![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সমাজপতি বুলন্দরকে সূর্যোদয়ের আগেই উঠতে হলো নিতান্ত বাধ্য হয়ে। ‘এই-ই হচ্ছে আজকাল।’ জাগরণে তার বিরক্তি ‘যত্তোসব গাড়োল আর মূর্খ।’ সে দেখল পাশে তার বউ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। ‘শালী খাওয়া ঘুম ছাড়া কিছু চেনলে না’, বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল সে। গত কয় মাস সে নীরবে সব সহ্য করেছে। একে তো বলিষ্ঠ শরীর, তার ওপর সে সমাজপতি! ‘কতক্ষণ সম্ভব, অ্যাঁ বিরক্তি চেপে রাখা!Ñ আজ এর একটা বিহিত আমি করেই ছাড়ব।’ সে চোখ মেলতে থাকা বেতাল গ্রামের মাটির পথ ধরে খালি পায়ে হাঁটি হাঁটি চলল...
অঘ্রাণের কুয়াশা বিছিয়ে দিয়েছে নিজেকে সমস্ত গ্রামের পরে। ‘তারপরও হতভাগাটা একটুও হতাশ হয়নি! ও তো দেখা যাচ্ছে নেড়িকুত্তার থেকেও নাছোড়বান্দা’! মুরলীকে একঠাঁই বিলের ধারে বসে থাকতে দেখে ভাবল সে। এবার বুলন্দর পা টিপে টিপে বিড়ালছানার মতো এগোতে থাকল। একেবারে মুরলীর পাশে এসে সে জোরে চিৎকার করে ওঠল। আ আ আ ! তার সে চিৎকার যেন কোনো বিজন বনে করা হয়েছে। মুরলী তার নিজের সুরে আপন মনে গলা সেধে চলেছে : আ আ আ ও ও ও
এই ধরণীর পরে
কিসে স্বার্থক কিসে ধন্য
হয় রে জীবন?
ভোলা মন, ভোলা মন আ আ মন
শিখে নে তুই তার আয়োজন।
আ আ আ ও ও ও
বৃথা রে তুই কাটাসনে দিন
হতাশ মনে ব্যর্থ জন
কর কর্ম কর সাধনা,
সার্থক তোর কর জীবন।
ভোলা মন, ভোলা আ আ মন
শিখে নে তুই সেই আয়োজন
আ আ আ ও ও ও
মুরলী বুলন্দরের কান ফাটানো চিৎকারেও কোনো কোন সাড়া দিলো না। বুলন্দরের মনে হলো সে যেন একটা ব্যর্থ বাদুর আর মুরলী একটা ফলবান বৃক্ষ। ‘দাঁড়া, তোর দেখাচ্ছি মজা!’ বুলন্দর দ্রুত বাড়ির পথ ধরল পাছে কেউ অবজ্ঞাত সমাজপতিকে দেখে ফেলে!
মুরলী বুলন্দরের হুমকিতে ভয় না পেয়ে আরও কিছুক্ষণ ‘আÑ আÑ’ করে গলা সাধল। তারপর বিলের জলে মুখ-হাত ধুয়ে বসে বসে তার সুরের উত্থান-পতন, আনা-গোনা নিয়ে ভাবতে লাগল।
মোটামুটি এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে লাঠি সড়কি হাতে একদল লোককে দেখা গেল। তারা খালি পায়ে খালি গায়ে কোমরে গামছা বেঁধে হাতে লাঠি সড়কি নিয়ে খুব দ্রত আসছে। দলটার সামনে হন্যে হয়ে হাঁটছে বুলন্দর। বুলন্দরের কথা মতো নিমেষের মধ্যে ওরা মুরলীকে ঘিরে ফেলল। কিছুক্ষণের মধ্যে লাঠি সড়কি বাহিনীর নেতা গজরাতে লাগল, ‘আগে বল তুই হুজুরের সাতে ক্যান করলি খারাপ আচরণ?’ সে মুরলীকে এক হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে দিলো। মুরলীর গাল টিপে ধরল সে। বলল, ‘চাদু মুখ তো তোমার নিমাইমার্কা। তুমার ভাই আসতিচে। আর গিরামের এসব লোকও আচে। এগের সবার সামনে তুমার মাতা মুড়িয়ে মাতায় ঘোল ঢেলে গাধার পিঠে উল্টে চড়িয়ে গাঁ-ছাড়া করা হবে।’ পিছন থেকে একজন উৎসাহী মুরলীর পাছায় দুটো বাড়ি কষিয়ে দিলো। মুরলী ক্যাবলার মতো এদিক-ওদিক তাকাল। কেউ কেউ বলল, হারামিডার পাছায় বাঁশ দেও। খায় ছোটভায়ের ঘাড়ে চড়ে, থাকে ভাই-বৌর আঁচলের তলায়! মান-ইজ্জত এর আচে কিচু? ওর গাধার পিটি চড়ায় আর কী করবা বরং ওর মকি মুতি দ্যাও; এট্টা কুত্তা কনগের!
