নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মূল আইডি মহামান্য এডমিন কর্তৃক অঘোষিত ব্যান করে রাখায় এটা আমার ২নং ব্যাকআপ আইডি!! \nমূল আইডির লিংক www.somewhereinblog.net/blog/AhmedFiroj

আহমাদ ফিরোজ

আমি হবো সত্য বলার পাখি

আহমাদ ফিরোজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শহীদ আব্দুল মালেকের অসাধারণ কথামালা

১১ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:২৫


শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের সংবাদ শুনে সেদিন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.) বলেছিলেন-

‘‘আব্দুল মালেক বাংলাদেশে(তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তান) ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ তবে শেষ নয়।’

ইসলামী শিক্ষার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদী ও সমাজতন্ত্রীদের হাতে গুরুতর আহত হওয়ার ৩ দিন পর ১৯৬৯ সালের ১৫ আগষ্ট আব্দুল মালেক শহীদী মৃত্যুর অমিয়সুধা পান করেন।

শহীদ আব্দুল মালেকের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের জমিনে শহীদের মিছিলের সারি দিন দিন কেবল দীর্ঘই হচ্ছে.....

অসম্ভব মেধামী ছাত্র ছিলেন আব্দুল মালেক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন বিভাগের সেরা ছাত্রটিই ছিলেন তিনি। তার অসাধারণ কিছু কথামালা নিয়েই এই লেখা.....


“আমার প্রিয় ক্যাম্পাসের ছাত্রদেরকে ইসলামের দিকে আমার ডান হাত দিয়ে ডাকবো, ইসলামের শত্রুরা যদি আমার ডান হাতটি কেটে ফেলে তাহলে বাম হাত দিয়ে ডাকবো। ওরা যদি আমার বাম হাতটিও কেটে ফেলে তাহলে দুটো পা দিয়ে হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ইসলামের সুমহান আদর্শের দিকে ডাকবো। ওরা যদি আমার দুটো পাও কেটে ফেলে তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি ছেলেকে ইসলামের দিকে ডাকবো। ওরা যদি আমার চলার গতি স্তব্ধ করে দেয় তাহলে আমার যে দুটো চোখ বেঁচে থাকবে সে চোখ দুটো দিয়ে হলেও ছাত্রদেরকে ইসলামের প্রতি ডাকবো। আমার চোখ দুটিকেও যদি ওরা উপড়ে ফেলে তাহলে হৃদয়ের যে চোখ রয়েছে তা দিয়ে হলেও আমি আমার জীবনের শেষ গন্তব্য জান্নাতের দিকে তাকিয়ে থাকবো।”


‘‘বেঁচে থাকার জন্য ডিগ্রি নিতে হবে যাতে আয়-রোজগারের একটা পথ হয়। কিন্তু ওটাকে জীবনের চরম লক্ষ্য বানিয়ে নিতে চাই না। খুব ভালো রেজাল্টের ধান্দা করলে ক্যারিয়ার গড়ার নেশায় পেয়ে বসার আশঙ্কা আছে।’’


মজার বিষয় হলো, উপরিউক্ত মন্তব্য করার পরেও কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রটি আব্দুল মালেকই ছিলেন।


“সৎগুণ ও সৎবৃত্তির বিকাশে মানুষের জীবন মনুষ্যত্বে ও মহত্বে পূর্ণ করে জীবন ও জগতের কল্যাণ সাধনই আদর্শ জীবনের চরম লক্ষ্য, পরম উদ্দেশ্য।”


“জানি আমার কোন দুঃসংবাদ শুনলে মা কাঁদবেন, কিন্তু উপায় কি বলুন? বিশ্বের সমস্ত শক্তি আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আমরা মুসলমান যুককরা বেঁচে থাকতে তা হতে পারেনা।”




“মায়ের বন্ধন ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। বৃহত্তর কল্যাণের পথে সে বন্ধনকে ছিঁড়তে হবে। কঠিন শপথ নিয়ে আমার পথে আমি চলতে চাই। আশির্বাদ করবেন, সত্য প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে যেন আমার জীবনকে আমি শহীদ করে দিতে পারি।”


“আমার মা এবং ভাইরা আশা করে আছেন, আমি একটা বড় কিছু হতে যাচ্ছি। কিন্তু মিথ্যা সে সব আশা। আমি চাইনে বড় হতে, আমি ছোট থেকেই স্বার্থকতা পেতে চাই।”


“হয় বাতিলের উৎখাত করে সত্যের প্রতিষ্ঠা করবো, নচেৎ সে চেষ্টায় আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে।”


“আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন, যাতে কারাগারের নীরন্ধ্র অন্ধকার, সরকারি যাঁতাকলের নিষ্পেষন আর ফাঁসীর মঞ্চও যেন আমাকে ভড়কে দিতে না পারে।”


ইনশাআল্লাহ তার যোগ্য উত্তরসূরী কাদের মোল্লা আর কামারুজ্জামানদেরও ফাঁসির মঞ্চ ভড়কে দিতে পারেনি। হাসিমুখেই তারা জান্নাতের এই সিঁড়ি অতিক্রম করেছেন।


