নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রেম

প্রেম বড় অদ্ভূত স্ববিরোধ শুয়ে থাকে আনাচে কানাচে

অবাক মানুষ

আমি প্রতিদিন জন্ম নিই এবং প্রতিদিন যাই মরে আমি প্রতিদিন যাই ভেঙ্গে আবার প্রতিদিন উঠি গড়ে

অবাক মানুষ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মায় যে আমার কত কাছে রয়

১২ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১২:৩১



বাংলা গানে মা। কাজল কানন এই বিষয়ে গদ্য লিখতে বলাতেই রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু আমি কি জানিনা আমি যে গদ্য লেখক নই? জানি জানি। তবু আগ্রহী হয়ে উঠলাম এই কারনে যে গান আমার প্রিয়তম বিষয়। আর মা? আশা করি উত্তরের প্রয়োজন নেই। যা জানা প্রয়োজন তা আবারো জানাই,আমি গদ্যের কারিগর নই। সুতরাং মায়ের গান নিয়ে লিখতে গিয়ে আমার পক্ষে তত্ত্ব,তথ্য,ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হাজির করা সম্ভব নয়। যা সম্ভব তা হোল মাকে নিয়ে গান শোনার আমার ব্যাক্তিগত আবেগ অনুভব উপলব্ধি আর অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করা। আমি এখানে সেই চেষ্টা টুকুই করবো।



***

মাকে নিয়ে আমার প্রথম শোনা গান কোনটি? আজ আর মনে পড়েনা। তবে পেছনে ফিরে তাকালে প্রথম যে গানটির কথা মনে হয়, তা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমরা সকলেই গেয়ে উঠেছি



ওমা ফাগুনে তোর আমের বনের ঘ্রাণে পাগল করে

ওমা অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি

মধুর হাসি।।



কী শোভা কী ছায়া গো,কী স্নেহ কী মায়া গো-

কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।



সেই শৈশবেই ওই লাইন গুলো আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। আজো প্রিয়।

জানি জানি। মার গান লিখতে বসে আমি যে দেশের গান দিয়ে শুরু করেছি আর তা করেছি সচেতন ভাবেই এবং আরো করতে থাকব। কারন বাংলা গানে মাতৃভূমিকে মা রূপে রেখে অজস্র গান লেখা হয়েছে। তো সে গুলো আমি এড়াবো কী করে? আর এড়াবোই বা কেন? সুতরাং এই সুযোগে দেশ মাকে নিয়ে লেখা আরো কিছু গানের কথা বলে ফেলা যেতেই পারে।



মাতৃভূমিকে নিয়ে লেখা গানের কথা শুরু করলাম রবীন্দ্রনাথ দিয়ে। কিন্তু ঠাকুরে বেশীক্ষণ থাকা যাবেনা। কারন গীতবিতানে তার স্বদেশ পর্যায়ে এত এত এ বিষয়ক গান রয়েছে যে এ নিয়ে বোধ করি অনেক লেখা হয়েছে এবং আরো হবে, কিন্তু আমরা ঠাকুরের বৃত্তের বাইরে যেতে চাই, তবে তার আগে আরেকটি গানের কথা না বললেই নয়।



ওগো মা তোমার কোলে জনম আমার,মরণ তোমার বুকে

তোমার পরে খেলা আমার দুঃখ সুখে।



তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে

তুমি শীতল জলে জুড়াইলে

তুমি যে সকল সহা সকল বহা মাতার মাতা ।।



এই গানটি লেখা হয়েছিল ১৯০৫ সনে বঙ্গ ভঙ্গের সময়ে। ঠাকুরের অজস্র গানের মত মাতৃভূমিকে নিয়ে লেখা এ দুটি গান সমস্ত বাঙ্গালীকেই যে কম বেশি আপ্লুত করে তা বলে দিতে বোধ হয় কারো সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ হবার দরকার নাই।



***

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক ধারায় অভূতপূর্ব জোয়ার এনেছিল। সেই জোয়ারে উল্লেখযোগ্য ভাবে প্লাবিত হয়েছিল বাংলা সংগীতও। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রকে ঘিরে তখন প্রচারিত হচ্ছিল অজস্র দেশ গান। সেই সময়ের দুটি গানের কথা উল্লেখ না করলেই নয়, যে দুটি গানে কথা সুর আর গায়কী মিলিয়ে এমন অসাধারন মেলোডি তৈরি হয়েছিল যে আজো যে কোনো শ্রোতাকে দারুন ভাবে আবেগায়িত করে। দুটি গানেরই মূল শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন।

