নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আব্দুল্লাহ নাম, আবু মুসা কুনিয়াত। কুনিয়াত দ্বারাই তিনি অধিক পরিচিত। পিতা কায়েস, মাতা তাইয়েব্র। তার ইসলাম পূর্ব জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়না। এতটুকু জানা যায় যে, তিনি ইয়ামানের অধিবাসী ছিলেন। তথাকার আল আশয়ার গোত্রের সন্তার হওয়ায় তিনি আল আশয়ারী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। হযরত আবু মুসা ইসলামের পরিচয় লাভ করে ইয়ামান থেকে মক্কায় আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সা) এর হাতে বাইয়াত হন। মক্কার আবদু শামস গোত্রের সাথে বন্ধু সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিছুদিন মক্কায় অবস্থানের পর স্বদেশবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার উদ্দেশ্যে ইয়ামান ফিরে যান। হযরত আবু মুসা ছিলেন তার খান্দানের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। খান্দানের লোকেরা খুব দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে দাওয়াতে সাড়া দেয়। প্রায় পঞ্চাশজন মুসলমানের একটি দলকে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে যাওয়ার জন্য ইয়ামান থেকে সমুদ্র পথে যাত্রা করেন। সমুদ্রের প্রতিকুল আবহাওয়া এ দলটিকে হিজাযের পরিবর্তে হাবশা ঠেলে নিয়ে যায়। এদিকে হযরত জাফর বিন আবী তালীব ও তার সংগী সাথীরা যারা তখনও হাবশায় অবস্থান করছিলেন, মদীনার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। আবু মুসা তার দলটিসহ এই কাফিলার সাথে মদীনার পথ ধরলেন। তারা মদীনায় পৌছলেন, আর এদিকে রাসূলুল্লাহর (সা) নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী খাইবার বিজয় শেষ করে মদীনায় ফিরেন। রাসূল সা. আবু মুসা ও তার সংগী সকলকে খাইবারের গনীমতের অংশ দান করেন। হযরত আবু মুসা মক্কা বিজয় ও হুনাইন যুদ্ধে শরীক ছিলেন। হুনাইনের ময়দান থেকে পালিয়ে বনু হাওয়াযিন আওতাস উপত্যকায় সমবেত হয়। রাসূল সা তাদেরক সমূলে উত্খাতের জন্য হযরত আবু আমেরের নেতৃত্বে একটি দল পাঠান। তারা আওতাস পৌছে হাওয়াযিন সর্দার দুরাইদ ইবন্যুস সাম্মাকে হত্যা করে তাদের ছত্র্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু ঘটনাক্রমে হাশামী নামক এক মুশরিকের নিক্ষিপ্ত তীরে আবু আমের মারাত্নকভাবে আহত হন। আবু মুসা আশয়ারী পিছু ধাওয়া করে এই মুশরিককে হত্যা করেন। হযরত আবু আমের তার মৃত্যুর পূর্বে আবু মুসাকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন্ এবং আবু মুসার কাছে এই বলে অনুরোধ করেন যে, ভাই রাসূলুল্লাহর খেদমতে আমার শেষ সালাম পৌছে দেবেন এবং আমার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতে বলবেন। আবু আমের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন। আবু মুসা তার বাহিনী সহ মদীনায ফিরে এসে রাসূলুল্লাহ সা কে আবু আমেরের অন্তীম অসীয়তের কথা বর্ণনা করলেন। রাসূল সা: পানি আনিয়ে ওযু করলেন এবং আবু আমেরের জন্য মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করলেন। আবু মুসা আরজ করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ আমার জন্যও একটু দোয়া করুন। রাসূল সা: করণের হে আল্লাহ আব্দুল্লাহ ইবনে কায়েসের পাপসমূহ মাফ করে দিন। কিয়ামতের দিন তাকে সম্মানের সাথে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ দিন। হিজরী নবম সনে তাবুক অভিযানের তোড়জোড় চলছে। আবু মুসার সংগী সাথীরা তাকে পাঠালেন রাসূলুল্লাহর সা: কাছে তাদের জন্য সওয়ারী চেয়ে আনার জন্য। ঘটনাক্রমে আবু মুসা যখন পৌছলেন তখন রাসূলুল্লাহ সা: কোন কারণে উত্তেজিত ছিলেন। আবু মুসা তা না বুঝে আরজ করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ আমার সাথীরা আমাকে পাঠিয়েছে, আপনি যেন তাদেরকে সওয়ারী দান করেন। রাসূল সা: বসে ছিলেন। উত্তেজিত কন্ঠে তিনি বলে ওঠেন আল্লাহর কসম