“সংগ্রামের জিন্দেগী, মঞ্জিল তো অনেক দূরে। কুরআনের ডাকে, সেই পথে তীব্র গতিতে ছুটে চল।”


“কেবল নফল ইবাদত আর তাসবীহ পড়ে ঐ তাসবীহর দানার উপর ইসলাম কায়েম হবেনা। ”


ইসলামী আন্দোলনের এক কর্মীকে উদ্দেশ্য করে আব্দুল মালেকের চিঠি-

প্রিয় বেলাল,
মুসলমানদের জিন্দেগী খুবই কঠিন। জাহানে নও এ হয়তো পড়ে থাকবে। গত ২৯ আগস্ট মিসরে যারা ইসলামী আন্দোলন করতেন সেই ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ৩ জন নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ সাইয়েদ কুতুব শহীদ। ১৯৫৪ সালেও এ দলের ৬ জন নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মিসরের সর্বোচ্চ বিচারপতি ড. আব্দুল কাদের আওদাহ। এ সময় সাইয়েদ কুতুবের দশ বছরের কারাদণ্ড হয়। ইসলামী আন্দোলনে মিসরের মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। জয়নব আল গাজালী নামে এক মহিলাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। সাইয়েদ কুতুবের বোন হামিদা কুতুবকে দেয়া হয়েছে ১০ বছরের কারাদণ্ড। বেলাল চিন্তা করতে পারকি এদের কথা। এদের জীবন শহীদের, মুজাহিদের জীবন। মৃত্যুও শহীদের মৃত্যু। এদের অপরাধ ছিল এই যে, এরা মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসেরের অনৈসলামী কাজের সমালোচনা করেছিলো। আমাদেরকেও ওদের মতো হতে হবে। রাসূলের (সা.) পথ শাহাদাতের পথ। তোমরা তাই জেগে ওঠো, তৈরি হও সেই চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য। এই শপথ নাও।

তোমাদের মালেক ভাই,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩ মার্চ, ১৯৬৭।

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:৪৫

তৃণ বলেছেন: জানলাম একজন নেতার কথা।

১১ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:৫৪

আহমাদ ফিরোজ বলেছেন: সচরাচর নেতা নয়... একজন ইসলামী আন্দোলনের দায়িত্বশীলের কথা জানলেন।

২| ১১ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:৫৬

প্রামানিক বলেছেন: তার সম্পর্কে আগে কোন ধারনা ছিল না।

১১ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:০২

আহমাদ ফিরোজ বলেছেন: আরো বিস্তারিত জানতে এটা পড়ুন...

ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আব্দুল মালেক

৩| ১১ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:০২

শাহমুন নাকীব ফারাবী বলেছেন: জাজাকাল্লাহ।

১১ ই আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৬

আহমাদ ফিরোজ বলেছেন: শুকরিয়া...।

৪| ১১ ই আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:২৭

হাবিবুর রাহমান বাদল বলেছেন: প্রামানিক বলেছেন: তার সম্পর্কে আগে কোন ধারনা ছিল না।
তার সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানালে ভাল হত। বিশেষ করে কিভাবে প্রথম শহীদ হলেন?

১২ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৯:১৮

আহমাদ ফিরোজ বলেছেন: এই লেখাটা পড়লে অনেকটাই ধারনা পাবেন....
ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আব্দুল মালেক - See more at: Click This Link

৫| ১২ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৯:২২

আহমাদ ফিরোজ বলেছেন: ইসলামী শিক্ষা আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আব্দুল মালেক

ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে বাংলাদেশে যে কয়েকজন ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন শহীদ আব্দুল মালেক তাঁদের মধ্যে অন্যতম। একজন তুখোর মেধাবী ছাত্র হয়েও যিনি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থাকতে পছন্দ করতেন। আব্দুল মালেকের প্রত্যেকটি কাজই ছিল দ্বীনের উদ্দেশ্যে। জানার আগ্রহ ছিল তাঁর অনেক বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আব্দুল মালেক খুব কম সময়ের মধ্যেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। তাঁর সকল কাজের মধ্যমনি ছিল কিভাবে ইসলামী শিক্ষাকে এদেশে বাস্তবায়ন করা যায়। ইসলামী শিার কথা বলতে গিয়ে নিজের জীবনকে একেবারে তুচ্ছ মনে করে শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করেন শহীদ আব্দুল মালেক।

ছাত্র হিসেবে আব্দুল মালেক

১৯৪৭ সালে জনগ্রহণকারী শহীদ আব্দুল মালেক বগুড়ার অদূরবর্তী থানা ধুনটের খোকসাবাড়ীতে মৌলভী মুন্সি মোহাম্মদ আলী ও মা ছাবিরুন নেছার ৫ জন ছেলের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। একাডেমিক জীবনের হাতেখড়ি থেকে শুরু করে সর্ব্বোচ্চ বিদ্যাপিঠ পর্যন্ত তিনি মেধার স্বার রেখে গেছেন। খোকসাবাড়ী প্রাইমারি স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে তিনি স্কলারশিপ লাভ করে ভর্তি হন গোসাইবাড়ী হাইস্কুলে। সেখানেও তিনি অষ্টম শ্রেণীতে স্কলারশিপ লাভ করেন। জ্ঞানের তীব্র আকাক্সা নিয়ে এবার তিনি নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন বগুড়া জেলা স্কুলে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আব্দুল মালেক শিক শিার্থীর ভালোবাসা অর্জন করতে সমর্থ হন। সময় গড়িয়ে এবার এলো এসএসসি পরীা। দেখা গেলো এবারও তিনি তাঁর মেধার স্বার রেখেছেন। এসএসসি পরীায় তিনি রাজশাহী বোর্ডে মেধা তালিকায় একাদশ স্থান অর্জন করেছেন।

