নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল

আরাফাত শাহরিয়র

আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস! আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর, আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল! আমি মানি না কো কোন আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!

আরাফাত শাহরিয়র › বিস্তারিত পোস্টঃ

রাসেলের জীবন

২৬ শে মে, ২০১৪ বিকাল ৫:২২

রাসেল যখন তার স্কুলের আয়তাকার ছোট্ট সবুজ মাঠটিতে টিফিন ঘণ্টায় বন্ধুদের সাথে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে বেড়াত, বিকেলে রাস্তার পাশে, বাগানের ঝোপঝাড়ে পাতার নিচে লুকিয়ে থাকা সোনালী পোকা কিংবা গ্রীষ্মের দুপুরগুলোতে আকাশে কাটা পড়ে বাতাসে ভেসে ভেসে ভূপাতিত হতে থাকা রঙিন ঘুড়ি খুঁজে বেড়াত তখনই তার মা-বাবা দেশের অর্থনৈতিক হাওয়া-বাতাস বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাসেলকে কমার্স পড়াবেন; ব্যবসায় শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। চারিদিকে তখন বিবিএ-এমবিএ’র জয়জয়কার! গার্মেন্টস, লজিস্টিকস, ব্যাঙ্ক, বিজ্ঞাপন, পরিবহন (বিপণন)– কোথায় এমবি’র কদর ছিল না! এমনকি সেই সময় ডাক্তার ইঞ্জিনিয়াররা পর্যন্ত তাদের সমস্ত পড়াশুনা শেষে একটা এমবিএ করে রাখতে আগ্রহ বোধ করতেন। সেই বাস্তবতায় রাসেলের মা-বাবার মত, তখনকার সাধারণ শিক্ষিত দম্পতিদের জন্য সন্তানের সচ্ছল ভবিষ্যৎ কামনা করে তাকে ব্যবসায় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাওয়ার সিদ্ধান্তটি ছিল সবচেয়ে সহজ এবং নিরাপদ সিদ্ধান্ত।



বড় হয়ে অন্তত ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বৈজ্ঞানিক, বৈমানিক (মানবিক) ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনাগুলোকে লীন করে দেয়া সিদ্ধান্তটি চূড়ান্ত করার সময়ও রাসেল বিষয়টিকে পুনঃ বিবেচনা করার মত উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে পারেনি। ততদিনে ছোঁয়াছুঁয়ি, লুকোচুরি, সোনালী পোকার মোহো কেটে গিয়েছিল ঠিক, কিন্তু সেই সময়টিতে রাসেলদের এলাকায় ফুটবল টুর্নামেন্ট চলছিল বলে দারুণ ব্যস্ত ছিল সে। টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর একটির অধিনায়ক হিসেবে তার তখন চিন্তিত হবার জন্য পড়াশুনা ছাড়াও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল হাতে। তাছাড়া তখন মাঝেমাঝেই পাশের পাড়াগুলোতে ক্রিকেট খেলতেও যেতে হত তাকে, বন্ধুদের অনুরোধে! ছোটাছুটি, পোকামাকড়, মাছ-ব্যাঙ, লাটিম-ঘুড়ির পাঠ চুকলেও মাঠ, বাগান, আকাশ কিংবা বিকেলের সাথে রাসেলের সম্পর্ক বরং গভীরতর হয়ে উঠেছিল। তার ঘরে ঢোকা আর সন্ধ্যা মিলিয়ে যাওয়ার সময়ের ব্যবধানও বাড়ছিল প্রতিদিন। তবে এও নয় যে নিজের সেই নির্বিঘ্নতার কারণে পরবর্তীকালে রাসেলকে আফসোস করতে হয়েছিল কখনো। বরঞ্চ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চমৎকার, প্রসন্ন শিক্ষা জীবন কাটিয়েছিল সে। পড়াশুনার প্রতি রাসেলের অনুরাগই ছিল, রাগ ছিল না; জেদ ছিল, ক্ষেদ ছিল না। তাছাড়া ছোটকাল থেকেই সে নিজের মতামতের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে; নিজেকে একজন ভালমানুষ ভেবেছে এবং অন্যে তাকে নিয়ে কি ভাবছে তা নিয়ে আক্ষরিক অর্থেই ভাবিত হয়নি সে কখনোই। ফলে পড়াশুনা শেষ করে একের পর এক ব্যর্থ ইন্টার্ভিউ ও পরবর্তী শূন্য, রিক্ত দিনগুলোর ভেতর দিয়ে যাওয়া স্বত্বেও দ’মে না গিয়ে বরং অবশেষে সে ঠিকই একটি নামকরা কোম্পানিতে ভাল পদে, ভাল বেতনের চাকরি জোগাড় করে ফেলেছিল। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনদের ঠিক যেন খুশি করা নয়– আশ্চর্যান্বিত, ঈর্ষান্বিত করার মত চাকরি ছিল সেটি। আর তার অতুলনীয় আগ্রহ, আকাঙ্ক্ষা, উৎসাহ, উদ্যম এবং পরিমিতি বোধ তাকে নিয়ে গিয়েছিল স্বচ্ছন্দ, সফলতা এবং সচ্ছলতার শীর্ষ বিন্দুতে।