এতসব অপমানজনক কথায় মনে মনে মুরলী মুষড়ে পড়ল। তার খুব খারাপ লাগছে। আমি তো কারও বাড়া ভাতে ছাই দেইনি, কারও সাতে ঝগড়া কত্তি যাইনি। ছিলাম নিজির মতো। ছোট ভায়েরডা খাই ঠিক তা আমি তো কিচু কাজও করি!, ভাবছে মুরলী।
মুরলী ভাবতে ভাবতে তার ভাই আর ভাই-বউ দুজনে এসে গেল। বুলন্দর তার মোচে প্যাঁচ কষে বলল, এবার কও সলিল কী করব তুমার ভায়ের? সলিল তার বড় ভাইকে বেজায় ভালোবাসে। বউয়ের কোনো কথা যেন ভাইয়ের মনে কষ্ট না দেয় তার চেষ্টা করে। ছোটবেলা থেকে সে তার ভাইকে কোনো ঝগড়া বা কোলাহলে জড়িয়ে পড়তে দেখেনি। এমন একজন শান্তিপ্রিয় মানুষের এই অবস্থা দেখে সে কষ্ট পাচ্ছে। আর মানুষটা তার ভাই হওয়ায় সে একদম মুষড়ে গেল। বলল, ভাই কী করেচে? সড়কি বাহিনীর প্রধান ধমকে উঠল। কী করিনি তোর ভাই? সড়কি প্রধানের কথা শেষ না হতে একটা চড় এসে পড়ল তার মুখে। ‘মুখ সামলে কথা বলবি হারামি। চুরি-ডাকাতি করে দুই দিনে দুটো পয়সার মুখ দেখে ধরাকে সরা জ্ঞান করছো, না? আমার স্বামীরে ইজ্জত দিয়ে কতা কবা!’ বুলন্দর তার চামচাটার নির্বুদ্ধিতায় নীরব হয়ে গেল। সেও সলিলের বউকে বেজায় ভয় পায়। তার বাপ ও-গাঁয়ের গ্রামপ্রধান, তাছাড়া এক সময় বুলন্দরের বাপ তাদের এক কর্মচারী ছিল মাত্র। সেঁজুতি বুলন্দরের দিকে ফিরে কণ্ঠ সংযত করে বলল, শোন বুলন্দর চামচিকে কখনও চিল হয় না; এ-বিচার আমি করব!