তারপর শুরু হলো উচ্চ শিক্ষা অর্জনের পথ চলা। বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেন রাজশাহী কলেজে। আব্দুল মালেক এবার আরও ভালো রেজাল্ট করতে সমর্থ হলেন। এইচএসসি পরীক্ষায় এবার তিনি মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন। উচ্চ শিক্ষার সুতীব্র আকাক্সা নিয়ে এবার তিনি প্রাণ রসায়নে ভর্তি হলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানেও তিনি প্রথম স্থান অধিকার করতে থাকেন। শাহাদাত বরণকালে তিনি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

কর্মী হিসেবে আব্দুল মালেক

আব্দুল মালেক একজন নীরব কর্মী ছিলেন। অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী হয়েও তিনি কখনো গর্ব করে বেড়াতেন না। তিনি শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করেই সামনের দিকে এগুতে চাইতেন। আর তাইতো তিনি নবম শ্রেণীতে থাকা অবস্থায় তাঁর পিতার নিকট লিখলেন- “বাড়ির কথা ভাবি না, আমার শুধু এক উদ্দেশ্য খোদা যেন আমার উদ্দেশ্য সফল করেন। কঠিন প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি এবং কঠোর সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি দোয়া করবেন খোদা যেন সহায় হন। আমি ধন সম্পদ কিছুই চাই না শুধু যেন প্রকৃত মানুষরূপে জগতের বুকে বেঁচে থাকতে পারি।”

আব্দুল মালেক ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য কর্মী। যখন তিনি ঢাকা শহর শাখার অফিস সম্পাদক তখন অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি সেই অফিসের চেহারা পাল্টে দিলেন। আব্দুল মালেকের দায়িত্বশীল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী বলেছেন- “আব্দুল মালেকের সহযোগিতায় ঢাকা শহর শাখার পর পর তিনজন সভাপতি যত সহজে বিরাট দায়িত্ব পালন করেছেন তেমন আরামে ও সহজে গুরুদায়িত্ব পালনের সুযোগ কোনদিন কেউ পেয়েছে বলে আমার জানা নাই।”

শহীদ আব্দুল মালেক একদম সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তাঁর একটা মাত্র জামা ছিল। সারাদিন কাজ শেষে রাতে রুমে এসে সেটা ধুয়ে শুকাতে দিতেন আর তা পরের দিন পড়ে আবার দ্বীনের কাজে বেড়িয়ে যেতেন।

ইসলামী আন্দোলনের একজন উদীয়মান কর্মী হিসেবে তাঁর মন ছিল মানবতার দরদে ভরপুর। দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের অবস্থা জানাও ছিল তাঁর অন্যতম কর্মসূচি। বর্তমান আমীরে জামায়াত বলেছেন- ‘‘ঈদুল আজহা উপলক্ষ কর্মীরা বাড়িতে যাচ্ছে। রাতের ট্রেনে আব্দুল মালেক বাড়ি যাবেন শুনেছি। দু’একদিনের মধ্যে দেখা হয়নি। সময় মতো স্টেশনে গিয়ে হাজির হলাম। আব্দুল মালেককে খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগেছে। কারণ তিনি মধ্যম শ্রেণীতে উঠেননি। আমাকে দেখে তিনি বেশ অপ্রস্তুত হলেন। আমার স্টেশনে যাওয়া তাঁর কাছে কেমন যেন লেগেছে। বেশ একটু জড়সড় হয়ে বলতে লাগলেন, আপনি স্টেশনে আসবেন জানলে আমি যে করেই হোক দেখা করেই আসতাম। অবশ্য একবার খোঁজ করেছি আপনাকে পাইনি। আমি কথাগুলোর দিকে কান না দিয়ে কামরাটার দিকে ভালো করে দেখছিলাম। তিল ধরনের জায়গা নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে সারারাত। আমি চেষ্টা করলাম ইন্টারে জায়গা করে দেয়ার। টিকিটের ঝামেলাও চুকিয়ে দেয়া যেত। কিন্তু রাজি করানো সম্ভব হলো না। আব্দুল মালেক অকপটে বলেই ফেললেন, এই লোকগুলোর সাথে আলাপ করলে আমার ভালো লাগবে। তখনো বুঝতে পারিনি কত মর্যাদাবান ব্যক্তির কাছে এই কথাগুলো শুনছি।’’

