![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস! আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর, আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল! আমি মানি না কো কোন আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
শাটল ট্রেনের পরিবর্তে সেদিন আমরা তিন বন্ধু মিলে তরীতে চেপে ভার্সিটি যাচ্ছিলাম। নৌকা নয়, ‘তরী’ শহর থেকে ভার্সিটি রুটে চলাচল করা একটি বাস সার্ভিসের নাম। দিনটি ছিল অত্যন্ত উষ্ণ এবং কড়া রোদে উজ্জ্বল। যতদূর মনে পড়ে সকালের অফিস ও ভার্সিটি-গামী যাত্রীতে কানায় কানায় ভরা তরীটির পেছন দিকের সিটে বসে আমরা তিনজন বন্ধু তুমুল হাসি-ঠাট্টায় মশগুল ছিলাম। সেদিন রাস্তায় জ্যাম ছিল না তেমন। তাই নৌকার মতই এপাশ ওপাশ দুলতে দুলতে ঝরঝরা তরী-গাড়িটি বেশ ভালই এগোচ্ছিল।
কিন্তু হাটহাজারি রোডে শহর-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝামাঝি একটা স্থানে এসে হঠাৎ করেই উটকো একটি জ্যামে পড়ল গাড়িটি। রাস্তার মাঝখানে মানুষজনের এলোমেলো চলাফেরা, অস্থির ভিড় দেখে বোঝা যাচ্ছিল জ্যামটি ঠিক স্বাভাবিক নয়। অস্বাভাবিক কিছু একটা ঘটেছে সামনে। তির-তির করে জ্যাম ঠেলে আরও খানিকটা এগোতে আমি হঠাৎ জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম আঁটসাঁট সাদা শার্ট পরিহিত মোটাসোটা এক ভদ্রলোক খালি পায়ে রাস্তার মাঝখান বরাবর হাঁপাতে হাঁপাতে এদিকে হেঁটে আসছেন আর তার পেছনে উৎসুক মুখের ছোট একটা দল। স্থূলকায় ভদ্রলোক এলোমেলো পা ফেলে ঠিক যেদিক যেদিক যাচ্ছিলেন, তার পেছনে আঠার মত লেগে থাকা ছোট দলটিও মন্ত্রমুগ্ধের মত ঠিক সেদিক সেদিক তাকে অনুসরণ করছিল! নিরুপায় ভদ্রলোকটিকে খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল আমার। তাকে ‘কোথায় যেন দেখেছি’, ‘কোথায় যেন দেখেছি’, এই ভাবনা শুরু হয়ে অগ্রগতি পাওয়ার আগেই এক বন্ধু চিৎকার করে বলে উঠল “আররে এতো দেখি স্যার”! হায় হতোস্মি! যে শিক্ষকের ক্লাস করতে ভার্সিটি যাচ্ছি, তাকেই আমি চিনতে পারিনি! অবশ্য এ নিয়ে নিজেকে বেশিক্ষণ দুষবার সময় ছিল না। নিশ্চয়ই কোনও দুর্ঘটনা! আমরা তিনজন আর কিছু চিন্তা না করে তরী থেকে নেমে (এর মধ্যেও অর্ধেক রাস্তার ভাড়া মিটিয়ে দিতে হেল্পার আমাদের ভুলতে দিল না) ভিড়ের কাছ থেকে আমাদের বিপদগ্রস্ত অসহায় শিক্ষকের অধিকার দ্রুত বুঝে নিলাম। বিপদগ্রস্ত শিক্ষক রাস্তার মাঝখানে অপরিচিত মানুষের ভিড়ে ছাত্রদের পেয়ে যেন অকূল পাথারে দিক হারিয়ে ফেলা নাবিকের মত উদ্ধারকারী জাহাজের দেখা পেলেন। অবশ্য তিনিও আমাদের চিনতে পেরেছিলেন বলে মনে হল না কারণ শতাধিক ছাত্রছাত্রীতে ভরে থাকা ক্লাসে আমরা ছিলাম ব্যাকবেঞ্চার! যাহোক, তাড়াতাড়ি করে তাকে রাস্তার পাশের একটা দোকানের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চে নিয়ে বসালাম। তার হাতে পায়ে এদিক ওদিক ছিলে-টিলে গিয়েছিল। দুর্ঘটনায় ঘাবড়ে গিয়ে, পৌষ মাসের কনকনে শীতের সকালে পুকুরের বরফ-শীতল পানিতে স্নান-রত মানুষের মত থর থর করে কাঁপছিলেন তিনি। দোকান থেকে এক বোতল পানি কিনে আমরা তাড়াতাড়ি স্যারের সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। যত্ন করে সাবধানে তার হাত-পায়ের আহত স্থানগুলো ধুয়ে দিলাম। এর মধ্যেই হড়বড় করে দুর্ঘটনার কথা বর্ণনা করছিলেন তিনি। তিনি নাকি একটি সিএনজি ট্যাক্সিতে করে ভার্সিটির দিকে (আমাদের ক্লাস নিতে) চলছিলেন। ট্যাক্সির গতি যে খুব বেশি ছিল তা নয় বরং অপর দিক থেকে আসা দ্রুতগামী একটি প্রাইভেট-কার তার ট্যাক্সিটিকে ধাক্কা দিলে সেটি ছিটকে গিয়ে রাস্তার পাশের একটা