নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অলিক চক্রবর্ত্তী

অলিক চক্রবর্ত্তী › বিস্তারিত পোস্টঃ

বুমেরাং বেতার বাণী

২৫ শে মে, ২০১৬ রাত ৯:৫৬

‘লন্ডনের রাণী আর রাজ সভাসদ’দের কি হঠাৎ একসাথেই ভীমরতি হলো নাকি!’- বললো রামালিঙ্গম।
‘শুধু রাণী আর সভাসদ’দের কথাই কেন বলছেন স্যার? অনেক সাধারণ বাসিন্দাও তো বিষয়’টা মেনে নিয়েছেন; বলতে গেলে অধিকাংশেই মেনে নিয়েছে; কিন্তু কোন ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বিষয়’টার’- বললো পান্ডে।
চীফ্ অফ্ সি বি আই এতক্ষণ চুপ করেছিলেন; তিনি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন অরুনেশের ভাববিহ্বল মুখের দিকে; কিছু গভীর ভাবনা’য় ডুবে আছে অরুনেশ। এবার চীফ্ মুখ খুললেন;
‘তুমি কিছু বলবেনা অরুনেশ?’
‘ব্যপারটা যে সাদা-মাটা নয় সেটা বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না স্যার; কিন্তু উৎসটা ঠিক ধরতে পারছি না! লন্ডন না গেলে কিছুই ধরতে পারবো না!’
‘কিন্তু যা করতে হবে ভীষণ গোপনে অরুনেশ; ধড়া পড়লে লন্ডনের গুপ্তচর বিভাগের অনেকের সাথে তোমাদেরও প্রাণ সংশয় হবে। রাণীর মাথা’র এখন ঠিক নেই একদম!'
‘সে বিষয়ে আপনি চিন্তা করবেন না স্যার’
‘করতে হয় অরুনেশ; তোমার মতো অফিসার’দের জন্য করতে হয় চিন্তা! বেস্ট অফ্ লাক্!’
‘থ্যাঙ্ক ইউ সা………’

ঘটনা’র সূত্র কয়েক সপ্তাহ আগে; রাণীর জন্মদিনের দিন সন্ধ্যা’য় বাকিংহ্যাম প্যালেসে বিরাট অনুষ্ঠান হয়; সেই সন্ধ্যা’য় অনুষ্ঠানের শেষের দিকে আচমকা রাণী’সহ সভাসদ, আগত অতিথি এমনকি নিরাপত্তারক্ষী সহ যারা ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাদের মাথা’য় একসাথে যন্ত্রণা শুরু হওয়ায় অনুষ্ঠান সেই মূহুর্তেই স্থগিত করে দেওয়া হয়। তারপর দিনই আচমকা ঘোষিত হয় যে,
সম্পূর্ণ গ্রেট ব্রিটেন দেশ পূর্ব-পশ্চিম ক্ষেত্র অনুসারে দু’ভাগ হবে! একভাগ হবে জন্মসূত্রে ব্রিটিশ দেশবাসী’দের নিয়ে, নাম হবে ব্রিটিশ ইউনিয়ান; অপরটি হবে সমস্ত প্রবাসী বা এ দেশের বাসিন্দা হলেও যাদের শরীরে মোটেও ব্রিটিশ রক্ত বইছে না তাদের নিয়ে, সেটা হবে ই বি ইউ অর্থাৎ এমিগ্রান্ট্ ব্রিটিশ ইউনিয়ান। সেই অনুযায়ী বিগ্ বেনের শেষ ভাগ থেকে এই পার্টিশান কার্যকরী করার আদেশ জারী করা হয়েছে, সাথে এও বলা হয়েছে, যারা যে ভূখন্ডে অবস্থান করছেন, তারা যেন তাদের যথার্থ পরিচিতি অনুসারে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র সচিবালয়ে পরীক্ষা করিয়ে সঠিক দেশাংশে বা পার্টিশানের পরবর্তী নতুন নামাঙ্কিত দেশে চলে যায় এবং সেখানে অবস্থান করে; যারা সঠিক ভূখন্ডে আছেন তাদের ক্ষেত্রে সেটা প্রয়োজনীয় নয়, কিন্তু যারা ভুল অংশে আছেন তাদের ক্ষেত্রে সেই আদেশ যত তারাতারি সম্ভব পালন করতে বলা হচ্ছে; যদি কেউ এই আদেশ অমান্য করে, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে ইউনাইটেড কিংডম যদদূর সম্ভব কড়া পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে।
ঘোষনা’র পরমূহুর্ত থেকেই সমগ্র লন্ডন জুরে সাংঘাতিক অরাজকতা’র শুরু হয়েছে; বিগ বেনের শেষাংশে বিশাল প্রাচীর গড়ে তোলার কাজও শুরু হতে চলেছে যেকোন মূহুর্তে; প্রচুর মানুষ বিরোধীতা করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছে, হত্যাও করা হয়েছে হাজার-হাজার মানুষ’কে! ধর্ষিত হচ্ছে অসংখ্য নারী, বিশেষত প্রবাসী নারী’রা, তথাকথিত ভদ্রতম এই দেশে; খুন রাহাজানী ডাকাতি দখল সহ আরও অনেক কিছু চলছে যাদের বিরুদ্ধে প্রশাসন সেভাবে কোন ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষম!
গুপ্তচর বিভাগের বিশেষ অংশ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করা হয়েছে অন্যান্য দেশের গোয়েন্দা বিভাগীয় প্রধান’দের কাছ থেকে।
অরুনেশ তৈরী তার দল নিয়ে, লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে।

‘দেখলেন তো সব পরিস্থিতি মিস্টার চ্যাটার্জী, বাকিংহ্যাম প্যালেসের চূড়া এবং বিগ বেনের চূড়া থেকে দুই বিশাল’কায় বেতার ঝোলানো হয়েছে যেখান থেকে ক্রমাগত রাণীর পার্টিশান অ্যাক্ট্ অপারেট করা হয়ে চলেছে! সবাই সেই অনুযায়ী চলছে কিসের আশায় জানিনা! আমি রক্তসূত্রে গ্রীক, যদিও আমরা পাঁচ পুরুষ ধরে এদেশে আছি ব্রিটিশ হয়েই; হিসেব মতো এমিগ্রান্ট আমাদের আর বলা যায় না কোনভাবেই! কিন্তু রাণীর হঠাৎ চরম অপদার্থ স্বৈরাচারের দাম দিতে হবে আমাকেও, আমার পরিবারকেও; সেখানে আইনের উপরে রাণী; সবার ঊর্ধে রাণী সত্য, তাহার ঊর্ধে নাই! টেক্সাসে আমাদের দেড়শো বছরেরও বেশি প্রাচীন ভিটে ছেড়ে সমস্ত সম্পত্তি ছেড়ে আমাদের চলে যেতেই হবে! আপনি যে করে হোক এর কোন ব্যবস্থা করুন মিস্টার চ্যাটার্জী, বিষয়টা যথেষ্ট সন্দেহজনক! বুদ্ধিমতী রাণী হঠাৎ এমনটা কেন যে করছেন জানিনা!’
কথাটা বললেন ব্রিটেনের ভেঙে পড়া গুপ্তচর বিভাগীয় এক অফিসার আলফ্রেড হোমাস। ছদ্মবেশী অরুনেশ এবং তার ছদ্মবেশী সঙ্গী’দের।
অরুনেশ বললো;
‘আমি একটা বিষয় নিয়ে বেশ সন্দীহান যে, দেশের হাজার হাজার মানুষ কেন অবলীলাক্রমে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন! রাণীর সভাসদ’দের মধ্যে, সেনেটর’দের মধ্যেও অনেকেই রক্ত বা জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নন, তাদেরও তো ই বি ইউ’তে চলে যেতে হবে স্বাভাবিকভাবেই, তারাও কিচ্ছু প্রতিবাদ করলেন না!’
‘সামান্যতমও নয়! বরং হাসিমুখে মেনে নিলেন দ্বিখন্ডিতকরণের আইন! সেজন্যেই তো বলছি, কিছু একটা গন্ডগোল হচ্ছে! তাই আপনাদের ডেকেছি গোপন তদন্তের জন্যে, গুপ্তচর বিভাগ ছাড়া অন্য জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগেরও অনেকেই রাণীর এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন বাইবেল বাক্যের মতো! হাসিমুখে বিনয়ী হয়ে, কেন!’
‘বুঝলাম; আপনি আমাদের চারজনের জন্য এখানকার রক্তসূত্র বাসিন্দা হিসেবে নকল ব্রিটিশ পাসপোর্ট-এর বন্দোবস্ত করুন; আর নকল স্থায়ী ঠিকানা’র বন্দোবস্ত করুন; কি কি নামে হবে পাসপোর্ট’গুলো সেটা আমি আপনাকে ম্যাসেজ করে দিচ্ছি’
‘নিশ্চই! আর কিছু?’
‘আর যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, রানীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বাকিংহ্যাম প্যালেসের সমস্ত ক্লোসড্ সার্কিট ক্যামেরার গুপ্ত ভিডিও ফুটেজ আমার চাই’
‘এটা খুব কঠিন ব্যপার মিস্টার চ্যাটার্জী!’
‘কেন! আপনারা অফিসিয়ালি লন্ডনের জাতীয় গুপ্তচর বিভাগীয় প্রধান, আপনাদের ক্ষেত্রে তো এটা জলভাত!’