০১

জন্ম আমার ধন্য হল মাগো

এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাকো।।



তোমার কথায় কথা বলি পাখির গানের মত

তোমার দেখায় বিশ্ব দেখি বর্ণ কত শত

তুমি আমার খেলার পুতুল আমার পাশে থাকো মাগো

এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাকো।।

এই গানটির গীতিকার নয়ীম গহর এবং সুরকার আজাদ রহমান

০২

ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা

রূপের সুধায় হৃদয় আমার যায় জুরিয়ে

ও মার বাংলা মাগো...



শ্যামল মেঘের ভেলায় চড়ে আষাঢ় নামে তোমার বুকে

শ্রাবণ ধারায় বরষাতে কি সিনান করিস পরম সুখে

নীলাম্বরী শাড়ি পড়ে শরত আসে ভাদর মাসে

অঘ্রাণে তোর ধানের ক্ষেতে সোনা রঙ্গে ফসল হাসে



নিত্য চাষির কুঁড়েঘরে দিস মাগো তুই আঁচল ভরে

পৌষ পাবনের নবান্ন ধান আপন হাতে উজাড় করে।।

গীতিকার আবুল ওমারাহ মোঃ ফখরুদ্দিন সুরকার আলাউদ্দিন আলী



স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের এই পরযায়টি শেষ করব গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর ও গায়কীতে একটি গানের কথা দিয়ে যা ব্যাক্তিগত ভাবে আজো আমাকে উজ্জীবিত করে।



মাগো ভাবনা কেন

আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে

তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি

তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি



আমরা হারবোনা হারবোনা

তোমার মাটির একটি কণাও ছাড়বোনা

আমরা পাঁজর দিয়ে দুর্গ ঘাঁটি গড়তে জানি

তোমার ভয় নেই মা আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।।

***

এই ধারাবাহিকতায় এবং আবহে আশির দশক প্রজন্ত অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। তবে আমি এক লাফে নব্বইয়ের গণ আন্দোলন চলাকালীন সময়ে প্রকাশিত একটি এ্যালবামের প্রসঙ্গে চলে আসতে চাই। এ্যালবামটির নাম ছিল “শঙ্খ বাজুক” যার উপশিরোনাম ছিল “যুদ্ধ ও জীবনের গান”



এই পুরো এ্যালবামটিই আমাকে মারাত্মকভাবে আলোড়িত করেছিল আন্দোলিত করেছিল। এবং এর সব গুলো গান যিনি লিখেছিলেন সুর করেছিলেন গেয়েও ছিলেন তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য আমি মোহগ্রস্তের মত কখনো তাঁর অস্থায়ী বাসস্থানে কিংবা নিয়মিত আড্ডাস্থলে হন্যে হয়ে খুঁজে বেরিয়েছি কিন্তু সামান্য সময়ের হেরফেরে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি আজো। সেই সময়ে খুব বেশি পরিচিতি না থাকলেও এখন তিনি যথেষ্ট পরিচিত এবং জনপ্রিয়। তাঁর নাম মাহমুদুজ্জামান বাবু। সেই প্রিয় এ্যালবাম থেকে দুটি গানের কথা উল্লেখ করছি

০১

ঘুমিয়ে ছিলাম ঘুমের দেশে ঘুমিয়ে ছিলাম আমি

জাগালে মাগো দেখালে আমায় বিপন্ন স্বদেশভূমি



কতনা রক্ত ঝরেছে এখানে মৃত্যু শীতল রাতে

হায়েনার থাবা কেড়েছিল সব ঘাতকের কালো হাতে

তবুও ক্ষমা পেয়েছে ওরা ক্ষমা করনি তুমি...

