![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মা, আমি অনেক বড় হয়ে গেছি।
আমি এতো বড় কবে হলাম?
মনে আছে-যখন ছোট ছিলাম তখন আমি ছোট্ট ছোট্ট পায়ে তোমার কাছে এসে গুটগুট করে জিজ্ঞেস করেছিলাম-আকাশের রঙ নীল কেন মা?
তুমি তোমার অদ্ভুত কল্পনা দিয়ে মিশিয়ে দেব-দত্যি-দানো মিলিয়ে একটা উত্তর দিয়েছিলে আর সেই উত্তর শুনে আমি রোজ মেঘের খাঁজে দেবদানো খুঁজে বেড়াতাম। আর যখন বৃষ্টির সময় আকাশে গুড়ুগুড়ু আওয়াজ হতো-আমি বলতাম-ওই দেখো দত্যিরা যুদ্ধ করছে আর কড়কড়িয়ে বাজ পড়লে ভাবতাম ওরা দারুণ রেগে গেছে আর ভয়ে তোমার বুকে মুখ লুকাতাম আর তুমি তখন বলতে বাবা-ভয় পাসনা-আমি তো আছি।
এরপর আমি বড় হয়ে গেলাম।
বিজ্ঞান বইয়ের কড়কড়ে পাতা আমাকে শেখালো যে নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘের জন্য আকাশ নীল আর বজ্রপাত মানে মেঘে মেঘে ঘর্ষণ-কোন দৈত্যের যুদ্ধ নেই তাতে।তখন আমি মেঘের মাঝে দেবদানো খোজা বন্ধ করে দিলাম কারণ জানতাম ওইখানে শুধুই শূণ্যতা। আর যখন মনে হতো এই সত্যিকারের শূণ্যতা থেকে আমার তুচ্ছ মিথ্যেকারের দেবদানোয় ভরা আকাশ অনেক মিষ্টি ছিলো-তখনই আবার নিজেকে ঝাড়ি মেরে বলতাম-বড় হও।
বড় হলাম।তবু...তবু যখন আকাশ কেঁপে খড়খড়িয়ে বাজ পড়তো আমার খুব ভয় হতো মা। দৌড়ে গিয়ে তোমার আচলে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করতো আর তোমাকে বলতে ইচ্ছে করতো-মাগো-ভয় কি? তুমি তো আছো!
কিন্তু আমি বড় হয়ে গিয়েছিলাম । বড় মানুষদের বাজ শুনে ভয় পেতে নেই। বড় মানুষেরা সব জানে-তাই অজানাকে ভয় পায় না।
বড় মানুষদের ভয় পেতে হয় জানা জিনিস। প্রত্যেকদিনকার জীবনের খাজে খাজে আমাদের শরীর ছেড়া ভয় লুকিয়ে থাকে আর সবচেয়ে বেশি ভয় হয় নিজেকে। হ্যাঁ সবচেয়ে বেশিভয় হয় আমার চিরপরিচিত নিজেকে কারণ একসময় হঠাৎ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়-এই চিরপরিচিত আমি আর আমাকে চিনিনা আর এই অপরিচিত আমি হয়ে আমি বাচতে চাইনা-চাইনি কখনো।
তখন মামনি আমি ক্লান্ত হয়ে তোমাকে খুঁজি আর খুঁজি কিন্তু আমার বড় হয়ে যাওয়া বুড়ো হয়ে যাওয়া মনটা তোমার কাছে যাবার সাহস করেনা কারণ আমার মনে হয় আমি অনেক কঠিন কঠিন সমস্যার সমাধান তোমার ছোট্ট মাথায় নেই কারণ জ্ঞান বিদ্যে বুদ্ধির কাগজের দোহাই দেখিয়ে আজ তোমার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্বান হয়েছি আমি-অনেক অনেক বুদ্ধিমান লোককে আমি চিনি যারা তোমার চেয়ে অনেক বেশি জানে-আর তাদের কাছেই কোন উত্তর নেই-আর তুমি মা কেমন করে জানবে বলো... আমি না এখন অনেক বড়! এতো বড় যে আমার কোন সমস্যার সমাধান তোমার নেই মা!
আমি এতো বড় কবে হয়ে গেলাম মা?
