নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল

আরাফাত শাহরিয়র

আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস! আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর, আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল! আমি মানি না কো কোন আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!

আরাফাত শাহরিয়র › বিস্তারিত পোস্টঃ

একজন শান্তির জীবনের গল্প

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:৩১

শান্তি দারুণ উচ্ছল, প্রাণবন্ত, হাসিখুশি একজন মানুষ ছিল। সে দেখতে যেমন ছিল অপূর্ব সুন্দর, তার মনটাও ছিল অদ্ভুত স্বচ্ছ। গল্প, উপন্যাস পড়তে ভালবাসত সে। ভালবাসত ছবি দেখতে, বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যেতে, মাঝে মাঝে এটা সেটা নিয়ে লেখালেখি করতে। ষোড়শী মেয়েরা সাধারণত যেমনটা হয়ে থাকে- শান্তিও উৎফুল্ল, অমলিন চিত্তে সম্মুখের আনন্দময় দীর্ঘ জীবনের স্বপ্নে বিভোর ছিল। গভীর, ছায়াময় চোখ, কান্তিময় মুখ, নিজের দীঘল লালচে-কালো চুলের সৌন্দর্যের সদ্য আবিষ্কারক, সম্প্রতি তারুণ্যে পদার্পণ করা শান্তির পক্ষে অপ্রত্যাশিত কোনও সঙ্কটের কথা আশঙ্কা করে উদ্বিগ্ন হওয়া সম্ভব ছিল না। বরং প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে আরও একটি নির্জলা রোদে ভরা উজ্জ্বল দিন, একটি চমৎকার জীবন যাপন করার প্রফুল্লতায় আবিষ্ট হয়ে পড়ত সে। রিকশায় চড়ে শুভ্র মুখমণ্ডলে ঝকঝকে দিনটির সোনালী রোদ মেখে, রোদের শুষ্ক ঘ্রাণে ভরা বাতাসে সুন্দর চুলগুলোকে উড়িয়ে দিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে, কোনও বন্ধুর বাসার দিকে কিংবা তাদের কাউকে সাথে নিয়ে এলোমেলো, উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ানোর সময় সে মুখোমুখি হতে চাইত কোনও অদ্ভুত ঘটনার, যেখানে হয়ত আছে কোনও দীপ্র তরুণ যাকে সে আগে কখনো দেখেনি। অথবা তেমন কেউই নেই সেই ঘটনায়; শুধু সম্ভাবনা আছে; আছে দুর্জ্ঞেয় অথচ উপভোগ্য এক নূতন অনুভূতি।



কিন্তু শান্তির বাবা ছিলেন পুরনো চিন্তাধারার, একজন রক্ষণশীল মানুষ। উচ্চাভিলাষী তিনি ছিলেন না, যদিও স্ত্রী, কন্যাকে বশে রাখার অভিলাষ ছিল তার। সামাজিক জীবনে প্রতিপত্তির লোভ ছিল না, কিন্তু একজন সমঝদার মুরুব্বী হিসেবে প্রতিষ্ঠার লালসা ছিল। তবে মেয়েকে ভালবাসতেনই বোধহয় তিনি। মেয়ের কোমল এবং একই সাথে নিঃসঙ্কোচ ব্যক্তিত্বের জন্য, তার বহির্মুখিতা ওনার চোখে বিঁধত না।