০২

কেঁদো না মা কেঁদো না

তোমাকে কাঁদিয়ে পথ ছেড়ে যাবনা

তোমাকে কাঁদিয়ে ঘরে ফিরে যাবনা

রুমিরা কখনো পথ ছাড়ে না।।



ছিল যখন মাগো পাথর সময়

আপোষের চোখে ছিল ভীরুতার ভয়

নিজের দুঃখ তুমি ফেরালে হেলায়

তোমার আঁচলে উড়ে ফিরে এলো জয়।।



সম্ভবত এই এ্যালবামটি শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে সেই সময়টিতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন চলমান ছিল। গানে উল্লেখিত রুমি জাহানার ইমামের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান রুমিকেই স্মরণ করা। প্রাসঙ্গিকক্রমে বলে রাখি মাহমুদুজ্জামান বাবুর মত এই এ্যালবামের সংগীত পরিচালক বাপ্পা মজুমদারের কুশলতাও ছিল মুগ্ধ হবার মত। যদি ভুল না হয় তবে এটাই দুজনের প্রথম এ্যালবাম ছিল।

***

এই পরযায়ে এসে এইবার আমি খানিকটা অসহায় বোধ করছি। আমার প্রিয় এবং জনপ্রিয় এত এত মায়ের গান মাথায় এসে ঘুরপাক খাচ্ছে যে কোনটা আগে আর কোনটার কথা যে পরে বলবো বুঝতে পারছিনা। ওই যে মনে আছে তো? আমি যে গদ্যকার নই? তাই এত হিমশিম খাচ্ছি। ভাল হতো যদি এক সঙ্গে সব গুলো গানের কথা বলে ফেলা যেতো। তা যখন সম্ভব নয় তখন সংক্ষিপ্তভাবে বেশ কিছু গানের কথা বলে ফেলি। কিন্তু খবরদার কেউ যেন আবার ধারাবাহিকতার প্রশ্ন তুলবেন না। প্লীজ।



* মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে

মাকে মনে পরে আমার মাকে মনে পরে।

কৈশোরে প্রথম শোনা থেকে আজো ভালোলাগা বিদ্যমান।



* মায়ের একধার দুধের দাম

কাটিয়া গায়ের চাম, পাপোষ বানাইলে ঋণের শোধ হবেনা

এমন দরদী ভবে কেউ হবেনা আমার মাগো

আজো বাংলার শহরে ও গ্রামে সমানভাবে সমাদৃত।



* মা আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিল

সকলি ফুরায়ে যায় মা

জনমের শোধ ডাকি গো মা তোরে

কোলে তুলে নিতে আয় মা

সকলি ফুরায়ে যায় মা

দরদী শিল্পী পান্নালালের কথা হয়তো অনেকেই জানেননা, কিন্তু তার গাওয়া এই গান শোনেননি এমন বাংলা ভাষাভাষী শ্রোতা হয়তো খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর হবে।



* পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে তব

মাগো বল কবে শীতল হবো

কত দূর আর কত দূর বল মা।

মরুতীর্থ হিংলাজ সিনেমায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া এই গানের শিল্পী,সুরকার এমনকি ছবির নাম না জানলেও আপামর বাঙ্গালীর কাছে এই গান অতি চেনা আর প্রিয় তো বটেই আজকাল মোবাইল কোম্পানির প্রচার প্রসারেও তা সমাদৃত। আমি জানি বাঙালি মাত্রই সুররসিক তাই আপনারাও এইসব গানের কথা ভাল করেই জানেন, যেমন জানেন লালন সাইজীর এই গানটি



* বলি মা তোর চরণ ধরে,ননী চুরি আর করবোনা

আর আমারে মারিসনে মা।



কিংবা হারিয়ে যাওয়া মাকে ফিরে পাওয়ার আকুলতা প্রকাশে গেয়ে ওঠা নির্মলা মিশ্রের সেই আসাধারন গান



* ও তোতা পাখিরে শিকল খুলে উড়িয়ে দেব

মাকে যদি এনে দাও,আমার মাকে যদি এনে দাও



ঘুমিয়ে ছিলাম মায়ের কোলে কখন যে মা গেল চলে

সবায় বলে ওই আকাশে লুকিয়ে আছে খুঁজে নাও

ও তোতা পাখিরে...

