![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মৌলালি; সেদিনও অন্যান্য ব্যস্ত দিনের মতোই ভিড়; বাস ট্যাক্সি প্রাইভেট গাড়ি ক্রমাগত চলেছে দ্রুতবেগে। কাছেই এন্টালি বাজার। সময় সকাল ১১ টা; এক চল্লিশোর্ধ মধ্যবিত্ত বাঙালি ভদ্রলোক বাজারের ভিতর থেকে হাতে একটা ভারী ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে মূল রাস্তা’য় উঠে বাসের অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎই একটি টাটা ইন্ডিকা খুব দ্রুতবেগে তার খুব কাছ দিয়ে ঝরের মতো বেরিয়ে যায়; ইন্ডিকা’র খোলা কপাটের ভিতর থেকে কোন আরোহী একটা কাগজের মোরক ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে মোরকটা এসে সরাসরি পড়ে সেই ভদ্রলোকের মুখের উপর। ভদ্রলোক স্বভাবসিদ্ধ বাঙালি ভঙ্গিতে গলা তুলে দু-চারটে গালি বিপরীতে ছুঁড়তে ছুঁড়তে ততক্ষণে গাড়ি অনেক দূর চলে গেছে। রাগে গজরাতে গজরাতে ভদ্রলোক মুখ থেকে সরিয়ে হাতে রাখা ভেলপুরি’র গুঁড়ো মাখা খবড়ের কাগজের টুকরো মোরকটা বেখেয়ালেই চোখের সামনে একবার তুলে ধরে তারপর সেটা ফেলতে গিয়ে হঠাৎ কিছু একটা ভেবে আটকে যান! আবারও কাগজটা চোখের কাছে এনে দেখেন, সম্ভবত কোন একটা খবড়, কি খবড়; দেখতে দেখতে ভদ্রলোকের মুখমন্ডলের রঙ অন্যরকম হতে থাকে, উদ্বেগের চিহ্নের সাথে চোখ’দুটোয় কিছু একটা অমোঘ প্রাপ্তির লেশ খেলতে থাকে! তিনি এদিক-ওদিক দেখে কাগজ টা একবার ভালো করে ঝেরে আবার একবার পড়ে সেটা খুব যত্নে এক হাতেই ভাঁজ করে জামা’র বুকপকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে হাওরা-গল্ফগ্রীন মিনি বাসে উঠে পড়েন। কি দেখেছিলেন তিনি, ওই রহস্যময় কাগজের খবড়ে?
রাজারহাট নিউ টাউনের একটা সুসজ্জিত থ্রি বি-এইচ-কে ফ্ল্যাট; সকাল ছ’টা; খবড়ের কাগজওয়ালা “কাগজ” বলে চিল্লিয়ে একটা কাগজ ছুঁড়ে দোতলা’র ঝুলবারান্দায় ফেলে দিয়ে এগিয়ে চলে গেলো তার সাইকেল ছুটিয়ে। ব্যালকনী থেকে অরুনেশ কাগজ’টা তুলে নিয়ে ভিতরে চলে গেলো; সাদা পাজামা আর সাধারণ একটা টি-শার্ট পরিহিত অরুনেশের বয়স বছর পঁয়ত্রিশেক, সুদর্শণ সুঠাম লম্বা ফর্সা সুন্দর স্বাস্থ্য, কাগজ’টা হাতে নিয়ে ভিতরে গিয়ে টেবিল থেকে চা’এর পেয়ালা’টা তুলে নিয়ে উল্টোদিকের ব্যালকনীতে গিয়ে চেয়াড়ে বসে কাগজ’টার প্রথম পাতা’র প্রথম হেড লাইন দেখেই ভ্রূ কুচকালো হাল্কা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক উন্নতি’র প্রধান কারিগর আমেরিকান ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানী দেউলিয়া ঘোষণা করেছে নিজেদের! শেয়ার বাজারে ভয়ঙ্করতম সূচক পতন, বিশ্বব্যাঙ্ক; ওয়ার্ল্ড রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং ভাইসরয় ব্যাঙ্কে রক্ষিত ইউনাটেড ফ্রুট কোম্পানী’র সমস্ত অর্থ চুরি!-গতকাল রাতে। “সর্বনাশ”;-
আচমকা অরুনেশ-এর ফোন বেজে উঠলো তার ভীষণ পরিচিত ক্লাসিফায়েড রিংটোনের সাথে। ফোন’টা রিসিভ করলো সে; হেড কোয়ার্টার থেকে সরাসরি;-
“শুনা?”
“যেস্ সা…”
“আ হ্যাভ টু ক্যানসেল যো ভ্যাকেশান”
“আই নো সা…”
“কাম উইদিন টুমরো শার্প”
“স্যুও সা……আ’ম রেডি”।
পরদিন সকাল ১০ টা; দিল্লী সি.বি.আই হেড কোয়ার্টার; গোপন মিটিং রুমে কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার বসে আছেন; চিফ্ এসে ঢুকতেই সকলে উঠে দাঁড়িয়ে সুপ্রভাতী সম্মান জানালেন তাকে। সরাসরি কথা শুরু হলো; (বাংলা গল্প বলে বাংলাতেই বলা উচিত মনে করলাম)
“সো জেন্টলম্যান, পরিস্থিতি সাংঘাতিক শোচনীয়! সবাই আপনারা খবড়টা জানেন বলে রিপিট করে সময় নষ্ট করতে চাই না। মার্কিন সরকারী গোয়েন্দা সংস্থা সি.আই.এ. বহু দেশের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা’র কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছে, বিশেষত ভারতের কাছ থেকে; গোপন সূত্রে খবড় চোর ভারতীয়। আমাদের কাছে পি.এম এর অর্ডার আছে সাহায্যের। তাই আমি আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টিম’কে ইউ-এস-এ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই টিম চার জনের, আমার ডিপার্টমেন্টের চার টপ অফিসার; আমি নামগুলো বলছি;
শিবাজী পান্ডে
হরকিশেন সিঙ্ঘ রাজপুত
মহেশ্বর রামালিঙ্গম; এবং
অরুনেশ চ্যাটার্জী
অরুনেশ এই টিম’কে নেতৃ্ত্ব দেবে। কোয়ি শাক্?”
একত্রে অনেকগুলো কণ্ঠস্বর গর্জে উঠলো, “নো সা…”
“আপনাদের কালই রওনা হতে হবে; অরুনেশ, পরিকল্পনা বলো”।
C.I.A. থেকে রিপোর্ট পাওয়া গেলো, চোর ভারতীয়।
“কিসের ভিত্তিতে?”
“চোর নিজে প্রমাণ দিয়ে গেছে”- সচিব বললেন।
“কি প্রমাণ?”
প্রমাণ হিসেবে একটা চিঠি পাওয়া গেল, চিঠি বলা যায় না এটাকে, ছোট একটা ধাঁধাটে ইংরাজী বাক্য;
I Need Destruction of Impotent America
“এই থেকেই আপনারা অনুমান করে নিলেন?”
“কেন নয়? দেখুন, প্রতিটা ইনিশিয়াল খেয়াল করুন, I N D I A”
এবার অরুনেশ মৃদু হাসলো, গলা খাঁকরালো বাকীরা। অরুনেশ উঠে দাঁড়ালো এবার
“আপনাদের মনে হয় এই ধরণের আন্তর্জাতিক চরম বুদ্ধিমান চোর এত সহজ একটা প্রমাণ চোখের সামনে রেখে দিয়ে যাবে? অকূস্থল থেকে এই কাগজ’টা পাওয়া গেছে বলেই যে এটা সেই চোরেরই লেখা তার কি কোন প্রমাণ আছে?”