দায়িত্বানুভূতি ও স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল শহীদ আব্দুল মালেকের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক। এব্যাপারে মাওলানা নিজামী বলেন- ‘‘সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে একদিন ঢাকায় প্রবল বৃষ্টি হয়ে গেল। আগামসি লেনস্থ সংঘের পূর্ব পাক দফতর থেকে বেরোবার উপায় ছিল না আমাদের। বস্তির লোকেরা বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতন কলভবন, হোসেনী দালান ও সিটি ল’ কলেজে আশ্রয় নিয়েছে। আমি কোনোমতে ফজলুল হক হলে গেলাম। তিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে আমরা কি করতে পারি সে সম্পর্কে পরামর্শ করাই ছিল আমার উদ্দেশ্য। এ প্রসঙ্গে কথা উঠার আগেই আব্দুল মালেকের মুখে খবর পেলাম ঢাকা শহর অফিসে পানি উঠেছে। বৃষ্টি একটু থেমে যেতেই তিনি অফিসে গিয়ে সব দেখে এসেছেন। অধিক পানি ওঠায় কাগজপত্রাদি সামান্য তিগ্রস্ত হয়েছে। আব্দুল মালেক ওগুলো সব ঠিকঠাক করে এসেছেন। তাঁর দায়িত্ব সচেতনতার এ চাুষ প্রমাণটুকু আমার পে কোনোদিনই ভুলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। তারপর কর্মী বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে একদিন নিউমার্কেট ও আরেক দিন জিন্নাহ এভিনিউয়ে রোড কালেকশন করা হলো। অল্প সময়ে কর্মীদেরকে জমায়েত করে এত বড় কাজ আঞ্জাম দেয়ার মতো আর কোন কর্মীই ছিল না। আমারতো কাজ ছিল শুধু কাগজের টুকরায় কিছু নোট লিখে অথবা আধঘণ্টা পনের মিনিটের আলাপে মোটামুটি কিছূ বুঝিয়ে দেয়া। আব্দুল মালেকের সুদ পরিচালনায় সংগৃহিত অর্থের নিখুত হিসাব পেলাম। সিকি, আধুলি, পাই পয়সা থেকে নিয়ে কত টাকার নোট কতটি, তার হিসেবের ব্যবস্থাও তিনি করে রেখেছিলেন। এরপর তিন দিন তিন রাত একটানা পরিশ্রম করে আব্দুল মালেক অল্প সংখ্যক কর্মী নিয়ে চাল বন্টনের কাজ সমাধান করে ফেললেন। সেদিন আব্দুল মালেককে স্বচে অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখেছি। আর মুরুব্বি সেজে পরামর্শ দিয়েছে কাজটা আর একটু সহজে কিভাবে করা যায়। এই ভাগ্যবান ব্যক্তির পরিশ্রমকে লাঘব করার জন্য সেদিন তার সাথে মিলে নিজ হাতে কিছু করতে পারলে আজ মনকে কিছু শান্ত্বনা দিতে পারতাম।’’

নেতা হিসেবে আব্দুল মালেক

সাধারণত একজন নেতার যে সকল গুণাবলী থাকা দরকার শহীদ আব্দুল মালেকের মধ্যে তার পুরোটাই ছিল। ১৯৬৮-৬৯ এর সেশন শুরু হয়েছে। আব্দুল মালেক ঢাকা শহর শাখার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় কার্যকরি পরিষদের নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিতে নির্বাচিত তিনজন সদস্যের মধ্যে তিনি অন্যতম। ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপোষহীন, নির্ভীক। তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টায় ইসলামী আন্দোলনের কাজ অনেকটা গতিশীল হলো। তিনি ছিলেন কর্মীদের একজন আস্থাবান দায়িত্বশীল। এত বড় একজন দায়িত্বশীল হয়েও তিনি কর্মীদের খোঁজ-খবর নিতে ভুলতেন না। শহীদ আব্দুল মালেকের একটা চিরাচরিত অভ্যাস ছিল চিঠির মাধ্যমে কর্মীদের প্রেরণা যোগানো। তিনি নিয়মিতই বিভিন্ন কর্মীকে চিঠি লিখতেন। এমনি একজন কর্মী বেলালকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন- ‘‘সৃষ্টির আদি থেকে একটি শ্বাশ্বত নিয়মের মতো এ সত্য চলে এসেছে যে, মহাপুরুষরা সত্যের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজের মন-প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছেন। নির্মম সমাজ সেই মহাপুরুষকেই কঠিন ও নির্দয়ভাবে আঘাতের পর আঘাত হেনেছে। বিদ্রুপ, লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার এই ইতিহাস নতুন কিছু নয়। আরবের বালুকণা ও প্রস্তর কাদের তাজা খুনে রঞ্জিত হয়েছিল? ওমর, ওসমান, আলী আর হাসান হোসাইন এর জীবন নাশের জন্য কারা দায়ী? ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ, মুহাম্মদ ইবনে কাশিম, কোতায়বা কাদের চক্রান্তে নিহত হয়েছিলেন? ইসলামের ইতিহাস পড়ে দেখ, রক্তের লাল স্রোত শুধু কারবালাতেই শেষ হয়ে যায়নি। আজও পৃথিবীর বুকে সহস্র কারবালা সৃষ্টি হচ্ছে। আজো মুসলমান ফাঁসির মঞ্চে নিজের জীবন বিলিয়ে দিচ্ছে খোদার দ্বীনকে টিকিয়ে রাখার জন্য। তোমরাতো পৃথিবী দেখনি, দেখনি মুসলমানদের উপর নির্যাতন, শোননি তাদের হাহাকার। যে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানব নিজের জীবন তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলেন, যার জন্য হাজারো মুজাহিদের তপ্ত রক্ত পৃথিবীর মাটি লাল করে দিয়েছে, সেই ইসলামই লাঞ্ছিত হচ্ছে মুসলমানদের হাতে।”