তোমাদের আমি কোন সওয়ারী দেবনা। আবু মুসা ভীত হয়ে পড়লেন, না জনি কোন বেয়াদবী হয়ে গেল। অত্যন্ত দখিতত মনে ফিরে এসে সংগী সাখীদের তিনি এ দু:সংবাদ জানালেন। কিন্তু তখনও তিনি স্থির হয়ে দাড়াতে পারেননি, এর মধ্যে বিলাল দৌড়ে এলেন আবদুল্লাহ ইবনে কায়েস কোথায় তুমি? চলো রাসূলুল্লাহ সা: তোমাকে ডাকছেন। তিনি বিলালের সাথে রাসুলুল্লাহর সা: দরবরে হাজির হলেন। রাসূল সা: নিকটে বাধা দুটি উটের দেকে তিনি ইঙ্গিত করে বললেন: এ দুটিকে তোমার সাথীদের কাছে নিয়ে যাও। হযরত আবু মুসা উট দুটি নিয়ে গোত্রীয় লোকদের কাছে ফিরে এসে বললেন রাসূল সা: তোমাদের এ দুটি উট সওয়ারী হিসেবে রুপে দান করেছেন, তবে তোমাদের কিছু লোককে আমার সাথে এমন কোন লোকরে কাছে যেতে হবে যে রাসূলুল্লাহর পূর্বের কথা শুনেছিল। যাতে তোমাদের মনে এ ধারণা না হয় যে, আমি আগে যা বলেছিলাম তা আমার মনগড়া কথা ছিল। লোকেরা বলল আল্লাহর কসম আমরা আপনাকে সত্যবাদী বলেই বিশ্বাস করি। তবে আপনি যখন বলছেন. চলুন। এভাবে কিছু লোককে সংগে নিয়ে তিনি তার পূর্বের কথার সত্যতা প্রমান করেন। তাবুক থেকে ফেরার পর একদিন আশয়ারী গোত্রের দুইজন নেতৃ্স্থানীয় ব্যাক্তি হযরত আবু মুসা আশয়ারীকে সংগে নিয়ে রাসূলুল্লাহর কাছে গেল। তারা রাসূলুল্লাহর কাছে যে কোন একটি পদ লাভের আকাঙ্খা ব্যক্ত করল। রাসূলুল্লাহ সা মিসওয়াক করছিলেন। তাদের কথা শুনে তার মিসওয়াক করা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি আবুর দিকে ফিরে বললেন আবু মুসা আবু মুসা। আবু মুসা আরজ করলেন ইয়া রাসূলুল্লাহ আমি তাদের অন্তরের কথা জানতাম না। আমি জানতাম না তারা কোন পদ লাভের আকাঙ্খা ব্যক্ত করবে। রাসূল সা: বললেন যদি কেউ নিজেই কোন পদের আকাঙ্খী হয়, আমি তাকে কখখনো সেই পদে নিয়োগ করবোনা। তবে, আবু মুসা তুমি ইয়ামানে যাও। আমি তোমাকে সেখানকার ওয়ালী নিযুক্ত করলাম। সেই প্রাচীনকাল থেকে ইয়ামান দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। ইয়ামান আকসা ও ইয়ামান আদনা। হযরত মুয়াজ বিন জাবালকে ইয়ামন আকসার এবং আবু মুসাকে ইয়ামন আদনার দায়িত্ব দেয়া হল। দুজনকে বিদায় দিয়ে রাসূল সা: তাদের উদ্দেশ্যে বললেন: “ইয়ামন বাসীর সাথ নরমে ব্যবহার করবে, কোন প্রকার কঠোরতা করবেনা। মানুষকে খুশী রাখবে, ক্ষেপিয়ে তুলবেনা। পরস্পর মিলে মিশে বসবাস করবে।” নিজ দেশ হওয়ার কারণে ইয়ামন বাসীর ওপর হযরত আবু মুসার যথেষ্ট প্রভাব শুরু থেকেই ছিল। তাই সুষ্ঠুভাবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। পার্শ্ববর্তী ওয়ালী হযরত মুয়াজের সাথে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল। মাঝে মাঝে সীমান্তে গিয়ে তারা মিলিত হতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরস্পর মত বিনিময় করতেন। হিজরী দশম সনে রাসূলুল্লাহ সা: হজ্জ আদায় করেন। হযরত আবু মুসা ইয়ামন থেকে এসে হজ্জে অংশগ্রহন করেন। রাসূলুল্লাহ সা: তাকে জিজ্ঞেস করলেন : আব্দুল্লাহ ইবনে কায়েস, কি হজ্জের উদ্দেশ্যে এসেছ? তিনি জবাব দিলেন: হা ইয়া রাসুলুল্লাহ! রাসূল সা: প্রশ্ন করলেন: তোমার নিয়ত কি ছিল? তিনি বলেন: আমি বলেছিলাম রাসূলুল্লাহর সা: যে নিয়াত আমারও সেই নিয়ত। রাসূল সা: আবার প্রশ্ন করলেন কুরবানীর পশু সংগে এনেছ কি? তিনি বললেন না:। রাসূল সা: নির্দেশ দিলেন তাওয়াফ্ ও সায়ী করবার পর ইহরাম ভেঙ্গে ফেল।