“তবে কি আপনি বলতে চান চোর ভারতীয় নয়?”
“চোর ভারতীয় কি অন্য কোন দেশের এটা প্রসঙ্গ নয়, আমরা চোর ধরতে এসেছি, চোরের নাগরিকত্ব ধরতে নয়! তাই প্রসঙ্গ হলো চুরির কারণ”
“কারণ আর কি! চোর চুরি করেছে প্রচুর অর্থের চাহিদায়; এরকম চুরি তো হামেশাই হয়!”
“এত বড়ো পদক্ষেপের কারণ এটা নয়! আপনারা বিগত কয়েক বছরের কিছু আন্তর্জাতিক চুরির পরিসংখ্যান মিলিয়ে দেখেছেন?”
“কিরকম?”
“বছর দেড়েক আগে, লন্ডনের বিশ্ববিখ্যাত আন্তর্জাতিক ইস্ট ইন্ডিয়া গ্রুপ অফ কোম্পানীজ এবং ল্যাঙ্কাশায়ার ও ম্যাঞ্চেস্টার এর শতাব্দী প্রাচীন কটন মিল এভাবেই দেউলিয়া হয়ে যায় একই দিনে মাত্র কয়েক মিনিটের তফাতে। সেখানেও একটা চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল যাতে লেখা ছিল, I Need Destruction of United Kingdom, এক্ষেত্রে কি আপনি বলবেন INDUK বলে কোন দেশ আছে? তার আরও দু’বছর আগে স্কটল্যান্ড থেকে চুরি যায় সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ ২০০৬ সালের জুলাই মাসের জি-এইট শীর্ষ বৈঠকের মেক পভার্টি হিস্ট্রি’র একটি চরম গোপণীয় ব্লু প্রিন্ট যেখানে কি ছিল সেটা এখনও অনেকেরই অজানা, কিন্তু বিষয়টা নিয়ে যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে আটটা দেশ যেখানে আছেন আপনারাও সেক্ষেত্রে গুরুত্বটা বুঝতে সবাই পারছে। এই তিনটে চুরি থেকে কিছুই কি আন্দাজ করতে পারেননি?”
“আপন কি বলতে চাইছেন এই তিনটে চুরি একজনই করেছে?”
“চুরির মোটিভ খুঁজতে চেষ্টা করলে এটাই হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক”
“মোটিভ’টা কি?”
“সেটা আমি এখন বলতে চাই না তদন্তের স্বার্থে”
“বেশ, আপনি আপনার তদন্ত চালিয়ে যান”
“ধন্যবাদ”
তদন্তের কাজ শুরু হলো। অরুনেশ বিভিন্ন দেশ এবং খোদ C.I.A-র তদন্তকারী অফিসারদের নিয়ে মোট সতেরো জনের তদন্ত কমিটী গঠণ করে তাদের আমেরিকা, ব্রিটেন এবং লন্ডনেরই অপরাংশ স্কটল্যান্ডে ছড়িয়ে দিল। আরও কয়েকজনকে ছড়িয়ে ছিল প্রথম বিশ্বের পরবর্তী চুরির সম্ভাবনাময় কিছু দেশে।
কিছু চাহিদা আর কিছু সংকেত রইল;
“ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানী’তে গত দেড় বছরে কারা নতুন কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন তার ডিটেলস্ রিপোর্ট চাই, একই রিপোর্ট চাই কারা লন্ডনের ইস্ট ইন্ডিয়া গ্রুপ অফ কোম্পানীজ এবং ওই দুই কটন মিলের ক্ষেত্রেও সাড়ে তিন বছর আগের; কারা সম্প্রতি চুরির পর প্রতিষ্ঠানগুলো ছেড়ে চলে গেছেন বা পাওয়া যাচ্ছে না কোনভাবেই তারও রিপোর্ট চাই। আর চাই জি-এইট এর মেক পভার্টি হিস্ট্রী কর্মসূচীর সেই গোপণ ব্লু প্রিন্টের প্রত্যয়িত নকল এবং সেই প্রিন্ট সংরক্ষক’দের ডিটেলসও। কোন কোন কম্পিউটার থেকে হ্যাকিংগুলো করা হয়েছে তারও হদীশ চাই যত তারাতারি সম্ভব। বিশ্বব্যাঙ্ক; ভাইসরয় ব্যাঙ্ক; ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক এবং ফেডারেল ব্যাঙ্ক অফ ওয়ার্ল্ড এরও শেষ ছ’বছরের এইসব প্রতিষ্ঠান’গুলোর সমস্ত রকম আদান-প্রদানের রিপোর্ট চাই। যারা অন্যান্য দেশে যাচ্ছেন তারা জি-এইট এর মধ্যস্থ সেই আটটি দেশের মধ্যে বাকী ছ’টি তে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যস্থ প্রথম সারীর আর্থো-সামাজিক প্রতিষ্ঠান’গুলোতে নজরদারী চালাবেন গোপণে এবং তাদেরও এই ব্যাঙ্ক’গুলির সাথে সমস্ত রকম আদান-প্রদান নজরে রাখবেন, বিশেষত নজরে রাখবেন এদের নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে বা নতুন অফিসার হিসেবে কারা ঢুকছে, তাদের ডিটেলস্ রিপোর্টে নথিভূক্ত করবেন। আমার যতদূর ধারণা বন্ধুরা, চোর আমেরিকা ছেড়ে অন্য দেশে ঢুকে পড়েছে, সতর্ক থাকবেন প্রত্যেকেই; আর কোন চুরি না যেন কোনভাবেই না হয়। ওভার এন্ড আউট”।
সবাই কাজ শুরু করে দিল অরুনেশের কথা অনুযায়ী। অরুনেশ আলাদা করে তার ভারতীয় অফিসারদের মধ্যে একজনকে ডেকে বললো;
“রামালিঙ্গম, আমার আরেকটা রিপোর্ট চাই যেটা যোগার করা তোমার দায়ীত্ব”
“বলুন স্যার”
“আজ থেকে বছর পাঁচেক আগের কর্পোরেট সোস্যাল রেস্পন্সিবিলিটি’র সমস্ত শীর্ষ বৈঠকের ডিটেলস্ রিপোর্ট”
“ও.কে. সা…”
“প্রসিড”
“ইয়েস্ সা……”
রামালিঙ্গম চলে গেল।
অরুনেশ একা, মৃদু হাসলো; নিজের মনের অন্তঃকোণ থেকে সেই মূহুর্তে একটা কথা অপ্রত্যাশিতভাবেই বেরিয়ে এলো তার;
“তুমি যেই হও বস্, আমার আন্দাজ অনুযায়ী তোমার মোটিভ যদি হয়, তাহলে ধরতে পারি আর না পারি, তোমার জন্য আমার প্রণাম রইলো। আর যদি এ ছাড়া অন্য মোটিভ হয়, তাহলে রইলো একটাই বুলেট। সী ইউ সুন”।
রিপোর্ট’গুলো হাতে এলো অরুনেশের।
“লন্ডনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং ল্যাঙ্কাশায়ার ও ম্যাঞ্চেস্টার কটন মিলে আজ থেকে সাড়ে তিন বছর আগে ঠিক সাত মাস করে ব্যবধানে একাধিক নিযুক্তিকরণ ঘটে এবং কেউ কেউ কয়েক মাস বা বছর পর চাকরি ছেড়ে চলে যায় অথবা ছাঁটাই হয়ে যায়। এখান থেকে আর কি পাওয়া যেতে পারে? এটা সাময়িক ঘটনা, স্বাভাবিকও”।– বললেন তদন্ত কমিশনের একজন।
প্রত্যুত্তরে অরুনেশ অনেক্ষণ ধরে রিপোর্ট’গুলোয় কিছু নথি খুব গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণে পর্যবেক্ষণ করে মুখ খুললো
“লক্ষ্য করুন অফিসাররা, সবার আসা-যাওয়া অনিয়মিত হলে বিষয়’টা সামান্য হতে পারতো কিন্তু, আমি লক্ষ্য করছি কিছু গবেষণারত ছাত্রের আস-যাওয়া, যেগুলো বড্ড চোখে লাগার মতো নিয়মিত!”