একটা বিষয় খেয়াল করার মতো। তিনি আজ থেকে প্রায় ৪৬ বছর আগে যেই বিষয়টা নিয়ে লিখেছিলেন আজও সেই অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। এই তো সেদিন আবদুল কাদের মোল্লাকে (রাহ.) বিনা অপরাধে (তাঁর অপরাধ শুধু একটাই যে তিনি ইসলামী আন্দোলন করেন) ফাঁসি দিয়ে হত্যা করলো এদেশেরই নামধারী মুসলমান সরকার। আজও মুসলমানদের হাতেই ইসলামের সর্বনাশ হচ্ছে। মিসরে মুসলমানের (জেনারেল সিসি) হাতেই হাজার হাজার মুসলমান নিহত হলো। আমাদের এই সবুজ বাংলাদেশে মুসলমান শাসকের হাতেই শত শত মুসলমান নিহত হলো-হচ্ছে। ফিলিস্তিনের মুসলমানদের আজ পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। মিয়ানমারের মুসলমানদের পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে। চীনের মুসলমানদের রোজা পর্যন্ত রাখতে দেয়া হচ্ছে না। এক কথায় আজকে সমগ্র বিশ্বের প্রায় সকল মুসলমানই বিশেষ করে মুসলমানের মতো যারা জীবন যাপন করতে চায় তাদের সকলেই কঠিন নির্যাতনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন।

আব্দুল মালেক জানতেন যে ইসলামী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া মানেই কঠিন পরীাকে মাথা পেতে নেয়া। সেটা জেনে পথ চলার কারণেই কোনো প্রতিবন্ধকতা তাঁর পথ আগলে রাখতে পারেনি। পাহাড়সম দৃঢ়তা নিয়ে এগিয়ে গেছেন সম্মুখ পানে। তাঁর বলিষ্ঠতা, আত্মবিশ্বাস এবং সংগ্রামী চেতনার পরিচয় মিলে নিম্নের এই লেখায়-

‘‘জানি আমার দুঃসংবাদ পেলে মা কাঁদবেন, কিন্তু উপায় কি বলুন? বিশ্বের সমস্ত শক্তি আল্লাহর দেয়া জীবন বিধানকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে। আমরা মুসলমান যুবকেরা বেঁচে থাকতে তা হতে পারে না। হয় বাতিল উৎখাত করে সত্যের প্রতিষ্ঠা করবো নচেৎ সে প্রচেষ্টায় আমাদের জীবন শেষ হয়ে যাবে। আপনারা আমায় প্রাণভরে দোয়া করুন জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়েও যেন বাতিলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে পারি। কারাগারের অন্ধকার, সরকারি যাতাকলের নিষ্পেষণ যেন আমাকে ভড়কে দিতে না পারে।”

সত্যিই আব্দুল মালেককে কোনো কিছুই ভড়কে দিতে পারেনি। তিনি পাহাড়ের মতো অটল অবিচল থেকে দ্বীনের দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে গেছেন। আব্দুল মালেক যে কত দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন তার নজির মিলে তাঁর এক বক্তব্যের মাধ্যমে। শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা (রাহ.) এক সময়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন : আমি যখন ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দিলাম তখন এক কর্মী শিা শিবিরে ঢাকায় আসলাম। আব্দুল মালেকের কথা শুনেছি কিন্তু তাঁকে তখন পর্যন্ত দেখা হয়নি। তিনি ছিলেন সেই শিা শিবিরের ব্যবস্থাপক। কিন্তু প্রায় তাঁকে দেখা যেত না। শেষ দিনে এসে তিনি একটা ছোট্ট বক্তব্য দিলেন। তাঁর বক্তব্যটা ছিল এরকম-

‘‘... আমরা তো জেনে বুঝেই এ পথে এসেছি। এই পথ থেকে ফিরে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। আমরা যদি পিছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে অনেকদূর পথ পেরিয়ে এসেছি, কিন্তু সামনের দিকে তাকালে মনে হবে আমাদের আরও অনেক পথ চলতে হবে। এই পথে চলতে গিয়ে যদি আমরা দ্রুতগামী কোনো বাহন পাই তাহলে সেটাতে সওয়ার হয়েই মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছবো, যদি তেমনটা না পাই তাহলে শ্লোথ কোনো বাহনে করে হলেও আমরা সেই মঞ্জিলে পৌঁছার চেষ্টা করবো। এই পথ চলতে গিয়ে বাতিল শক্তি যদি আমাদের পা দুটো কেটে ফেলে তাহলে আমরা হাতের উপর ভর করে মঞ্জিলে পৌঁছার চেষ্টা করবো। বাতিল শক্তি যদি আমাদের হাত দুটোকেও কেটে ফেলে তাহলে আমরা আমাদের শরীরের উপর ভর করে মঞ্জিলের দিকে এগিয়ে যাব, এই পর্যায়ে বাতিলেরা যদি ধর থেকে আমাদের মাথা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তাহলে আমরা আমাদের চোখ দিয়ে সেই মঞ্জিলের দিকে চেয়ে থাকবো, বাতিল শক্তি যদি আমাদের চোখ দুটোও তুলে নেয় তাহলে আমরা আমাদের মন দিয়ে ধ্যান করবো যে কখন আমরা আমাদের মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছাব, এরপরও আমরা বাতিলের সামনে কখনো মাথা নত করবো না।’’