(সহীহুল বুখারী) উল্লেখ্য যে. রাসূল (সা) হজ্জে কিরান আদায় করেছিলেন। আর হজ্জে কিরানের জন্য কুরবানীর পশূ সংগে নিয়ে আসা জরুরী। হজ্জ শেষে আবু মুসা ইয়ামনে ফিরে আসেন। এদিকে আসওয়াদ আনাসী নামক এক ভন্ড নবী নবুওয়াত দাবী করে, বিদ্রোহ ঘোষনা করে বসে। এমনকি হযরত মুয়াজ বিন জাবাল আবু মুসার রাজধানী মারেব চলে আসতে বাধ্য হন। এখানেও তারা বেশী দিন থাকতে পারলেনা। অবশেষে তারা হাদরামাউতে আশ্রয় নেন। যদিও ইবনে মাকতুহ মুরাদী আসওয়াদ আনাসীকে হত্যা করেন, তবুও রাসুলুল্লাহ সা: এর ইনতিকালে আবার বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অত:পর প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রা: মদীনা থেকে বাহিনী পাঠিয়ে এই বিদ্রোহ নিমূর্ল করেন। ইয়ামনের দুই ওয়ালী নিজেদের স্থানে আপন আপন দায়িত্বে ফিরে যান। হযরত আবু মুসা হাদরামাউত থেকে নিজ কর্মস্থল হাদরামাউতে ফিরে আসেন। এবং দ্বিতীয় খলিফার খিলাফত কালের প্রথম পযার্য় অত্যন্ত সফলভাবে দায়িত্ব পালন করতে খাকেন। হযরত উমারের রা: খিলাফাতকালে বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা শুরু হলে আবু মুসা রা: জিহাদে শরীক হওয়াল প্রবল আকাঙ্খায় ওয়ালীর দায়িত্ব ত্যাগ করে হযরত সাদ ইবন আবী ওয়াক্কাসের বাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগদান করেন। হিজরী ১৭ সনে সেনাপতি সাদের নির্দেশে তিনি নাসিবীন জয় করেন। এবছরই বসরার ওয়াশী মুগীরা ইবন শুবাকে রা: অপসারণ করে তার স্থলে আবু মুসা রা: কে নিয়োগ করা হয়। খুযিস্তান হচ্ছে বসরার সীমান্ত সংগলগ্ন এলাকা। ঐ এলাকাটি তখনো ইরানীদের দখলে ছিল। হিজরী ১৬ সনে খুযিস্তান দখলের উদ্দেশ্যে হযরত মুগীরা রা: আহওয়াযে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন। আহওয়াযের সর্দার অল্প কিছু অর্থ বার্ষিক করদানের বিনিময়ে মুগীরার সাথে সন্ধি করেন। মুগীরা ফিরে যান। হিজরী ১৭ সনে মুগীরার স্থলে আবু মুসা দায়িত্ব গ্রহন করলে আহওয়াজবাসী কর প্রদান বন্ধ করে দিয়ে বিদ্রোহ করে। বাধ্য হয়ে আবু মুসা সৈন্য পাঠিয়ে আহওয়াজ দখল করেন এবং মানাযির পযর্ন্ত অভিযান অব্যহত রাখেন। বিশিষ্ট সেনা অফিসার হযরত মুহাজির ইবন যিয়াদ রা: এই মানাযির অভিযানের এক পযার্য়ে শাহাদাত বরণ করেন। শত্রু বাহিনী তার দেহ থেকে মস্তিষ্ক বিচ্ছিন্ন করে কিল্লার গম্বুজে ঝুলিয়ে রাখে। আবু মুসা হযরত মুহাজিরের ভাই হযরত রাবীকে মানাযির দখলের দায়িত্ব দেন। রাবী মানাযির দখলে সফল হন। এদিকে আবু মুনা সোস অবরোধ করেন। শহরবাসী কিল্লায় আশ্রয় নেয়। অবশেষে তাদের নেতা এই শর্তে আবু মুসার সাথে সমঝোতায় পৌছেন যে, তার খান্দানের একশত ব্যক্তিকে জীবিত রাখা হবে। নেতা এক এক করে একশ ব্যক্তিকে হাজির করলো এবং আবু মুসা শর্ত অনুযায়ী তাদের মুক্তি দিলেন। দুভাগ্যক্রমে নেতা নিজের নামটি পেশ করতে ভুলে গেল এবং সন্ধির শর্তানুযায়ী তাকে হত্যা করা হলো। সোস অবরোধের পর আবু মুসা ‘রামহরমুয’ অবরোধ করেন এবং বার্ষিক আট লাখ টাকা দিরহাম কর আদায়ের শর্তে তাদের সাথে সন্ধি হয়। চারদিক থেকে তাড়া খেয়ে শাহানশাহে ইরানের সেনাপতি হরমুযান শোশতার এর মজবুত কেল্লায় আশ্রয় নিয়েছে। আবু মুসা শহরটি অবরোধ করে বসে আছেন। শহরটি পতনের সব চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছে। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে এক ব্যক্তি গোপনে শহর খেকে বেরিয়ে আবু মুসার ছাউনীতে চলে এলো। সে প্রস্তাব দেয়, যদি তার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হয় তাহলে সে শহরের পতন ঘটিয়ে দেবে। লোকটির শর্ত মনজুর হলো। সে আশরাস নামক এক আরবকে সংগে নিল।আশরাস চাদর দিয়ে মাথা মুখ ঢেকে চাকরের মত লোকটির পিছে পিছে চলল। তারা নদী ও গোপন সুড়ংগ পথে শহরে প্রবেশ করে এবং নালা অলি গলি পেরিয়ে হরমুযানের খাস মহলে গিয়ে হাজির হয়। এভাবে আশরাস গোপনে শহরের সব অবস্থা পযর্বেক্ষন করে গোপনে আবার আবু মুসার কাছে ফিরে আসে এবং বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করে। অত:পর আবু মুসার নির্দেশে আশরাস দু’শো জানবাজ সিপাহী সংগে করে হঠাত্ আক্রমন করে দ্বার রক্ষীদের হত্যা করে দরযা খুলে দেয়। এদিকে আবু মুসা ও তার সকল সৈন্যসহ দরজার মুখেই্উপস্থিত ছিলেন। দরযা খোলার সাথে সাথে সকল সৈনিক একযোগে নগরের অভ্যন্তরে প্রবেশ কর্ শহরে হৈ চৈ পড়ে যায়। হরমুযান দৌড়ে কিল্লায় আশ্রয় নেয়। মুসলিম বাহিনী কিল্লার পাশে পৌছলে হরমুযান কিল্লার গম্বুজে উঠে ঘোষনা করে যে, যদি আত্নসমর্পনে রাজী। তার