“মানে?”
“আজ থেকে সাড়ে তিন বছর আগে নিকোলাস ফ্লিন্টফ্ নামে একজন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী’তে যুক্ত হয় টেকনিক্যাল ট্রেনার হিসেবে, এক বছরের চুক্তির ভিত্তিতে এবং পার্ট টাইমার হিসেবে; সাত মাস পর তার কোন হদীশ পাওয়া যায় না! তার নিযুক্তিকরণের তারিখ ছিল পয়লা জুলাই দু’হাজার বারো, সকাল সাত’টা। আচমকা তাকে সাত মাস পর খুঁজে পাওয়া যায় না! ঠিক তার দিন পনেরো পরেই ম্যাঞ্চেস্টার কটন মিলে ডেভিড ব্রাউন বলে আরেকজন গবেষনারত ছাত্র টেক্সটাইল প্রোডাকশান ওভারশীয়ার হিসেবে নিযুক্ত হয় অস্থায়ীভাবেই যদিও ঠিক সেই সাত মাস পরই মালিকপক্ষের সাথে শ্রমিক’দের মজুরি বাড়ানোর প্রসঙ্গ নিয়ে বচসার জেরে ব্রাউন ছাঁটাই হয়ে যায়! ওই একই সময়ে অর্থাৎ ম্যাঞ্চেস্টার কটন মলে যুক্ত হওয়ার সাত দিন পরেই পার্ট টাইমার সিকিওরিটি চীফ্ অফিসার হিসেবে আরেকজন গবেষণারত ছাত্র নিযুক্ত হয় যার নাম উইলহেম কপারফিল্ড; অতিরিক্ত অনুপস্থিতির জন্য তাকে ছাঁটাই করে দেওয়া হয় মাস ছয়েক পরেই; এই কামাই এর ধরণ’টা উল্লেখযোগ্য; প্রতি মাসে ঠিক ষোল দিন করে, যে ক’মাস ছিল! অস্থায়ী বলেই বোধ হয় এতদিন টিকে গেছিল, যদিও এর কাজের রিপোর্ট অসামান্য। এবার বিষয়’টা হচ্ছে, এই দুই ছাত্রকে ছাঁটাই করার কয়েকদিনের মধ্যেই একসাথে একই কম্পিউটার থেকে চুরি’গুলো কয়েক মিনিটের হেরেফেরে ঘটে যায় নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক’গুলো থেকে! দিন’টা ছিল, পয়লা সেপ্টেম্বড়, তেরো; সময় সন্ধ্যে সাত’টা বেজে চার মিনিট সাত সেকেন্ড। তার উপর এই তিন জন গবেষণারত ছাত্রই এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি’তে গবেষণা করছিল। কি বুঝলেন স্যার?”
“আপনি কি বুঝলেন বলুন?”
“আমি কি বুঝলাম পরে ভাবা যাবে; আপনি এবার আপনার দেশের দিকে নজরটা ঘোরান”
“বলুন”
“সেপ্টেম্বরের ঘটনা’র পর ঠিক মাস ছয়েক ঘুরতেই ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানী মিচিগান ইউনিভার্সিটি থেকে আবার এক গবেষণারত ফুড টেকনোলজিস্ট্ ছাত্রকে নিযুক্ত করে কোম্পানী’তে স্থায়ী অ্যাসিস্টেন্ট জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে, সেও দেখছি চুরির ঘটনা’র দিন সাতেক আগে চাকরি’তে ইস্তফা দিয়ে চলে গেছে!”
“কে? কি নাম?”- প্রশ্ন করলেন এরিক আইজেনহাওয়ার, ইনি বর্তমানে ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানী’র চেয়ারম্যান এবং C.I.A-র অ্যাসিস্টেন্ট চীফ্।
“জন বিল ম্যাকেনরো”
“ম্যাকেনরো? সে অসাধারণ ছিল; ব্রাইটেস্ট জুনিয়ার আমার। এত ব্যবসায়িক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আমি এর আগে দেখিনি! হঠাৎ কি হল কে জানে! সন্যাসী হয়ে চাকরি ছেড়ে আত্মভোলা হয়ে চলে গেলো! শেষ দিন অফিসে এমন শুরু করেছিল যেন, যেসাস খ্রাইস্ট’কে সরাসরি সামনে দেখতে পাচ্ছে!”
“তিনি এখন কোথায়?”
“তা জানিনা! ওনাকে রেকমেণ্ড যিনি করেছিলেন আমায়, তিনি বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক, তাও আপনারই দেশের, জানেন?”
“কে?”
“প্রফেসার নিরুপম সেন”
“কে? যিনি সবচেয়ে কম খরচায় এবং সবচেয়ে সহজে যন্ত্রণাহীণ দ্রুততম সম্পূর্ণ দেহে প্লাস্টিক সা্র্জারি আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন আজ থেকে আট বছর আগে, সেই নিরুপম সেন!”
“হ্যাঁ; উনি আমার পরম বন্ধু; এডিনবার্গের প্রফেসার, মাঝে মধ্যে গেস্ট লেকচারার হিসেবে আসেন মিচিগ্যান ইউনিভার্সিটি’তে”
অরুনেশ মাথায় কিছু একটা খেলতে লাগলো, সে অস্থির হয়ে উঠলো যদিও নিজের শরীরি ভাষা স্থির রাখার চেষ্টায় সে বেশ সক্ষম ছিল; তার ভ্রূ কুচকাতে লাগলো খুব বেশিই গভীরভাবে। কি সূত্র পেল সে?
“আমার প্রফেসার নিরুপম সেনের ডিটেলস্ চাই”- বলে উঠলো অরুনেশ;-“আজকের মধ্যেই”।
“ইয়েস্ সা……”- কয়েকটা গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর আবারও গর্জে উঠলো।
একলা কেবিনে বসে অনেক্ষণ যাবৎ দুটো তারিখ খেয়াল করে চলেছিল অরুনেশ, আর বিড়বিড় করছিল মুখে
“পয়লা জুলাই……দু হাজার বারো; সকাল……ঠিক সাতটা; পয়লা সেপ্টেম্বড়………তেরো……সন্ধ্যে সাতটা বেজে চার মিনিট………সাত সেকেণ্ড”- বারবার এই তারিখ’গুলোই পুনরাবৃত্ত করে চলেছিল অরুনেশ। বারবার।
হঠাৎই একজন অফিসার এসে প্রফেসার নিরুপম সেনের ডিটেলস্ সমৃদ্ধ ফাইল তার টেবিলে রেখে চলে গেলো।
ফাইল’টায় প্রায় ঘন্টা তিনেক এক নাগাড়ে চোখ বুলালো অরুনেশ, আবারও বিড়বিড় করতে শুরু করলো;
“এত সহজ হবে না………এত সহজ নয়………এত……”
হঠাৎ কি একটা ভেবে সে কোথাও ফোন করে বসলো; পর পর দু’টো ফোন দু’জায়গায় করে একেক বার প্রায় চল্লিশ মিনিট করে কথা বলার পর কোন একটা কথায় আচমকা কানে ফোন নিয়েই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো অরুনেশ; রিসিভার’টা নামিয়ে রেখেই একবার শুধু বিড়বিড় করে উঠলো;
“আই থিঙ্ক আই গট ইট!”