আজকে আমাদের মাঝে বক্তা এবং শ্রোতা, নেতা এবং কর্মী আব্দুল মালেক এবং আব্দুল কাদের মোল্লা কেউই আর বেঁচে নেই। দুজনই শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করে আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে অবস্থান করছেন। দু’জই আজকে সফল মানুষের খাতায় না লিখিয়েছেন। আর আমাদের জন্য রেখে গেছেন এক উজ্জ্বল প্রেরণা। শহীদ আব্দুল মালেক আমাদের সেই পথে চলার প্রেরণা দেয়ার জন্য তাঁর প্রিয় কর্মী বেলালকে আরেকটি চিঠিতে লিখলেন- ‘‘প্রিয় বেলাল, মুসলমানদের জিন্দেগী খুবই কঠিন। জাহানে নও এ হয়তো পড়ে থাকবে। গত ২৯ আগস্ট মিসরে যারা ইসলামী আন্দোলন করতেন সেই ইখওয়ানুল মুসলিমীনের ৩ জন নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন প্রখ্যাত চিন্তাবিদ সাইয়েদ কুতুব শহীদ। ১৯৫৪ সালেও এ দলের ৬ জন নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মিসরের সর্বোচ্চ বিচারপতি ড. আব্দুল কাদের আওদাহ। এ সময় সাইয়েদ কুতুবের দশ বছরের কারাদণ্ড হয়। ইসলামী আন্দোলনে মিসরের মেয়েরাও পিছিয়ে নেই। জয়নব আল গাজালী নামে এক মহিলাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। সাইয়েদ কুতুবের বোন হামিদা কুতুবকে দেয়া হয়েছে ১০ বছরের কারাদণ্ড। বেলাল চিন্তা করতে পারকি এদের কথা। এদের জীবন শহীদের, মুজাহিদের জীবন। মৃত্যুও শহীদের মৃত্যু। এদের অপরাধ ছিল এই যে, এরা মিসরের প্রেসিডেন্ট নাসেরের অনৈসলামী কাজের সমালোচনা করেছিলো। আমাদেরকেও ওদের মতো হতে হবে। রাসূলের (সা.) পথ শাহাদাতের পথ। তোমরা তাই জেগে ওঠো, তৈরি হও সেই চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য। এই শপথ নাও।

তোমাদের মালেক ভাই,

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৩ মার্চ, ১৯৬৭।’’

শাহাদাতের প্রেক্ষাপট

আব্দুল মালেক সর্বদাই শহীদি তামান্নায় উজ্জীবিত ছিলেন। তিনি লেখা-পড়ার চেয়ে ইসলামী আন্দোলনকে কোনো অংশেই কম গুরুত্ব দিতেন না বরং কিছু সময় বেশিই গুরুত্ব দিতেন। তাঁর সহপাঠি ও সহকর্মীরা তাঁকে পরীায় খুব ভালো ফল করার দিকে মনযোগী হওয়ার পরামর্শ দিলে তিনি মৃদু হেসে বলতেন-

‘‘বেঁচে থাকার জন্য ডিগ্রি নিতে হবে যাতে আয়-রোজগারের একটা পথ হয়। কিন্তু ওটাকে জীবনের চরম ল্য বানিয়ে নিতে চাই না। খুব ভালো রেজাল্টের ধান্দা করলে ক্যারিয়ার গড়ার নেশায় পেয়ে বসার আশঙ্কা আছে।’’

মজার বিষয় হলো, উপরিউক্ত মন্তব্য করার পরেও কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রটি আব্দুল মালেকই ছিলেন। আর সেই কারণেই তিনি খুব ভালোভাবেই উপলব্ধিই করতে পেরেছিলেন যে, শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন হওয়া দরকার। বর্তমানেও তার ব্যতিক্রম নয়। আজকে এমন একটা শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে যে, এখান থেকে নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ গড়ে ওঠা অনেকটা অসম্ভব ব্যাপার। স্কুল কলেজে ধর্মীয় শিক্ষা নাই বললেই চলে আর মাদরাসাতে যা চালু আছে ইসলাম শেখার জন্য সেটাও অপ্রতুল বললে মনে হয় না বেশি বলা হবে। আজকে ছোট ছেলে-মেয়েদের শেখানো হচ্ছে কিভাবে সুদ কষার অঙ্ক করতে হয়। যারা ছোটবেলা থেকেই সুদের হিসেব নিকেষ করতে শিখছে তারা বড় হয়ে সেই সুদকে যে কতখানি প্রত্যাখ্যান করতে পারবে তা বলা কঠিন। মিস্টার আর মৌলভীতে বিভক্ত করা হচ্ছে আমাদের পুরো জাতিকে। ইসলামের যতটুকু শিক্ষা এখন পর্যন্ত চালু আছে তা শুধু ব্যক্তি উদ্যোগেই। শহীদ আব্দুল মালেক এই বিষয়গুলো হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি মনে করেছিলেন যে, এটার অবসান ছাড়া সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই তিনি ইসলামী শিা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য যেখানে যতটুকু সময়-সুযোগ পেয়েছেন লুফে নিয়েছেন।