রাসেল বিয়ে করেছিল তার মনের মত একজন মানুষকে। তারা সুখী হয়েছিল। তাদের একটি সন্তান হয়েছিল। সে ও তার স্ত্রীর যৎসামান্যের সাথে পরিবারের ‘না অতি সামান্য’ যোগ হয়ে তাদের চাহিদার পরিমাণ-মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল বটে, কিন্তু রাসেলের সামর্থ্যকে তা পেছনে ফেলতে পারেনি কখনই। বরং কিছু জমিজমা, কিছু অলস অর্থ জমে যাওয়ার পর চাকরির পাশাপাশি এটা-ওটার ব্যবসা শুরু করেছিল রাসেল। স্বল্প সময়ের মধ্যে তার ধৈর্য ও স্থৈর্যের ব’লে সেগুলো দাঁড়িয়েও গিয়েছিল এক আধ বার হোঁচট খাওয়া স্বত্বেও। একদিন সুন্দর একটি ঘরও কিনে ফেলেছিল সে। ঘরটিকে সাজিয়েছিল মনের সমস্ত সাধ, স্বপ্নগুলোকে একত্র-একাট্টা করে। বসার ঘরের ছাদ থেকে ঝুলিয়ে ছিল জমকালো ঝাড়বাতি; দরজায়-দেয়ালে করেছিল জাঁকালো কাঠের কাজ। মা-বাবার রুমগুলোতে নিশ্চিত করেছিল আলো-বাতাস-পানির তাপমাত্রা এবং প্রবাহের প্রাবল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা। দামী ডেকোর খচিত টাইলস, ফিটিংস; কৃত্রিম লতাপাতা, ফায়ার-প্লেস এটা সেটাই শুধু নয়, তাদের শোবার ঘরের লাগোয়া বারান্দায় সারিবদ্ধ ভাবে সাজিয়ে রাখা টবে বোনা ফুলের গাছগুলোতেও ফুটেছিল রঙিন, সজীব, সুগন্ধি ফুল।