সেঁজুতি জানে যে তার শ্বশুরের সম্পত্তিতে মুরলীর সমান অর্ধেক ভাগ আছে। সে মনেপ্রাণে এটা কামনাও করে যে, সম্পত্তির পুরোটা তাদের হোক। এখন সুযোগ হাতের নাগালে আসায় সে এটা হাতছাড়া করতে চাইছে না। সে বলল, ন্যায্য বিচারই হবে বুলন্দর। তোমার সড়কি বাহিনী সরে যেতে বলো। সড়কি বাহিনী পাশে সরে গেল কিন্তু সলিল এসে হাজির হলো সেখানে। সে বলল, সেজু! দাদার মনে কষ্ট দিও না।
‘এই মেয়েমার্কা ছেলে লোকটাকে দূরে রাখো তো। ন্যাকামি যতো!’ সড়কি বাহিনীর দুই জোয়ান এসে সলিলকে দূরে সরিয়ে রাখল। সেঁজুতি বলল, বুলন্দর! তুমিই তো সমাজপতি। তুমি তোমার ইচ্ছামতো মাথা মুড়তে পারো, মাথায় ঘোল ঢালতে পারো, আবার গাধার পিঠে চড়িয়ে তাকে গ্রামের বাহিরও করতে পারো। তবে যা করবা আজকেই, সূর্যাস্তের আগে, তবে মুরলী যেন আর বেতাল গ্রামে পা না দেয়।’ ‘কিন্তু তুমার স্বামী’? ‘তারে আমি সামলাব’। সেঁজুতি সলিলের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল। সলিল তার ভাইয়ের দিকে ফিরে ফিরে তাকাল। গাছের সঙ্গে বন্দি মুরলী দুঃখে আর চোখের জল আটকে রাখতে পারল না। সে ফোঁপাতে লাগল।
গ্রাম-পঞ্চায়েতে সবাই সায় দিলো যে মুরলীকে তারা যেখানে দেখেছে সেখানেই সে ‘আÑ আÑ’ করে মরেছে। চিৎকার করে মানুষের মাথা খেয়েছে। ‘গান না কলা! হেড়ে গলা যেন ফাঁটা বাশ! আÑ আÑ গাধা আর ঘোড়ার গলা ওর থেকে অনেক ভালো।’ তারা পরিবারের ও গ্রামের সাধারণ মানুষের শান্তিভঙ্গের অপরাধে মুরলীকে আজীবন নির্বাসন দিলো। তাদের পছন্দমাফিক এই রায় ঘোষিত হলো যে ‘অদ্য সূর্যাস্তের পূর্বে মস্তক মুণ্ডনপূর্বক মুরলী সুরপতিকে মাথায় ঘোল ঢেলে গাধার পিঠে উল্টো করে বসিয়ে গ্রামবাসীদের সবার সম্মুখে গ্রামের থেকে বহিষ্কার করা হোক। যতদিন মুরলী সুরপতি জীবিত থাকবে ততদিন এই গ্রাম তার জন্য নিষিদ্ধ। যে কেউ মুরলী সুরপতির সঙ্গে সদয় আচরণ করবে তার বিপক্ষেও এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে।’
আজ সন্ধ্যায় সবার সামনে মাথা মুড়িয়ে, মাথায় ঘোলের পরিবর্তে মাথায় ও মুখে চুনকালি মাখিয়ে, মুরলী সুরপতিকে গাধার পিঠে উল্টো করে বসানো হলো। মুরলীর দেহ সারা দিনের ক্লেশে অবসন্ন, মনোবেদনা ভার তুলনারহিত। তার চোখের ধারা যেন শ্রাবণসন্ধ্যার অক্লান্ত বর্ষণ। বুলন্দর ও গ্রাম পঞ্চায়েত আদেশ দিতে গাধা মুরলীকে নিয়ে চলতে শুরু করল। গাধা কিছুদূর যাবার পর সূর্যাস্তের ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল। উৎসাহী গ্রামবাসীরা ঘরের পথ ধরল। মুরলীর চোখ অশ্র“ভারে এতটাই টলমল যে সে দু চোখে কিছুই দেখছে না। পথের মধ্যে হঠাৎ বাধা পেয়ে সে চোখ মুছে তার ভাই সলিলকে দেখল। কাঁদতে কাঁদতে সে বলল, দাদা, আমিও তুমার সঙ্গে যাব। ‘ওরে বুকা! তোর ছেলেমেয়ে সংসার আচে’ মুরলী বলল, ‘তুই সেইখানে যা।’ সলিল তার ভাইকে জড়িয়ে ধরল। দাদা, তুমি অনুমতি দ্যাও। মুরলী বলল, ওরে হতভাগা! সন্তানদের অবজ্ঞা করা যে ঘোরতর পাপ! চোখের পানি মুছতে মুছতে তার হাতের পুঁটলিটা দাদার হাতে দিয়ে সলিল বলল, এর মদ্যি তুমার জামা আর লুঙ্গি আর কয়ডা রুটি আচে। আর ইট্টু দাঁড়াও দাদা! সে তার জামা খুলে বিলের পানিতে ভিজিয়ে তার দাদার মুখ মুছিয়ে দিলো। বলল, দাদা, আমার তুমি মাপ করে দাও। আমি অধম, তুমার জন্যি কিচু কত্তি পাল্লাম না! গাধা মুরলীকে পিঠে নিয়ে অজানার গন্তব্যহীনতায় এগোল।
সূর্যের আলো নিভে গিয়েছে আগেই। এখন চারধারের অস্তিত্বগুলোর উপস্থিতি অনুভব করা যায় শুধু, স্পষ্ট বোঝা যায় না। সলিল বিলের ধারে দাঁড়িয়ে রইল, মুরলীকে নিয়ে গাধা চলল মেটে পথ ধরে। যতক্ষণ অনুভব করা যায় ততক্ষণ সলিল একঠাই নির্বিকার দাড়িয়ে এখানে। মুরলীর ছায়া সর্বগ্রাসী অন্ধকারে বিলীন হওয়া পর্যন্ত সে অনুতাপ করে চলল।
সারারাতের ক্লান্তি শরীরে নিয়ে মুরলী ভোরের আলো দেখল এক জনশূন্য বনে। বনের পাশে একটা খাল আর ঝরনা। অন্য সময় হয়তো মুরলীর মনে গান চলে আসত, হয়তো সুর তাকে নিয়ে খেলত। এখন সুরের বিষয়ে না ভেবে সে গাধার পিঠ থেকে নামল। যারে যা পথ খুঁজে নে। বেঁচে থাক, জীবন খুঁজে নে! গাধাটাকে বলল সে, তারপর গাছের ছায়ায় ঘাসের পরে শুয়ে পড়ল।
বনটা গুল্মলতা আর বৃক্ষে ভরা। গুইসাপ, গিরগিটি, ব্যাঙ আর বেজির ঘোরাফেরা এখানে। বনজুড়ে পাখির রাজত্ব। টিয়ে বাবুই শ্যামা আর কাঠঠোকরা আর চড়–ই আর রকমারি সব শালিক। ভিতরে ভিতরে ফলের গাছ। বনের পাশের গ্রাম থেকে অভাবী মানুষেরা কখনও এখানে এসে পড়ে, কাঠ কিংবা ফলমূল খুঁজে নেয় তারা। আজ কিন্তু কেউ এল না। মুরলী মধ্য দুপুর পার করে তেড়েফুঁড়ে উঠল। জেগে উঠে সে তার স্মৃতির সঙ্গে বর্তমানকে মেলাল। সব কিছুতে সে অস্পষ্ট বিপদ অনুভব করল। আহারের সন্ধানে সে বনে, জলের সন্ধানে ঝরনায় আর জীবনের অনুসন্ধান করতে সুর সেধে চলল।
এভাবে একটি-দুটি দিন নয়, দু-চার মাস নয়, পুরো আটটা বছর মুরলী পাখির স্বর শিখে, ঝরনার ছন্দ জেনে ঝরাপাতার গান শুনে নিশ্চিন্ত মনে কাটিয়ে দিলো। এতগুলো মাস ও বছর পার করতে করতে তার মনে হয় যে, মেঘের গর্জন বৃষ্টির গুঞ্জন কিংবা নদীর কুলকুল চলাচল Ñ এমনকি নক্ষত্র তারার আলোক প্রদীপ সবই যেন আশ্চর্য সব সুরে বাঁধা। জগতের সব দৃষ্টিময় শ্র“তিময় স্পর্শময় অস্তিত্ব এবং যা ঘ্রাণে বা স্পর্শ-অনুভবে পাওয়া যায় তার সবই সুরের প্রকাশ। প্রকাশিত এই সুর অবলম্বন করে সে যখন গান গায়, সুরের স্রোতে ভাসিয়ে দেয় তখন যেন সে উপলব্ধি করে সমস্ত জগৎ তন্ময় হয়ে শুনছে তার সৃষ্টি!
