। সেই ঊনিশ শতকে ইবসেন (১৮২৮-১৯০৬) লিখলেন ‘A Doll’s House’ বা ‘পুতুলের খেলাঘর’ নাটকটি। আজও তা আপন মহিমায় প্রকাশিত। নাটকটিতে জটিলতা নেই, নেই দর্শনসুলভ চিন্তাময় বাক্য। আছে সহজ সাধারণ ঘটনা। তার মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয়ে চলেছে নারী-মনের চির স্বাধীনতার স্বপ্ন।



অনেকে বলতে পারেন, সাহিত্য কি তবে ভাব-গম্ভীর কঠিন কঠোর বাক্য? সাহিত্য যেমন নিছক ভাব-গম্ভীর বাক্যের সমাবেশ নয় তেমনি তা নিছক আনন্দ দানের উপকরণও নয়। সাহিত্যে থাকতে পারে হাসি তামাশা ঠাট্টা আনন্দ কিন্তু কোনক্রমে তা সাহিত্যের লক্ষ্য নয়। যদি আনন্দ দানই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্ম হতো তবে রম্য রচনার লেখকেরা হাসির ছলে গুঢ় কথা বলতেন না। লঘু কাহিনীর নৌকায় চড়িয়ে তারা আমাদের নিয়ে যান গভীর চিন্তার দেশে। যেমন, আমরা হয়ত পড়ছি কার্ভেন্টিস (১৫৪৭-১৬১৬)-এর উপন্যাস ‘ডন কুইক্সোট’। সেখানে অন্তহীন হাসি তামাশায় আমরা রীতিমত ডুবে যেতে পারব। অথচ আমরা পুরো কাহিনী শেষ করলে বুঝব যে তিনি আমাদের ডুবিয়ে দেননি রবং আমরা যে ডুবে ছিলাম তা তিনি আমাদের জানালেন। আমাদের প্রাণে ভেসে উঠবার বাসনা জাগালেন।একইভাবে যদি বলা হয় এরিস্টোফেনিস এর নাটক ‘লিসিসট্রাটো’র কথা তাহলেও বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই নাটকে নারীরা তাদের পুরুষদের শয্যা ত্যাগ করে এই দাবীতে যে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। যতদিন পুরুষেরা যুদ্ধ বন্ধ না করবে ততদিন তারা তাদের নারীদেরও শয্যায় পাবে না। সাহিত্যবোদ্ধারা নাটকটিকে কমেডি বলছেন। সেখানে হাস্য-রসের সুরে যে হৃদয়-গহন-গান শোনানো হচ্ছে তা বলে যে গড়বার শক্তিতে নারী এগিয়ে আছে পুরুষের থেকে। শান্তির সাধনায় তার ত্যাগ সবার ওপরে। কথাটি বা সংবাদ (message)টি ঘরে সংসারে সমাজে-রাষ্ট্রে নারীর মূল্যের এক চমৎকার স্বীকৃতি। তাই এটিও পেয়েছে চিরায়তের মর্যাদা।



চিরায়ত ধারার রম্যরচনাগুলো পড়লে আমরা বুঝি যে সাহিত্যেকের বলতে চাওয়া কথাটা তামাশার ছলে আমাদের মনে প্রবেশ করে আর আমরা তাকে চেতনার সম্পদ ভেবে মনের গভীরে যতœ করে রাখি। তবে কী সাহিত্যিক কী সাহিত্য সমালোচক কেউই নিছক আনন্দ বিতরণকারী সাহিত্য-কে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য বলছেন না! যেসব লেখাকে তারা শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের বা চিরায়ত সাহিত্যের মর্যাদা দিয়েছেন তার মধ্যে আছে ‘ইলিয়ড’ ‘ওডিসি’, ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, ‘ওয়ার এন্ড পিস’, ‘লা মিজারেবল’, ‘ফাউস্ট’, ‘দ্য ওয়েস্ট’, ‘ডাকঘর’, ‘ওথেলো’, ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’, ‘লা ফ্লা দু’ম্যাল’ ‘মহাভারত’, ‘শকুন্তলা’, ‘ম্যান এন্ড সুপারম্যান’, ‘দ্য রুটস’, ‘দ্য প্লেগ’, ‘দ্য প্রফেট’ ইত্যাদি।