শর্ত মঞ্জুর করা হয় এবং তাকে হযরতের সাথে দারুল খিলাফাত মদীনায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। শোশতার বিজয়ের পর আবু মুসার নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী জুনদিসাবুর অবরোধ করে। এ অবরোধ বেশ কিছুদিন ধরে চলছিল। একদিন শহরবাসী হঠাত শহরের ফটক উন্মুক্ত করে দেয়। তারা অত্যন্ত শান্তভাবে আপন আপন কাজে ব্যস্ত। মুসলিম বাহিনী শহরে প্রবেশ করে তাদের এমন নি:শঙ্কভাব দেখে অবাক হয়ে যায়। জিজ্ঞেস করলে তারা জানালো, কেন আমাদের তো জিযিয়ার শর্তে নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে। খোজ খবর নিয়ে জানা গেল, মুসলিম বাহিনীর এক দাস সকলের অগোচরে একাই এ নিরাপত্তার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সেনাপতি আবু মুনা দাসের এ চুক্তি মানতে অস্বীকার করলেন। শহরবাসী বলল, কে দাস, কে স্বাধীন তা আমরা জানিনে। শেষে এ বিষয়টি মদীনার খলিফার দরবারে উত্থাপিত হলো। খলীফা জানালো, মুসলমানদের দাসও মুসলমান। যাদেরকে সে আমান বা নিরাপত্তা দিয়েছে, সকল মুসলমানই যেন তাদের আমান দিয়েছে। এভাবে আবু মুসার নেতৃত্বে গোটা খুযিস্তানে ইসলামের ভিত্তি সুদৃঢ় হয়। এবং সেই সাথে তার অবস্থান স্থল বসরা শত্রুর হুমকি থেকে মুক্ত হয়ে যায়। খুযিস্তানের পতনের পর হিজরী ২১ সনে ইরানীরা নিহাওয়ান্দে এক চূড়ান্ত যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। খলীফা ইমার রা: নুমান ইবনে মুকরিনকে বিরাট এক বাহিনীসহ নিহাওয়ান্দে পাঠান এবং আবু মুসাকে তাকে সাহায্য করার নির্দেশ দেন। খলীফার নির্দেশ পেয়ে বিরাট এক বাহিনীসহ তিনি নিহাওয়ান্দে পৌছেন। এ যুদ্ধেও ইরানী বাহিনী মারাত্নকভাবে পরাজয় বরণ করে। খুযিস্তান জয়ের পর বিজিত এলাকা বসরার সাথে একীভূত করার জন্য আবু মুসা আবেদন জানালেন খলীফার কাছে। এদিকে কুফাবাসীরাও কুফার সাথে একীভূত করার দাবী জানালো তাদের ওয়ালী আম্মার ইবনে ইয়াসিরের (রাঃ) নিকট। খলীফ আবু মুসার দাবী সমর্ধন করে বিজিত এলাকা বসরার সাথে একীভূত করলেন। এ দিকে কুফাবাসী তাদের দাবী পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় আম্মারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠ্। অবশেষে খলীফা কুফাবাসীদের দাবী অনুযায়ী আম্মারকে সরিয়ে হিজরী ২২ সনে আবু মুসাকে কুফার ওয়ালী নিযুক্ত করেন। কিন্তু এক বছর পর হিজরী ২৩ সনে আবার বসরায় বদলী হন। এ বছরই (হি: ২৩) দাব্বা নামক এক ব্যক্তি খলীফার কাছে আবু মুসার বিরুদ্ধে নিম্নের অভিযোগগুলি উত্থাপন করে:
১. আবু মুসা যুদ্ধবন্দীদের থেতে ষাটজন সর্দার পুত্রকে নিজেই নিয়ে নিয়েছেন।
২. তিনি শাসনর্কাযের যাবতীয় দায়িত্ব যিয়াদ ইবন সুমাইয়ার ওপর ন্যস্ত করেছেন এবং প্রকৃতপক্ষে যিয়াদ এখন সকল দন্ডমুন্ডের মালিক।
৩. তিনি কবি হুতাইয়্যাকে এক হাজার দিরহাম ইনয়াম দিয়েছেন।
৪. আকলিয়্যা নাম্মী তার এক দাসীকে দু’বেলা উত্তম খাবার দেয়া হয়; অথচ তেমন খাবার সাধারণ মানুষ খেতে পায়না।
হজরত উমার নিজহাতে অভিযোগগুলি লিখলেন। আবু মুসাকে মদীনায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। অভিযোগগুলির ত্য মিথ্যা নিরুপনের জন্য যথারীতি অনুসন্ধান চালালেন। প্রথম অভিযোগটি মিথ্যা প্রমানিত হল। দ্বিতীয় অভিযোগের জবাব দিলেন যে, যিয়াদ একজন তুখোড় রাজনীতিক ও দক্ষ প্রশাসক। তাকে আমি উপদেষ্টা নিয়োগ করেছি। খলীফা যিয়াদকে ডেকে পরীক্ষা নিলেন এবং তাকে যোগ্য ব্যক্তি হিসেবে দেখতে পেলেন। যিয়াদকে তার পদে বহাল রাখার নির্দেশ দিলেন। তৃতীয় অভিযোগের জবাবে বললেন, হুতাইয়্যা যাতে আমার হিজু(নিন্দা) না করে এজন্য আমি তাকে আমার নিজ অর্থ থেকে উপঢৌকন দিয়েছি। কিন্তু চতুর্থ অভিযোগের কোন জবাব তিনি দিতে পারলেন না। হযরত উমার রা: একটু বকাবকি করে তাকে ছেড়ে দিলেন।(তাবারী)