এক ভোরে তার সুরে মৃত বাবলায় জেগে উঠল হরিদ্রাভ ফুল, একটা সাপ তার শিকার ধরতে ধরতে হয়ে উঠল স্থবির। সে বিকেলে তার সুর নিয়ন্ত্রণ করল পাখিদের গতিবিধি, মেঘের চলাচল! এসব ঘটনা যখন ঘটে চলছে মৃত্যুপথযাত্রী এক তরুণ তার সুর শুনে উঠে বসল আবার। সুরের মহিমায় বিভোর হয়ে সে তাজ্জব বনে গেল।
তারপর প্রকৃত অর্থে ’সুরপতি’ বনে গেলেন মুরলী। তিনি হয়ে উঠলেন সুরের মহা আচার্য। নিকট ও দূরের সুরপিপাসুরা এলেন তার কাছে শিখতে। মহাচার্য মুরলী সুরপতি এই ঝরনার শিয়রে বনের প্রান্তরে এক আশ্রম গড়লেন। শুরু হলো তার সুর এবং মহাসুর শিক্ষা দেয়া। তার নামে ছড়িয়ে পড়ল গল্প উপকথা। তিনি হয়ে ওঠেন রক্তমাংসের জীবন্ত এবং প্রায় অবিশ্বাস্য এক কিংবদন্তি।
যেখানে সুরপতি তার আশ্রম গড়ে তুলেছেন তার থেকে বেতাল গ্রাম গাধায় চড়ে দশ ঘণ্টার পথ। দূরত্ব যাই হোক, উপকথা আর উপাখ্যান কোথাও যেতে পিছ-পা হয় না। মুরলী সুরপতি তার মহা সুরের সাধনায় যা কিছু অর্জন করলেন লোককথা সেসবের থেকে ঢের বেশি হলো। বেতাল গ্রামের মানুষেরা শুনেছে যে, ‘মুরলী তার সুরের শৌর্যে মৃতকে জীবিত করে তুলতে পারে, সুর দিয়ে ঘটাতে পারে প্লাবন। এমনকি সে যদি চায় চাঁদের অস্তিত্বটাকে পুরোপুরি নামিয়ে আনতে পারে তার পছন্দ করা কোনো বটগাছের মাথায়।’ প্রথমত এসব বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তাদের, পরে যখন সেই সুদূর থেকে আগত একজন বিদেশি যাত্রীর মুখে মুরলীর কীর্তিকলাপ সব শুনল তখন তারা অবাক হলো। দীর্ঘদিন বেতাল গ্রামে খরা চলছে । বৃষ্টি নেই, বিষণœ জমি। ফুল নেই, ফল ফসল নেই। যদি সুরপতি আসেন! তার সুর যদি আনতে পারে বৃষ্টি! শত শত বুভুক্ষু আর কাঙাল, যারা নিজেদের অনেক আপন জনকে চোখের সামনে অর্ধাহারে অনাহারে মরতে দেখেছে, আশায় জেগে উঠল। একদিন সকালে বেতাল গ্রামের একটা ছোট প্রতিনিধি দল মুরলী সুরপতির আশ্রমের উদ্দেশে যাত্রা করল।
মুরলীকে এক যুগ আগে যারা দেখেছিল তাদের একজন আছে সেই দলে। প্রথমত সে মুরলীকে চিনতে পারল না। সুরপতি কয়েকজন ছাত্রের সাথে তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। পরে তাদের বলা হলো যে সকালে আশ্রমে সঙ্গীত ও সুরচর্চার পর আপনারা তার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।