রাসেলদের সন্তানটিকে লালন পালনে সহায়তার জন্য একজন কাজের মানুষের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল তাদের। প্রয়োজন সৃষ্টি হওয়ার অব্যবহিত পরেই তাদের দালানের সদর দরজার দায়িত্বে থাকা প্রবীণ দারোয়ান তথা প্রাঙ্গণের তত্ত্বাবধায়ক একটি মেয়ে জোগাড় করে এনে দিয়েছিল তার গ্রাম থেকে। কিশোরীর নাম ছিল রিমি। খুব চঞ্চল ছিল রিমি যখন সে এসেছিল রাসেলদের বাসায়– রোদে পোড়া ত্বক, অবিন্যস্ত লালচে চুল, পরনের একটি মাত্র মলিন জামা আর এক গাল হাসি নিয়ে। সে দারুণ স্নেহে এবং পরম দায়িত্বের সাথে বড় করে তুলেছিল রাসেলদের শিশুটিকে; নিজেও বড় হয়ে উঠছিল তরতর করে! দেখতে না দেখতেই একদিন মেয়েটির মা-বাবা মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোরজোড় করে দিল। সে নাকি বিবাহ-যোগ্য হয়ে উঠেছিল! এরপর আসন্ন জীবনের জন্য মনে ও সামর্থ্যে সচ্ছল রাসেলদের যথেষ্ট সহযোগিতা, বস্তু-অবস্তুগত আশীর্বাদ ও প্রাপ্য মজুরী নিয়ে রিমি চলে গেলে রাসেলের স্ত্রীর এক পরিচিতা আরেকজন কাজের লোক জোগাড় করে এনে দিয়েছিল তাদের। এই মেয়েটির নাম ছিল ফাতেমা। নিজের একটি সন্তান রেখে এসেছিল সে এখানে। কিছুদিনের ব্যবধানে ফাতেমা সব গুছিয়ে নিলেও রাসেলের স্ত্রী সবসময় রিমির খোঁজখবর নিত ফোনে। রিমির স্বামী ছিল ইটের ভাটার শ্রমিক। ইটের ভাটাগুলো শ্রমিকদের বেতন মাসে নয়, একবারে, আগাম দিয়ে দিত। হয়ত এভাবে অনেকগুলো টাকা একসাথে দিয়ে অশিক্ষিত শ্রমিকদের ফাঁকি দেয়া সহজ ছিল! আগাম টাকাটা হাতে পেলে কাজে যোগ দেয়ার আগে রিমির স্বামীর মত শ্রমিকেরা খুব বাজার করত নিজেদের জন্য– জামাকাপড়, জুতা-স্যান্ডেল কিনত, ঘরের কাজ করাত, চালের ফুটো সারাত, মন ভরে মুড়িমুড়কি, এটা সেটা খেত, নতুন মোবাইলও কিনত একখান! কিন্তু কাজে যোগ দিয়ে তারা যখন রীতিমত নিরুদ্দেশ হত, তার কিছুকাল পরেই তাদের পরিবারগুলো আবিষ্কার করত- খেয়ে পরে বাঁচার যা খরচ, সে পরিমাণ অর্থ-ব্যবস্থা তারা হিসেব করে রাখতে পারেনি। এদিকে ইটের ভাটার প্রচণ্ড পরিশ্রম, হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ শেষে কিংবা শেষ হওয়ার আগেই রীতিমত পালিয়ে শ্রমিকরা- রিমির স্বামীরা- যখন ঘরে ফিরে আসত, তখন ক্লান্তি-অবসাদ-অসুস্থতা-অবসন্নতা-খিটখিটে মেজাজ ছাড়া সেখান থেকে তারা আর কিছুই নিয়ে আসতে পারত না সঙ্গে করে। স্বাভাবিকভাবেই, আরও অনেকের মত, ইটের ভাটার শ্রমিক রিমির স্বামীও পরিবার গড়ে তুলতে কিংবা তাকে টেনে নিতে অপারগ হয়ে রিমিকে ছেড়ে দিয়েছিল বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। তালাক-প্রাপ্ত, পরিত্যক্তা, অসহায় রিমি একদিন শহরে ফিরে এসে কোথায় যে হারিয়ে গিয়েছিল তারপর, তার জের রাসেল কিংবা রাসেলের স্ত্রী ধরে রাখতে পারেনি আর। হয়ত তাদের বর্তমান ফাতেমা, রিমির মতই একজন ছিল! সহায়সম্বলহীন, নিঃস্ব, অসহায় হয়ে গ্রাম থেকে শহরে হারিয়ে এসেছে তাদের দ্বারপ্রান্তে অথবা যেত কোনও কারখানার সদরদরজার সামনে লাইনে দাড়াতে।