তারই অংশ হিসেবে ১৯৬৯ সালে শহীদ আব্দুল মালেকসহ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পাকিস্তানের তৎকালীন শিামন্ত্রী এয়ার মার্শাল নূর খানের সাথে সাাৎ করে দেশে সার্বজনীন ইসলামী শিা ব্যবস্থা চালুর দাবি করেন। শহীদ আব্দুল মালেকের প্রতিনিধি দলের পর দেশের অন্যান্য আরও সংগঠন একই দাবি তুলেন। সবার দাবির মুখে অল্প কিছুদিনের মধ্যে সরকার নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নের ল্েয একটি শিা কমিশন গঠন করেন। এটি ছিল পাকিস্তান আমলের গঠিত সর্বশেষ শিা কমিশন। গঠিত শিক্ষা কমিশন একটি শিক্ষা নীতিও ঘোষণা করেন, ঘোষিত শিক্ষানীতিতে কিছু ত্র“টি-বিচ্যুতি থাকলেও এতে ইসলামী আদর্শের প্রাধান্য পরিলতি হয়। কিন্তু বাধসাদে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেতাবাদের ধ্বজাধারীরা। তারা এ শিক্ষা নীতি বাতিলের দাবি জানায়। এমনিই প্রোপটে শিক্ষা ব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তি কি হবে তা নিয়ে জনমত জরিপের আয়োজন করা হয়। জনমত জরিপের অংশ হিসেবে ১৯৬৯ সালের ২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন (নিপা) ভবনে (বর্তমান ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ) এ শিানীতির উপর একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই আলোচনা সভায় বামপন্থীদের বিরোধিতামূলক বক্তব্যের মধ্যে শহীদ আব্দুল মালেক মাত্র ৫ মিনিট বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। অসাধারণ মেধাবী বাগ্মী শহীদ আব্দুল মালেকের সেই ৫ মিনিটের যৌক্তিক বক্তব্যে উপস্থিত সবার চিন্তার রাজ্যে এক বিপ্লবী ঝড় সৃষ্টি করে। ফলে সভার মোটিভ পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যায়। জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তির বিষয়ে তিনি সেদিন স্পষ্ট করে বলেছিলেন-

‘‘এ শিক্ষানীতির Basic সম্পর্কে বলা হয়েছে Pakistan must aim at ideological unity, not at ideological vacuum-it must impart a unique and integrated systen of education wich can impart a common set of cultural values based on the precepts of Islam.’’ তিনি বক্তব্যে Common set of cultural values এর ধারণা উত্থাপন করে এর সুন্দর ব্যাখ্যা ও যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। তিনি বলেন এর মানে One set of cultural values নয়। One set of cultural values সোভিয়েট রাশিয়াতে রয়েছে। যেখানে রয়েছে একটি Authorian society আর সেখানে বিভিন্ন অংগ রাষ্ট্রগুলো তাদের Culturalকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দিয়ে সেখানে একটি One set of cultural values তৈরি করেছে। আমরা এটার বিরোধী। আমরা এখানে চাই Common set of cultural values not One set of cultural values.’’