সব শুনে সুরপতি বললেন যে তিনি যাবেন। প্রতিনিধি দলকে তিনি বললেন, আমাকে একদিন সময় দিতে হবে। সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আজ সন্ধ্যায় তার ছাত্রদের সুরপতি বললেন যে তিনি বেতাল-এ যাচ্ছেন। তার প্রিয় ছাত্র কীর্তি বলল, কবে ফিরবেন? ‘ঠিক জানি না’ সুরপতি বললেন, ‘তবে সম্ভবত কখনও নয়’। সুরপতি শান্ত সাবলীল গলায় বললেন, আবেগের কথা থাক, সুর আর সঙ্গীত নিয়ে আমরা কথা বলি। বয়স্ক বিরূপাক্ষ এ-কথায় বললেন, আপনি সুর ও মহাসুর এই দুয়ের কথা বলছেন কিন্তু মহাসুরের শিক্ষা দেননি কখনো। সুরপতি হাসলেন, যার সুরের সব কলা শিক্ষা শেষ হয় মহাসুর তার কাছে আপনি এসে ধরা দেয়। যতদিন তোমরা সিদ্ধি অর্জনকে মোক্ষ বলে জানবে ততদিন মহাসুর তোমাদের কাছেই থাকবে। যেদিন সিদ্ধি নয়, সফলতাকে তোমরা কামনা করবে সেদিন মহাসুর তোমাদের থেকে দূরে সরে যাবে। যার সিদ্ধি অর্জিত হয়েছে সফলতা তার পিছু নেবে। আর সফলতা কখনও মানুষ বা মানুষের সাধনা কোনো কিছুকে সার্থক করতে পারে না।
এর পর সুরপতিকে আর এ আশ্রমে দেখা গেল না। তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ বিরূপাক্ষকে আশ্রমের কার্যনির্বাহী পর্ষদের প্রধান এবং কীর্তি প্রথা আনন্দকে প্রধান আচার্যের পদাধিকার দিয়ে যান।
সুরপতি আর তার সহযাত্রীরা বেতাল গ্রামে পৌঁছলেন সন্ধ্যার সময়। চারদিক থেকে এখন ধেয়ে আসছে রাত্রির অন্ধকার। আবহাওয়া গুমোট তবু বট আর অশ্বত্থে ভরা গ্রাম-পঞ্চায়েতের জায়গায় মানুষ তার অপেক্ষায়। মানুষদের মধ্যে মুরলী তার কোনো আত্মীয়ের চেহারা দেখতে পেল না। গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান বুলন্দর তার চকমকে ভুড়ি নিয়ে মুরলীকে স্বাগত জানাল এতটা মমতায় যেন মুরলী তার বাপ। মুরলী এসব গ্রাহ্য না করে বলল, আগামীকাল থেকে আমি আমার কাজ শুরু করব। ‘কিন্তু মহাদেব!’ বুলন্দর মিনতি করল। ‘আমি সব শুনেচি’। উপস্থিত মানুষের মধ্য থেকে এক শীর্ণ বৃদ্ধা আকুল হয়ে মুরলীকে জড়িয়ে ধরল। কেঁদে কেঁদে বলল সে, আমার খোকা! আমার খোকা! আমার মুরলী! মুরলী তার চাচিকে চিনতে পারল। আরো কয়েকটা প্রদীপ জ্বালা হলো এখানে। কথায় কথায় মুরলী জানতে পারল যে তার ভাই সলিল সুরপতি আর বেঁচে নেই। তার ভাইয়ের ছেলে এসে তাকে তাদের বাড়ি যাওয়ার কথা বলতে মুরলী রাজি হয়ে গেল।
তাকে এগিয়ে দিতে বুলন্দরও এলো। মুরলী তার পূর্বপুরুষদের বাড়িটাতে কোনো উন্নতি দেখতে পেলো না। তাকে দেখে সেজুতি কাঁদল আর প্রণাম করল। মুরলী গ্রামের আর সব বাসিন্দাদের মতো তার বাড়ির মানুষদের শরীরেও দারিদ্র্যের ছাপ অনুভব করল। বুলন্দর সে সময় ‘মাহাদেব’ সম্বোধন করে বলল, দেখছেনই তো কী দারিদ্র্য। আপনি বরং আমার বাড়িতে থাকবেন। সেখানে আপনার অসম্মান হবে না। ‘তুমি কি ভুলে গেছো বুলন্দর আমরা একই সঙ্গে পাঠশালায় যেতাম? এছাড়া তুমি আমাকে ‘তুই’ করে বলতে এখনো তুমি ‘তুই’ করে বললে আমি কিছু মনে করব না।’ সুরপতির কথায় বুলন্দর নিজেকে গুছিয়ে তুলল, মহাদেব, আপনি জগদ্বিখ্যাত হয়েছেন। আপনার গুণপনার কথা দিগি¦দিক ছড়িয়ে পড়েছে। এখন আপনাকে ‘তুই’ বলাটা ঘোর অধর্মের কাজ হবে। একদিন আপনি কী ছিলেন সে-পরিচয় আজ গৌণ; আজকের দিনে বর্তমানের পরিচয়েই পরিচয় আপনার, আর সে পরিচয়ে আপনি আর সবাইকে ছাড়িয়ে সুউচ্চে উঠেছেন। যদি আপনি অনুমতি করেন অধম বুলন্দর আপনার সেবা করে ধন্য হবে।