মনে আছে-যখন ছোট ছিলাম তখন আমি গুটগুট পায়ে স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটাকে একদিকে ছুড়ে দিয়ে রেগেমেগে তোমাকে সবার নামে নালিশ করে দিতাম।
ওরা আমায় খেলায় নেয়নি মা-ওরা বকেছে-ওরা মেরেছে আমাকে।
তুমি বলতে-ওদের দরকার নেই-তুই আমার সাথে থাক-আমার সাথে খেলার আমার সাথে বসে হাজার হাজার কিম্ভুত কিমাকার খেলা বানিয়ে বসতে আর আমি খেলতাম সেইসব খেলা।সেইসব খেলার কথা মনে করে আজ বড় হাসি পায় আর আমি হাসতে থাকি আমি হাসতে থাকি-হা হা হা হা হা হা
মা-ওরা আজকেও আমায় খেলায় নেয়নি। আমার আশেপাশে ওরা সবাই ঘুরে ঘুরে আমাকে সবকিছুর থেকে আলাদা করে দিয়ে ঠেলে আমার অন্ধকার কোণায় ফেলে ফেলে দিয়ে বলেছে আমি নাকি একলা আর নোঙরা আর বিশ্রী। আমি নাকি কখনো ওদের মতন হতে পারবোনা মা আর আমি নাকি সবসময় তলায় পড়ে থাকবো।
কিন্তু মা আমি ওদের কথায় একদম দমে যাইনি মা। ওদের আমি আমাকে নিচে ফেলে রাখতে দেইনি আর আমি উপরে ওঠার চেষ্টা করেছি-করছি-করবো-জানো তো! আমি কখনো হাল ছাড়িনি কিন্তু মা জানো আমি যতই উপরে উঠেছি ওরা আবার নতুন নতুন উপরের জন্ম দিয়েছে আর দেখিয়ে বলেছে যে উপরের কোন শেষ হয়না আর যতই উপরে উঠিনা কেন-আমি নাকি ততই নামছি নিচে আর আমি তার কিছুই চাইনি সত্যি।উপরে নিচের এতো হিসেব কিতেব ছিড়েখুড়ে আমি শুধু চেয়েছিলাম ওদের একজন হতে-ওদের সাথে খেলতে মা। কিন্তু ওরা আমায় খেলায় নেয়নি।
আমি আমার আশেপাশে তাকিয়ে দেখেছি আমি একা আর আমার এই একাকিত্ব নাকি আমার দোষেই আর আমি নাকি এর চেয়ে বেশি পাবার যোগ্যই নই আর আমিও মেনে নিয়েছি কিন্তু তবু রোজ আমার বুকে একশোটা নালিশ জমে আর সেই নালিশের পাহাড় নিয়ে আমার তোমার বুকে গিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে মামনি।
কিন্তু আমি আবার নিজেকে সামলে নেই। আমি তো বড় হয়ে গিয়েছি। আমি শিখেছি যে নালিশ করে কোন লাভ নেই আর নালিশ নাকি শুধু দূর্বলেই করে আর সবলের জন্য যুদ্ধ কিন্তু আমার আর যুদ্ধ করবার শক্তি নেই মা। আমি নালিশ করতে চাই। কিন্তু বড় হয়ে গিয়েছি বলে নালিশও করতে পারিনা মা।
আমি এতো বড় কবে হয়ে গেলাম?