***

আপনাদের কাউকে কাউকে স্মৃতি কাতরতায় পেয়ে বসেছে কিনা জানিনা, তবে আমাকে পেয়ে বসেছে। কিন্তু এতে ভাবার কোনো কারন নেই যে অধুনা সময়ের গানের কোনো খোঁজ খবর আমার কাছে নেই। আছে। এবং মাকে নিয়ে এই সময়ের অনেক গানও আমার পছন্দের। কিন্তু তার আগে আরো কিছুটা সময় পেছনে ঘুরে আসা যাক। কৈশোরে সিনেমা হলে গিয়ে বাংলা সিনেমা দেখায় আমি ছিলাম ওস্তাদ লোক। সেই সব সিনেমা এখনো মাঝে মাঝে টেলিভিশন বা ডিভিডির কল্যাণে নতুন করে দেখতে বসলে নিজের রুচি আর ভালোলাগা নিয়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। কিন্তু যখন সেইসব সিনেমার গানের প্রসঙ্গে আসি তখন আবার মনে ফিরে আসে সস্তি । মনে হয় আহা সহজ কথা সুর আর মায়াবী কণ্ঠের সমন্বয়ে কত কত শ্রোতা প্রিয় গান ছিল আমাদের। তো “বাংলা সিনেমায় মায়ের গান” এমন একটা উপশিরোনামে কয়েকটা গানের কথা তো বলাই যায় তাইনা?



এটা কোনো গবেষণাপত্র নয়,শুধু ব্যাক্তিগত শ্রুতি অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয় চলচ্চিত্রে মাকে নিয়ে গানে সব থেকে শ্রোতা প্রিয়তায় এগিয়ে মোঃ খুরশিদ আলম এবং রুনা লায়লা। বিশেষ করে “সমাধি” চলচ্চিত্রে খুরশিদ আলমের গাওয়া



মাগো মা ওগো মা আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা

আমি দুনিয়া ছাড়ি যেতে পারি তোকে আমি ছাড়বনা

আজো সুপারহিট গানের তালিকায়। এবং একই সঙ্গে “শহর থেকে দূরে” সিনেমার খুরশিদের আরেকটি গানও জনপ্রিয়



মা তুই বেহেস্তেরই ফুলের হাসি মা

মা তুই দুনিয়াতে খোদার ছায়া মা

পাইছি তোরে এই জীবনে আর কি ভাবনা

ঠিক তেমনি বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক লিজেন্ড শিল্পী মোঃ আব্দুল জাব্বারের গাওয়া “মতি মহল” ছবির “ মাগো তোর চরণ তলে বেহেস্ত আমার” গানটিও সেই সময়ের আরেকটি শ্রোতাপ্রিয় গান



এবার আসি রুনা লায়লার গানের প্রসঙ্গে। তিনি বাংলা সিনেমায় মাকে নিয়ে একাধিক গান করেছেন, আমার স্মৃতিতে থাকা অন্তত তিনটি গানের কথা উল্লেখ করতে পারি যার দুটি গানই “আগুন” নামক ছায়াছবির



০১ মাগো তোর কান্না আমি সইতে পারিনা

দোহাই মা আমার লাইগা আর কান্দিস না। এবং



০২ মাগো তুমি যেওনা আমায় একা ফেলে

এ ছাড়া “প্রতিনিধি” ছবিতেও মা কেন্দ্রিক দুটি গান ব্যবহৃত হয়েছে সেখানেও রুনা লায়লার একটি গান ছিল এরকম



যেওনা যেওনা যেওনা মা

আমাকে ফেলে চলে যেওনা

অন্যটি প্রিয় শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে সেই সময়ে অনেক শ্রোতার মুখে মুখে উচ্চারিত গানটি হোলো



সবায় বল মা-মা

মায়ের দাম কি হয়?-না

পৃথিবীতে মায়ের নেই তুলনা

মাগো তোমার নেই তুলনা।



তবে এই সময়কাল থেকে আরেকটু পেছনে ফিরে তাকালে “ ডুমুরের ফুল” সিনেমার

"করো মনে ভক্তি মায়ের থাকতে হাতে দিন"

এবং অনন্য সঙ্গীত স্রস্টা খান আতাউর রহমানের “দিন যায় কথা থাকে” ছবির



মায়ের মত আপন কেহ নাইরে

মা জননী নাইরে যাহার ত্রিভুবনে তাহার কেহ নাই



গান দুটি স্মরণ করা উচিত। তবে প্রয়াত মান্না অভিনীত আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া আম্মাজান চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত



আম্মাজান আম্মাজান আপনি বড় মেহেরবান

জন্ম দিছেন আমায় আপনার দুগ্ধ করছি পান

সম্ভবত বাংলাদেশের সিনেমা জগতে মাকে নিয়ে সবচে সারা জাগানো গান যা সিনেমা না দেখা ব্যাপক মানুষের কানেও পৌঁছে গিয়েছিল।