“আমি একবার দেশে যেতে চাই স্যার”- বললো অরুনেশ।
“কারণ?”- C.I.A সচিব জিজ্ঞাসা করলো।
“তদন্তের স্বার্থে; এখন আর এর বেশী কিচ্ছু বলতে পারবো না; আমার রওনার ব্যবস্থা করুন”
“কিন্তু এ সময় আপনি…মানে…আপনি ছাড়া অন্য কেউ যদি……”
“অন্য কাউকে দিয়ে কাজটা হলে অন্য কাউকেই পাঠিয়ে দিতাম স্যার, দয়া করে দেরী করবেন না সময় একদম হাতে নেই”
“বেশ; কবে যেতে চান?”
“আজই”।
অরুনেশ পান্ডে’কে ডেকে পাঠালো, সাথে রামালিঙ্গম’কেও। ওরা হাজির হলো।
“রামালিঙ্গম, কর্পোরেট সোশ্যাল রেপন্সিবিলিটি’র শীর্ষ বৈঠকের রিপোর্টস্ এসে গেছে?”
“যেস্ সা……এই ফাইলে সব আছে”- একটা মোটা ফাইল এগিয়ে দিল রামালিঙ্গম, অরুনেশের হাতে।
“পান্ডে, জি-এইট শীর্ষ বৈঠকের চুরি যাওয়া দু’হাজার ছয় সালের সেই ব্লু-প্রিন্টের নকল?”
“ওরা কিছুতেই দিচ্ছে না স্যার, স্যরি!”
“জানতাম!”- মুচকি হাসলো অরুনেশ। আবার কথা বললো সে
“শোন মন দিয়ে, আমি যতদিন ভারতে থাকবো তোমরা দুজন এদিকের কাজ চালিয়ে যাবে। আমার কাছে বেশ কিছু রিপোর্টস্ এসেছে যেগুলো আমি নিয়ে যাচ্ছি; তোমাদের একটা জরুরী কাজ করতে হবে”
“বলুন স্যার”
“আমাদের তদন্তের টীমে দুজন লাতিন আমেরিকান অফিসার আছেন, একজন হন্ডুরাস থেকে আর অপরজন ইকুয়েডর থেকে, তাইতো?”
“হ্যাঁ স্যার”
“তাদের এক্ষুনি গুয়াতেমালা’য় রওনা করে দাও, অফিসার আতালিও’কে জাকার্তা’য় পাঠাও যত দ্রুত সম্ভব; কালই পাঠাও; সময় একদম নেই! তাদের কি কি করতে হবে সেখানে গিয়ে সেটা এই পেন্ ড্রাইভে আছে”
একটা ছোট পেন্ ড্রাইভ এগিয়ে দিল অরুনেশ, রামালিঙ্গমের হাতে। রামালিঙ্গম সেটা দেখে নিল।
“কোন প্রশ্ন?”
“নো সা…”
“প্রসিড”
“যেস্ সা……”
এরই মধ্যে আরেক কাণ্ড ঘটে গেল আচমকা অপ্রত্যাশিতভাবে; ভারতে অরুনেশের কাছে ফোন গেলো;
“স্যার, রামালিঙ্গম”
“বলো”
“কাল রাতে এখানে নিজের বাসভবনে প্রফেসার নিরুপম সেন খুন হয়ে গেছেন!”
“হোয়াট?”
“হ্যাঁ স্যার; তার উপর কাল রাত থেকেই এরিক আইজেনহাওয়ার’কেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”
“কোন কানেকশান?”
“স্যার, প্রফেসারের বাসভবনের কেয়ারটেকার ডেভিড কাটার’কে জেরা করে জানা গেছে কাল সন্ধ্যেবেলায় আইজেনহাওয়ার এসেছিলেন প্রফেসারের বাড়িতে; তাদের মধ্যে বেশ খোশ’গল্প চলতে চলতে হঠাৎ কিছু একটা নিয়ে হাল্কা কথা কাটাকাটি শুরু হয়!”
“তারপর?”
“তারপর স্যার…কাটার চলে যায় নিজের কাজ সেড়ে, সে কালকের ঘটনা আর কিছুই জানে না; আজ ভোরে কাজে এসে দ্যাখে প্রফেসার সেনের নিষ্প্রাণ দেহ’টা সোজা হয়ে হেলে আরাম কেদাড়া’য় পড়ে আছে, মাথার ডানদিকে রক্তের ছাপ গড়ানো, মনে হচ্ছে গুলি করা হয়েছে স্যার! যদিও পোষ্ট মর্টেম রিপোর্ট এখনও আসেনি”
“হ্যাঁ! কি বললে? মাথার ডানদিকে গুলি!”- অরুনেশের মাথায় আচমকা কিছু একটা খটকা লাগলো সাংঘাতিকভাবে। সে কিছুক্ষণ চুপ করে গেল। তারপর আবার কথা বললো;
“রামালিঙ্গম, পোষ্ট মর্টেম রিপোর্ট আসার সাথে সাথেই আমায় কল করবে, এক সেকেণ্ডও দেরী করবে না”
“যেস্ সা…”
ফোন’টা কেটে গেলো, অরুনেশ নিজের মনে আবার বিড়বিড় করলো
“সোজা হয়ে শোয়া………মাথার ডানদিকে গুলি……মাথা সোজা……”
বারবার এই কথা বলে যেতে লাগলো অরুনেশ, কিছুক্ষণ এই চলার পর বললো;
“শালা ঘাপলা আছে!”
ঘন্টা আটেক বাদে, তারপর দিন সকালে যখন অরুনেশ অথর্ব বেদের একটা অধ্যায় নিয়ে বেশ গুরুত্ব সহকারে কিছু একটা দেখছে নিজের ফ্ল্যাটে বসে তখন, রামালিঙ্গমের ফোন এলো আবার;
“স্যার; অবিশ্বাস্য পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এসে গেছে”
“কি এসেছে? গুলিতে মৃত্যু নয় তাইতো?”- মৃদু হাসলো অরুনেশ। রামালিঙ্গম অবাক হলো।
“হ্যাঁ স্যার! কিন্তু…”
“কি করে জানলাম? রামালিঙ্গম, বচসার জেরে যদি প্রফেসার সেন’কে আইজেনহাওয়ার গুলি করে খুন করেই থাকতো তাহলে সরাসরি সামনে থেকে করত যেটা লাগতো হয় প্রফেসারের কপালের মাঝখানে নয় বুকে; মাথার ডানদিকে কোনমতেই নয়! তার উপর বডি’টা সোজা কেদাড়া’য় শুয়ে!- মাথার ডান দিকে গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়া মৃতদেহ বাঁ দিক হেলে পড়ে থাকবে, সে যেখানেই পড়ুক; আমি যদি ধরেও নিই যে আইজেনহাওয়ার খুন করার পর দেহ’টা ওভাবে রেখে দিয়েছিলো তাতে কি প্রমাণ হয়! কেন এটা করবে সে! এটা করে সে কি কিছু উলটো প্রমাণ বা নিজের দোষ ঢাকার কাজ করতে পারবে?”
“না স্যার!”
“তা ছাড়া সবচেয়ে বড়ো কথা হল রাগের মাথায় মানুষ কেন মাথার ডান দিকে গুলি করতে যাবে!”
“আচ্ছা স্যার, আইজেনহাওয়ারই যে খুন’টা করেছে, তারও তো কোন প্রমাণ নেই আমাদের কাছে!”
“সেতার উপর জোর দিয়ে এক্ষেত্রে কোন লাভ হবে না! আপাতত একটা কথা বলতো, খুন হয়েছে কিভাবে!”
