![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি কবিতা,গল্প,প্রবন্ধ,বই ও লিটলম্যাগ আলোচনা লিখে থাকি । ‘এবং মানুষ’ নামে একটি লিটলম্যাগ সম্পাদনা করি। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। ব্লগারের অনুমতি ছাড়া কোন লেখা কপি করে অন্য কোথাও ছাপানো নিষেধ।
ছোটবেলা থেকেই গ্রামের প্রতি আমার প্রবল আকর্ষণ ছিল। সুযোগ হলেই গ্রামের নদী-নালা, খাল-বিল চষে বেড়াতাম। বাবার চাকরির সুবাদে শহরের এক জেলা থেকে অন্য জেলা পর্যন্ত ছুটে বেড়াতে হয়েছে। গ্রামের মাটিতে, ধূলোবালিতে মাখামাখি করার তেমন সুযোগ আমার খুব বেশি হয়নি। তবে গ্রাম আমাকে হাতছানি দিয়ে সব সময় ডাকতো। ডাকের আবেদন মমতাময়ী মায়ের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না।
সেই গ্রামে আমার আবার দাদা বাড়ির চেয়ে নানা বাড়ি অনেক বেশি আপন করে জড়িয়ে নিত। কারণ, দাদা বাড়িতে একমাত্র দাদী ছাড়া আর তেমন কেউ ছিলনা। দাদা বাড়িকে ঠিক গ্রাম বলা যাবে না। পদ্মার তীরবর্তী রূপপুর গ্রামের পাশেই দিয়াড় বাঘইল গ্রাম, অনেকটা উপশহরের মত। চাচাতো ভায়েরা থাকলেও তাদের সাথে আমার সখ্যতা বেশি গড়ে ওঠেনি। স্কুলে গ্রীষ্মকালীন ছুটি হলেই দে ছুট। রকেট মেইল ট্রেনে চেপে সোজা নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে পাবনার ঈশ্বরদী। বাবা, দাদীর জন্য খাবার এবং টাকা পাঠাতেন। সেগুলো দাদীকে পৌঁছে দিয়ে কোন মতে খাবার সেরেই একই উপজেলার আট কিলো দূরে খড়ের দাঁইড় গ্রামে নানাবাড়িতে ছুটতাম। বলে রাখি, নানা বাড়িতে আমিই তাদের সব’চে বড় নাতি। কাজেই নানা-নানি, খালা-মামারা সবাই আমাকে কেন যেন খানিক বেশিই স্নেহ করতেন। যা এখনো উপলব্ধি করি।
নানাবাড়ি গ্রাম, নদী, নৌকা, গোয়াল, গরুগাড়ি, লাঙল-জোয়াল আমাকে ভীষণভাবে কাছে টানতো। সেখানে একটা নদী ছিল। নদীটির নাম সুতি গাঙ। নদীটির প্রশস্থ কম ছিল বলে এলাকাবাসী তাকে নাম দিয়েছিল সুতি গাঙ। হয়তো সুতা থেকে আঞ্চলিকতায় দুষ্ট হয়ে সুতি নাম ধারণ করেছিল। একটা জলা ছিল। জলাটির নাম ছিল দশ ভাগার বিল। অর্থাৎ, দশভাগা বলতে কারোরই মালিকানা সেভাবে ছিল না। আশপাশের লোকজন এমন কি দূর গ্রামের লোকজনও সবাই বর্ষার শেষে একযোগে মাছ মারতো বলে বিলটাকে দশ ভাগার বিল বলা হতো। সেই দশভাগার বিলে মাছ ধরতে দল বেধে শত শত মানুষ মাছ ধরতে যেত। আমিও আমার বড় মামার সাথে মাছ ধরায় নেমে পড়তাম। কী যে মজা হতো তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