এদিকে যেমনটা হওয়ার ছিল, অচিরেই কলেজে এক ছেলে শান্তির প্রেমে হাবুডুবু খেতে শুরু করল। শান্তির রূপে প্রমত্ত ছিল যদিও অনেক ছেলেই, কিন্তু শান্তির মনোযোগ আকর্ষণ করার মত উন্মত্ততা অর্জন করতে পেরেছিল শুধু সেইই। বাবার রক্ষণশীল মানসিকতা সম্পর্কে শান্তি ভালভাবেই অবগত ছিল। তাই অজানা কোনও বন্ধুত্বের জন্য তার ভেতরে চাঞ্চল্য থাকলেও, সে তা সনাক্ত কিংবা স্বীকার করতে চাইত না। আর তাই ছেলেটির অমন ভালবাসা প্রকাশে শান্তি বিমোহিত হবার চেয়ে, বিচলিতই হল বেশি। সেই ছেলেও দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না। নীরব প্রত্যাখ্যানে সে ক্রমান্বয়ে প্রতিদিন যেন আরও বেশি মরীয়া হয়ে উঠতে শুরু করল। প্রথমে শান্তির যাওয়া-আসার সময় কাকতালীয়ভাবে মূল ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যেত তাকে। কিংবা ক্লাসে হয়ত স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিবার লক্ষ্য করত সে শান্তিকে। কিন্তু কিছুদিন বাদে বাসার সামনের রাস্তায় ছেলেটিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পেল শান্তি। এবং ছেলেটিকে ঘিরে শান্তির উৎকণ্ঠা ক্রমে কোনদিন যে উচ্ছ্বাসে রূপ নিতে শুরু করেছিল, তা সম্পর্কে সে সচেতনভাবে অজ্ঞ থাকতে চাইল। এর মধ্যে একদিন বিকেলে শান্তি প্রতিদিনের মত ছাদে ঘুরতে গিয়েছিল একা; একটি বই আর এক কাপ চা নিয়ে হাতে। সিঁড়ির অন্ধকার থেকে দরজা দিয়ে আলোকিত ছাদে ঢুকতেই ভুত দেখার মত চমকে সে দেখে, সেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে। কি করে যেন এখানে উঠে এসেছে সে! তবে বিস্ময়কর দ্রুততায় নিজেকে সামলে নিয়ে ছেলেটির সাথে কথা বলে সে। এবং নিজেকে অবাক করে দিয়ে তাকে সে তখনি চলে যেতে বলেনি। এভাবে আরও কিছু বিকেলের পর একদিন শান্তির মা তাদের দুজনকে ছাদে কথা বলতে দেখে ফেলে। তারপর কিভাবে ছেলেটি সেখান থেকে চলে গিয়েছিল আর কি ভয়ানক মানসিক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে যে সেই সময়টা পার করেছিল শান্তি, তা সে মনে করতে পারে না আজ। সেই ঘটনার পর থেকে তার কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং এক সপ্তাহের মধ্যে তার বাবা, নিজের এক সহকর্মীর সাথে ঐ টুকু বয়সেই তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। বর-কনের বয়সের পার্থক্য যতটুকু হলে অসম বিয়ে বলা হয়, হবু বরের বয়স ছিল তার চেয়ে বেশি। একটি অলস শ্লথের মত ছিল তার আচরণ। বিরক্তিকর, একঘেয়ে ছিল তার কথা বলার ভঙ্গি কিংবা মূক অভিব্যক্তি। কিছু বুঝে উঠার আগেই একদিন সেই লোকের সাথে শান্তির বিয়ে হয়ে গেল। সংসার জীবনে, শান্তির সাথে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকা তার বয়স্ক, নিষ্প্রাণ পুত্তলির মত স্বামীটির আচরণ ছিল এমন, যেন বিয়ে করে সে শান্তিকে উদ্ধার করেছে; বাঁচিয়ে দিয়েছে তার পরিবারের সংকটাপন্ন মান-মর্যাদা। এহেন নিরন্তর মানসিক অত্যাচারে এক সময়ের উচ্ছল শান্তি যখন ভয়ানক অস্থির হয়ে উঠছিল এবং ফলশ্রুতিতে যখন সে বড় ধরণের কোনও সিদ্ধান্ত নিতে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছিল, ঠিক তখন সে আবিষ্কার করে তার ভেতর এক চিলতে সূর্যালোকের মত জন্ম নিয়েছে একটি নতুন প্রাণের সম্ভাবনা। এবং তারপরই সেই নূতন দ্যুতিটির জন্য তাকে উপেক্ষা করতে হল সমস্ত মানসিক নিপীড়ন; সে বিসর্জন দিল নিজের নবীন জীবনকে।