আবু মুসা এ বছরই (হি: ২৩) ইস্পাহানে অভিযান চালিয়ে অঞ্চলটি ইসলামী খিলাফাতের অন্তর্ভূ্ক্ত করেন। ইস্পাহান বিজয় শেষ করে ফিরে এলে সেই বছরই তাকে বসরা থেকে কুফায় বদলী করা হয়। বসরাবাসীদের ভীষন পানি-কষ্ট চিল। বিষয়টি খলীফার দরবারে পৌছানো হলো। দিজলা নদী থেকে খাল কেটে বসরা শহর পযর্ন্ত নেওয়ার জন্য খলীফা নির্দেশ দিলেন। আবু মুসার নেতৃত্বে দশ মাইল দীর্ঘ একটি খাল খনন করে বসরাবাসীদের পানি-কষ্ট দূর করা হয়। ইতিহাসে এ খাল নহরে আবি মুসা নামে প্রসিদ্ধ। হিজরী ২৩ সনে জিলহজ্জ মাসে দ্বিতীয় মাসে খলীফা উমার শাহাদাত বরণ করেন। হযরত উসমান(রাঃ) খিলাফাতের দায়িত্বভার গ্রহনের পর প্রশাসনের কাঠামোতে অনেক রদবদল করেন। কিন্তু হিজরী ২৯ সন পযর্ন্ত আবু মুসা বসরার ওয়ালী পদে বহাল থাকেন। হিজরী ২৯ সনে কুর্দীরা বিদ্রোহ ঘোষনা করে। আবু মুসা মসজিদে গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ সর্ম্পকে এক জ্বালাময়ী ভাষন দান করেন। ভাষনে আল্লাহর রাস্তায় পায়ে হেটে চলার ফযীলত বর্ণনা করেন। তার প্রতিক্রিয়া স্বরুপ কিছু মুজাহিদ তাদের নিকট ঘোড়া থাকা সত্ত্বেও পায়ে হেটে চলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। আবু মুসার সমালোচক তাদেরকে বলল: আমাদের এত তাড়াতাড়ি করা উচিত হবে না। দেখা যাক আমাদের আমীর আবু মুসা কিভাবে চলেন। আবু মুসাও ঘোড়ার ওপর সওয়ার হয়ে বের হয়ে এলেন। মুজাহিদরা তার ঘোড়ার লাগাম ধরে প্রতিবাদ করে বসল। আসলে আবু মুসার ভাষনের অর্থ এমন ছিলনা যে, যাদের ঘোড়া আছে তারা তাদের কাঝে তা ব্যবহার করবে না। বস্তুত: তখন সময়টি ছিল ফিতনা ও ষড়যন্ত্রের। হাঙ্গামাবাজরা এই সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে মদীনায় চলে গেল এবং তার অপসারণ দাবী করলো। খলীফা উসমান তাকে সরিয়ে নিলেন। হিজরী ৩৪ সনে কুফাবাসীদের সাঈদ ইবনুল আসের স্থলে খলীফা উসমা, আবু মুসাকে আবার কুফার ওয়ালী নিযুক্ত করেন। খিলাফতের সবর্ত্র তখন চলছে দারুণ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। রাসূলুল্লাহ সা: আবু মুসার স্মরণে ছিল। তাই তিনি তার বক্তৃতা ভাষনে সবর্দা কুফাবাসীদের এ ভবিষদ্বানীর কথা শোনাতেন। তাদেরকে সব ফিতনা থেকে দুরে থাকার উপদেশ দিতেন। হিজরী ৩৫ সনে হযরত উসমানের (রাঃ) শাহাদাত ও হযরত আলীর খলীফা হওয়ার পর সেই ফিতনা আত্নপ্রকাশ করে। তৃতীয় খলিফা হযরত উসমানের রা: রক্তের কিসাসের দাবীতে সোচ্চার হয়ে হযরত আয়িশা, তালহা ও যুবাইর রা: মক্কা থেকে বসরার দিকে রওয়ানা হলেন। এদিকে তাদের প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে খলীফা হযরত আলী রা: উপস্থিত হলেন যি’কার নামক স্থানে। অন্যদিকে আম্মার ইবনে ইয়াসিরের সাথে হযরত হাসানকে পাঠালেন কুফায়। হযরত হাসান যখন কুফা পৌছলেন, আবু মুসা আশয়ারী তখন কুফা মসজিদে এক বিশাল মসজিদে এক বিশাল জনসমাবেশে ভাষন দিচ্ছিলেন। ভাষনে তিনি জনগনকে এ্ই ফিতনা থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিচ্ছিলেন। হযরত হাসান সেথানে উপস্থিত হলেন এবং আবু মুসার রা: সাথে তার কিছু বাক বিতন্ডা হয়। আবু মুসা নীরবে মসজিদের মিম্বর থেতে নেমে আসেন এবং কোন রকম প্রতিবাদ না করে সোজা সিরিয়ার এক অজ্ঞাত গ্রামে গিয়ে বসবাস করতে থাকেন। এভাবে তিনি গৃহযুদ্ধে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন। সিফফিনে হযরত আলী(রাঃ) ও হযরত মুয়াবিয়া রা: যুদ্ধ বিরতি ঘোষনা করলেন এই শর্তে যে, উভয় পক্ষ একজন করে দু’জন নিরপেক্ষ বিচারকের ওপর বিষয়টি নিষ্পত্তির ভার দেওয়া হবে। তাদের মিলিত সিদ্ধান্ত উভয় পক্ষ মেনে নেবে। আলীর রা: পক্ষ আবু মুসাকে এবং মুয়াবিয়ার রা: পক্ষ আমর ইবনুল আসকে রা: বিচারক নিযুক্ত করেন। উভয় পক্ষ ‘দুমাতুল জান্দাল’ নামক স্থানে একত্র হলেন। বিষয়টি নিয়ে দু’জনের মধ্যে দীর্ঘ আলোচনা হলো। অবশেষে তারা এ্ই সিদ্ধান্তে পৌছলেন যে, উম্মাতের স্বার্থে আলী ও মুয়াবিয়া উভয়কে খিলাফতের পদ থেকে অপসারণ করতে হবে এবং মজলিসে শুরা তৃতীয় কাউকে খলীফা নিবার্চন করবে। তারা উভয়ে জনগনের সামনে হাজির হলেন তাদের সিদ্ধান্ত ঘোষনার জন্য। আমর ইবনুল আসের অনুরোধে আবু মুসা প্রথমে উঠে সিদ্ধান্ত ঘোষনা করলেন; আবু মুসা তার পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে হযরত মুয়াবিয়াকে খলীফা ঘোষনা করে বসলেন। আবু মুসা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