যাইহোক এইবার সিনেমায় ব্যবহৃত গানের প্রসঙ্গে সকলের জানা একটি কথা আমি আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি আর তা হোল সিনেমায় ব্যবহৃত গান সৃষ্টি হয় কাহিনীর প্রয়োজনে, সুতরাং কাহিনী থেকে আলাদা করে নিলে দেখা যাবে অনেক গানই তখন স্বতন্ত্র শক্তি নিয়ে দাঁড়াতে পারছেনা। চলচ্চিত্রের গানের এই সীমাবদ্ধতা আমাদের কোনভাবেই ভুলে গেলে চলবে না।



চলচ্চিত্রের গান নিয়ে অনেক হোল। এই পরবটি শেষ করব আমার শোনা সিনেমায় সরবশেষ সুন্দর ও শ্রোতাপ্রিয় “স্বামী স্ত্রীর ওয়াদা” চলচ্চিত্রে কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া একটি গানের কথা লিখে। এই গানটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল শ্রেষ্ঠ শিল্পী এবং কবির বকুল শ্রেষ্ঠ গীতিকারের শাখায়



একটা চাঁদ ছাড়া রাত আঁধার কালো

মায়ের মমতা ছাড়া কে থাকে ভাল

মাগো মা মাগো মা তুমি চোখের এত কাছে থেকে দূরে কেন বল না



খাঁচার পাখি খাঁচায় বসে দূরের আকাশ দেখে

কেমন করে ঘুমাও মাগো আমায় একা রেখে

***



এবার কিছুটা দৃষ্টি দেয়া যাক আমাদের অডিও শিল্পে যারা এককভাবে এবং ব্যান্ডদলের মধ্য দিয়ে সঙ্গীত চর্চা করছেন। এই মাধ্যমে মাকে নিয়ে গানের কথা আলোচনা করতে চাইলে আমার প্রথমেই মনে আসে ফেরদৌস ওয়াহিদের তুমুল আলোড়ন তোলা একটি গান



এমন একটা মা দেনা এমন একটা মা দেনা

যে মায়ের সন্তানেরা

কান্দে আবার হাসতে জানে

ফেরদৌস ওয়াহিদকে আজও টিকিয়ে রাখার জন্য তার গাওয়া যে কয়েকটি গানের ভূমিকা রয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম।



সম্ভবত কাছাকাছি সময়েই মাকে নিয়ে কুমার বিশ্বজিতের একটি গানও বেশ শ্রোতা প্রিয়তা পায়



সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে

সেই কথা সত্যি হয়েছিল আমার মায়ের জীবনে

যদিও এই গানে যে আদর্শ মায়ের কথা বলা হয়েছে তা এক সময়ের বাংলা সিনেমায় যে ধরনের আদর্শ মা আর আদর্শ স্ত্রীর চরিত্র নির্মাণ করা হোত অনেকটা সেই রকমের এবং যা ছিল পুরোপুরি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। এইখানে এসে একটি বেদনার কথা বোধ হয় বলে ফেলা যায়। আমাদের সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় বাংলা গান যতটা সময় ধরে চর্চিত হয়ে এসেছে সেই তুলনায় লিরিকের মান অত্যন্ত হতাশাজনক। বিশেষত যখন থেকে বাংলাদেশে গানের ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে গানের বাজার তৈরী হয়েছে এবং পেশাদার গীতিকারদ্বারা গান লেখা হচ্ছে বলা যায় তখন থেকেই লিরিকের মান যেন আরও নিম্নমুখী। যদি ভাল করে খেয়াল করতে চান তবে জনপ্রিয় যে কোনো গানের লিরিকটা একবার লিখে তারপর পড়তে থাকুন, আমার ধারনা অধিকাংশ সময়েই আপনি হতাশ হবেন। বিশ্বজিতের গানটি নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলছিলাম সেটা আরেকটু খোলাসা করতে এই গানটির একটি অন্তরায় যাই



রোজ রাতে বাবা আমার ফিরতো বাড়ি

তাস খেলায় ভাগ্যেরে যাচাই করি

মা আমার থাকতো বসেই ভাতের হাড়ি গরম করে আগুনে

সেই কথা সত্যি হয়েছিল আমার মায়ের জীবনে



এই হোল পুরুষ গীতিকারের মায়ের বর্ণনা এবং এই মায়ের চরিত্র একটু দুখি দুখি না হলেও যেন ঠিক মানায়না। প্রসঙ্গক্রমে এই ধরনের আরেকটি গানের উদাহরণ দেই, গানটির কারিগর মূলত শাহ্‌ আলম সরকার তবে গানটি জনপ্রিয়তা পায় মমতাজের দরদী গায়কিতে