‘জলভাত ছিলো, এখন আর নেই! এ দেশে এখন আর আইন কানুন বলতে কিচ্ছু নেই! রাণীর নির্দেশে ঐ দিনের সমস্ত ফুটেজ এমনভাবে রেস্ট্রিক্টেড্ করে রাখা হয়েছে, যেন রাণী ছাড়া কেউ সেগুলো ছুঁতেও না পারে’
‘বাবা! এ তো কড়াকড়ির চরমপন্থী পর্যায়!’
‘তবে আর বলছি কি মিস্টার চ্যাটার্জী! অবস্থা বুঝুন একবার আমাদের! অপারক হয়ে বসে আছি; মনে হচ্ছে এ দেশে আর গুপ্তচর বা গোয়েন্দা বিভাগের কোন প্রয়োজনই নেই! হয়তো নিরাপত্তারও প্রয়োজন নেই আর!’
‘সেক্ষত্রে কোন কম্পিউটারে সেই ফুটেজ ফাইল’গুলো আছে সেই খবর’টা দিতে পারবেন তো?’
‘হ্যাঁ সেটা নিশ্চই পারবো’
‘আমার কালকের মধ্যেই সেই খবর চাই; বাকীটা আমার উপর ছেড়ে দিন’
‘ও কে মিস্টার চ্যাটার্জী’।

খবর এলো, ফুটেজ’গুলো রয়েছে রাণীর খাস পরিচারিকা এলিনা ফ্লিন্টফ্-এর ল্যাপটপে, যেটা বিশেষ পাসওয়ার্ড ছাড়া খোলে না; সেখান থেকে কোনভাবে পেনড্রাইভে যদি তুলে আনা যায়, তাহলেই পাওয়া যাবে সব।
পান্ডে বললো;
‘স্যার, ল্যাপটপ’টা চুরি করে নিলেও তো হয়! একইরকম আরেকটা ল্যাপটপ যথাস্থানে রেখে দিলেই তো…’
‘মূর্খের মতো কথা বলোনা পান্ডে! শুধুমাত্র ফুটেজ’গুলো কপি হলে কেউ কিচ্ছু জানবে না, কিন্তু গোটা ল্যাপটপ চুরি হলে ঠিকই সব ধড়া পড়বে, তাও খুব দ্রুত! তুমি কি জানো ঐ ল্যাপটপে কি কি প্রোগ্রাম ফাইল আছে, কি অপারেটিং সিস্টেম আছে, কি ফিচারস্ আছে সে সমস্ত? চুরি করে অন্য ল্যাপটপ রাখলে শুধু বাইরেটা নয়, ভিতরটাও একই রুপ দিতে হবে, নইলে সব শেষ হয়ে যাবে পরিশ্রম! ভুলে যেও না চীফ্ কি বলেছিলেন, ধড়া পড়লে কিন্তু আমাদের সাথে ভারতের কোন যোগাযোগ নেই, আমাদের কেউ চেনে না! আর কিছু বলার আগে মাথায় রেখো, এটা ভারত নয়, লন্ডন; এখানে আঠারো মাসে বছর নয়! ক্লীয়ার?’
‘স্যরি স্যার!’
‘পরিকল্পনাটা অন্যরকম করতে হবে! মিস্টার হোমাস, আমার এলিনা ফ্লিন্টফের সম্পর্কে ডিটেলস্ রিপোর্ট চাই’
‘ও কে মিস্টার চ্যাটার্জী’

কয়েকদিন পর তথ্য এলো;
‘নাম- এলিনা ফ্লিন্টফ্
বয়স- একত্রিশ বছর তিন মাস বাইশ দিন
জন্মসূত্রে ব্রিটিশ
বেশ সুন্দরী এবং নাক-উঁচু হওয়ায় এখনও অবিবাহিতা
তুখোড় কম্পিউটার অ্যানালিস্ট্
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স এবং আইনে স্নাতক
রাণীর পরিচারিকা বললে ভুল হবে, ইনি রাণীর ব্যক্তিগত সচিব, অসামান্যা বুদ্ধিমতী, বিশেষত রাজনীতি’তে
বেশ অহঙ্কারী মহিলা
দীর্ঘাঙ্গী, ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি, মাঝারি এবং লোভনীয় স্বাস্থ্য; অনেকের নজরে থাকলেও কেউ এগোতে সাহস করেনা
আত্মরক্ষায় সক্ষম, মার্শাল আর্টে ব্ল্যাক্ বেল্ট্, তাও চীনের শার্লিন টেম্পল্ থেকে
রাণীর সমস্ত রকম খেয়াল রাখেন
রাণীর সব গোপন খবর, পদক্ষেপ সবই সবার আগে এই মেয়েটিই জানতে পারে
মেয়েটির সাথে শুধুমাত্র তার দাদু থাকেন, যিনি আবার জন্মসূত্রে ভারতীয়, এলিনা’র মা’য়ের বাবা; এলিনা ব্রিটিশ হলেও তার বাবা বিয়ে করেছিলেন এক জন্মসূত্রে ভারতীয় মহিলা’কে, এলিনা’র মা; যিনি এখন মৃত; এলিনা’র বাবা’ও মৃত; আছেন শুধু এই বর্ষীয়ান দাদু, বয়স ঊননব্বই বছর ষোল দিন, নাম গোরক্ষনাথ ভট্টাচার্য্য; এখনও চলতে ফিরতে বেশ সক্ষম; রোগ নেই কোন’।
বললেন এক গুপ্তচর বিভাগীয় গোপন অফিসার।
‘দাদু, মানে, মিস্টার ভট্টাচার্য্য কি করতেন?’- জিজ্ঞেস করলো অরুনেশ।
‘তিনি নাকি তেইশ বছর বয়সে নিজের দেশ ছেড়ে লন্ডনে পালিয়ে এসেছিলেন, বেশ কিছু টাকা ছিলো সাথে, তা দিয়ে এখানে নিজের ব্যবসা শুরু করেন, পাবলিশিং এজেন্সী; পরে নিজেও বেশ কিছু বই লিখে বিখ্যাত হয়েছেন; এখন আর লেখেন না’।
‘কি বিষয়ে লিখতেন জানা আছে? আমি কোনদিন তার বই পড়িনি! নাম শুনেছি বলেও মনে পড়ছে না!’
‘উনি লন্ডনের বাইরে তেমন একটা নাম করতে পারেননি; তাই হয়তো জানেন না; এখানে বিখ্যাত হলেও খুব একটা নন! মূলতঃ কবিতা’র বই বেরিয়েছে ওনার গোটা দশেক, এই যা; বিষয় বলতে, সাধারণ মানুষের জীবন, ইতিহাস, নন্দনতত্ব, কনজিউমারিজমের বিরোধীতা, পোস্ট মর্ডানিজমের বিরোধিতা; এই আর কি!’
‘এলিনা ফ্লিন্টফের ছবিটা এনেছেন?’
‘হ্যাঁ স্যার, এই যে’
গুপ্তচর ছবিটা এগিয়ে দিলো অরুনেশের হাতে; অরুনেশ দেখলো; খুঁটিয়ে;
‘হুম্; সত্যিই সুন্দরী! বড়ো মাপের সিনেমা বা থিয়েটারের নায়িকা হওয়ার ক্ষমতা রাখেন!’
রাজপুত হেসে জিজ্ঞেস করলো, ঠাট্টার ছলে;
‘কি ভাবছেন স্যার? ডেটে যাবেন নাকি?’