আসলে আবু মুসা ছিলেন অত্যন্ত সরল ও সাদাসিধে প্রকৃতির। ধোকা ও কূটনীতি কি জিনিস তিনি জানতেন না। এ কারণে তাকে বিচারক নিযুক্ত করার ব্যাপারে হযরত আলী রা: দ্বিমত পোষন করেছিলেন। কিন্তু তার পক্ষের লোকদের চাপাচাপিতে তিনিও মেনে নেন। আমর ইবনুল আসের কুটনৈতিক জালে পরাজিত হয়ে আবু মুসা অনুশোচনায় এত দগ্ধিভূত হলেন যে, সেই মুহুর্তে তিনি মক্কার পথ ধরলেন। জীবনে আর কোন ব্যাপারে তিনি অংশগ্রহন করেননি। তার মৃত্যু সন ও স্থান সম্পর্কে বিভিন্ন মত রয়েছে। কারো মতে মক্কায় আবার কারো মতে তিনি কুফায় মৃত্যুবরণ করেন। তবে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ মতে তিনি মক্কায় ইনতিকাল করেন। অনুরূপভাবে তার মৃত্যুসন হি: ৪২, ৪৪ ও ৫২ সন বলে একাধিক মত রয়েছে। তবে প্রসিদ্ধ মতে হি: ৪৪ তার মৃত্যুসন। (তাজকিরাতুল হুফফাজ)
হযরত আবু মুসা রা: জীবনের শেষ পর্যন্ত রাসুলুল্লাহর সা: আদেশ নিষেধ পালনে অত্যন্ত যত্ববার ছিলেন। এমনকি যখন তার অবস্থা সঙ্কটজনক হয়ে পড়ে এবং তিনি চেতনা হারিয়ে ফেলেন, তখন মহিলানা কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। সেই মারাত্নক মুহুর্তেও ক্ষনিকের জন্য চেতনা ফিরে পেয়ে বলে ওঠেন: যে জিনিস থেকে রাসুল সা: এমন বিলাপকারিনীদের থেকে দায়িত্ব মুক্তির কথা বলেছেন। প্রথম জীবনে দারিদ্র ছিল তার নিত্য সঙ্গী। কিন্তু পরবর্তী জীবন সচ্ছলতায় কেটেছে। হযরত উমার রা: তার ভাতা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন।
রাসূলুল্লাহর সা: বিশেষ নৈকট্য লাভের সৌভাগ্যে যাদের হয়েছিল হযরত আবু মুসা রা: সেই সব বিশিষ্ট সাহাবীদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। রাসূলুল্লাহর সা: জীবদ্দশায় যে ছয় ব্যাক্তি ফাতওয়া দানের অনুমতি পেয়েছিলেন, তিনি তাদের অন্যতম। (তাজকিরাতুল হুফফাজ) আসওয়াদ নামক একজন তাবেয়ী বলেন আমি কুফায় হযরত আলী রা: ও হযরত আবু মুসা রা: অপেক্ষা জ্ঞানী ব্যাক্তি আর দেখিনি। হযরত আলী রা: বলতেন: মাথা খেকে পা পর্যন্ত আবু মুসা ইলমের রঙে রঞ্জিত। তিনি সব সময় জ্ঞানী-ব্যক্তিবর্গের সাহচর্যে থাকতেন এবং তিনি তাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। এ আলোচনা কখনও কখনও বাহাস-মুনাজিরা পর্যন্ত পৌছে যেত। বিশেষত: আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও মুয়াজ বিন জাবালের রা: সাথে তার বিশেষ তর্ক-বাহাস হতো। একবার তায়াম্মুমের মাসআলার ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: ও আবু মুসার রা: মধ্যে বিতর্ক হয়। ইমাম বুখারী তায়াম্মুম অধ্যায়ে এ বিতর্ক বর্ণনা করেছেন। তিনি যে শুধু জ্ঞান পিপাসু ছিলেন তাইনা, জ্ঞানের প্রচার ও প্রসারে জন্য আপ্রান চেষ্টা করতেন। তিনি মনে করতেন, যতটুকু তিনি জানবেন অন্যকে তা জানানো ফরজ। একবার এক ভাষণে বলেনধ যে ব্যক্তিকে আল্লাহ ইলম দান করেছেন, তার উচিত অন্য ভাইদের তা জানানো। তবে যে বিষয়ে তার কোন জ্ঞান নেই সে সম্পর্কে একটি শব্দও মুখ থেকে বের করবে না। তার দারসের পদ্ধতিও ছিল বিভিন্ন ধরণের। যথারীতি হালকায়ে দারস ছাড়াও কখনও কখনও লোকজন জড়ো করে তাদের সামনে ভাষন দিতেন। পথে ঘাটে কোথাও এক স্থানে কিছু লোকের দেখা পেলে তাদের কাছে রাসূলুল্লাহর সাধ দু”একটি বাণী পৌছে দিতেন। শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে তিনি খুব কোমল আচরণ করতেন। কেউ অজ্ঞতা বশত: বোকার মত প্রশ্ন করে বসতো, তিনি উত্তেজিত হতেন না। অত্যন্ত নরম সুরে তাকে বুঝিয়ে দিতেন।