চিরায়তের মহিমা পেয়েছে এমন সাহিত্য সম্পর্কে অভিযোগ আছে যে, এগুলো দুর্বোধ্য! দুর্বোধ্যতার অভিযোগে ‘অভিশপ্ত’ লেখাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুনার্মের ভাগী হয়েছে ‘ওয়েটিং ফর গোডো’, ‘ফাউস্ট’ ইত্যাদি। ফাউস্টের কাহিনীতে বাস্তবতা এবং ছদ্ম-বাস্তবতার ভিতর দিয়ে মানুষের মানসিক দ্বন্দ্ব, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে। ওয়েটিং ফর গোডোতে বলা হয়েছে ‘মঙ্গল’ বা ‘শুভ’ বা ‘ভালো’র জন্য মানুষের চিরন্তন প্রত্যাশা ও প্রতীক্ষার কথা। সাহিত্যকর্ম দুটিতে রয়েছে রূপকের উপর্যুপরি প্রয়োগ। আমরা প্রতিদিনের জীবনে অনেক ধরনের রূপক ব্যবহার করি। যেমন, মা তার সন্তানকে আদর করে ডাকছেন ‘সোনার চাঁদ’, প্রিয় তার প্রিয়তমাকে ভালোবেসে বলছে, ‘তোমার ওষ্ঠ যেন টসটসে আঙ্গুর’, একজন আরেকজনের উদ্দেশ্যে বলছে, ‘লোকটা যেন ফেরেশতা’ ইত্যাদি। বাস্তব জীবনের রূপক ঠিক মতো বুঝলেও সাহিত্যে রূপক বুঝতে প্রায় সময় আমাদের ভুল হয়। কিন্তু যখন বলা হয় ‘মেরে তক্তা বানায়ে দেব’ তখন কোনভাবেই ভাবি না যে একজন মানুষকে মারধোর দিয়ে তক্তা বানানো হবে! আমাদের এই না বোঝার জন্য অভিযুক্ত হন লেখক, অথচ নিজেরা আমরা এতটুকুু ভাবতে রাজী নই!



যাই হোক, চিরায়ত সাহিত্য কখনও কোনকালে কারও না বোঝা বা বিরোধিতার কারণে মৃত্যুবরণ করেনি। তা এগিয়ে চলেছে তার অতিদীর্ঘ আয়ু নিয়ে। আর তা যেতেই থাকবে মহাকালের চিরায়ত পথ ধরে হাজারো মননশীল মানব মেধার মধ্য দিয়ে।

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১২:৩৩

স্বপ্নচারী গ্রানমা বলেছেন:
চিরায়ত সাহিত্য কখনও কোনকালে কারও না বোঝা বা বিরোধিতার কারণে মৃত্যুবরণ করেনি। তা এগিয়ে চলেছে তার অতিদীর্ঘ আয়ু নিয়ে। আর তা যেতেই থাকবে মহাকালের চিরায়ত পথ ধরে হাজারো মননশীল মানব মেধার মধ্য দিয়ে।

চমৎকার অবতারণা করেছেন চিরায়ত সাহিত্যের সেকাল একাল নিয়ে ।
অনেক ভালোলাগা রইল আপনার সাহিত্য বোধ আর আন্তরিক আলোচনায় ! + ভালো থাকুন আবু সিদ ভাই ।

২| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:৫৭

আবু সিদ বলেছেন: প্রিয় পাঠক, আপনার মতামত ও শুভ কামনার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।

৩| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১:৫৭

জুলিয়ান সিদ্দিকী বলেছেন: খুব ভালো লিখেছেন। বিশ্লেষণাত্বক পোস্ট।

চিরায়ত সাহিত্য হয়ে ওঠে পাঠকের কল্যাণে, এখানে যা লেখকের অজ্ঞাত থাকা বিচিত্র নয়। লেখক তার লেখাটি শেষ করে বা আগেই বলতে পারেন না যে, এটির স্থায়ীত্ব আদৌ হবে কি না। সাহিত্য (যে কোনো) যদি সত্যিই সাহিত্য হয়ে ওঠে তার আসন পোক্ত হবার সম্ভাবনা বাড়ে। প্রকৃত সাহিত্যের জন্য ঢাক-ঢোল লবিং-চ্যানেলের প্রয়োজন হয় না। হয়তো শুরুর দিকে তা দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়, কিন্তু এক সময় তা ঠিকই নিজের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। দির্ঘস্থায়ী জায়গা করে নেয় পাঠকের মনে।

পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৫:৫৪

আবু সিদ বলেছেন: জনাব জুলিয়ান সিদ্দিকী, আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ। আপনার সাথে সহমত।

৪| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০১

অন্ধবিন্দু বলেছেন:
ভালো লিখছেন, আবু সিদ।

৫| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:০৬

আমি ময়ূরাক্ষী বলেছেন: খুব ভালো লাগলো লেখাটি। প্রিয়তে রেখে দিলাম।

৬| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:০৮

আবু সিদ বলেছেন: প্রিয় পাঠক ও লেখক বন্ধুরা, সহৃদয় মতামতের জন্য ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.