রাসেল কিংবা তার স্ত্রী রিমিকে খুব যে স্নেহ করত এমন নয়! তাদের সম্পর্ক নিয়োগকর্তা ও নিয়োজিতের সম্পর্কের অতিরিক্ত কিছু ছিল না। তথাপি, রিমির অমন পরিণতি প্রবল ভাবে আলোড়িত করেছিল রাসেল ও রাসেলের স্ত্রীকে। সফলতা-স্বাচ্ছন্দ্য-সচ্ছলতা, বাসা-গাড়ি, সাজানো-সুখী-সুস্থ পরিবার পেয়েও মনের গভীরে রিমির পরিণতির অভাবনীয় ধাক্কা সবকিছু পালটে দিয়েছিল রাসেলের জীবনের। সে যে এই ঘরেই থাকত এক সময়! খেলত তাদের শিশুটির সাথে! আকস্মিক, যেন অকারণ, সেই অভিঘাত রাসেলের অন্তর্দেশে প্রক্ষিপ্ত করেছিল একটি অমোঘ, অসহনীয় চিন্তা– এ ক্যামন সফলতা তাদের? এ ক্যামন করুণ নিয়তিতে তারা নির্ধারিত? যে জীবন নিজেদেরটির ছাড়া আর কারো জীবন গড়ে না, কোনও পরিবর্তন করে না, শুধু দানখয়রাতের শ্লাঘায় মাতিয়ে লাইফ সাপোর্ট হয়ে উপার্জনকারী, ভোগকারীকে বাঁচিয়ে রাখে বছরের বছর; তারপর তার সন্তানসন্ততিদের, তারপর তাদের পরবর্তী প্রজন্মকেই শুধু, অথচ তাদের চারপাশে ক্রমাগত আবর্তিত হয় হাজারো দুঃস্থ জীবন এবং জমে থাকে কাজের মানুষ কিংবা শ্রমিক সরবরাহের পাইপলাইনে…সেই জীবনের কী অর্থ? এ জীবন কিভাবে গৌরবময় হতে পারে? এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চাবি দেয়া পুত্তলির মত চারটা সুন্দর দেয়াল, সুস্বাদু খাবার, সুললিত শ্রী, সমুজ্জ্বল যানের পেছনে কতদিন তারা ছুটবে ঔজ্জ্বল্য-কামী পোকামাকড়ের মত? শুধু খেয়ে-পরে-চড়ে-থেকে-খেয়ে একে একে একঘেয়ে মরণ তারা আর কতদিন মরবে, ঘর ও বাক্সের ভেতর? গাছের কাণ্ড ভেদ করে অন্ধকারে বাসা বাঁধা পোকার মত নিভৃতে, নিঃশব্দে? এই ভয়াবহ উপলব্ধি ভয়াল আগ্নেয়গিরির মত উৎক্ষিপ্ত হওয়ার পরেও রাসেল বেঁচে ছিল অনেক দিন। এবং অগৌরবে, শুধু ইট-কাঠ-পাথরের মালিক বেশে মরার প্রচণ্ড ভয় সে নিঃসন্দেহে সঞ্চারিত করেছিল তার ছেলেমেয়েদের মাঝেও, যারা তাদের বাবার চিন্তাকে শ্রদ্ধা করেছিল, যদিও তার জীবনের মত জীবনগুলোকে প্রচণ্ড ভয় করেছিল।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে মে, ২০১৪ রাত ৯:৪০

উদাস কিশোর বলেছেন: চমত্‍কার লিখেছেন

২৭ শে মে, ২০১৪ সকাল ৯:২৬

আরাফাত শাহরিয়র বলেছেন: ধন্যবাদ! :)

২| ২৭ শে মে, ২০১৪ সকাল ১১:৪৯

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:


ভাল লাগল লেখাটা পড়ে +++

২৭ শে মে, ২০১৪ দুপুর ১২:৪৫

আরাফাত শাহরিয়র বলেছেন: পড়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ! :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.