নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আবু উবাইদাহ আল হিন্দী আমি ইসলামী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা লেখি করি

আবু উবাইদাহ আল হিন্দী

লেখক, দ্বায়ী, এক্টিভিস্ট

আবু উবাইদাহ আল হিন্দী › বিস্তারিত পোস্টঃ

পশ্চিমা বিশ্বে বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধিঃ বিশ্বরাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে?

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ১১:০২



জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা ও পরিবেশদূষণ কমাতে সারা বিশ্বেই বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ভারত চীন জাপান সহ অনেক দেশই এখন বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদন করছে। তবে এই ক্ষেত্রে পশ্চিমা দেশগুলো অন্যদের চেয়ে একটু বেশি অগ্রসর। পরিবেশবান্ধব ও জ্বালানী সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়াও আরো কিছু বিষয় রয়েছে যে কারণে পশ্চিমাবিশ্বে ইলেকট্রিক গাড়িকে অটোমোটিভ শিল্পের ভবিষ্যৎ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
.
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষনা করেছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে তারা গ্যাসোলিন অর্থাৎ জ্বালানি চালিত গাড়ি উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ করবে এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাবহার শতভাগ নিশ্চিত করবে। ফলে বাধ্য হয়ে গাড়ি নির্মাতাদের ইলেক্ট্রিক ভেহিক্যাল (EV) এর উৎপাদন বাড়াতে হচ্ছে।
.
কিন্তু শুধু উৎপাদন আর বিক্রি বাড়ালেই তো হবেনা, চার্জিং ব্যাবস্থাকেও তো উন্নত ও সহজলভ্য করতে হবে। এই লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০৩০ সালের মধ্যে মহাসড়কের প্রতি ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে অন্তত একটি করে চার্জিং স্টেশন স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
.
কার অগ্রগতি কতটা?
.
বাইডেন প্রশাসন ঘোষণা করেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে আমেরিকায় বিক্রি হওয়া নতুন গাড়ির ৫০% হবে ইলেকট্রিক গাড়ি। এই লক্ষ্যকে বাস্তবায়নের জন্য কর ছাড় এবং প্রণোদনা বৃদ্ধির মত পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তারা।
.
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের লক্ষ্য ২০৩৫ সাল হলেও এর অনেক আগেই অনেকগুলো দেশ এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়। যেমন নরওয়ে ২০২৫ সালের মধ্যে ৭৫-৮০ শতাংশ এবং ২০২৭ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশ বৈদ্যুতিক গাড়ির ব্যাবহার নিশ্চিত করার কথা জানিয়েছে। বর্তমানে সেখানে নতুন বিক্রি হওয়া গাড়ির আশি শতাংশেরও বেশি ইলেকট্রিক গাড়ি। অথচ নরওয়ে ইউরোপের অন্যতম তেল উৎপাদনকারী দেশ।
.
শুধু নরওয়ে বা আমেরিকা নয়, ইউরোপের অন্যন্য দেশেও ইভির বাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। যেমন জার্মানীতে ২০২৩ সালে ইভি বিক্রির পরিমাণ ছিল ২৫ শতাংশের বেশি, যা বিগত বছরগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। ফ্রান্সের শেয়ারবাজারে ইলেকট্রিক গাড়ির শেয়ার বেড়ে ১৫ শতাংশ উন্নীত হয়েছে। যুক্তরাজ্য ২০৩০ সাল থেকে পেট্রোল ও ডিজেল চালিত গাড়ি বিক্রি নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েছে, এই ঘোষণার ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইভির বিক্রি বেড়েছে।
.
পশ্চিমারা কেন ইলেক্ট্রিক গাড়ির দিকে ঝুঁকছে? -
.
মোটাদাগে বলতে গেলে দূষণ কমানো, পরিবেশ রক্ষা, তেলের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং নতুন শিল্প গড়ে তোলা ইত্যাদিই হল বৈদ্যুতিক গাড়ির দিকে ঝোঁকার কারণ। কিন্তু এগুলো ছাড়াও গোপন আরো কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলো প্রচারের আড়ালে রয়ে গেছে। এবার একটু কারণগুলো ব্যাখ্যা করে বলি।