‘হুমমমমম! ডেটে তো যেতেই হবে রাজপুত! এতো সুন্দরীকে কি ছেড়ে দেওয়া যায়! আমি আসছি এলিনা, তোমার কাছে; তৈরী থেকো’।

এক বাঙালীর ছদ্মবেশেই তৈরী ছিল সেদিন অরুনেশ, ঠিক যে রাস্তা দিয়ে এলিনা একা একা কর্মস্থলে যায় সে রাস্তা’র এক কোণে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল এলিনা’র জন্য। পরিধান’টা কিছুটা পাগলাটে, তবে পুরোপুরি নয় তা বোঝা যাচ্ছে, মাথাভরা চুল সাথে উসকো-খুসকো ঢেউ খেলানো দাড়ি, একটা লং কোট দু-চার জায়গায় তাপ্পি মারা, ভিতরে ময়লা জামা, তার ভিতরে রং-ওঠা টি-শার্ট, ঢলঢলে প্যান্টুলুন, আধ’ফাটা জুতো, কাঁধে একটা ভারী হয়ে ঝুলে পড়া ব্যাগের মধ্যে সম্ভবত মোটা কিছু বই খাতা কাগজ।
অরুনেশ লক্ষ্য করলো এলিনা দূর থেকে আসছে নিজের খেয়ালে; সত্যিই বেশ সুন্দরী চলন ভঙ্গি তার।
হঠাৎই অরুনেশ মাঝ রাস্তায় এসে দূর্গা পূজোর বিসর্জনের উদোম নৃ্ত্য আর বগল-তোলা নৃ্ত্য শুরু করে দিল, মুখে সহজ বাংলায় গলা তুলে কথা বলতে থাকে;
“ঠিক হয়েছে শালা! বেশ হয়েছে! হারামী মগা-মাগীর দল আমার দেশ’টাকে দু’টুকরো করে দিয়েছিল! তার জের এখনও চলছে, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা! ডিভাইড অ্যান্ড রুল! হিন্দুস্তান-পাকিস্তান! শুয়োরের বাচ্চা শালা মর এবার মর, মর মর মর হারামজাদী! এবার তোদের মধ্যেও লাগবে, ব্রিটিশ ইউনিয়ন আর এমিগ্রান্ট ব্রিটিশ ইউনিয়নের মধ্যেও এরপর দাঙ্গা লাগবে, যুদ্ধ হবে, দেখে যা শুধু দেখে যা, এবার আমি হাসবো, হা হা হা হা”- হাসতে শুরু করলো অরুনেশ।
রাস্তায় লোক জরো হয়ে গেলো বেশ কিছু, তামাশা দেখতে; এলিনা’ও দাঁড়িয়ে দেখছিলো এই পাগলামী, অরুনেশ আঢ়চোখে সবই লক্ষ্য করে চলেছিল নাচতে নাচতে আর গালাগাল দিতে দিতে; লোকজন আবার কর্মব্যস্ততায় রাস্তা ফাঁকা করতে শুরু করে দিলো; এলিনা কিন্তু দাঁড়িয়েই রইল।
ক্ষণিক পরে যখন ছদ্মবেশী অরুনেশ অন্যত্র চলে যাওয়ার ভান করছিল নাচতে নাচতেই তখনও এলিনা দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে অরুনেশ’কে দেখেই যাচ্ছিলো; বোধ হয় কিছু একটা বলবে বলে ভাবছিলো কিন্তু, কিছু একটা ভেবে সেও চুপচাপ চলে গেলো। অরুনেশ মনে মনে বললো;
“বেশ বুদ্ধিমতীও, শুধুই সুন্দরী নয়! বাট্, আমার সন্দেহটা আরও বাস্তবের দিকে এগিয়ে চলে গেলো; এতো সহজে হাতে তুমি আসবে না জানি এলিনা, কিন্তু দেখা আবার তোমার সাথে আমার হবেই, খুব শিগগিরিই”।
কদিন বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছদ্মবেশী অরুনেশ’কে বিভিন্ন মানুষের মতো এলিনাও দেখতে পেলো আনন্দে হয় নাচতে নয় গালাগালি দিতে নয় ভাঙন নিয়ে বিভিন্ন ভাষার কবিতা আওরাতে, তার কয়েকটা সম্ভবত এলিনারও জানা, বাকীগুলো একেবারেই অজানা। ক্রমশ এলিনা’র চোখে তার কর্মকান্ডের প্রতি আগ্রহ বাড়তে চোখে পড়ছিলো অরুনেশের। এভাবেই চলতে লাগলো বেশ কয়েকটা দিন। কিন্তু সেদিন হঠাৎই রাণীমহল থেকে ফেরার পথে এক জনাকীর্ণ রাস্তায় অরুনেশের কর্মকান্ডে এলিনা আর এড়িয়ে এগোতে পারেনি;
ছদ্মবেশী অরুনেশ একাই বেশ ব্যস্ততার সাথে দেওয়ালে দেওয়ালে ছোট ছোট পোস্টার মারছিলো, হাতে লেখা পোস্টার; সাদা এ-ফোর সাইজ কাগজ ভারটিকালি আটকাচ্ছিলো সে, তাতে লেখা;
“DON’T PREVENT THE PARTITION MY DEAR EMIGRANT FRIENDS FROM INDIA”
“IT SHOULD BE OUR INTERNATIONAL REVENGE EMIGRANT FRIENDS FROM INDIA; DON’T TRY TO PROTEST AGAINST THE PARTITION PLEASE”
কিছু লোক দেখছিলো এলিনা’র মতোই দাঁড়িয়ে ঘটনা’টা; যদিও এলিনার মতো কেউই কোন আগ্রহ দেখায়নি।
সেই ঝুলে পড়া খোলা ব্যাগ থেকে এক এক করে লেখা কাগজ বের করছে ছদ্মবেশী অরুনেশ, পাশে ফুটপাথের এক কোণে রাখা এক ধাউশ বোতলে আঠা ভর্তি; বোতল’টা দেখে খুব একটা পুরনো মনে হচ্ছে না; সম্ভবত গ্রিফিক্স আঠাই মনে হচ্ছে এলিনা’র।
হঠাৎই এক তারা তৈরী পোস্টার একসাথে যেঁচেই বার করতে গিয়ে হাত থেকে পড়ে যাওয়ার ভান করে ফেলে দিলো অরুনেশ; সাথে সাথেই সেগুলো তুলতে উদ্যত হলো সে; সেই মূহুর্তেই এগিয়ে আসে ব্যস্ত এলিনা;
“আমি তুলে দিচ্ছি”- বলে ওঠে এলিনা।
উফ্ কি অসামান্য সুন্দর কণ্ঠস্বর! দেখতে যতোটা সুন্দরী, তার চেয়েও সুন্দর এই কণ্ঠস্বর, মাখনের মতো! আঢ়চোখে আপাদমস্তক এলিনা’কে দেখতে লাগলো অরুনেশ; এক মাথা কোকরানো চুল অর্ধেক পীঠ অবধি নেমে এসেছে, গা’য়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, কোন সুদক্ষ নন্দনতাত্ত্বিক চিত্রকর এই চোখ এঁকেও ফোটাতে পারতো না কোনমতেই, গোলাপী গালে মৃদু হাসিতে হাল্কা টোল পড়েছে, কোমল সুন্দর নিটোল গলায় একটা সরু সোনার চেন ঘাড়’গুলোকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে, হাল্কা গোলাপী ঠোঁট, পরিধানে পরিচ্ছন্ন বাদামী লং কোট বোতাম আটকানো গলার একটু নিচ পর্যন্ত, কালো ন্যারো প্যান্টুলুন, পা’য় লম্বা হাঁটুর কাছাকাছি অবধি বুটজুতো’জোরা সাদা মার্বেলের মতোই, মাথা’য় নীলচে কাউবয় হ্যাটের গাঢ়ো লাল রিবন’টায় এলিনা’কে আরও মোহময়ী লাগছিলো! ঠিক যেন নভেম্বর স্নো ফলসের মাঝে একলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কোন এক নাম জানা অথচ অনামিকা হয়ে সুখী সেই স্বপ্নসুন্দরী যাকে দেখলে যেকোন কবি ওক গাছের তলায় টেমসের ধারে দাঁড়িয়ে হাতে কলম তুলে নিতে বাধ্য হবেই, সুরকার হাতে গীটার তুলে তাতে রোমাঞ্চ জাগানো সুর তুলবেই, আর সে কবিতা যখন সে সুরে গান হবে তখন, মরু’র পৃথিবীর ঠোঁটেও শীতল বৃষ্টি চুমু ঝরাবেই!
কিন্তু একভাবে মোহময়ীর সৌন্দর্য্যে ফেঁসে থাকলেই তো হবে না অরুনেশ’কে! তার উদ্দেশ্য যে গভীর! কিন্তু, এর চেয়ে গভীর সত্যিই কিছু আছে কি! না না অরুনেশ, তোমার কাজ তুমি করো, থেমো না; কিন্তু, আরেকটু দেখি, আরেকটু! এই অমলিন হাসি’তে যেন গোটা বিশ্ব এক মূহুর্তে নিষ্কলঙ্ক এক আঙুরের দানা হয়ে ধরা দিচ্ছে আজ অরুনেশের হৃদয়ের হাতে; কিন্তু, আজ উপায় নেই আর একে উপভোগ করার! চোখ সরিয়ে অন্য রূপ ধরলো অরুনেশ; কাগজ’গুলো ছিনিয়ে নিলো এলিনা’র কোমল হাতের বন্ধন থেকে আচমকাই এক টান মেরে; ধাড়ালো কণ্ঠস্বরে বলে উঠলো সে;
“দিয়ে দাও; এটা আমার, এতে তোমাদের ব্রিটিশ’দের কোন অধিকার নেই! তুমি দূর হয়ে যাও এখান থেকে, নয়তো তোমায় আমি খুন করে ফেলবো”- লং কোটের পকেট থেকে একটা মরচে-পড়া ছোট ছুড়ি বার করলো সে; কিন্তু সাহসী এলিনা’র ভাবলেশহীণ দৃষ্টির ফলস্বরূপ আরও অমোঘ সম্মোহণে অরুনেশের হাত এগলো না! এই দৃষ্টি কি জন্মগত এমনই রোম্যান্টিক! এই সৃষ্টি কি শেলী’র? না কীটস্ এর? না ওয়ার্ডসওয়ার্থের সলিটারী রিপার? নাঃ! আটকে গেলে চলবে না এখানে অরুনেশ! বেরিয়ে এসো এই দশা ছেড়ে, বেরিয়ে এসো।
অরুনেশ এলিনা’কে বাঁ হাতের হাল্কা ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে চলে গেলো; শুধু বলতে বলতে গেলো;
“তোমাদের হাতে আমি কোনদিনও আসবো না ব্রিটিশ কুকুরের দল, তোমাদের ধ্বংসেই আমাদের মুক্তি…”
এলিনা নিজেকে সামলে নিয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো; লোকজন বলাবলি করতে লাগলো নিজেদের মধ্যেই;
“আচ্ছা পাগোল দেখছি!”