“ওটাই তো অবিশ্বাস্য! এটা খুন নয়! পোস্ট্ মর্টেম রিপোর্ট বলছে প্রফেসার নিরুপম সেনের মৃত্যু হয়েছে কার্ডিয়াক ফেলিয়োরে!”
“হার্ট অ্যাটাক!”
“হ্যাঁ স্যার; গুলি’টা লেগেছিল সাত’টা চুয়ান্নোয়; মৃত্যু হয়েছে সাত’টা বাহান্নোয়!”
“আর কোন তথ্য……?”
“হ্যাঁ স্যার; বিশেষ তথ্য, প্রফেসারের রক্তে একরকম ট্যাবলেটের স্যাম্পেল পাওয়া গেছে যা কোনভাবে শরীরের ভিতরে যাওয়ার ঘন্টা’খানেকের মধ্যেই মানুষ এভাবেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়, তাই এটা যে খুন সেটা বুঝতে আর কোন সন্দেহ থাকে না!”
“আর একটা কথা রামালিঙ্গম, দেহ’টা যেহেতু এখনও সৎকারের ব্যবস্থা হয়নি, তুমি একটা কাজ করতো, মৃতদেহের দাঁতের পাটি ভালোভাবে খুঁটিয়ে দেখে আমায় জানাও তো কোন অমিল পাও কি-না জীবিত প্রফেসারের সাথে, কাটারের সাহায্য নিও এক্ষেত্রে। জানাও যত তারাতারি হয়”
“যেস্ সা”
কিছুক্ষণ পর;-
“স্যার, আরও অবাক কাণ্ড!”- রামালিঙ্গমের ফোন; শুনে আবারও মৃদু হাসলো অরুনেশ।
“বলো”
“প্রফেসারের মৃতদেহে দাঁতের সেটের রাসায়নিক পরীক্ষায় জানা গেছে তিনি দামী সিগার খেতেন, কিন্তু কাটার এবং তাকে এখানকার আরও যারা চিনতেন তাদের থেকে জানা যায়, প্রফেসার’কে কেউ কোনদিন ধূমপান করতেই দ্যাখেনি! তিনি সম্পূ্ণ নেশামূক্ত মানুষ ছিলেন!”
“আচ্ছা, সিগার’টা কি কোম্পানীর হতে পারে তা ফরেন্সিক রিপোর্ট থেকে জানা গেছে কি?”
“হ্যাঁ স্যার, সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে দামী ডাচ ফ্যাবোলা কোম্পানীর সিগার খেতেন তিনি”
“ডাচ ফ্যাবোলা! এই সিগার আইজেনহাওয়ার খেতেন না রামালিঙ্গম?”
রামালিঙ্গম কিছুক্ষণ ভেবে বললো “হ্যাঁ স্যার তাইতো! তাহলে কি কাল উনি প্রফেসার’কে খাইয়েছিলেন?”
“অতো সহজ করে ভাবা বন্ধ করো রামালিঙ্গম; আর শোন, ইন্দোনেশিয়া আর গুয়াতেমালা থেকে তথ্য কিছু এসেছে?”
“হ্যাঁ স্যার”
“আমায় সমস্ত তথ্য মেল করো এক্ষুণি”
“স্যুও সা…”
“আমার এদিকের কাজ প্রায় শেষ; খুব শিগগিরি ফিরছি; জাস্ট রিপোর্ট’গুলো দ্যাখাই বাকী, গুয়াতেমালা আর, ইন্দোনেশিয়ার; এক্ষুণি পাঠাও রামালিঙ্গম”
“যেস্ সা……”
ফোন’টা কেটে গেলো।
অরুনেশ চেয়াড়ে হেলান দিয়ে আবার বিড়বিড় করতে শুরু করল;
“সাত’টা বাহান্ন; সাত’টা চুয়ান্ন; সিগার; আইজেনহাওয়ার; প্রফেসার; কলকাতা; গুয়াতেমালা; জাকার্তা……”
অরুনেশ তার কয়েক দিন পরই রাত্রে চটজলদি ফোন করে রামালিঙ্গম’কে;
“রামালিঙ্গম, আর সময় নেই হাতে; মাত্র দু’ সপ্তাহ বাকী”
“কি হয়েছে স্যার?”
“একটা বিরাট কিছু ঘটতে চলেছে; তুমি পান্ডে, রাজপুত আর কয়েকজন সি আই এ অফিসার’দের নিয়ে পরশু’র মধ্যে গ্রীস পৌঁছাও, আমিও ঢুকছি; যা করতে হবে খুব গোপনে, তাই সি আই এ- কে বেশী কিছু বলার কোন প্রয়োজন নেই, নিজেদের মতো ম্যানেজ করে নাও”
“ও কে সা……”
“অ্যাণ্ড……গেট রেডি ফ অ্যাকশান”
“যেস্ সা……”
১১ই মার্চ, ২০১৫; গ্রীসের ঘড়িতে রাত তখন ২ টো বেজে ২ মিনিট; অরুনেশের সাথে পান্ডে, রামালিঙ্গম, রাজপুত এবং সি আই এ-র দু’জন অফিসার; প্রত্যেকে সশস্ত্র এবং সম্পূর্ণ কালো সর্বাঙ্গ’ঢাকা পোষাকে গ্রীসের ‘এপিকিউরাস হাউস’ নামের এক বিরাট পান্থনিবাসের একেবারে উপরতলার সুসজ্জিত নির্জন ছাদের বিভিন্ন গুপ্ত কোণে অপেক্ষারত, হয়তো স্বয়ং আন্তর্জাতিক সেই চোরের জন্য রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা’য় তারা।
সম্পূর্ণ ঢাকা-চাপা দেওয়া কালো পোষাকে কারা দুজন যেন ছাদে এসে দাঁড়ালো; তাদের মুখ’ও দেখা যাচ্ছে না কোনমতেই! তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, উচ্চতা প্রায় একই, হয়তো চেহাড়াও একই, দেখছে সম্ভবত উলটো দিকে অদূরের বিখ্যাত ঊনসত্তর বছরের পুরনো আমেরিকার সবচেয়ে বড় গুপ্তচর সংস্থা’র ঘাঁটি, জ্বলজ্বল করছে। দু’জনের মধ্যে কথপোকথন শুরু হলো, স্পষ্ট বাঙলা ভাষা’য়; গলা শুনে আন্দাজ দু’জনেরই পঞ্চা্ন্ন!
“বহু প্রতীক্ষার পর কাল আমাদের বিপ্লবের প্রথম পদক্ষেপ সফল হতে চলেছে”
“হ্যাঁ, আমি তারই নেশায় নিজেকে ডুবিয়ে রেখেছি ভাই”
“বেশী ডুবে যাস না, কালকের কাজ’টা আগে হোক”
“হবেই বন্ধু, সাত দশক ধরে লক্ষ লক্ষ কমরেড’দের রক্তাক্ত লাশের উপর দাঁড়িয়ে জ্বাজল্যমান ঐ মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা’র ঘাঁটি আমরা তছনছ করে প্রথম প্রতিশোধ নিয়ে আমাদের নতুন বিপ্লবের সূত্রপাত করবই! কাল ১২ই মার্চ; ১৯৪৭ সালের এই দিনেই তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি হ্যারি এস ট্রুম্যান ঘোষণা করেছিলেন, পৃথিবী নাকি ধ্বংসের মুখে দাঁড়াবে যদি সারা পৃথিবীর কমিউনিস্টদের সাথে লড়াই করে তাদের নিধন না করা যায়!”