মনে আছে-যখন আমি ছোট্ট ছিলাম তখন ছোট্ট ছোট্ট পা ভাজ করে তোমার পাশে বসে তোমার সাথে কত রঙের গল্প করতাম আমি।
আজকে জানো এই হয়েছে-ওই হয়েছে।ও না হাটতে হাটতে হঠাৎ নালায় পড়ে গিয়েছিলো আর আমি যখন তুলতে গেলাম-তখন আমাকেও ফেলে দিলো। কত গল্প আমার সব তোমার কাছে করতাম আমি।আমার প্রতিদিনের ছোট-বড় রাগ অভিমান ভালোলাগা মন্দলাগার সব সাক্ষী হয়ে থাকতে তুমি।
এরপর একদিন আবার কেমন বড় হয়ে গেলাম আর আমার গল্পগুলোও বড় হয়ে গেলো আর তোমাকে বলার মতন থাকলনা। সেইসব গল্প বড় গোপন গল্প-তাই তোমার থেকে লুকিয়ে রাখতে হতো। লুকিয়ে রাখছি বলে তুমি কষ্ট পেতে জানি কিন্তু মা আমি তোমাকে বলে দিলে তুমি কষ্ট পেতে আরো। তাই তোমাকে কষ্টের থেকে বাঁচাতে রোজ রোজ তোমাকে জেনেশুনে কষ্ট দিয়ে গেছি আর ভেবোনা মা তাই করতে আমার খুব ভালো লেগেছে কারণ তোমার একেকটা দীর্ঘশ্বাসে আমার বুক চিরে গেছে কিন্তু বিশ্বাস করো আমার আর কিছু করার ছিলোনা কারণ আমার গল্পে এখন আর কেউ হাটতে হাটতে নালায় পড়ে যেতনা বরং এখন আমি নিজের আনন্দে নিজের সুখে রোজ নালার নোংরা জল গায়ে মেখে নিচ্ছিলাম আর তোমাকে সেই গল্প বলার আমার সাহস ছিলোনা মামনি।
আমার তোমার সাথে এখন আর গল্প করার কথাও নয়-আর গল্প করার বয়সও নেই মামনি কিন্তু আমি যে বড় হয়ে যাচ্ছি এইটা তো আমার গল্পগুলো আর জানেনা তাই অবাধ্য নির্লজ্জ গল্পরা এখনো আমার বুকের মাঝে জমাট বাঁধে আর দিনের পর দিন ধরে সেই গল্পগুলো জমাট বাধতে বাধতে একসময় আমার বুকের মাঝে পাথর হয়ে জমে যায় আর সেই পাথরকে আমার রোজ টেনে নিয়ে নিয়ে চলতে হয় মা।
তুমি জানো মা আমি এর কিচ্ছু চাইনি সত্যি। আমি এই পাথর চাইনি-আমি কখনো উপরে উঠতে চাইনি আর বিশ্বাস করো আর নাই করো আমি কখনওই জানতে চাইনি আকাশটা কেন নীল। আমি সত্যি সত্যি সত্যি সত্যিই তোমার সাথে অর্থহীন ভ্যাডর ভ্যাডর আর অনর্থক নিরর্থক খোঁচাখুঁচির খেলাধুলা নিয়েই বড্ড সুখী ছিলাম মা।
বিশ্বাস করো-আমি ছোট থাকতে যতই তোমাকে বলিনা কেন আমি বড় কবে হবো-বড় কবে হবো-সত্যি সত্যি সত্যি সত্যি আমি কোনদিন বড় হতে চাইনি।
আমি তোমার বুকের মাঝে লুকিয়ে থাকতে চাইতাম।
দেখো! তবু আজ কত্তো বড় হয়ে গেছি। শরীরটাকে শতবার ভাজ করলেও হয়তো তোমার বুকের মাঝে আটানো যাবেনা মাগো আর গল্পগুলোকে শতবার পরিশ্রুত করলেও আর আমি তোমাকে শুনাতে পারবোনা আর আমি উপরে ওঠা বন্ধ করে তোমার জঠরে ঠাই নিলে বরং তুমিই আমাকে নালায়েক বলে গালি দেবে।
তাও মামনি আজ-একটা দিনের জন্য-একটা বারের জন্য-আমাকে একটূখানি নির্বল-নির্বোধ-নির্লোভ ছোট্ট একটা-তুচ্ছ একটা মানুষ হয়ে তোমার বুকে থাকতে দাও।
আমাকে আবার বলো আকাশের দৈত্যদানোর কথা-আমি সত্যি আবার ভয় পেতে চাই।
আমাকে নিয়ে আবার অনর্থক হাজার খেলাধুলার পসরা সাজাও-আমি সত্যিই সময় নষ্ট করতে বড় ইচ্ছুক
আর আবার আমার আজে বাজে বিচ্ছিরি গল্পগুলো হা করে মনোযোগ দিয়ে শোন গো মা। আজ আজেবাজে কথা বলতে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে
মা...মাগো...মামণিগো...দেখোনা একটু চেষ্টা করে। এই বুড়ো হাবড়াটাকে ভাজ করে আবার তোমার কোলে পুরে রাখা যায় কিনা
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ২:১২
হাসান মাহবুব বলেছেন: খুব ভালো লিখেছেন। অনেকেরই মনের কথা।