এলিনা শুধু একবার মৃদু হেসে নিজেই নিজেকে বললো;
“পাগোল তুমি নও! অবশ্য, দেশপ্রেমিক’কে লোকে পাগোল বলেই বোঝে সহজে! দেখা তোমার সাথে হবেই”।

“আমিও আপনারই পথের পথিক মহাশয়”- একদিন ছদ্মবেশী অরুনেশ’কে আবারও হাতে লেখা সেই পোস্টার মারতে দেখে এগিয়ে গিয়ে সরাসরি বলেই ফেললো এলিনা; অরুনেশ চমকে গিয়ে তার দিকে তাকালো; যদিও তখন বেলা এগারোটা তবুও এলিনা’কে দেখে মনে হলো, এই সবে সূর্য উঠছে রাজপথের কোল থেকে। অরুনেশ যেতে উদ্যত হয়েও থেমে গেলো দেখে এলিনা আবার বললো;
“পালাবেন না! আমায় ভয় পাওয়ার কিছুই নেই, রাণীমহলে কাজ করি বলে ভুল করবেন না; আমিও রক্তগত ভারতীয়”
লাফিয়ে ওঠার ভান করলো অরুনেশ;
“আপনিও ভারতীয়? আপনিও ভারতীয়? আপনিও তাহলে বুঝবেন”- বলেই কয়েকটা লিফলেট এগিয়ে দিলো এলিনা’র দিকে। এলিনা একটু পিছিয়ে গেলো;
“এখানে নয়, আজ এই রাস্তাতেই থাকবেন, সন্ধ্যে ৭ টা নাগাদ”
“না!”
“কেন?”
“আপনি যদি আমায় পুলিসে ধরিয়ে দেন! আমি থাকবো না”
“আমায় বিশ্বাস করতে পারেন; করেই দেখুন না একবার”
অরুনেশ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো এলিনা’র বিশ্বস্ত চোখ’দুটো আর মৃদু নিষ্পাপ হাসির দিকে। এলিনা আবার বললো;
“সন্ধ্যে ৭ টায় দেখা হচ্ছে; এখন চললাম”- এলিনা শেষ কথাটা বলে চলে গেলো গট্ গট্ করে।
অরুনেশ তাকিয়ে রইলো এলিনার যাওয়ার পথের দিকে; এলিনা কিছুদূর গিয়ে একটা বাঁক নেওয়ার আগে আবারও এলিনার দিকে তাকিয়ে সেই মৃদু হাসির ঝলক দিয়ে চলে গেলো। অরুনেশ মনে মনে বললো;
‘কাজ হয়ে গেছে; সন্ধ্যায় কি উঠে আসে দেখি”।

একই রাস্তায় সন্ধ্যেবেলা যথাসময়ে একই বেশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিলো অরুনেশ; ঠিক ৭ টায় এলিনা এলো সেই রাস্তা দিয়েই; সরাসরি এসে বললো;
“এখানে আর কথা নয়, আমার সাথে এসো”
অরুনেশ চললো এলিনা’র পিছু পিছু; যেতে যেতে অরুনেশ মনে মনে ভাবছে কোথায় চলেছে সে এই রূপবান কন্যার সাথে; সম্ভবত কোন ডেরায়; কোন বিপদের আশঙ্কার কথাও ভাবছিলো সে, যদিও তাতে জোর দেয়নি।

চলতে চলতে পৌঁছালো তারা একটা দোতলা বাড়ির দ্বোরগোড়ায়; বাড়ির পরিকাঠামো প্রাচীন ফরাসী বাড়িগুলির মতো ষড়ভূজাকৃ্তি, সম্মুখে বেশ লম্বাটে দড়জাটা পুরু উইলো কাঠের, কাঠের জানলা সম্মুখে একতলায় দুটি ও দোতলায় আরও দুটি, দড়জার মাথার দিকের ছাদ থেকে একটা মিনার্বাল জাতীয় লাইট ঝোলানো যাতে বেশ ঝকমকে আলোকিত সামনের অংশটা, বাড়িটা সম্পূর্ণই হাল্কা গোলাপী রঙের, ছাদের বীট’গুলো গাঢ়ো বাদামীটে মনে হচ্ছে স্ট্রীটলাইটের আলোর প্রতিফলনে, বাড়ির সামনের ছোট প্রবেশিকা রাস্তার দুপাশে ছোট বাগানে বেশ কিছু বিভিন্ন জাতের ফুলের গাছ সাজানো বেশ যত্নের সাথে, তার কয়েকটা অরুনেশ চেনে, বাকীগুলো চেনে না; ম্যাগনোলিয়া, হাসনুহানা, ডালিয়া আর ক্যালেন্ডুলা চিনতে পেরেছে মনে হলো অরুনেশের। মনে মনে সে বললো;
‘ইন্টারেস্টিং, যদিও পুরনো ধাচের’।
এলিনা অরুনেশের দিকে তাকিয়ে বললো;
“এসো”
বলেই সে এগিয়ে প্রবেশিকা রাস্তা পার করে একেবারে দড়জার সামনে গেলো সে, অনুসরণ করলো অরুনেশ।
এলিনা ডোরবেল বাজালো; অদ্ভূত এক মোহিত করা শব্দ, যেন নাইটিংগেলের গান; মূহুর্তে চতুর্দিকে একটা অদ্ভূত বাখের কনচের্তোয় সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে গেল। দড়জা খুলে বেরিয়ে এলেন এক বৃ্দ্ধ ভদ্রলোক; এই বোধ হয় এলিনার দাদু, কোন সন্দেহ নেই ভদ্রলোকের অভিজাত ভারতীয় গড়ন দেখে; মাথাভরা সুন্দর পেতে আছরানো ঘন পাকাচুল, টিকালো নাকের নিচে পাতলা ঠোঁটজোরা লালচে এখনও, প্রশস্ত কপাল, বেশ ফর্সা ইনিও তাতে সন্দেহ নেই, অন্তত ছ’ ফুট এক ইঞ্চী দীর্ঘাঙ্গ, বেশ সুপুরুষ এখনও, গালের চামড়া এমনকি মোটা কালো হাউসকোটের হাতার ফাঁক দিয়ে বেরনো হাতের থাবার উল্টোদিকের চামড়াও কোচকায়নি আজও, ঠোঁটের ডগায় কালো একটা পাইপ, অমায়িক অমলিন হাসিমুখ বেশ উজ্বল নক্ষত্রের আলোড়ন যেন! কালো হাউসকোটের নিচে হাল্কা ছাই রঙের দামী রাজকীয় ঘরোয়া পাজামা, হাউসকোটের ফাঁক দিয়ে বোঝা যাচ্ছে ভিতরে আকাশী কলারওয়ালা সাদা জামা পড়ে আছেন ভদ্রলোক, পা’য় লাল ফিতেওয়ালা স্নিকার’জোরা।
ভদ্রলোক বললেন;
“ও এসে গেছিস দিদিভাই?”- কণ্ঠস্বরেও আভিজাত্য ছলকে পড়ছে, মখমলের মতো গম্ভীর অথচ ক্রুর নয়।
“হ্যাঁ দাদু”- বলেই জরিয়ে ধরলো এলিনা দাদু’কে, দাদুও নাতনী’কে জরিয়ে আলিঙ্গন করলো।
অরুনেশ’কে দেখিয়ে এলিনা বললো, “দাদু ইনিই…”
“বুঝেছি দিদিভাই, এসো নবীন বিপ্লবী, সুস্বাগতম”- দারূণ অভ্যর্থনা জানালেন দুহাত বাড়িয়ে তিনি; অরুনেশ কাছে যেতেই তাকেও বুকে জড়িয়ে ধরলেন বৃ্দ্ধ ভদ্রলোক একেবারে অভিজাত বাঙালী কায়দায়।
ঘরের ভিতরে ঢুকলো সবাই; ভিতরটাও বেশ সুন্দর সাজানো-গোছানো; কিন্তু দড়জা’টা বন্ধ করেই হঠাৎ ছদ্মবেশী অরুনেশ’কে সজোরে এক ধাক্কা মারে এলিনা’র দাদু; জোরালো আচমকা হামলা’য় পাশের দেওয়াল-ঘেঁষা সিঙ্গল সোফার গদীতে পড়ে যায় অরুনেশ এক্কেবারে থতমত খেয়ে, দাদুর অপ্রত্যাশিত এই ব্যবহারে স্তম্ভিত হয়ে যায় এলিনা নিজেও, সে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কান্ডকারখানার দিকে, দাদু হাতে একটা আধুনিক ব্রিটিশ পিস্তল উঁচিয়ে অরুনেশের দিকে তাক করে চাপা কণ্ঠস্বরে ক্ষীপ্রতার সাথে চেঁচিয়ে উঠলেন;
“কে তুমি? বলো কে তুমি? নইলে কিন্তু ঝাঁজরা করে দেবো তোমার বুক বলে দিচ্ছি! ভেবোনা বুড়ো বলে পার পেয়ে যাবে তুমি, আমার নিশানা এখনও অব্যর্থ, আর ক্ষমতাও কতোটা বুঝতেই পেরেছো যুবক; বলো কে তুমি”
এলিনা বলে উঠলো, “দাদু কি করছো তুমি এটা?”