“আর তারপরেই শুরু হলো নৃশংস সেই নিধন যজ্ঞ যা আজও চলেছে সারা পৃথিবী’জুড়ে, এই গ্রিসেই প্রথম এই ঘাঁটি তৈরী করা হয় কমিউনিস্ট খুনের অভিযানের ষঢ়যন্ত্র শুরু করতে”
“সশস্ত্র নির্মম নিধন যজ্ঞ চালানো হয় সমস্ত কমিউনিস্ট মাথাচাড়া দেওয়া দেশ’গুলোয়, গ্রিস, সোভিয়েত ইউনিয়ন, গুয়াতেমালা, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মনগুজ, চিলি, কিউবা, এমনকি বাদ যায়নি ভারতও!”
“কাল, এই ষঢ়যন্ত্রের আখরা আমরা নেস্তনাবুঁদ করে দেবো ওদেরই লোঠা টাকায় বিস্ফোরক বানিয়ে”
“ওদের টাকা আবার কি! সারা পৃথিবীর প্রলেতারিয়েত মেহনতী সর্বহারাদের লুঠ করে যে টাকা ওরা করেছে, সেই টাকা”
“যন্ত্রটা কোথায়?”
আরেকজন লম্বা কোটের পকেট থেকে একটা ছোট্ট সরু পেন্সিলের মতো কিছু একটা বের করলো,
“এই তো”
“কাল এই আমাদের স্বপ্নের প্রথম ধাপ পূরণ করবে”
“বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক”
আচমকা অরুনেশ লাফিয়ে বন্দুক’হাতে তাদের মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো অপ্রত্যাশিতভাবে; অরুনেশ’কে অনুসরণ করলো বাকীরাও, চারদিক থেকে ঘিরে ফেললো তারা সেই দু’জনকে। অরুনেশ কথা বলে উঠলো এবার;
“ঘোমটা’টা খুলে ফেলুন স্যার, আপনি ধড়া পড়ে গেছেন; আমি আপনারই দেশ থেকে এসেছি, সি বি আই অফিসার অরুনেশ চ্যাটার্জী, বাঙালি; আপনাদের সব কথাই আমি শুনে ফেলেছি, আর, বুঝেও ফেলেছি!”
কেউ পালানোর কোনরকম চেষ্টাই করলো না, মাথার আচ্ছাদন নামালো একজন, মৌখিক পর্দা উন্মোচনের সাথে সাথেই প্রফেসার নিরুপম সেনের হাসিমুখ’টা স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করলো; সবাই স্তম্ভিত, অরুনেশ ছাড়া
হাসিমুখে অরুনেশ বললো;
“আপনি সবাইকে ফাঁকি দিতে পারলেও আমায় পারেননি প্রফেসার সেন; আমি জানতাম আপনি বেঁচে আছেন”
“তাহলে ঐ ডেড’বডিটা……”- রাজপুত প্রশ্ন করলো হতবাক হয়ে।
“ওটা মৃত আইজেনহাওয়ার, যে খুন হয়েছে প্রফেসারের হাতেই; কি ঠিক বলছি স্যার?”
“একদম ঠিক”- হাসিমুখে প্রফেসার বললেন। অরুনেশ আবার বলতে শুরু করলো;
“এবার দ্বিতীয়জনও মুখটা দেখিয়ে দিন, ঘোমটা খুলুন মিস্টার……স্বাধীন তালুকদার, নাটক শেষ”
দ্বিতীয়জনও হাসিমুখে ঘোমটা খুলতেই বেরিয়ে এলো সেই গল্পের শুরুতে বলা প্রায় মাঝবয়সী মধ্যবিত্ত বাঙালি ভদ্রলোকের উজ্বল হাসিমুখ।
“ইনি কে স্যার?”- প্রশ্ন করলো পান্ডে।
“বলছি বলছি; লম্বা কাহিণী এটা; কি স্যার বলি?”
“স্বচ্ছন্দ্যে বলুন, তাড়া নেই, আমরা পালাব না”- হাসিমুখেই বললেন তালুকদার। সবাই অবাক হলো!
“আপনাদের ভয় করছে না?”- রামালিঙ্গম জিজ্ঞাসা করলো দুজন’কে।
“কমিউনিস্ট কখনও ভয় করেনা কমরেড”- উত্তর দিলেন কমরেড তালুকদার। রামালিঙ্গম চুপ করে গেলো।
অরুনেশ বলতে শুরু করলো;
“এই গল্পের শুরু করতে হলে যেতে হবে আজ থেকে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর আগে, সময়টা তখন ঊনিশ’শো ঊনয়াশি-আশি; প্রেসিডেন্সী কলেজের দুই ব্রাইট অ্যাণ্ড ব্রিলিয়েন্ট স্টুডেন্ট, নিরুপম সেন আর স্বাধীন তালুকদারের বন্ধুত্ব হয় কলেজের প্রথম দিন থেকেই; এই বন্ধুত্ব আরও প্রগাঢ় হয় তাদের সমান রাজনৈতিক এবং আর্থো-সামাজিক মতাদর্শগত ঐক্য থেকে, দুজনেই হার্টথ্রব কমিউনিস্ট বরাবরই ছিলেন। কলেজে উভয়েই কেমিস্ট্রী অনার্সের ছাত্র ছিলেন, তুলনামূলক একটু বেশি ব্রাইট ছিলেন নিরুপম সেন যদিও স্বাধীন বাবুর সাথে তার ফারাক ছিল ঊনিশ-বিশ।
কলেজে পড়াকালীন এরা দুজনে এস এফ আই-এর দুই নাম করা নেতাও হয়ে উঠেছিলেন। এদের মাথায় অনেক কিছুই খেলতো, যেভাবে একদিন হঠাৎই খেলে গেছিল এমন এক হরমোনাল-কেমিক্যাল বিক্রিয়ক পদ্ধতি আবিষ্কারের পরিকল্পনা, যার দ্বারা সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচায় এবং দ্রুততম আরোগ্যতায় ফিরিয়ে আনার মতো যন্ত্রণাহীণ প্লাস্টিক সার্জারি পদ্ধতি, যা প্রথমে কিন্তু তালুকদার বাবুরই মাথায় আসে, যার উস ছিল, অথর্ব বেদের ‘রূপায়নসূত্রম্’। তালুকদার রাজনিতিতে অধিক সক্রিয় ছিলেন, নিরুপম সেনের শরীরে জোর কম ছিল, তিনি শারীরিকভাবে তেমন সক্রিয় ছিলেন না; তিনি তুলনামূলক বেশির ভাগ সময় সেই গবেষণার কথা ভাবতেন। দুজনে কলেজ শেষ করে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে এম্ এস্ সি পড়ার সময় গোপণে এক্সপেরিমেন্ট শুরুও করেন, কিছুদূর এগোয়ও; কিন্তু হঠাৎ নিরুপম সেনের বাবা বদলি হয়ে যেতে তাদের সকলকে চলে যেতে হয় দিল্লী; তারপর এই দুই বন্ধুর মধ্যে আর কোনরকম সাক্ষাৎ হয়নি! এরই মধ্যে তালুকদার বাবু এম্ এস্ সি তে ফার্স্ট ক্লাস নিয়ে পাশ করেন এবং খুব শিগগিরি রামমোহন কলেজে অধ্যাপনার চাকরি পেয়ে যান, এক্সপেরিমেন্ট’টা আর ক্রমশ করা হয়ে ওঠেনি তার পক্ষে।
সংসারের চাপে আর কমিউনিজমের ক্রমপতনে তার মনও ভেঙে যায়, তিনি রাজনিতিও ছেড়ে দেন বহুকাল।
এরই মধ্যে হঠাৎই আজ থেকে আট বছর আগে তিনি খবড়ের কাগজের পাতায় দেখতে পান তারই সেই অন্তরঙ্গ বন্ধু নিরুপম এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি’তে তাদের সেই রিসার্চ একাই এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সেই পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছে। তার মাথায় খেলতে থাকে এই পদ্ধতির সাহায্যে সারা পৃথিবী’ব্যাপি নতুন করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্ম দেওয়ার কথা, দুজনে মিলে। তিনি চাকরি’তে ইস্তফা দিয়ে চলে যান বন্ধুর কাছে, লন্ডনে, সরাসরি। অনেকদিন পর সাক্ষাৎ হওয়া দুই বন্ধু তাদের ফেলে আসা জীবন-স্বপ্ন আবার ফিরে পায়।