সেই সুতি গাঙে, আমি বঁড়শি দিয়ে মাছ ধরেছি। পলো দিয়ে মাছ ধরেছি, এমন কি নদী শুকিয়ে গেলে কাদা-পাক মাটি নিয়ে বাঁধ দিয়ে পানি সেচে ছোট ছোট মাছ ধরেছি। একদিন এক ঢাউস আকৃতির আঁইড় মাছ নদীতে ফেলে রাখা এক বড় চারোর মধ্যে ধরা পড়েছিল। যা আমি আর ছোট মামা মিলে সবাইকে ডেকে এনে নৌকায় তুলে কিনারে আনা হয়েছিল। সেদিন সবাই আমাকে সাবাস দিয়েছিল। আর একদিন নানাদের নৌকা নিয়ে আওতাপাড়া হাটে যেতে নৌকার গলুইয়ের কাছে বসে বসে নৌকার হাল ধরা পরখ করতে করতে এমসময় মাঝিকে সরিয়ে যেই আমি হাল ধরেছি অমনি নৌকা আমার শাসন না মেনে বাঁকা হয়ে মাছ ধরার জন্য নদীতে আড়াঅড়ি বাঁধ দেয়া বাঁশের খাঁচা (বানা) ভেঙে একাকার করে দিল। সামনে বসে থাকা বড় মামা ততক্ষণে বুঝতে পারলো যে, আমি কী সর্বনাশ করে ফেলেছি। সেদিন খেলাম বকা। কী আর করা, হজম করতে হলো। তবে আমিও দমবার পাত্র না। নৌকার গলুই আমাকে পেয়ে বসলো। যখনই দেখি ঘাটে নৌকা বাধা। তখনই ছোট মামাকে সাথে নিয়ে নৌকা ভাসাতাম মাঝ গাঙে যেয়ে পদ্ম ফুল আর শালুক সংগ্রহ করতাম। একবার কচুরি পানার মাঝে ডাহুক পাখির ছানা দেখে তা ধরে এনেছিলাম।
নানাবাড়ির রাখাল ছেলে জান্টু মামা বৃষ্টির মধ্যে আমার জন্য পাখির ছানা ধরে এনে উপহার দিত। তার উপহার দেবার কৌশল ছিল ভিন্ন। ঝড়ো বৃষ্টি হচ্ছে, আমি আর ছোট মামা বৈঠক খানায় ঘরে বসে আছি। বৃষ্টির ঝাপটা আমাদের চোখে-মুখে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে। আমরা পুলকিত হচ্ছি। হঠাৎ করে কাক ভেজা হয়ে জান্টু মামার উদয় হলো। মাথায় ছাতা, তবে তাতে বৃষ্টির কোন বাধা মানতে চাইছে না। ঠিক ছাতার উপর জড় সড়ো হয়ে ভয়ে কুঁকড়ে আছে একটি শালিক পাখির ছানা। জান্টু মামা কাছে আসতেই বললেন, মুকুল এটা তোর জন্য। বলে রাখি, নানা শখ করে আমার নাম রেখেছিল মুকুল। হয়তো কোন এক মুকুলের ঋতুতে জন্মেছিলাম বলে সেই নাম। এখনো নানা বাড়ি আর খালারা ছাড়া এ নামে আর কেউ আমাকে ডাকে না। আমি মুকুল তাদের কাছে মুকুলই রয়ে গেছি। আজও ফুটতে পারিনি। আমি ভেজা পাখিটিকে নিয়ে তুলার মধ্যে বসিয়ে দিলাম আর তার খাদ্য হিসাবে ঘাস ফড়িং ধরতে মহা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। জান্টু মামা আমাকে আরো পাখি ধরে এনে দিয়েছিল। মাঠে লাঙল রেখে খেতে বসলে আমি সেই লাঙল আর গরু দু’টোকে শাসন করার চেষ্টা করতাম। লাঙলের মুঠ ধরে, হাতে গরু চরানো লাঠি নিয়ে ডা-ডা, ভোড়-ভোড় করে গরুকে হালকা মার দিতাম। এ কাজে কতবার যে গরুর পায়ে লাঙলের ফলা সেঁদিয়ে দিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। সেই জান্টু মামা বেঁচে আছেন কীনা এতকাল পরে তাও জানতে পারিনি।