দাদু আবার কথা বললো একই সুরে, “তুই এখনও খুব ছেলেমানুষ দিদিভাই! ওর সাথে কোলাকুলি করার সময়েই আমি দেখতে পেয়েছি উল্টোদিকের ফুটপাথের ফার গাছটার পিছন থেকে কেউ একজন লক্ষ্য করছে আমাদের বাড়ির দিকে! দিদিভাই, তুই সতর্ক হয়ে যা”
অরুনেশ তখন কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মনে মনে বললো, “ছাগল রামালিঙ্গম শালা! এই বুদ্ধি নিয়ে সি বি আই”
সাথে সাথেই এলিনা’র অবাক ভাবটা কেটে গিয়ে দাদু’র আঙ্গিকে হাতে আর একটা বদুক নিজের লং কোটের বাঁ পকেট থেকে বের করে তুলে সতর্ক চাহুনীতে বন্ধ দড়জার দিকে তাক করে থাকলো শিকারীর দৃষ্টিতে; দাদু আবার গর্জে উঠলেন;
“কি হলো বলো কে তুমি, কিজন্য এসেছো”
অরুনেশ ধাতস্থ হয়ে বুঝলো, এবার তার আত্মপরিচয় প্রকাশ করাটাই সঠিক কাজ, যদিও তার সাবধানী হাত’দুটো তখনও দুদিকে উঁচু করাই রয়েছে; সে স্পষ্ট বাংলায় এবার বলে উঠলো;
“অরুনেশ চ্যাটার্জী; সেন্ট্রাল ব্যুরো অফ্ ইনভেস্টিগেশান, আমি কলকাতা থেকে এসেছি মিস্টার ভট্টাচারিয়া”
“কি প্রমাণ আছে?”- বুড়োও বাংলায় কথা বললো এবার
“আমার কোটের ডান পকেটে হাত দিলেই প্রমাণ পাবেন”
“দিদিভাই, একবার দেখতো”- বুড়ো নির্দেশ দিলো এলিনা’কে; এলিনা এগিয়ে গিয়ে অরুনেশের ডান কোটের পকেট হাতরে একটা শক্ত ভিজিটিং কার্ড বের করলো, সেটা খুলে মেলে ধরে বললো;
“হুম্, উনি ঠিক পরিচয়ই দিয়েছেন দাদু”
“জাল হতেও পারে!”- সন্দেহ প্রকাশ করলেন গোরক্ষনাথ
“অশোক স্তম্ভ’টা এখনও কেউ জাল করতে পারেনি গোরক্ষনাথ বাবু”- মৃদু হেসে বললো অরুনেশ।
“আবার দাদুর মুখের ওপর কথা হচ্ছে!”-বলেই রেগে ক্ষীপ্র হাতের বন্দুকের বাট দিয়ে সজোরে আঘাত করলো এলিনা, অরুনেশের মাথার বাঁ দিকে; অরুনেশ আবারও আচমকা আঘাতে জখম হয়ে অচৈতন্য হয়ে গেলো, তার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত পড়তে লাগলো; অরুনেশ নুইয়ে পড়ে গেলো ডান দিক ঘেঁষে। এলিনা একটু থতমত খেয়ে গেলো আঘাতটা অতিরিক্ত হয়ে যাওয়ার জন্যে, সে দাদুর দিকে তাকালো; দাদু বললো;
“মরেনি! একে সি বি আই তার ওপর বাঙালী, জান অনেক, দমও অনেক, অজ্ঞান হয়েছে; বেঁধে ফেল চেয়াড়ের সাথে। এখন জ্ঞান আসবে না, চল্ ডিনার সেড়ে নিই। কিন্তু, লক্ষ্য রাখিস একটু, বাঙ্গালি রক্ত”।
খুব সাবধানে দুটো ডিনারের ডিশে রাতের খাবার নিয়ে এলো এলিনা, দাদু এখনও তাক করে আছে অরুনেশের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ডান হাতে, আরেকটা বন্দুক বাঁ হাতে দড়জার দিকে তাক করে রেখেছেন। এলিনা’কে খাবার আনতে দেখে তিনি বললেন;
“দিদিভাই তুই আগে খেয়ে নে”
“না দাদু, আগে তুমি খাও; আমি লক্ষ্য রাখছি ওর দিকে”
“যা বলছি তাই কর”- দাদু গম্ভীরভাবে বলতে এলিনা অনুগত লক্ষী মেয়ের মতো তারাতারি খেতে শুরু করলো।
তখন রাত প্রায় ন’টা; রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে, লোকজন নেই একদম রাজপথ থেকে গলীগুলোয়; হঠাৎই এলিনা’দের বাড়ির দড়জার কাছে কেউ কর্কশ কণ্ঠস্বরে বীকট আর্তনাদ করে উঠতেই দাদু আর নাতনীর তীব্র মনঃসংযোগও আচমকা বাইরের দিকে ঘুরে গেলো নিশুতি নীরব শীতের রাতের আচমকা এই ঘটনায়, স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রীয়ায়; আর এই সুযোগ’টাই নিলো অরুনেশ, বিদ্যুদ্বেগে চকিতে সোফার ডান পাশের হাল ফ্যাশনের লম্বাটে টেবিলের ওপর থেকে ভারী চিনামাটির ফুলদানীটা ছুঁড়ে মারলো সে গোরক্ষনাথ’কে লক্ষ্য করে, গোরক্ষনাথের হাতের বন্দুক’দুটো জোর আঘাতে ছিটকে গিয়ে পড়লো একেবারে অদূরে থাকা ফায়ারপ্লেসের অগ্নিকুন্ডের আঁচে, গোরক্ষনাথ ধরাশায়ী হলেন, চেঁচিয়ে উঠলো এলিনা ‘দাদু’ শব্দে, অরুনেশ আরও তীব্র গতিবেগে তার ময়লা জামা’র দুই পকেট থেকে দুটো ছোট জার্মান বন্দুক বের করে দাদু আর নাতনীর দিকে তাক করে উঁচিয়ে ধরলো;
“খবরদার, আমার বন্দুক কিন্তু আপনার চেয়ে দ্রুত চলে মিস্টার ভট্টাচার্য্য, সাবধান এলিনা, কোন হরকত্ নয়”- শান্তস্বরে বললো অরুনেশ।
“টিকটিকির বাচ্চা’টাকে মেরে ফেললেই ভালো হতো দাদু”- ক্রোধোন্মত্ত এলিনা ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠলো;
“না দিদিভাই, ওর থেকে আমারও কিছু জানার ছিলো যে”- আহত গোরক্ষনাথ একটু ধাতস্থ হয়ে বললো।
সজোরে দড়জায় ধাক্কা মেরে ভেঙে ঢুকলো রামালিঙ্গম, পান্ডে, রাজপুত এবং ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরের সেই গোপন মিশনে অরুনেশ’দের আমন্ত্রণ জানানো উচ্চপদস্থ অফিসার; আরও চার’জোরা বন্দুকের নলের সামনে পড়ে দমে গেলো দাদু-নাতনীর সমস্ত উৎসাহ; মৃদু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হেসে গোরক্ষনাথ এলিনা’কে বললেন;
“এবার সত্যি বুড়ো হয়েছি দিদিভাই, চালে ভুল হয়ে গেলো যে! আর কিচ্ছু করার নেই আমাদের”
এলিনা’ও ভেঙে পড়লো এবার, তার অসহায় মুখ’টা মনে হচ্ছিলো থমথমে চতুর্দশীর চাঁদের মতো, চোখ ছলছল করছে। অরুনেশ এবার নিজের বন্দুক’জোরা সরিয়ে ছদ্মবেশ ত্যাগ করলো নকল দাড়ি-গোঁফ খুলে।
“আমি অজ্ঞান হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু অনেক্ষণ আগেই আমার জ্ঞান ফিরে গেছিলো সেটা গোরক্ষনাথ বাবুর বোঝার কথা নয় কারণ, আমি একইভাবে অজ্ঞান হয়ে থাকার ভান করছিলাম”- হাসলো অরুনেশ।
গোরক্ষনাথ দু’চোখ টিপে আফসোসের মুখভঙ্গি করলো। অরুনেশ আবার বলতে শুরু করলো;
“ধন্যবাদ রাজপুত, তুমি ওরকম না চিৎকার করলে আমি ফেঁসেই থাকতাম এখনও”
“থ্যাঙ্ক ইউ সা…”- রাজপুত বললো।
“আর, রামালিঙ্গম, তুমি সি বি আই-এর চাকরী ছেড়ে স্টেট্ পুলিস কন্সটেবলে জয়েন করো; আজ তোমার জন্য আমি ফেঁসে গিয়েছিলাম, আমার মৃত্যুও হতে পারতো, তার দায় কি তুমি নিতে অপদার্থ?”
“স্যরি স্যার!”- লজ্জায় মাথা নিচু করলো রামালিঙ্গম। অরুনেশ চীৎকার করে উঠলো,-“হোয়াট্ স্যরি!”
রামালিঙ্গম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। অরুনেশ আবার কথা বললো,- “ওভাবে কেউ লক্ষ্য রাখে? সব ট্রেনিং ভুলে গেছো? যাক্ গে, তোমার হিসেব পরে হবে; এখন আসল কথায় আসা যাক্”।
মুখ’টা এলিনা আর গোরক্ষনাথের দিকে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলো অরুনেশ;
“আমি জানি ব্রিটেনে যা ঘটেছে পার্টিশান নিয়ে, সবই আপনাদের দুজনের জন্য; এবার বলুন তো কি ঘটিয়েছিলেন বাকিংহ্যাম প্যালেসে রাণীর জন্মোৎসবের দিন?”