.
১. পরিবেশ রক্ষা ও জলবায়ু সংকট মোকাবেলা
.
জ্বালানি চালিত গাড়ি বাদ দিয়ে ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যাবহারের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বায়ু দূষণ এবং কার্বন নিঃসরণ কমানো। কারণ পশ্চিমা দেশগুলো বিশ্বের শীর্ষ কার্বন নিঃসরণেকারী দেশগুলোর অন্যতম। অব্যহত চাপের কারণে তারা চাচ্ছে এটি কমিয়ে আনতে। আর ইলেকট্রিক গাড়ি ব্যবহারের মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। কারণ ইলেক্ট্রিক গাড়ি থেকে সরাসরি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ হয়না বলে পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব কম পড়ে।
.
২. তেলের ওপর নির্ভরতা কমানো
.
পশ্চিমা বিশ্ব দীর্ঘদিন ধরে তেলের ওপর নির্ভরশীল। তেল মূলত মধ্যপ্রাচ্য এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলো থেকে আসে। তারা চাচ্ছে ধীরে ধীরে এই নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে। যেন ভবিষ্যতে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো তেল দিতে অস্বীকার করলে তাদের কোন সমস্যা না হয় এবং তারা চাইলে উল্টো যেকোন সময় তাদেরকে চাপের মুখে ফেলতে পারে। এজন্য তারা তেলের বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তি ও ব্যাটারির উপর নির্ভরশীল হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্বজুড়ে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর শক্তি ও প্রভাব কমতে পারে এবং এর স্থলে ব্যাটারি ও নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনকারী দেশগুলোর প্রভাব বাড়তে পারে।
.
৩. নতুন শিল্প ও অর্থনীতির ক্ষেত্র তৈরি করা
.
ইলেকট্রিক গাড়ির উৎপাদন পশ্চিমা দুনিয়ায় শিল্প ও প্রযুক্তি খাতে নতুন যুগের সূচনা করেছে। এই শিল্পে ব্যাটারি উৎপাদন, চার্জিং ইন্টারফেস, নবায়নযোগ্য শক্তির সঙ্গে সংযোগ ইত্যাদি খাতে শ্রম ও অর্থনীতির নতুন নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলো এই খাতে চীনের সাথে পাল্লা দিয়ে বিনিয়োগ করছে। তারা চাচ্ছে এই খাতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে। কারণ এনার্জির নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে সেই বিশ্বে ক্ষমতাবান বলে বিবেচিত হবে।
.
৪. চীনের প্রভাব খর্ব করা
.
ইলেকট্রিক গাড়ি শিল্পে চীনের শক্তিশালী অবস্থান ইতোমধ্যে বিশ্বের ভূরাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। চীন লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি উৎপাদন এবং ইলেকট্রিক গাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে চালকের আসনে আছে। যদি পশ্চিমা বিশ্ব চীনকে এই অবস্থান থেকে সরাতে না পারে তাহলে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনের আধিপত্য আরও মজবুত হবে। তাই পশ্চিমারা এই শিল্পে চীনকে দূর্বল করে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে চাচ্ছে।
.
৫. ভবিষ্যত যুদ্ধনীতি ও প্রতিরক্ষা
.
তেল গ্যাসের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বে কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ১৯৯০ এর গালফ ওয়ার এবং ২০০৩ এর ইরাক যুদ্ধ এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য। এখন যদি পৃথিবী ব্যাটারি এবং নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে তাহলে জ্বালানির পরিবর্তে প্রযুক্তি ও খনিজ পদার্থ যেমন লিথিয়াম, কোবাল্ট ইত্যাদি নিয়ে দেশে দেশে শত্রুতা ও মিত্রতার নতুন সমীকরণ সৃষ্টি হতে পারে এমনকি যুদ্ধও হতে পারে।
.
এরফলে ভূরাজনীতিতে যে প্রভাব পড়তে পারে-
.