মায়ের কান্দন যাবজ্জীবন

দুই চারমাস বোনের কান্দন রে

ঘরের পরিবারের কান্দন কয়দিন পর আর থাকেনা

দুখের দরদী আমার জনম দুখি মা



এখানে লক্ষ্যনীয় যে মায়ের প্রতি মমতা দেখাতে গিয়ে ঘরের পরিবার অর্থাৎ নারীর প্রতি পুরুষীয় দৃষ্টিভঙ্গিটির সরল প্রকাশ ঘটে গেছে।



যাইহোক এই বিষয়ে আমরা আর কথা বাড়াবো না। তা ছাড়া শুরুতেই বলেছি যে গানের তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা আমার কম্ম না। আমরা বরং ফিরে যাই অডিও ইন্ডাস্ট্রির প্রস্তুতকৃত মায়ের গান প্রসঙ্গে।



দশমাস দশদিন ধরে গর্ভে ধারণ

কষ্টের তীব্রতায় করেছে আমায় লালন,

হঠাৎ কোথায় না বলে হারিয়ে গেল

জন্মান্তরের বাঁধন কোথা হারালো।

সবাই বলে ঐ আকাশে লুকিয়ে আছে

খুঁজে দেখ পাবে দূর নক্ষত্র মাঝে।

রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস

কোথায় আছে কেমন আছে মা।

ওরে তারা রাতের তারা মা“কে জানিয়ে দিস

অনেক কেঁদেছি আর কাঁদতে পারিনা।



আমি কিছু বলার আগেই ভাল করে জানি যে এই শিল্পীর নাম আপনাদের সকলেরই জানা। তিনি বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতের জগতে অনন্য সাধারণ কণ্ঠ আর গায়কীর অধিকারী জেমস। হিন্দি সিনেমায় গান গেয়ে বিশ্ব পরিচিতি পাবার পর মহেশ ভাট যাকে বলেছিলেন এশিয়ার জিম মরিসন। আমি যদি ভুল না করি তো এই গানটির গীতিকার সুরকার প্রিন্স মাহমুদ। যিনি অসংখ্য শ্রোতাপ্রিয় গানের স্রষ্টা। তুলনামূলকভাবে এই গানের লিরিকটি চমৎকার। এখানে উল্যেখ্য যে শুরু থেকে অধ্যাবধি জেমসের গাওয়া গানের লিরিকের মান আর দশটা শিল্পীর তুলনায় বেশ ভাল এবং বৈচিত্রপূর্ণ। এই ধারাবাহিকতায় আরেকজন গুণী গীতিকারের একটি গান দিয়ে এই পর্বটি শেষ করতে চাই। গানটি গেয়েছিলেন ক্লোজআপ ওয়ানের একজন প্রতিযোগী শিল্পী রাশেদ। খুবই আসাধারন গেয়েছিলেন তিনি। গীতিকার ছিলেন আসিফ ইকবাল আর সুরকার শওকত আলী ইমন।



ওই আকাশের তারায় তারায় চাঁদের জোছনায়

ঝিরি ঝিরি কাঁপন তোলা উদাসি হাওয়ায়

আমার হৃদয় জুড়ে আছো স্মৃতির পাতায় পাতায়

স্মৃতির বুকে অশ্রু ঝরে হৃদয় ভেসে যায়

আমি খুঁজেছি তোমায় মাগো আমি খুঁজেছি তোমায় ।।

***

লেখাটি আর খুব বেশি দিরঘায়ীত করা উচিৎ নয় মনে হবার পরেও আমি আরও কিছুটা বলে নিতে চাই। বোধ জন্মাবার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত মাকে নিয়ে অসংখ্য গান শুনেছি। কোনোটি ভাল লেগেছে কোনোটি লাগেনি। অনেক গান যেমন আজও স্মৃতিতে গেঁথে আছে আবার অনেক হয়তো শোনার পরপরই মন আর মাথা থেকে সরে গেছে। কিন্তু মা প্রসঙ্গ এলেই একটি গানের যাদুকরী দুটি লাইন আমার মন আর মাথায় দুম করে সব গানের ভীর ঠেলে অগ্রভাগে চলে আসে। সেই গানটি রজ্জব দেওয়ানের। রজ্জব দেওয়ান নামটির সাথে শৈশবেই পরিচিত হই আমার বাবার মাধ্যমে। বাবা তার গান গাইতে ভালবাসতেন। এরপর নিজের যখন নানান জায়গায় রাত জেগে বয়াতি গান শোনার সুযোগ হয়, তখন দুয়েকবার আমি সরাসরি তার গান শুনেছি। সেই রজ্জব দেওয়ানের যাদুকরী লাইন দুটি হোল