পবিত্র কুরআনের সাথে আবু মুসার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। রাত-দিনের প্রায় প্রতিচি মূহুর্ত কুরআন তিলাওয়াত ও কুরআন শিক্ষাদানের মাধ্যমে ব্যয় করতেন। ইয়ামনের ওয়ালী থাকাকালে একবার মুয়াজ বিন জাবাল জিজ্ঞেস করেছিলেন. আপনি কিভাবে কুরআন তিলাওয়াত করেন? বললেন: রাত্র দিনে যখনই সুযোগ পাই একটু করে তিলাওয়াত করে নিই। তিনি সুমধুর কন্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। রাসূল সা: বলতেন: আবু মুসা দাউদের আ: লাহানের কিছু অংশ লাভ করেছে।
তার রাসূল সা: খুব্ই পছন্দ ছিল। তার কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পেলেই রাসূল সা: দাড়িয়ে যেতেন। একবার হযরত আশিয়াকে রা: সংগে করে রাসূল সা: কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আবু মুসার কুরআন তিলাওয়াত শুনতে পেয়ে সেখানেই দাড়িয়ে যান। কিছুক্ষন শোনার পর আবার সামনে অগ্রসর হন। একবার আবু মুসা জোর আওয়াজে ইশার নামাজে কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। সুমধুর আওয়াজ শূনে উম্মুহাতুল মুমিনীন হুজরার পর্দার কাছে এসে কান লাগিয়ে কুরআন তিলাওয়াত শুনতে থাকেন। সকালে যখন এ কথা জানতে পারলেন বললেন: আমি যদি এ কথা জানতে পারতাম তাহলে আরো চিত্তাকর্ষক আওয়াজে তিলাওয়াত করে তাদেরকে কুরআনের আশেক বানিয়ে দিতাম। তার এই অসাধারণ খোশ লাহানের কারণেই রাসূল সা: মুয়াজ বিন জাবালের সাথে তাকেও নওমুসলিমদের কুরআনের তালীম দানের জন্য ইয়ামনে পাঠান। পবিত্র কুরআনের সাথে সাথে হাদীছের খিদমতেও তার অবদান কোন অংশ কম ছিলনা। কুফায় তার স্বতন্ত্র হালকায়ে দারসে হাদীছ ছিল। এই দরসের মাধ্যমে বড় বড় মুহাদ্দিসীন সৃষ্টি হয়েছে। তার বর্ণিত হাদীছের সংখ্যা ৩৬০। তন্মধ্যে ৫০ টি মুত্তাফাক আলাইহি, ৪৫টি বুখারী এবং ২৫টি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন। কুরআন ও হাদীছে তার প্রভূত দখল থাকা সত্ত্বেও নিজের ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন। তেমনিভঅবে অন্যের জ্ঞানের কদরও করতেন। এববার তিনি মীরাস সংক্রান্ত একটি মাসয়ালায় ফাতওয়া দিলেন। ফাত্ওয়া জিজ্ঞেসকারী আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদের কাছেও বিষয়টি জিজ্ঞেস করে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ অন্যরকম ফতোয়া দিলেন। আবু মুসা নিজের ভুল স্বীকার করে মন্তব্য করেন, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ জীবিত থাকা পর্যন্ত তোমাদের আমার কাছে আসা উচিত নয়। হযরত আবু মুসার জীবনটি ছিল, রাসূলের পাকের জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। সর্বদা তিনি চেষ্টা করতেন রাসূলুল্লাহর সা: প্রতিটি কাজ, চলন, বলন, ইত্যাদি হুবহু অনুকরণ ও অনুসরণ করতে। একবার তিনি মক্কা থেকে মদীনা যাচ্ছিলেন। পথে ইশার নামাজে দুউ রাকায়াত আদায় করলেন। তারপর আবার দাড়িয়ে সূরা আন নিসার ১০০টি আয়াত পাঠের মাধ্যমে এক রাকায়াত আদায় করলেন। লোকেরা প্রতিবাদ করলে তিনি বললেন, আমি সব সময় চেষ্টা করে. যেখানে যেখানে রাসূল সা: রেখেছেন সেখানে সেখানে কদম রাখার এবং তিনি যে কাজ করেছেন হুবহু তাই করার।
রামাদানের রোযা ছাড়াও নফল রোজা এজন্য রাখতেন যে, রাসূল সা: তা রেখেছেন। আশুরার রোযা তিনি বরাবর রাখতেন এবং মানুষকে তা রাখার জন্য বলতেন। সুন্নাত ছাড়া মু্স্তাহাবেরও তিনি ভীষন পাবন্দ ছিলেন। কুরবানীর পশু নিজ হাতে জবেহ করা মুস্তাহাব। শুধু এ কারণে তিনি তার নিজ কন্যাদেরকেও হুকুম দিতেন নিজ হাতে পশু জবেহ করার জন্য।