একদিন সত্যি সত্যি ঘনায়মান সন্ধ্যায় ভরে থাকা শান্তির জীবন আলো করে এলো তার সূর্য, তার সন্তান। এরপর, কিভাবে বছরের পর বছর কেটে যেতে লাগল, কিভাবে একের পর এক তপ্ত গ্রীষ্ম এলো, অজর-মেঘমেদুর বর্ষা কিভাবে প্রশান্তি বইয়ে দিল মানুষের সাদাসিধে জীবনে, কিভাবে অস্ফুট শরত, হেমন্ত, শীত, বসন্ত ফিরে ফিরে এসে নিজেদের বারংবার তুলে দিল ভৈরব গ্রীষ্মের নিদাঘ হাতে, তার ঠাহর করতে পারল না শান্তি। এভাবে দুই যুগ পার হয়ে গেল। শান্তি তখন মধ্য বয়স্কা; তার পুত্র নিজের দেখভাল করার মত যথেষ্ট পরিণত আর স্বামীটি আগের মতই- দীর্ঘদিনের চর্চায় এবং হীনমন্যতায় জেরবার হতে থেকে শান্তিকে অবিরত মানসিক অত্যাচার করতে অভ্যস্ত এবং দক্ষ। সব কিছু চলছিল আপাতদৃষ্টিতে, ঠিকঠাক। কিন্তু একদিন, কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই সবকিছু ভোজবাজীর মত আমূল পালটে গেল। জীবিত লাশের মত জীবন হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে অভ্যস্ত শান্তির অন্তর্জগতে ঘটে গেল এক আকস্মিক বিস্ফোরণ। যেন দীর্ঘকাল ধরে ঘোরের ভেতর বাস করে হঠাত এক ভোরে জেগে উঠল সে এবং সে যেন ভয়ানক বিস্ময়ের সাথে উপলব্ধি করল, অনাড়ম্বর-নিপীড়িত-বঞ্চিত তার এই একটি মাত্র জীবন কিভাবে অগৌরবে শেষ হতে চলেছে। সে তীব্র আতঙ্কের সাথে ভাবল, এভাবে সে মরে যেতে পারে না। এই জীবন তার প্রাপ্য ছিল না। নিজের দেনাপাওনা বুঝে নিতে সে যেন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে উঠল! কিন্তু তার আদরের পুত্র ও বয়োবৃদ্ধ স্বামী গাঁটছড়া বেঁধে শান্তির আকস্মিক ব্যাকুলতাকে কটাক্ষ করল; তীব্র তিরস্কারে নাকাল করল শান্তিকে। শান্তি হতবাক হয়ে দেখল- যে ছেলের জন্য নিজের তারুণ্যকে সে বিসর্জন দিয়েছিল, সে ছেলে আজ তার মুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে! কিন্তু ততদিনে শান্তি পোড় খাওয়া কঠিন এক মানবী। যত যাই হোক, সমাজ যন্ত্রের নিষ্ঠুর পিস্টনে সৃষ্ট আচার এবার আর দমিয়ে রাখতে পারবে না তাকে।



তারপর একদিন অনেক খুঁজে পাওয়া এক পুরনো বন্ধুর হাত ধরে শান্তি সত্যি সত্যি ছেড়ে ছিল ঘর, স্বামী, পুত্র; নিজের সাজানো যান্ত্রিক সংসার। সবাই বলল, 'আন্না কারেনিনার মত করুণ পরিণতি হবে এই দুর্বিনীত ভদ্রমহিলার'; শেষে, আত্মহননের পথ বেঁছে নিতে হবে একে। কিন্তু কই? লোকের রটানো বদনাম, স্বামীর ছড়ানো কুৎসা, ছেলের বিস্ময়কর উপেক্ষাকে উপেক্ষা করে শান্তি শহরতলীতে ছোট্ট একটি বাসা ভাড়া নিয়ে একার সংসার বেঁধে নিয়ে নির্ভার, মুক্ত জীবন যাপন করতে শুরু করল অচিরে। ততদিনে তার নির্দয় মা-বাবা গত হয়েছে। একটি স্বার্থপর ভাই, কিছু বন্ধুবান্ধব ছাড়া এই পৃথিবীতে তার আর কেউ ছিল না। সে জানে না এর শেষ কোথায়। কিন্তু সে জানে, ধুকে ধুকে নিজের একটি মাত্র জীবনকে নিঃশেষ হতে দেখার চেয়ে, অজানা, অনির্দেশ্য ভবিষ্যতের উদ্দেশ্যে স্রোতের বিপরীতে সাতার দেয়াও অনেক গৌরবের, স্বস্তির। বছরের পর বছর ধরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে থাকা শান্তির নিষ্প্রাণ জীবনে অবশেষে দৈবাধীন নয়, এমন এক ভোরে দপ করে জ্বলে উঠল এক অচেনা নক্ষত্র। শান্তি বেঁচে উঠল।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৯:০৭

পাঠক১৯৭১ বলেছেন: কিন্তু আপনি কি তাকে সুখী করেছেন?

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৪৪

আরাফাত শাহরিয়র বলেছেন: কী?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.