গোরক্ষনাথ আরও কিছুটা ধাতস্থ হয়ে বলতে শুরু করলেন;
“এটা একটা যুদ্ধ অরুনেশ, যা শুরু হয়েছিল বহু বছর আগে থেকেই। নাইন্টিন ফর্টি সেভেনে পার্টিশানে আমি আমার সর্বস্ব হারাই, দেশভাগের আগে আমি থাকতাম পেশোয়ারে, সেখানে আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটে ছিলো, আমরা খুব আনন্দে কাটাতাম; হিন্দু-মুসলিম বলে কোন ফারাক ছিলো না, আমি আর আমার প্রিয় বন্ধু ইয়াসির একই কলেজ থেকে বি এস্ সি পাশ করেছিলাম, একই সাথে স্কুলেও পড়েছি, আমার মনে আছে সেবার ইন্টারমিডিয়েটে ইয়াসির স্টেটে সেকেন্ড হয়েছিলো, আমি হয়েছিলাম সিক্সথ্, আমাদের সে কি আনন্দ! গ্রামে আমাদের নিয়ে মাথায় তুলে কি হইচই! তারপর হঠাৎই কি সব হয়ে গেলো! একদিকে সব ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসতে হবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে হিন্দুস্তানে, আরেকদিকে লাগলো হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা! সব এই ব্রিটিশ শুয়োড়ের বাচ্চা’গুলোর জন্যে; জানো অরুনেশ, একদিন দেখি, আমার সেই বন্ধু ইয়াসির, আমার দিকেই তরোয়াল উঁচিয়ে তেড়ে এসছে, আমায় কাটবে বলে! তখন আমরা ভারতে আসতে প্রস্তুত হচ্ছি, দেখি ইয়াসির আর ওর বাড়ির লোকজনের সাথে আরও কিছু লোক শ্মশান করে ফেলে আমার বাড়ি! আমার বাবা কাকা’দের মেরে ফেলেছে, আমার ভাই’দেরও মেরে ফেলেছে, আমার মা কাকীমা’দের আর চার বোন’কে নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে খুন করেছে তারাই যারা একদিন, ওদের ভাবীজান বলে প্রণাম করতো! আমি তখন বিষ বছরের ডানপিটে যুবক, কিভাবে জানিনা সাংঘাতিক আহত হয়ে ধরাসায়ী হলেও অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকি কতদিন, তারপর জ্ঞান ফেরে একদিন গভীর রাতে, কোনরকমে আহত অবস্থাতেই পালিয়ে আসি লুকিয়ে ট্রেনে ভারতে; ট্রেনে এক সহানুভূতিশীল ডাক্তার আমায় লুকিয়ে নেন এবং তিনিই আমায় সুস্থ করেন দিল্লী’তে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে, তিনিও ছিলেন মুসলমান!- রাকিবুল ইউনুস; প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা হওয়ার জন্য তাকে ভারত থেকে কেউ সরাতে পারেনি, তিনি পেশোয়ার গিয়েছিলেন রিলিফ ক্যাম্পে”।
এই অবধি বলে গোরক্ষনাথ একটু থামলেন; ঢোক গিলে আবার বলতে শুরু করলেন;
“তার বাড়ি’তেই আমি ছিলাম বছর তিনেক, অকৃ্তদার সাহসী অসামান্য ব্যক্তিত্বের মানুষটি আমায় নতুন করে বাঁচতে শেখালেন, যদিও তখন থেকেই আমার মনে গোপ্ন বিপ্লবের আগুন ফুঁসছে! দেশভাগ’কে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না, কোনভাবেই না! এদিকে রাকিবুল চাচা আমায় দিল্লী ইউনিভার্সিটি’তে ভর্তি করলেন, আমায় সন্তানস্নেহে মানুষ করেন; দিল্লী ইউনিভার্সিটি থেকে আমি এম্ এস্ সি পাশ করি ফার্স্ট্ ক্লাস নিয়ে; আমার লেখাপড়ায় আগ্রহ দেখে তিনি আমায় রিসার্চ করার পরামর্শও দেন কিন্তু…”
আবার থামলেন গোরক্ষনাথ;
“কিন্তু কি?”- প্রশ্ন করলো অরুনেশ। গোরক্ষনাথের চোখ ছলছল করে এলো;
“নাইন্টিন ফিফটি, তিনি এক জনসভায় গুলিবিদ্ধ হন! আহত অবস্থাতেই হসপিটালে উকিল ডেকে সজ্ঞানে নিজের সমস্ত সম্পত্তি আমায় দিয়ে ইহলোক ছেড়ে চলে যান! আমার একমাত্র অভিভাবকও আমায় ছেড়ে…”
চোখ থেকে কয়েক’ফোঁটা জল আঁখিপল্লবের বাঁধ ভেঙে গাল বেয়ে ঝর্নার আকার নেয়; অরুনেশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

“সেদিনই ঠিক করি ও দেশে আর থাকবো না, কিছুতেই না, এ টুকরো দেশ তো আমার হতে পারেনা অরুনেশ, আমি তো গোটা দেশে জন্মেছি, অবিভক্ত ভারতবর্ষে, তাহলে শুধু ভারত কি করে আমার দেশ হতে পারে! যখন-তখন কেউ এল, আর আমার ঘরে ঢুকে বললো, এখান থেকে বেরিয়ে যাও, এটা এখন তোমার নয়, এটা কি মেনে নেওয়া যায়! থাকবোই না, কিন্তু………যাব কোথায়! আর তো আমার কেউ কোথাও নেই! হঠাৎই মনে হলো, কেন, যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ঘটিয়ে আমার দেশ’টাকে টুকরো রুটি বানিয়ে চলে গেলো, তাদের বহাল তবিয়তে থাকার কি অধিকার আছে! তখনই স্থির করলাম, আমি লন্ডন যাব, ওখানেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ওদেশের সর্বনাশ করবো, যতদিনই লাগুক। আর এক মূহুর্তও দেরী করিনি, সদ্য পাওয়া সমস্ত সম্পত্তি বেচে সব টাকা পয়সা নিয়ে চলে আসি এখানে, সেদিন থেকে আর আজও ভারতে ফিরে যাইনি একবারের জন্যেও, এখানে প্রথমে ফার্গুসান স্ট্রীটে থাকতাম একটা মেসের ঘর ভাড়া করে, পরে টেক্সাসে একটা জায়গা কম টাকায় পেয়ে সেখানে পাবলিশিং এজেন্সী খুললাম, অফিসেই থাকতাম, সেখানে আমারই মতো প্রবাসী বাঙালী পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করলাম, এলিনা’র দিদিমা, শর্বরী; ব্যবসা জমে উঠলো, নিজের টাকায় এই বাড়ি করলাম, এলিনা’র মা জন্ম নিলো, ব্যবসা আরও ফুলে ফেঁপে উঠলো, সংসার আর কাজের চাপে আমি আমার উদ্দেশ্যের দিকে আর তাকানোর সময়-সুযোগ কিছুই পেলাম না!
লেখার অভ্যেসটা কলেজ জীবনে একটু-আধটু ছিলো, তারপর এক বন্ধুর নির্দেশে আবার লিখলাম, তখন এলিনার দিদিমা মারা গেছেন কার্ডিয়াক ব্লকে; আমার ছেলে বিশ্বরূপ বিয়ে দিই আমার ব্রিটিশ বন্ধু হেবারের একমাত্র মেয়ে ক্লডিয়ার সাথে, তখনও আমার স্ত্রী জীবিত ছিলেন; উনি মারা যান, তার মাস সাতেক পরেই জন্মায় এলিনা; তারপর এলিনা যখন একটু বড়ো তখন, আচমকা একটা গাড়ি অ্যাকসিডেন্টে আমার একমাত্র ছেলে আর বৌমা দুজনেই একসাথে মারা যায়! আমি আমার ছোট্ট সাড়ে তিন বছরের নাতনী’কে নিয়ে ভীষণ একা হয়ে পড়ি! সে সময় হেবারই আমায় লিখতে বসায়, আমার কিছু বই বেরোয়, মার্কেটে নামও হয়, লিখতে লিখতে আবার আমার পুরনো অভিসন্ধিটা জেগে ওঠে, মনে পড়ে যায় আমার এখানে চলে আসার কারণটা আবারও, আর এক মূহুর্ত অপেক্ষা করিনি আমি; সেদিন থেকে আমার জীবনে দুটো উদ্দেশ্য, এলিনা’কে মানুষের মতো মানুষ করা, আর এই ইংরেজদের সর্বনাশ করা! সেইমতো আমার জীবন কাটতে থাকে, নতুন করে পরিকল্পনা শুরু হয় কিভাবে কি করা যায়, সিদ্ধান্ত নিই পার্টিশানের ভয়াবহ পরিস্থিতি আমি এখানে তৈরী করে ওদের বোঝাবো ওদের পূর্বপুরুষরা কি ক্ষতি করে গিয়েছিলেন আমার দেশের!”
আবার থামলেন গোরক্ষনাথ, এলিনা বুঝতে পারলো দাদুর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে, তাই সে এবার নিজেই মুখ খুললো;
“দাদু আমায় ছোটবেলা থেকেই ভারতবর্ষের ইতিহাস, দর্শন, ভৌগলিক গঠণ, প্রাচীন ঐতিহ্য আভিজাত্য, বিজ্ঞান, পৌরাণিক কাহিণী, ভাষা, সভ্যতা, রাজনীতি নিয়ে শিক্ষা দিয়েছিলেন; দাদুই আমায় উদ্বুদ্ধ করেন এই বিপ্লবে, আমার মধ্যে দেশপ্রেম জাগান, তারপর আমি আর আমার দাদু মিলে এক শক্ত-পোক্ত গোপন পরিকল্পনা করতে শুরু করি।
আমাদের পরিকল্পনা’র জন্য প্রয়োজন ছিলো ব্রিটেনের রাণীর খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠার, সবথেকে কাছের বিশ্বস্ত মানুষ; তাই নিজের দক্ষতার জোরে আমি রাণীর ব্যক্তিগত সচিবের ইন্টারভিউ দিই, চাকরীটা পেয়েও যাই বছর ছয়েক আগে; শুরু হয় রাণীর সবথেকে বিশ্বস্ত হয়ে ওঠার জন্য আমার লড়াই, বিশ্বস্ততা অর্জন করার লড়াই, যেটা মোটেও সুবিধেজনক ছিলো না! অনেকরকম কুপ্রস্তাব আসতে থাকে আমার কাছে, সে রাণীর ব্যক্তিগত ফাইল চেয়েই হোক আর, আমার সাথে রাত্রিযাপনই হোক, সবই হজম করেছিলাম আমি আমার বুদ্ধি দিয়ে এড়িয়ে যেতে যেতে, ততদিনে রাণীর সাথে আমার ভাবটা বেশ ভালোই হয়ে গিয়েছিলো; তাই কিছুটা তার প্রতিরোধেও আমার কাজটা সহজ হতে থাকে; ধীরে ধীরে এমন পরিস্থিতি আসে যখন, রাণী নিজের সব কথাই আমায় বলতেও শুরু করে, অনেক ব্যক্তিগত কাজও করাতে থাকে; এর ফলে লোকমুখে প্রচারিত হয়ে যায়, আমি নাকি রাণীর পরিচারিকা!”