রাসূলুল্লাহর সা: নির্দেশ ছিল কোন ব্যাক্তি যখন কারো বাড়িতে যাবে তখন ভিতরে প্রবেশ করার আগে যেন অনুমতি নেয়। যদি তিনবার অনুমতি চাওয়ার পরেও অনুমতি না পাওয়া যায় তাহলে সে যেন ফিরে আসে। একবার আবু মুসা গেলেন খলীফা উমারের সাথে দেখা করতে। এক এক করে তিনবার তিনি অনুমতি চাইলেন, কিন্তু খলীফা অন্য কোন কাজে ব্যস্ত থাকায় সাড়া দিতে পারলেন না। আবু মুসা ফিরে আসলেন। অন্য এক সময় খলীফা জিজ্ঞেস করলেন আবু মুসা ফিরে গেলে কেন? বললেন, আমি তিনবার অনুমতি চাওয়ার পরেও সাড়া পাইনি তাই ফিরে গেছি। এই কথার পর তিনি এ সম্পর্কিত রাসূলুল্লাহর সা: হাদীছটি বর্ণনা করে শুনালেন। উমার রা: বললেন, হাদীছটি তুমি ছাড়া অন্যকেউ শুনেছে এমন একজন সাক্ষী নিয়ে আসো। আবু মুসা ভয়ে কাপতে কাপেতে আনসারীদের এক মজলিসে উপস্থিত হলেন। সেখানে উপস্থিত উবাই বিন কাবও হাদীছটি শুনেছিলেন। তিনি উমারের রা: কাছে উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দেন। শাবী বলেন: ছয়জনের কাছ থেকে ইলম গ্রহন করা হয়: উমার, আলী, উবাই,ইবনে মাসউদ, যায়িদ ও আবু মুসা।
খলীফ উমার রা: তাকে বসরার ওয়ালী নিযুক্ত করে পাঠালেন। সবরায় পৌছে তিনি সমবেত জনতার সামনে ভাষন দিতে গিয়ে বলেন আমীরুল মুমিনীন আমাকে আপনাদের কাছে পাঠিয়েছেন। আমি আপনাদেরকে আপনাদের রবের কিতাব ও তার নবীর সুন্নাত শিক্ষা দেব এবং আপনাদের পখ ঘাট সমূহ আপনাদের কল্যানের জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবো। ভাষন শুনে জনতাতো অবাক। জনগনকে সংস্কৃতিবান করে তোলা, তাদেরকে দ্বীনের শিক্ষায় শিক্ষিত করাতো শাসকের দায়িত্বের আওতায় পড়তে পারে। কিন্তু তাদের পথঘাটসমূহ পরিষ্কার করার দায়িত্ব তিনি কেমন করে পালন করতে পারেন? ব্যাপারটি তাদের কাছে ভীষন আশ্চর্য্যের মনে হলো। তাই হযরত হাসান রা: তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন : তার চেয়ে উত্তম আরোহী বসরাবাসীদের জন্য আর কেউ আসেনি। (রিজালুন হালার রাসূল) রাসূল সা: তার সম্পর্কে বলতেন: আবু মুসা অশ্বারোহীদের নেতা।
ইরান জয় এর সময় তুসতুস নগরী যখন আবূ মূসা রাঃ জয় করেন সে সময় এর হযরতদানিয়েল আঃ এর লাস কবর দেওয়া কথাও অনেক ইতিহাস গন উল্লেখ করেছেন।তিনি যখন তুসতুস নগরী জয় করেন তারই এক শৈন্য হযরত দানিয়েল আঃ এর লাশ আবিস্কার করেন।তিনি সেই লোক কে সাথে করে সেখানে যান ।লাস দেখেও কপালে চুম্বন করেন এবং ওমর রাঃ এর কাছে চিঠি লিখেন।হযরত ওমর সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি লিখেন লাশ এর সাথে কিছু চর্বি এবং অনেক মুদ্রা পান আর পান একটা আংটি যেটাতে দুইটি সিংহ দানিয়েল আঃ কে চাটছে।হযরত ওমর রাঃ তাকে মহর গুলো বাইতুল মালে জমা করতে বলেন আর সেই আংটি আবু মূসা কে ব্যবহার করতে বলেন।তখন তিনি সেই লাশ বন্দিকৃত ৪ জন লোক কে নিয়ে গিয়ে নদী খনন করান বাদ দিয়ে।নদী খনন করার পর উক্ত নদীতে হযরত দানিয়েল আঃ কে দাফন করেন এবং বাধ খুলে দেন।তারপর সেই চার কয়েদি কে হত্যা করেন যাতে কেউ এই লাশের কবর দেওয়ার স্থান না জানতে পারে।উল্লেখ্য আবু মূসা রা ঃ মারা যাবার পরও তার সন্তানদের কাছে সেই আংটি দেখা যায়।(ইবনে কাসির -আল বেদায়া ওয়ান নেহায়া)
হযরত আবু মুসার সামনে উম্মাতের কল্যান চিন্তাটাই ছিল সবচেয়ে বড়। এজন্য সারাজীবন ব্যক্তিগত সব লাভ ও সুযোগের প্রতি পদাঘাত করেছেন। আলী রা: ও মুয়াবিয়ার রা: মধ্যে যখন যুদ্ধ চলছে, তখন একদিন মুয়াবিয়া আবু মুসাকে বলেছেন. যদি তিনি মুয়াবিয়া সমর্থন করেন, তাহলে তার দু ছেলেকে যথাক্রমে বসরা ও কুফার ওয়ালী নিয়োগ করবেন এবং তার সুযোগ-সুবিধার প্রতিও যত্নবান হবেন। জবাবে আবু মুসা লিখলেন: আপনি উম্মাতে মুহাম্মাদীর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে লিখেছেন। যে জিনিস আপনি আমার সামনে পেশ করেছেন, তার আমার প্রয়োজন নেই।
লজ্জা-শরম ঈমানের অঙ্গ। আবু মুসার মধ্যে এই উপাদানটি পরিপূর্ণরুপে ছিল। রাতে ঘুমানোর সময়ও বিশেষ ধরণের পোশাক পড়ে নিতেন, যাতে সতর উন্মুক্ত না হয়ে যায়। একবার কিছু লোককে তিনি দেখলেন, তারা পানির মধ্যে উলঙ্গ হয়ে গোসল করছে। তিনি বললেন, বার বার মনে জীবিত হওয়া আমার মন:পূত তবুও একাজ আমার পছন্দ নয়।
সংগৃহীতঃ আসহাবে রাসূল ২য় খন্ড।
©somewhere in net ltd.
১| ২২ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ৯:৩৫
আবু আফিয়া বলেছেন: বিশেষ প্রয়োজনে হযরত আবু মূসা আল আশয়ারী (রা।) জীবন খুজতে গিয়ে আপনার লেখাটি পড়লাম, ভাল লাগল, ধন্যবাদ