তারপর শুরু হয় তাদের অভিযান।
প্রথমে তারা মানুষের মধ্যে আবার জাগরণ আনতে শুরু করে বিভিন্ন রকম সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এবং বহুবার নিজেরাও শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে। শুরু করেন গুয়াতেমালা এবং ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে। সেখানেই তাদের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে যায় সবচেয়ে বেশি, মানুষ সচেতন হতে শুরু করে তাদের কথায়; ফিরে আসতে শুরু করে আবার সমাজতন্ত্রের ভাষায়, কমিউনিজমের মধ্যে আবার নিজেদের অধিকারের পূর্তি দেখতে শুরু করে তারা, পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের মতলববাদকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তারা নেতা করে দুই বাঙালি বন্ধু’কে।
তালুকদার এবং প্রফেসার সেন বুঝতে পারেন তাদের বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে প্রচুর অর্থের দরকার যা তাদের এই মূহুর্তে নেই! তাই তারা স্থির করেন যারা যুগ যুগ ধরে সর্বহারা নিরপরাধ মানুষ’কে লুঠেছে তারা তাদেরকেই লুঠবে তাদের আন্দোলনের জন্য।
এই চুরির জন্য তাদের দরকার ছিল ২০০৬-০৭ আর্থো-বর্ষের আটটি মহা পুঁজিবাদী প্রভাবশালী দেশ নিয়ে হওয়া জি-এইট শীর্ষক সম্মেলনে ‘মেক পভার্টি হিস্ট্রী’ কর্মসূচীর সেই গোপন ব্লু-প্রিন্ট, যেখানে তাদের বিপুল অর্থ দানের মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর এন্ জি ও-গুলিকে সক্রিয় করে গরীবি হঠাও-এর নামে আসলে গরীব হঠাও কর্মসূচির বাস্তব রূপায়ন ঘটানো সম্ভব হবে। প্রফেসার সেনের কুইকেস্ট্ প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে ভোল বদল করে স্কটল্যান্ডেরই মানুষের ভোল নিয়ে এবং নকল স্কটিস্ আইডেন্টিটি বানিয়ে স্কটলয়ান্ডের সেই ব্লু-প্রিন্ট সংরক্ষণশালায় তিনি নতুন চীফ্ টেকনিক্যাল সিকিওরিটি অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হন এবং সেই ব্লু-প্রিন্ট হাতিয়ে পালিয়ে যান। নিরুপম সেন তাকে আবার তার বন্ধুর রূপে ফিরিয়ে আনেন দ্রুত, সেই স্কটিস্ চীফ্ সিকিওরিটি অফিসারের পরিচিতি শুধুমাত্র ইতিহাস হয়েই রয়ে যায়!
ব্লু-প্রিন্টের মাধ্যমে তারা দুজন বুঝতে পারে, দারিদ্র দূরীকরণের মতলববাদী পুঁজিবাদী কর্মসূচীর প্রধান সহায়ক হতে চলেছে আমেরিকার সেই ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানী, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ষঢ়যন্ত্রের মাধ্যমে সারা পৃথিবী জুরে কমিউনিস্ট নিধন চালিয়ে চলেছে পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন কায়েম রাখতে। যারা অপারেশান ডায়াবলো করে জনদরদী জ্যাকোবো আরবেনজ গুজমান সরকার’কে হঠিয়ে গুয়াতেমালা’য় তাদের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসী পুঁজিবাদী পৃষ্ঠপোষক সরকার প্রতীষ্ঠা করেছিল ১৯৫৪ সালে, সেখানকার অশিক্ষিত দরিদ্র জনতাকে ভুল বুঝিয়ে আর লোভ দেখিয়ে। যারা সি আই এ’র সাথে এক হয়ে দিনের পর দিন ষঢ়যন্ত্র করে একের পর এক দেশে নৃশংসভাবে অপারেশান মনগুজ, অপারেশান চিলি, অপারেশান ইতালি, অপারেশান জাকার্তা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ কমিউনিস্ট মেরেছে শুধুমাত্র নিজেদের মুনাফা’র রাজত্ব চলে যাওয়ার ভয়ে। যারা ১৯৬৫ সালের ১লা অক্টোবর থেকে টানা অভিযান চালিয়ে নৃশংসভাবে দশ লক্ষ কমিউনিস্ট মেরেছিলো ইন্দোনেশিয়ায়, সেকথা স্বীকার করেছিলো মার্কিন টাইমস্ পত্রিকাও।
এছাড়া ছিলো ভারতবর্ষ’কে লুঠে এলোপাথালি কাঁটাতার টেনে মৃতদেহ করে দিয়ে যাওয়া লন্ডনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং ল্যাঙ্কাশায়ার ও ম্যাঞ্চেস্টার কটন মিল এখনও স্বমহিমায়, আমেরিকার সাথে হাত মিলিয়ে।
তালুকদার এবং নিরুপম সেন স্থির করলেন প্রথমে লন্ডনের এই তিন কোম্পানী’কে দেউলিয়া করবেন। সেইমতো প্রফেসারের ইউনিভার্সিটিরই বিভিন্ন ছাত্রের বেশ সেই প্লাস্টিক সার্জারির সাহায্যে একের পর এক ধরে চুরি’গুলো করেন সেই খোদ তালুকদার বাবু, নিয়ম মেনে”।–অরুনেশ থামলো।
“নিয়ম মেনে!”-হতবাক হলো রামালিঙ্গম।
“হ্যাঁ রামালিঙ্গম নিয়ম মেনে; যে মিশনের শুরু হয়, পয়লা জুলাই দু’হাজার বারো’র ঠিক সকাল সাত’টায় প্রথম লন্ডনের কোম্পানীতে যুক্ত হওয়ার সময়; সংখ্যায় করলে, ১-৭-(২+০+১+২=)৫-৭ মানে ১৭৫৭ সাল; পলাশীর যুদ্ধ জিতে ইংরেজদের শাসন পাকা হওয়া ভারতবর্ষের রাজত্বকাল; মিশন শেষে শেষ কোম্পানীকে লুঠে সমস্ত টাকা জাকার্তা’য় বিশ্বস্ত চব্বিশ জন নতুন বিপ্লবের এজেন্টের অ্যাকাউন্টে আলাদা আলাদা পরিমাণ করে পাঠিয়ে দেওয়ার সময়, পয়লা সেপ্টেম্বড় তেরো সন্ধ্যা সাত’টা বেজে চার মিনিট সাত সেকেণ্ড; মানে ১-৯-(১+৩=)৪-১৯(মানে সন্ধ্যে সাত’টা)-৪-৭; মানে ১৯৪৭ সাল, দুবার হওয়ার কারণ একদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আরেক দিকে দুই শতাব্দী প্রাচীন কটন মিলের বরাবরের দ্বিমাত্রিক কারবার সংগঠন করা”
“ব্রিলিয়ান্ট!”- বললো পান্ডে।