একবার নানা বাড়িতে যেয়ে রাতে ডাকাতের কবলে পড়েছিলাম। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে আছি। রাতে হঠাৎ করে বন্ধুকের গুলির আওয়াজ। ঘুম ভাঙতেই দেখি জমদূতের মত বন্দুক হাতে ডাকাতদল। সবার চোখ-মুখ কালো কাপড়ে ডাকা। তারা সব চোখের নিমিষে লুট করে নিয়ে গেল। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। খালাদের কোলের মধ্যে লুকিয়ে সব দেখলাম। নানা খুব ভীতু প্রকৃতির লোক ছিল। দৌঁড়ে সে সবার আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামের লোক জড়ো করে। এরপর ডাকাতরা চলে যায়। তবে বড় মামা ডাকাতদের নাকি চিনতে পেরেছিল। কীভাবে যেন তাদের সাথে যোগাযোগ করে পরে অবশ্য নানীর সেলাই মেশিনটা ফেরত পেয়েছিল। এখন পর্যন্ত এটাই আমার ডাকাত দলের ডাকাতি কাজের চাক্ষুষ দর্শন।
আমার সাঁতার শেখা প্রথমে পুকুরে বদ্ধ পানিতে। বাবার চাকরী সূত্রে তখন আমরা চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। সীতাকুন্ড স্টেশনের সংগে আমাদের রেলের সরকারি বাসা। বাসা লাগোয়া ইয়া বড় এক পুকুর। আব্বা আমাকে পুকুরে নামিয়ে বুকের উপর হাত রেখে সাঁতার শেখাতেন। সাঁতারে আমার সীতাকুন্ডেই হাতে খড়ি। পরে সুতি গাঙে, টেপাগাড়ির বিলে আর ভাড়ইমারীর জলায়। আর আমার সাঁতার কাটার এক সহযাত্রী ছিল খালাতো বোন রাঙা। রাঙা আমার চেয়ে বছর তিনেকের ছোট ছিল। রাঙা আর আমি একসাথে সুতি গাঙে সাঁতার কাটতাম। তবে সেটা কালে ভদ্রে। কারণ, রাঙা থাকতো পাবনায় আর আমি থাকতাম রংপুরে। কাকতালীয়ভাবে উভয়ের নানা বাড়িতে আসা হলে ছোট মামাকে নিয়ে সাঁতারে নেমে পড়তাম। আমার দুই মেয়ের কেউ সাঁতার জানেনা। কারণ, তাদের শহরে বেড়ে ওঠা, আর সাঁতার শেখার আগ্রহের অভাবের কারনে শেখা হয়নি।
গ্রীষ্মকালে স্কুল ছুটি হলে নানাবাড়ি যেতাম। ছোট মামা আমার দু’বছরের ছোট হলেও আমরা ছিলাম দু’জনে যেন বন্ধু। নানাদের তখন অনেক আম বাগান ছিল। আজ তা আর আগের মত নেই। সেই আমের মধ্যে কোন গাছের আম টক, আর কোন গাছের আম মিষ্টি, তা কাঁচা অবস্থাতেই আমাদের মুখস্ত ছিল। কারণ, গাছের কাঁচা আম যে আমি আর আমার ছোট মামা মতি সবার আগে পরখ করে দেখে রাখতাম। আমি নারিকেল গাছেও একবার উঠেছিলাম। গাছে উঠে দেখি আমার বুকের অধিকাংশ যায়গা ছিলে গেছে। লাল টকটকে রং ধারণ করেছে। যেন রক্ত বের হয় হয়। কী আর করা গাছে উঠে কচি ডাব নিচে ফেলে দিতাম। ছোট মামা তা টপাটপ কুড়িয়ে জমা করতো। নানাবাড়ির অদূরে একটা ঝোপ ছিল। কথিত আছে জনৈক আয়েজ উদ্দিন একদিন অতি প্রত্যুশে প্রকৃতির ডাকে ঝোপের মাঝে গেলে বাঘ তাকে আক্রমন করে। আইজ উদ্দিন সেই বাঘের সাথে মল্লযুদ্ধে বিজয়ী হয়েছিলেন। বাঘকে মেরে পুরো গ্রাম ঘোরানো হয়েছিল। সেই থেকে তার নাম হয়ে গেল আইজদ্দি বাঘা। কী সাহসিকতা! সুদূর পাবনা জেলায় তার নামডাক ছড়িয়ে পড়লো। সেই