তাঁর বক্তব্যের এ ধারণাটিকে খুব সুন্দরভাবে যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করার কারণে সেদিন উপস্থিত শ্রোতা, সুধীমণ্ডলী এবং নীতি নির্ধারকরা শহীদ আব্দুল মালেকের বক্তব্যের সাথে ঐকমত্য পোষণ করে একটি সার্বজনীন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার পে মত দেন। আব্দুল মালেকের তত্ত্ব ও যুক্তিপূর্ণ অথচ সংপ্তি বক্তব্য প্তি করে দেয় ইতঃপূর্বে ধর্মনিরপে শিাব্যবস্থার পে বক্তব্য রাখা বাম, ধর্মনিরপে ও ইসলাম বিরোধী বক্তাদের। সকল বক্তার বক্তব্যের মাঝ থেকে নীতি নির্ধারক এবং উপস্থিত শ্রোতা-সুধীমণ্ডলী যখন আব্দুল মালেকের বক্তব্যকে পূর্ণ সমর্থন দেন তখন আদর্শের লড়াইয়ে পরাজিত বাম ও ধর্মনিরপে গোষ্ঠীর সকল ােভ গিয়ে পড়ে শহীদ আব্দুল মালেকের উপর। নিপার আলোচনা সভায় বাম ও ধর্মনিরপেবাদীরা ধর্মনিরপে শিাব্যবস্থার পে জনমত তৈরিতে ব্যর্থ হওয়ার পর তাদের হীনউদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ডাকসুর নামে ধর্মনিরপে শিার পে প্রস্তাব পাস করানোর উদ্দেশ্যে দশদিনের ব্যবধানে অর্থাৎ ১২ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক মিলনায়তনে (টিএসসি) এক আলোচনা সভার আয়োজন করে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে শহীদ আব্দুল মালেকসহ কয়েকজন ইসলামী শিক্ষার উপর কথা বলতে চাইলে তাদের সেই সুযোগ দেয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়। সভার এক পর্যায়ে জনৈক ছাত্রনেতা ইসলামী শিক্ষার প্রতি কটা করে বক্তব্য রাখে। তখন উপস্থিত শ্রোতারা এর তীব্র বিরোধিতা করে ইসলামী শিক্ষার পক্ষ স্লোগান দেন। সাথে সাথে বাম ও ধর্মনিরপেতাবাদের ক্যাডাররা হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সাধারণ ছাত্রদের উপর। সন্ত্রাসীদের ছোবল থেকে রা পাওয়ার জন্য শহীদ আব্দুল মালেক তাঁর সাথীদের স্থান ত্যাগের নির্দেশ দেন। এসময় সকল সঙ্গীকে নিরাপদে বিদায় দিয়ে শহীদ আব্দুল মালেক ২-৩ জন সাথীকে সাথে নিয়ে টিএসসির পাশ দিয়ে হলে ফিরছিলেন। হলে ফেরার পথে লোহার রড, হকিস্টিক নিয়ে ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসীরা তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তাঁকে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) নিয়ে ইটের উপর মাথা রেখে ইট, লোহার রড ও হকিস্টিক দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করে রক্তাক্ত ও অর্ধমৃত অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়। মারাত্মক আহত হন তাঁর সঙ্গী গাজী ইদ্রীসও। আহত এবং সজ্ঞাহীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করার ৩ দিন পর ১৫ আগস্ট শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান ইসলামী শিাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দেয়া ইসলামের এই সুমহান বক্তা- ইসলামী শিা আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদ আব্দুল মালেক। ১৯৬৯ সালের ১৫ আগস্ট বিশ্বের যে প্রান্তেই শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের সংবাদ পৌঁছেছে ইসলাম প্রেমিক প্রতিটি মানুষের চোখের পানি সেখানে ঝড়েছে। আব্দুল মালেকের শাহাদাতে শুধু এদেশের জনগণের হৃদয়ে রক্তরণ হয়নি বরং বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তর থেকে বিবেকবান মানুষের কান্নার ধ্বনি শোকের আবহ তৈরি করেছিল। শহীদ আব্দুল মালেকের শাহাদাতের সংবাদ শুনে সেদিন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম নেতা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ.) বলেছিলেন-

‘‘আব্দুল মালেক বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের প্রথম শহীদ তবে শেষ নয়।’’

শহীদ আব্দুল মালেকের নেতা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন- ‘‘তুমি পরে এসে আগে চলে গেছো, আল্লাহর দরবারে অনেক বড় মর্যাদায় ভূষিত হয়েছ, তাই তোমাকে বড় ঈর্ষা হয়। শাহাদাতের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তোমাকে বিশ্বস্ত সঙ্গী হিসেবে, একনিষ্ঠ সহকারী হিসেবে নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু আল্লাহর দরবারে শাহাদাৎ কবুলের মুহূর্ত থেকে আমি তোমাকে নেতা মানছি। তোমার কর্মতৎপরতা, আত্মগঠনে নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ও আনুগত্যের প্রশ্নে সতর্কতা ও ন্যায়নিষ্ঠার যে উদাহরণ তোমার জীবন থেকে আমি পেয়েছি তা সাধ্যমত নিজে অনুসরণ করা ও অন্যকে অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করাকে আমার নৈতিক দায়িত্ব মনে করছি।”

শেষ কথা

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন : ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদেরকে তোমরা মৃত বলোনা বরং তারা জীবিত কিন্তু এব্যাপারে তোমাদের কোনো চেতনা নাই’। শহীদ আব্দুল মালেক আজকে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া প্রেরণা চির ভাস্বর হয়ে আছে এবং থাকবে। একজন আব্দুল মালেকের জায়গায় আজ লাখ লাখ আব্দুল মালেক ছুটে এসেছে। শহীদ আব্দুল মালেক ইসলামী শিক্ষা বা ইসলামী আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠিত হিসেবে দেখে যেতে পারেননি ঠিকই কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য তাঁর উত্তরসূরিরা জানবাজ চেষ্টা করছে এবং করবে। পেছন থেকে প্রেরণা যোগাবে ল কোটি শহীদের মিছিলে শামিল হওয়া শহীদ আব্দুল মালেক। মরহুম কবি মতিউর রহমান মল্লিকের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বললে বলতে হয়-

‘‘শহীদ মালেক আজো আমায় ডাকে

সকল বাধা পেরিয়ে যেতে

সেই দিশারী আড়াল থেকে হাঁকে ...।’’

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.