“শুধু তাই নয়, আমেরিকার ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানী’কে দেউলিয়া করার পর সেই সমস্ত অর্থ পাঠিয়ে দেওয়া হয় গুয়াতেমালা’র মোট একান্ন জন এজেন্ট’কে একই পদ্ধতিতেই। সেখানের ভল পাল্টানোর কাজ করে যান নিরুপম সেন এবং চুরির কাজ’গুলো চালিয়ে যান অবশ্যই স্বাধীন তালুকদার নিজেই। আর যেদিন আইজেনহাওয়ার সি আই এ-তে কিছু কথায় প্রফেসারের কথা জানতে পারেন তখনই তিনি মনস্থির করেন তিনি তার তথাকথিত বন্ধুর সাথে দেখা করে সত্যিটা জানতে যাবেন, গিয়েওছিলেন তিনি; নিরুপম সেন তাকে ওয়াইনে সেই বিষাক্ত ওষুধ মিশিয়ে খাইয়ে দেন এবং কার্ডিয়াক ফেলিয়োরে তার মৃত্যুর পর তার ভোল পালটে নিজের রূপ দিয়ে দেন, যদিও লোক দেখাতে তার আগেই গুলি টা ভুল করে ভুল জায়গায় করে বসেন! এখানেও সংখ্যার খেলা আছে, ওষুধটা অসামান্য ক্যাল্কুলেশান করে খাওয়ানো হয় যেন আইজেনহাওয়ারের মৃত্যু ঠিক সন্ধ্যে সাত’টা বাহান্ন’তেই হয়, আর গুলি লাগার ঘটনাও ঘটানো হয় ঠিক সন্ধ্যে সাত’টা চুয়ান্নোয়; এটাও ইতিহাস; সন্ধ্যে সাত’টা বাহান্ন মানে ১৯টা ৫২; এবং যথারীতি ১৯টা ৫৪ মিনিট। গুয়াতেমালায় গুজমান সরকার’কে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা করেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডুয়েট আইজেনহাওয়ার, ১৯৫২ সালে; পরিকল্পনা সফল করা হয় ১৯৫৪ সালে; এও আবার এরিক আইজেনহাওয়ার, কাকতলীয়ভাবে! ঘটনাটা ঘটানোর পরেই নিরুপম সেন আর তালুকদার গ্রিসে চলে আসেন সেই রাতেই, আবারও অন্য রূপে, দুজনেই; এবং এখানে এসে স্বরূপে ফেরেন, কি পরিকল্পনা ছিল সবাই জানো, এনারা একটু আগে কথায় কথায় নিজেরাই বলেছেন”
“আপনি এই বন্ধুত্বের ইতিহাস জানতেই ভারতে গেছিলেন তাই না স্যার?”- রাজপুত প্রশ্ন করলো।
“হ্যাঁ রাজপুত, প্রফেসার সেনের ডিটেলস্ থেকে আমি তার কলকাতার ইতিহাস খুব হাল্কা জানতে পারি, তার সাথে জানতে পারি তিনি শারিরিকভাবে উইক্ ছিলেন ভীষণ, তাছাড়া চুরিগুলোর সময় তিনি ইউনিভার্সিটি’তে পরাচ্ছিলেন; তাই বুঝতে পারি তার পক্ষে এ কাজ’গুলো করা সম্ভব হয়নি, তাই সন্দেহবশেই আরও অনেক কিছু জানতে কলকাতা যাই এবং সেখানে তার পুরনো বন্ধু’দের কাছ থেকে সব জানতে পারি, এমনকি তাদের এই রিসার্চ-এর শরু অথর্ব বেদ থেকে হওয়ার দরুণ আমি নিজে অথর্ব বেদের ‘রূপায়নসূত্রম্’ স্টাডি করে বুঝতে পারি একমাত্র দাঁতের সেট কোন প্লাস্টিক সার্জারিতেই বদলানো যাবে না! তাই তোমাদের নকল নিরুপম সেনের মৃতদেহের দাঁতের সেট পরীক্ষা করাতে বলেছিলাম, সেখানেই ধড়া পড়ে গেলেন নিরুপম সেন”
বাকীরা সবাই চুপ করে রইল, কথা নেই কারোও মুখেই; শ্রদ্ধায়, শুধু অরুনেশের প্রতি নয়, বাকী দুজনও!
“আর, ইকুয়েডর এবং হন্ডুরাসের অফিসারদেরও গুয়াতেমালা এবং ইন্দোনেশিয়া কেন পাঠাই সেটা আশা করি আমার আগের তথ্যগুলোয় বুঝতেই পারছো তোমরা, আর কিছু কি বলতে হবে? ওনারা বিপ্লবী, আসামী নন!”- অরুনেশ শেষ করল।
এবার দুই বন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে নিজেদের দু’জোরা হাত এগিয়ে দিলেন;
“কি করবেন কমরেড? আমাদের কাজ কাল হবে না ঠিকই, কিন্তু কেউ না কেউ কোথাও না কোথাও আমাদের বিপ্লব এগিয়ে নিয়ে যাবেই, নিন, আপনারা আপনাদের কাজ করুন অফিসার; বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক!”
অরুনেশ তাদের অকুতোভয় চোখ আর মোহময় হাসিমুখ দেখে চোখের কোণে জল নিয়ে শুধুমাত্র বন্দুক তাদের দিকে তুলে তাক করে একবার গলা তুলে বললো;
“বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক”
ধায় ধায় দু’টো গুলি গর্জে উঠলো।
আজ ১২ই মার্চ, ভারতে ফিরছে চার অফিসার একসাথে; তারা সফল; সি আই এ থেকে ভবিষ্যতে পুরস্কৃতও হবে; প্রফেসার নিরুপম সেন এবং স্বাধীন তালুকদারের টাটকা লাশ তারা সি আই এ-কে দিয়ে এসছে।
“এরা কত বোকা তাইনা স্যার!”- রামালিঙ্গম বললো ফ্লাইটে।
অরুনেশ গলা খাঁকরে বললো;
“মতলববাদী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী’রা চালাক হয় ঠিকই, কিন্তু বুদ্ধিমান হয় না রামালিঙ্গম”
আলতো কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো এবার পান্ডে;
“সেজন্যই নিজেদেরই দুটো অফিসারের মৃতদেহ নিজেরাই চিনতে পারলো না! তদন্ত না করিয়েই সমাধিস্থ করে দিল প্রফেসার সেন আর চোরের লাশ ভেবে, আসলে তো আবার ভোল পাল্টে গেছে কাল রাত্রেই, আপনি প্রফেসার সেন আর তালুকদারের উপর গুলি চালাতে গিয়ে ঘুরিয়ে সি আই এ-র দুই অফিসারের দিকে চালানর পর, থ্যাঙ্কস্ টু প্রফেসার নিরুপম সেন’স্ ফরম্যূলা! কামাল করে দিলেন স্যার! স্যালুট আপনাকে!”
“কি জানি ওনারা এখন কোথায়!”- রাজপুত বলে উঠলো।
অরুনেশ বললো;
“ওনারা কোথায় জানিনা! কিন্তু ওনাদের কাজ শুরু হয়ে গেছে, নিউজ’টা দ্যাখো একবার………”
সামনের সীটের মোবাইল টি ভি-তে নিউজ হেড লাইনস্
“আন্তর্জাতিক বিপর্যয়! গ্রিসে স্থাপিত ঊনসত্তর বছরের পুরনো মার্কিন সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক গুপ্তচর ঘাঁটি আজ দুপুরে বিস্ফোরণে ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে! সমস্ত পৃথিবী শোক প্রকাশ করেছে, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহল গভীর শোকাহত, জাতীয় শোক পালন হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে; শোকপ্রকাশ ভারতের রাজনৈতিক মহলেরও”।
অরুনেশের মুখ দিয়ে শুধু একটাই কথা বের হলো;
“বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক কমরেড”।
_________________________________________________________
©somewhere in net ltd.