হঠাৎ পাইলে আঘাত মা শব্দটি মুখে লয়

মায় যে আমার কত কাছে রয়



আমি এখনো আপন মনে গাইতে গিয়ে চমকে উঠি। মায়ের সঙ্গে সন্তানের নৈকট্য কতটা গভীর হতে পারে তা অসাধারন উপলব্ধির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এই জন্যই একে আমার যাদুকরী লাইন মনে হয়।



সাম্প্রতিক সময়ে এসে আরেকটি গানের লিরিক আমার বোধে সেই উপলব্ধি এনে দিয়েছে, যে গানটি লিখেছেন কবি আরিফ বুলবুল।



সারাদিন শত কাজে সুখে দুখে বেদনার মাঝে

কেটে যায় সন্ধ্যা সকাল

অবসরে ভাবি কত আকাশ পাতাল



বাতাসের মাঝে থেকে যেমন ভুলে যাই বাতাসের কথা

তেমনি তোমায় ভুলে থাকি মা মনেতে নিওনা ব্যাথা



অর্থাৎ মায়ের অনুভব আমাদের অস্তিত্বের সর্বস্বজুড়ে এমনভাবে উপস্থিত যে বাতাসের মাঝে থেকে যেমন ভুলে যাই বাতাসের কথা ঠিক তেমনি মাকে আর আলাদা করে স্মরণ করবার প্রয়োজন হয়না। কারন মা যেন সন্তানের অস্তিত্ব জুড়ে মিলেমিশে একাকার।

***

যাইহোক, অনেক হোল। বুদ্ধিমানেরা বলে থাকেন থামতে জানাও নাকি শিল্পের অন্যতম শর্ত। সুতরাং আমিও থামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। শুধু এইটুকু আবারও বলে রাখি, এখানে কেবলই লেখকের ব্যাক্তিগত শ্রুতি অভিজ্ঞতা প্রকাশিত হয়েছে। লিখতে গিয়ে হয়তো এরচেয়েও আরও ভাললাগা কোন মায়ের গান বাদ পড়ে গেল। এমনকি সময়ের সীমাবদ্ধতার কারনে মাকে নিয়ে আমার আরও অনেক অনেক পছন্দের গানের কথাও উল্যেখ করা হল না। যেমন বলা হল না



কবির সুমনের- প্রথম মা

নচিকেতার – ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার

প্রতুলের – আমার মাগো তোর চোখে কেন জলের ধারা

কিংবা মৌসুমি ভৌমিকের- তোর জন্য শরীরের ভারে আমি নত



শুধু শেষমেষ এসে কিছুতেই অবদমন করা গেলনা আমার নিজের লেখা সুর করা একটি মায়ের গান থেকে,কী করে সম্ভব হবে বলুন আমি তো আর মহা পুরুষ নই! তা ছাড়া গানটি যে আমারও খুব ভাল লাগার গান!



আমার কখন ভুল হবে, আর কখন হবে যে ঠিক

আমি কখন ছুটতে ছুটতে হারিয়ে যাবো দিকবিদিক

আমি কখন বুঝবোনা কোন্ শব্দের কোন্ মানে

আমার মা সব জানে আমার মা সব জানে।



আমি কোন্ খেলাতে হারবো, পাবো কোন্ খেলাতে জয়

হবে কোন্ মানুষে বন্ধু, পাবো কোন্ মানুষে ভয়

আমি কখন মুখ লুকাবো কোন্ লজ্জায়, অপমানে

আমার মা সব জানে আমার মা সব জানে।



আমি কোন্ ইচ্ছের ঘুড়ি হয়ে নীল আকাশে উড়বো

আমি কোন্ না পারা রোদে, ক্ষোভে যন্ত্রণাতে পুড়বো

আমি কখন এসে মিলাবো সুর বদলে যাওয়া গানে

আমার মা সব জানে আমার মা সব জানে।





ছোট কাগজ "ধাবমান" ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই মে, ২০১৩ দুপুর ১:৪৩

আদনান মাননান বলেছেন: Click This Link

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.