এই পরিস্থিতিতেও মুখ টিপে হাসলো এলিনা; তারপর আবার বলতে শুরু করলো সে;
“এরই মধ্যে একদিন প্রচন্ড স্ট্রেসে রাণীর মাথায় খুব যন্ত্রণা শুরু হয়, তখন সে যন্ত্রণা কাটাতে দাদু আমায় একটা ট্রানজিস্টার দেন, যেখানে নাকি কিছু ধর্মীয় বাণী ছিল; আমি সেটা উপহার দিই রাণীকে; রাণী এতে খুব তৃপ্ত হয়ে আমায় বাহবা দেয়! কিন্তু সেই ট্রানজিস্টারে আসলে ছিল দাদুর গবেষণা করা প্রাচীনতম কিছু দেবনাগরী শব্দে গাঁথা বাণী, যা রাণী বুঝতে না পারলেও রাণীকে ভীষণ রিলিফ দিত মানসিকভাবে; রাণীর তাই নেশা হয়ে গিয়েছিলো রোজ অবসরে মাথার কাছে ঐ ট্রানজিস্টার নিয়ে চালিয়ে শুয়ে থাকার, কিন্তু তিনি বুঝতেই পারেননি ওই বাণীগুলোর আসল কাজ কি!”
আবার মৃদু হাসলো এলিনা; অরুনেশ জিজ্ঞাসা করলো;
“কি?”
“ওই শব্দগুলো ধীরে ধীরে মানুষকে এমনভাবে সম্মোহিত করে দিত, যার ফলে সেই মানুষ একেবারে তার বশ হয়ে পড়ে, যে সে সময় তাকে পরিচালনা করে; এটা বশীকরণ বিদ্যেও বলা যেতে পারে, মানুষের গুরুমস্তিষ্কের মধ্যে ঐ শব্দগুলো এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, যার ফলে সে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে একেবার অবোধ শিশুর মতো হয়ে যায়; যেটা রাণী হয়ে গিয়েছিলো; আরে সেই সময় আমিই পরিচালনা করছিলাম রাণীকে প্রতিদিন, প্রতি মূহুর্তে!”- অম্লান হাসি এলিনা’র মুখে।
“তারপর?”- অরুনেশ জিজ্ঞাসা করলো আবার।
“তারপর আর কি, রাণীর মগজে আমি লন্ডন পার্টিশানের সিদ্ধান্তের বীজ বুনতে থাকি খুব সাবধানতার সাথে; এদিকে দাদুর এমন আরও কিছু প্রয়োজন ছিলো, যাতে শুধু রাণী নয়, রাজ সভাসদ’রা, দেশের সমস্ত প্রথম শ্রেণীর প্রশাসনিক সামরিক অসামরিক কর্তারা, রাণীর পৃষ্ঠপোষকরা, শিল্পপতিরা, বণিকরা, মন্ত্রীসভা আরও অনেকে এবং অনেক সাধারণ জনগণও রাণীর সিদ্ধান্ত খুব সহজে মেনে নেয়”
এবার আবার গোরক্ষনাথ কথা বললো;
“আর এর জন্য দরকার ছিলো প্রচন্ড শক্তিশালী এবং দ্রুততম বিরাট একটা গণ-সম্মোহণ একসাথে ঘটানো; এর জন্যই আমি প্রাচীন ভারতীয় অথর্ব বেদের রাসায়নিক সূত্র-প্রণালী ঘেঁটে এমন এক আয়ুর্বেদিক রাসায়নিক সান্ধ্র পদার্থ আবিষ্কার করি, যার গন্ধ খুব দ্রুত বাতাসে ছড়িয়ে গিয়ে মানুষের ঘ্রাণের সাথে দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করলে মানুষের গুরুমস্তিষ্কের কোষে রাতারাতি এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যাতে দীর্ঘ সময়ের জন্যে সেই মানুষ সম্মোহিত অবস্থায় থাকে, সে সময় যে তাকে পরিচালিত করবে, তারই একানুগত হয়ে থাকে, যত বেশী মানুষ এই গন্ধ নেবে ততোই বেশী সময়ের জন্যে সে সম্মোহিত অবস্থায় থেকে যাবে!”
“ব্রিলিয়ান্ট”- বললো অরুনেশ, অভিভূত হয়ে তাকিয়ে গোরক্ষনাথের দিকে; এবার এলিনা আবার কথা বললো;
“ওষুধ তো তৈরী হলো, কিন্তু এবার অপেক্ষা ছিলো এমন কোন একদিনের, যেদিন এত মানুষ একসাথে এক জায়গায় সমবেত হবে। এরকম দিন লন্ডনে বছরে একবারই আসতে পারে, রাণীর জন্মদিনে; সেটাও চলে এলো; আমি আগেই রাণীর মগজে তার জন্মদিনের দিনই দেশভাগের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করার বাণী একেবারে বসিয়ে দিয়েছিলাম; আমারই কথায়, ঠিক কথায় নয়, বলতে গেলে আদেশেই রাণীর জন্মদিনের সন্ধ্যায় তারই কথায় বাকিংহ্যাম প্যালেসের চূড়ায় ওই বিশালকায় রেডিও ঝোলানো হয় ক্রমাগত পার্টিশান সংক্রান্ত আদেশ নির্দেশ আইন কানুন এবং সর্বস্ব পরিচালনার জন্য; এই কাজে বেতারের চেয়ে বেটার আর কিছু হতে পারেনা”
আবার গোরক্ষনাথ কথা বললো;
“তারপরের ভিডিও ক্লীপিংস্ তুমি এতক্ষণে দেখেই ফেলেছো অরুনেশ; যেটা ক্লোসড্ সার্কিট ক্যামেরায় ধড়া পড়েছিলো, তাই আমার তথ্য পেয়ে তুমি আবার বয়স শুনে আমারই উপর জোর বেশী দিয়েছিলে তোমার তদন্তে, তাই এলিনার পিছু নিয়েছিলে, তাইতো?”
“আপনি তো আমার চেয়ে অনেক এগিয়েই আছেন, তাহলে আজ ভুলটা করলেন কেন?”- বললো অরুনেশ।
“কালচক্র বোঝো? যখন খেলা শেষ হওয়ার সময় ঘটনাচক্রে চলে আসে, তখন এই সামান্য ভুল হওয়াটাও নিমিত্ত মাত্র অরুনেশ, নইলে তুমি নিজেও জোর দিয়ে বলতে পারো না যে, ধরতে তুমি আমায় পারতেই”
অরুনেশ গলা খাঁকরালো। গোরক্ষনাথ আবার বলতে শুরু করলো;
“সেই সন্ধায় অমন অপ্রত্যাশিত বমি করতে করতে খুব দ্রুত আমিই প্যালেস থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেছিলাম, সবাই দেখলেও কেউ আমল দেয়নি এক বুড়োর মদ্যপ অবস্থার বমি ভেবে, সবাই যখন আনন্দে মদে মশগুল তখন, আমি বমির সাথে সেই ওষুধ ছড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে আসি নাক মুখ চাপা দিয়ে আরও বমির উদ্রেকের অভিনয় করতে করতে; বেরিয়ে আসে অন্যদিক দিয়ে এলিনা’ও; আর, ওষুধ তার কাজ ঠিকঠাক করে ফেলে; এদিকে সেই ধাউশ বেতারে রাণীর দেশভাগের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের সাথেই প্রতি খবরের শুরুতে ও শেষে পর্যায়ক্রমে সেই প্রাচীন দেবনাগরী শ্লোক বাজানো হতেই থাকে এলিনা’র মাধ্যমে রাণীর নির্দেশে, যা মানুষ’কে আরও বেশী করে সম্মোহিত করে রাণীর কথায় পরিচালিত করে চলেছে, এই কারণেই অধিকাংশ মানুষ সাধারণভাবে কোন প্রতিবাদ না করে প্রতিরোধ গড়ে না তুলে পার্টিশানকে মেনে নিয়ে রাণীর অনুসরণ করছে। ওষুধের প্রভাব বাতাস থেকে কেটে গেলেও, মানুষ এখনও তাই সম্মোহিত হয়েই রয়েছে, বুঝলে?”