১. তেলের মূল্য কমতে পারে এবং তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর প্রভাব হ্রাস পেতে পারেঃ তেলের চাহিদা কমার সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে চাপের মুখে পড়তে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের আন্তর্জাতিক প্রভাবও কমে যেতে পারে।
.
২. খনিজ সম্পদ আহরণে প্রতিযোগিতা বাড়তে পারেঃ ইলেকট্রিক গাড়ির জন্য যেসব উপাদান প্রয়োজন যেমন লিথিয়াম, কোবাল্ট, এবং নিকেল, সেসবের জন্য নতুন নতুন রিসোর্সের তালাশে নামবে সবাই। ফলে বিশ্বজুড়ে নতুন ধরনের ভূরাজনৈতিক মিত্রতা এবং শত্রুতা গড়ে উঠতে পারে। আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকার যেসব দেশের হাতে এই খনিজ সম্পদ আছে, তাদের প্রভাব বাড়তে পারে।
.
৩. নতুন কৌশলগত মিত্রতা তৈরি হতে পারে: ইলেকট্রিক গাড়ি এবং নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন ও বিপণনে আগ্রহী দেশগুলো অংশীদারির ভিত্তিতে নতুন জোট গঠন করতে পারে। ইউরোপ এবং আফ্রিকার যেসব দেশে লিথিয়াম ও অন্যন্য খনিজ উপাদান অধিক পরিমাণে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
.
এখানে গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন হল, এর কারণে মুসলিম উম্মাহর উপর কি ধরণের প্রভাব পড়তে পারে বা তারা কি ধরণের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে।
.
পূর্বের আলোচনা থেকে আশা করি এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে যে, পশ্চিমারা চাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য এবং তাদের তেলের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে। যদি তারা এতে সফল হয় তাহলে সৌদি, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত সহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী দেশগুলো অনেকটা গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। তখন তারা প্রয়োজন হলে এই অঞ্চলে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিতে একটুও দ্বিধা করবেনা। কারণ তখন তাদের কিছু ব্যাবসায়িক লোকসান ছাড়া ভিন্ন কোন ক্ষতির ভয় থাকবেনা।
.
পশ্চিমারা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়াতে চায় না, যার প্রধান কারণ হলো অঞ্চলটির তেল সম্পদ। একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের ফলে বিশ্বে তেলের ঘাটতি দেখা দিলে এই মুহূর্তে পশ্চিমা দেশগুলোর উৎপাদন ও সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে, যা পুনরুদ্ধার করা তাদের জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত কঠিন হবে।
.
বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, বর্তমানে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে এই গতিতে অগ্রসর হলে পশ্চিমারা স্বল্প সময়ের মধ্যেই তেলের বিকল্প তৈরিতে সক্ষম হবে, কারণ শুধু একটি পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুতেই লাখ লাখ গাড়ি চার্জ দেয়া সম্ভব। আর পুরো ইউরোপজুড়ে এমন অসংখ্য বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং সামনে আরো হবে। তাছাড়া ব্যাটারী এবং ব্যাটারীর প্রয়োজনীয় কাঁচামালও তাদের প্রভাবাধীন অঞ্চল সমূহের মধ্যে রয়েছে। এখন শুধু প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি গুলো দাড় করাতে পারলেই হল। এরপর আর তাদেরকে তেল নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।
.
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, দিন যত গড়াবে বিশ্বজুড়ে সভ্যতার সংঘাত ততই তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। তাই এখনই যদি মুসলিম বিশ্ব এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে পরবর্তীতে তাদেরকে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়তে হতে পারে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.