মুরলী অপরের প্রাচুর্যের থেকে প্রিয়জনের দারিদ্র্য বেছে নিল। আজ রাতে সে তার বহু স্মৃতিসঞ্চিত অতীতের ঘরটাতে শুলো।
আজ বিকেলে মুরলী পঞ্চায়েতের সামনে গ্রামবাসীকে বলল, আমি জানি না আমার সুর আদৌ কোনো বৃষ্টি নামাতে পারবে কিনা। যদি পারে তবে তা কত দিনে সে কথাও আমার জানা নেই। এই কাজ আমি আমার সমস্ত জীবন ও সাধনা সমর্পণ করছি। আমার শুধু এই অনুরোধ যে যতদিন আবার ক্ষেতের ফসল আপনাদের সবার ঘরে না ওঠে ততদিন আমার ভাইয়ের পরিবারের লোকেরা যাতে খেয়েপরে বেঁচে থাকে সে দায়িত্ব আপনাদের নিতে হবে। বুলন্দর গ্রামবাসীদের সামনে দুই হাত উঁচু করে বলল, আপনার কথার অমর্যাদা হবে না মহাদেব। সমাজপতি বুলন্দর আমৃত্যু আপনার কথার মর্যাদা রক্ষা করবে।
সেই সন্ধ্যায় একটা বাঁশের ভেলায় চড়ে একাকী রওয়ানা হলেন সুরপতি। বেতাল গ্রামের পাশ দিয়ে সুরলহরী নামের যে নদী বয়ে যায় তার বুকে তিনি ভেলা ভাসালেন ঠিক সূর্যাস্তের পর। নদী পর্যন্ত এসে গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা তার আশীর্বাদ নিলো এবং তাকে আশীর্বাদ করল। সন্ধ্যার পা ধীরে ধীরে ধরণীর পথে পথে এগিয়ে এল, সুরপতি তার ভেলা ভাসালেন। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে তার ভেলা সুরলহরীরর উজান স্রোতে ভেসে গেল। ধীরে ধীরে ভেসে এল মুরলীর সুর-মূর্ছনা। প্রথমে কেবল গ্রামবাসীরা শুনল সে সুর, পরে ক্রমান্বয়ে আকাশ বাতাস সাগর বন ময়দানে ছড়িয়ে পড়ল তার মূর্ছনা।
এভাবে কয়দিন সুরপতি নদীতে নদীতে ও নদী থেকে সাগরে ভেসে গিয়েছিলেন তার সন্ধান জানে না কেউ। তবে তার সুর ধ্বনিত হতে শুরু করলে নানা জানা-অজানা থেকে অসংখ্য নিঃসঙ্গ ও দলবদ্ধ মেঘপুঞ্জ এসে এসে জমা হতে থাকে বেতাল গ্রামের আকাশে।
সুরপতির ভেলা ভাসাবার ষষ্ঠতম দিনে শুরু হয়েছিল বৃষ্টি। সে বর্ষা স্থায়ী হয়েছিল পুরো এক সপ্তাহ। সে বাদলে বেতালের নদী মাঠ পুকুর ডোবা আর ফসলের ক্ষেত ভরে ওঠে জীবনের আমেজে, জন্ম দেবার মহিমায়। তারপর থেকে আর কখনও খরা বা দুর্ভিক্ষ আসেনি বেতালে।
মানুষেরা বলে, সুরপতির সুর বুঝি এখনও বেজে চলছে অলক্ষ্য থেকে! সুরপতির প্রাণপাত করা সাধনা বিফল হয়নি কোনোমতে। তার মহাসুর হারিয়ে গেলেও তার সুর-তাল ভেসে বেড়াচ্ছে আজও বেতালের আকাশে আকাশে।
©somewhere in net ltd.