গাছের সাথে ধাক্কা খায়। উত্তেজিত হয়ে ঐ অবস্থাতেই তিনি আবার মুখ দিয়ে আওয়াজ করে দেখালেন সিএনজির সিলিন্ডারটি ফেটে ‘সিইইই’ করে কিভাবে গ্যাস বের হয়ে আসছিল। চালকের অবস্থা নাকি আশঙ্কাজনক ছিল। সেই ঘাতক গাড়িটিই নাকি গুরুতর আহত ট্যাক্সি চালকটিকে দ্রুত হাঁসপাতালে নিয়ে গেছে। কিন্তু তার অবস্থা গুরুতর ছিল না বলে তাকে আর তারা নিয়ে যায়নি! যাহোক, আমরা তাকে শান্ত করে, প্রাথমিকভাবে সেবা-শুশ্রূষা দিয়ে আরেকটি সিএনজি-ট্যাক্সি ডেকে তাকে আমাদের মাঝখানে বসিয়ে ছুটে চললাম ভার্সিটির হাসপাতালের দিকে। হাঁসপাতালে পৌঁছে তাকে নার্সদের হাতে সোপর্দ করে আমরা তিনজন যখন চলে যাচ্ছিলাম, তিনি আবার তখন আমাদের ডেকে নিয়ে আমাদের নাম জানতে চাইলেন। আমরা একে একে আমাদের নাম গুলো বললাম তাকে।
স্বাভাবিকভাবেই এরপর কয়েকদিন তিনি আর ক্লাসে এলেন না। কিন্তু আমরা অধীর আগ্রহে স্যারের আশু আরোগ্য লাভের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমরা বন্ধুবান্ধবরা হাসাহাসি করে হলেও বলাবলি করছিলাম যে স্যার পুরোপুরি সেরে ফিরে এসে নিশ্চয়ই ক্লাসে আমাদের খোঁজ করবেন এবং খোঁজ করতেই আমরা, সেদিনের সেই তিন অপ্রত্যাশিত উদ্ধারকারীরা, নিজ নিজ আসন আলো করে গর্বিত বদনে দাঁড়ালে তিনি আমাদের ধন্যবাদ জানাবেন। আর আমরা ক্লাসে উপস্থিত সকল ছাত্রছাত্রীদের (বিশেষ করে ছাত্রীদের) সপ্রশংস দৃষ্টিগুলোকে উপভোগ করতে করতে মুখে সাধু-সুলভ একটা মৃদু হাসি ফুটিয়ে বিনয়ের সাথে সেই ধন্যবাদ গ্রহণ করব। তো, এক সপ্তাহ পার হতেই সম্পূর্ণ সেরে উঠে তিনি আমাদের মাঝে ফিরে এলেন। অন্য সব শিক্ষকদের ক্লাস নিয়মিত ফাঁকি দেওয়া আমাদের প্রতিদিনের কাজ হলেও সেদিন ক্লাসে আমরা সকলেই উপস্থিত। কিন্তু একী! ক্লাসে ঢুকে স্যার অন্যান্য আর দশটা দিনের মত সরাসরি পড়াশুনায় চলে গেলেন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা তো বহু দূরের কথা, একবারের জন্য তার নাতিদীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণটা পর্যন্ত ব্যাখ্যা করলেন না! এভাবে এক দিন গেল, দু দিন গেল, সপ্তাহ কেটে গেল, মাস উড়ে গেল, বছর পেরিয়ে গেল, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনই শেষ হয়ে গেল; কিন্তু হায়, তিনি কোনোদিন ক্লাসে একটিবারের জন্যও সেই দিনের কথা উত্থাপন করেননি! স্মরণ করা তো দূরের কথা, আমাদের যে চিনতে পেরেছেন এমন চেহারাও কোনোদিন তিনি করেননি ক্লাসে কিংবা অন্য কোনও স্থানে! ভাবি, হয়ত আমাদেরই উচিৎ ছিল ক্লাসে সবাইকে চমকে দিয়ে একদিন লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়া এবং তারপর তার লেকচার থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করা, “স্যার আপনার মনে পড়ে, সেই যে সেদিন আপনি এক্সিডেন্ট করেছিলেন; দুর্ঘটনাস্থল থেকে তিনটি লোক আপনাকে হাঁসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিল? স্যার, আমরাই সেই লোক (গুলো)”।
http://www.notun-din.com/?p=9041
২| ১০ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ২:৩৮
তিক্তভাষী বলেছেন: শিক্ষকদের মধ্যে অনেককেই অনেক সময় খাপছাড়া আচরন করতে দেখেছি। মনক্ষুন্ন হবেন না। আপনারা সঠিক কাজটি করেছেন। কোন প্রতিদান কিংবা স্বীকৃতির আশায় নয় নিশ্চয়ই।
©somewhere in net ltd.
১|
১০ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১:৫৮
বিলাসী বলেছেন: যাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিব তারাই সুশিক্ষিত নন, তাই এই অবস্থা। আর আপনি একটু চোখ বোলান গোটা জাতীকে দেখেন সবারই একি অবস্থা। এটা তে বুঝা যায় এ জাতী কোথায় গিয়ে থামবে।