ঝোপে ছিল বঁইচি ফলের গাছ। আমি আর ছোট মামা সাহস করে ঐ ঝোপে ঢুকে পড়তাম আর বঁইচি ফল ছিড়ে এনে সুতি গাঙের পাড়ে বাতাসে গা এলিয়ে দিয়ে সাবাড় করতাম। আজ সেই সুতি গাঙ নেই, নেই দশভাগার বিল, টেপাগাড়ির বিল। সব শুকিয়ে আবাদী জমিনে পরিণত হয়েছে। সেই ঝোপ-ঝাড় কেটে সাবাড় করা হয়েছে। সেখানে ঘর বাড়ি তৈরি করে বসতি গড়ে উঠেছে। চলছে চাষাবাদ, ফলছে ধান, আর হারিয়ে গেছে আমার সেই মধূময় স্মৃতির ফেলে আসা হিরন্ময় দিনগুলো। আমার সেসব মধুর স্মৃতি কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না।
১৮ ই জুন, ২০১৪ সকাল ৯:৩৫
আনোয়ার কামাল বলেছেন: মন্তব্য করবর জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। গ্রামের হাতছানি অবশ্য সবাইকে দেয়। কেউ যেতে পারে, কেউ যেতে পারেনি। আমাদের প্রত্যেকেরই শিকড়ের সন্ধানে যেতে হয়। প্রত্যেকের মাটির কাছে, নদীর কাছে যেতে মন টানে। মন কাঁদে, যেতে চায় সেদিনের সেই ফেল আসা দিনগুলোর কাছে। কিন্তু হায়! বৃথা, বৃথা......।
২| ১৮ ই জুন, ২০১৪ রাত ১২:৩১
রেজওয়ানা আলী তনিমা বলেছেন: চমৎকার লাগলো । আমার নিজের পুরো স্মৃতি মূলত শাহরিক। গ্রাম খুব একটা দেখা হয়নি।কিন্তু গ্রামের স্মৃতি অন্য রকম আবেদনের বিষয়। যা আমার পাওয়া হয়নি আপনার লেখা পড়ে তার আমেজও পাওয়া হয়ে গেল।এজন্যে বিশেষ ধন্যবাদ
১৮ ই জুন, ২০১৪ সকাল ৯:৩৯
আনোয়ার কামাল বলেছেন: আপনার স্মৃতি শহরকেন্দ্রিক হলেও ঘুরে আসুন গ্রাম থেকে। দেখবেন আপনার জন্য অপেক্ষা করছে অপার বিশ্বয়! আর সবচে বড় দেখা, তা হচ্ছে ভ্রমণ। অশেষ ধন্যবাদ আপনাকেও।
৩| ১৮ ই জুন, ২০১৪ রাত ২:২৯
আহসানের ব্লগ বলেছেন: শুভেচ্ছা রইল ।
ভাল লিখেছেন
১৮ ই জুন, ২০১৪ সকাল ৯:৪২
আনোয়ার কামাল বলেছেন: লেখাটা পড়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শহর-গ্রাম, নগর-বন্দর, এইতো আমাদের বাংলাদেশ। প্রিয় বাংলাদেশ।
©somewhere in net ltd.
১|
১৭ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ২:৫৩
কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন। আপনার লেখা পড়ে আমি নিজেও বেশ নস্টালজিক হয়ে গেলাম। মনে পড়ে কোন একবার ছুটিতে বর্ষার সময় গ্রামে গিয়েছিলাম। চারিদিকে থৈ থৈ পানি। আমার নানা বাড়ির চারপাশে দিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা জমি। বর্ষার পানি জমে সেই জমি গুলো ছোটখাট সাগরে পরিনত হয়েছে। নৌকা নিয়ে সেই পানিতে ভেসে পড়েছিলাম। অসামান্য সৌন্দর্যের গৌধুলির পর যখন আকাশে চাঁদ উঠল তখন কিছুটা সময় আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল পৃথিবীর সৌন্দর্যের আর কি বাকি আছে!