থামলো গোরক্ষনাথ; দীর্ঘশ্বাস ফেললো অরুনেশ; অরুনেশের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টে, এলিনা।
“এবার আপনি কি করতে চান, মিস্টার ভট্টাচারিয়া?”- অরুনেশ বললো।
“এবার আর কি, আমার কাজ শেষ”
অরুনেশ নিজের জায়গা থেকে উঠে এসে গোরক্ষনাথ এবং এলিনার সামনে গিয়ে উটকে বসে বললো;
“একজন ভারতীয় এবং হিন্দুস্তান-পাকিস্তান পার্টিশানের বিরোধী হিসেবে আমি আপনার কর্মকান্ডকে সহস্র কোটি প্রণাম করি গোরক্ষনাথ বাবু; প্রণাম করি নিজের উজ্বল সম্ভাবনাময় যৌবনকে দেশপ্রেমে সঁপে দেওয়ার সাহসকে। সত্যি এত বছর পরেও এভাবে মাত্র দুজনের গোপন বিপ্লবে ঊনসত্তর বছর আগের স্বদেশী প্রতিশোধও এইভাবে নেওয়া যায়, তা যদি সত্যি টুকরো হয়ে যাওয়া দেশে এত বছর ধরে বাস করা মানুষগুলো বুঝতো, তাহলে আজ আমাদের দেশের এই ভোগান্তি হতো না, অন্তত টুকরো দেশটা আবার সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ হতে পারতো, আমাদের মহাগর্বের দেশ, এক অভিন্ন গোটা সেই পূর্বপুরুষের ভারতবর্ষ!”- দীর্ঘশ্বাস ফেললো অরুনেশ; আবার বললো;-
“আপনি সহানুভূতিশীল মানুষ বলেই বলছি, আপনাকে নতুন করে কিছু বলার স্পর্ধা আমার নেই; কিন্তু আপনি কি সত্যিই চান যে, পার্টিশানের জন্যে যে ভোগান্তি আমরা ভুগেছিলাম, যে ভোগান্তি আমরা আজও ভুগছি সে ভোগান্তি সত্যিই লন্ডনের এই প্রজন্ম, আগামী প্রজন্মও ভুগুক! চান কি এখানেও লক্ষ লক্ষ মানুষ একে অপরকে মেরে কেটে মরুক, লক্ষ লক্ষ নারী ধর্ষিতা হোক আবার, আপনার বন্ধু হেবার মারতে আসুক আপনাকে বা তার উত্তরসূরীরা এগিয়ে আসুক এলিনা’কে আপনার মা-বোনদের সেই ঊনসত্তর বছর আগের পরিণতিতে ফেলে দিতে নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে, চান কি! কি হবে সেই ইতিহাসের প্রত্যাবর্তন ঘটিয়ে যা কষ্টকর, কি হবে, তখন ছিল হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, এখানে হবে জন্মসূত্রে ব্রিটিশ আর প্রবাসী’দের দাঙ্গা, ক্ষতি আবার হবে; আবার এই ক্ষতির হিসেব চোকাতে আপনারই মতো কেউ আজ থেকে আবার পঞ্চাশ-ষাট কি সত্তর কি একশো বছর পরে প্রতিশোধ নেবে এই পার্টিশানের আরও আধুনিক উপায়ে; এই কর্মকান্ড কতযুগ ধরে চলবে? প্রতিশোধের নেশ সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নেশা; ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মতো একের পর এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ঘটবে আগামী দিনে ব্রিটিশ ইউনিয়ন আর এমিগ্রান্ট ব্রিটিশ ইউনিয়নের মধ্যে, বারবার, একাধিক বার; যুদ্ধ-যুদ্ধ-যুদ্ধ, আর কত? আর কত যুদ্ধ হবে? আর কত মা’য়ের কোল খালি হবে? আর কত স্ত্রী বিধবা হবে, কত প্রেমিকা তাদের প্রিয়তমকে হারাবে, কত বোন তার ভাই’য়ের ছায়া থেকে সরে যাবে, কত আর! আপনি থাকবেন না, আমিও থাকবো না হয়তো, এলিনাও, কিন্তু ভেবে দেখুন কি ঘটিয়ে যাবেন আপনি, আজ যদি এই ক্ষতি আপনি না আটকান তাহলে ভবিষ্যতে এই পৃথিবীতে তৃ্তীয় বিশ্বযুদ্ধ যে আপনার জন্য ঘটবে না, সেটা আপনি হলফ করে বলতে পারেন গোরক্ষনাথ বাবু? আপনার প্রতিশোধ তো শেষ, এবার অন্তত মুক্তি দিন বিশ্ব’কে এই ভবিষ্যত থেকে; নইলে আপনার সাথে ব্রিটিশ’দের কি তফাত থেকে যাবে?”
গোরক্ষনাথ এতক্ষণ সব শুনলেন নীরব পাথড়ের মতো, এবার তিনি মুখ খুললেন;
“অরুনেশ, আমার ওষুধের অ্যান্টিডোজ্ তৈরীই আছে; আমার এই বাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ডে আমার ল্যাবরেটরী, সেখানেই পেয়ে যাবে; তৈরীর ফর্মূলাও পেয়ে যাবে; বেশী পরিমাণে তৈরী করে যতো তারাতারি সম্ভব বাকিংহ্যাম প্যালেস থেকে ছড়িয়ে দাও বাতাসে সরাসরি; এলিনা তোমায় সাহায্য করবে ওষুধ বানাতে, আর রাণীর মাধ্যমে সেই বেতারের সাহায্যে সমস্ত জনতা’কে আবার একবার বাকিংহ্যাম প্যালেসে সমবেত হতে, রাণী এখনও ওর নিয়ন্ত্রণেই আছে; ওষুধ তৈরী অবধি এলিনার মাধ্যমে রাণী দেশে পার্টিশানে স্থগিতাদেশও জারী করাবে, চিন্তা করো না”।
“অজস্র ধন্যবাদ”- বললো অরুনেশ। মৃদু হাসলো গোরক্ষনাথ, তারপর বললো;
“ধন্যবাদ তোমাকে অরুনেশ, তুমি আমায় অনেক বড়ো পাপের হাত থেকে বাঁচালে; বাঁচালে আমার এলিনা’র ভবিষ্যতও; সত্যিই আমি অন্ধ হয়েগেছিলাম; ধন্যবাদ অরুনেশ; আর মনে রেখো, যখন দেখবে ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে, তখন সেই ধাউশ বেতার আর রাণীর সেই ছোট ট্রানজিস্টার নষ্ট করে দিও, ওগুলোই মহাকাল, সেটা জেনে রেখো; তাতেও এলিনা তোমায় সব রকম সাহায্য করবে, চিন্তা করো না”
“আর আপনি?”- অরুনেশ জিজ্ঞাসা করলো।
“আমার আর কি, আমার দোষ ধড়া পড়েছে, আমার তো মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত; শুধু এলিনা’কে তুমি রক্ষা করো, ওর পুরো জীবন আছে, ওর কোন দোষ নেই!”
“যদি পার্টিশান আটকে যায় ফাইনালি, তাহলে দোষ তো আপনারও থাকবে না গোরক্ষনাথ বাবু”
“সেটা তুমি কাউকে বোঝাতে পারবে না অরুনেশ”
“কাউকে বোঝানোর কোন দরকারই নেই; আপনার যেতে ইচ্ছে করে না নিজের দেশে? এলিনা’কে তার সত্যিকারের মাতৃভূমি দেখাতে ইচ্ছে করে না? যে দেশের জন্য এলিনা এতো বড়ো রিস্ক নিয়ে নিলো, সে দেশে ওকে আনন্দ করতে দেখতে ইচ্ছে করে না? সে দেশে এখনও ভোরে পাখী ডাকে, এখনও সূর্য তাপ দেয়, এখনও চাঁদ’কে দেখে অনেক নবীন কবিরা কলম ধরে, এখনও বসন্তে ফুল ফোটে, যাবেন না দেশে? চলুন না, শেষ জীবনটা নয়, ওখানেই কাটিয়ে আসবেন”
আবেগপ্রবণ গোরক্ষনাথের চোখের জল বেয়ে নেমে এল, সে তাঁর কাঁপা হাত’দুটো এগিয়ে অরুনেশের হাত’দুটো চেপে ধরে বললো;
“পারো নিয়ে যেতে?”
“আপনি অনুমতী দিয়েই দেখুন না একবার”- বললো অরুনেশ আশ্বাসী ভঙ্গিমায়।
“য……যাব”
অরুনেশ মূহুর্তে উঠে দাঁড়িয়ে সেই ব্রিটিশ অফিসারের দিকে বন্দুক তাক করে গুলি চালালো সরাসরি কপাল লক্ষ্য করে; মূহুর্তে একটা বীকট আর্তনাদের সাথে অফিসারের দেহটা লুটিয়ে পড়লো; এলিনা চেঁচিয়ে উঠলো;
“কি করলে!”
রাজপুত হেসে বললো;
“দিস ইজ্ অরুনেশ চ্যাটার্জী, ম্যাডাম”।
ফ্লাইটে করে ভারতে ফিরতি আকাশপথে টি ভি-তে নিউজ হেডলাইন্স্ দেখলো অরুনেশের দল আর গোরক্ষনাথ এবং সদ্য কাজে ইস্তফা দিয়ে আসা এলিনা;
‘লন্ডনের পার্টিশান শেষ পর্যন্ত রোধ করলেন রাণী; বিশাল বেতার ভেঙে ফেলা হয়েছে; অবস্থা এখন স্থিতিশীল; যারা অন্যত্র চলে গিয়েছিলেন তারা আবার বাড়ি ফিরছেন; অবস্থা এখন স্থিতিশীল, সঠিকভাবে কি হয়েছিলো তা এখনও জানা যায়নি, তদন্ত চলছে।–ব্যুরো রিপোর্ট, লন্ডন নিউজ্ টাইমস্’।
গোরক্ষনাথ মৃদু হাসলেন; এলিনা আর অরুনেশ পরস্পরের সাথে হাল্কা রোম্যান্টিক দৃষ্টি-বিনিময় করলো, সেটা দেখেও মৃদু হাসলেন আবার গোরক্ষনাথ। বন্ধুরা, তোমরাও কি মৃদু হাসছো?
___________________________

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.