![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বলার মত কোন বিশেষ গুনাবলি আমার নাই ।
আমরা গাজার প্রতি সহানুভূতিশীল কিন্ত নিজ মুক্তিযোদ্ধা অভাবে মারা গেলেও চেয়ে দেখি না, এটা নিয়ে কাল স্ট্যাটাস দেয়ায় এক মহিলা বলেছেনঃ
"কয়জন বাঙালি রোজা মুখে নিয়ে শহিদ হয়েছে? কয়জন বাঙালি মসজিদে সিজদারত অবস্থায় শহিদ হয়েছে? কয়জন বাঙালি মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হয়েছে? মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থা নিশ্চয়ই এতটাও শোচনীয় হয়নি !"
না, ওই মহিলার প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। আসলে সমাজের নষ্ট ভ্রষ্ট অশিক্ষিত একটা অংশ ফেসবুকে এসে হঠাত করে শিক্ষিত হয়ে গেছে, তবে একটু অন্যভাবে। তারা বিশ্বাস করা শুরু করেছে, মুক্তিযুদ্ধ একটা বিচ্ছিন্ন গণ্ডগোল, কিন্ত শাপলা চত্তরে ঠিকই আড়াই হাজার শহীদ হয়েছে। তারা বিশ্বাস করে হিটলার ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ঠিক কাজ করেছে, তারা বিশ্বাস করে গাজার হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড, তবে ইরাকে কেউ কাউরে মারে না, সিরিয়ায় আফগানিস্তানে কোনো যুদ্ধ নেই।
এই মানুষগুলো এখন বিশ্বাস করা শুরু করেছে, গাজায় যা হচ্ছে তার তুলনায় একাত্তর কিছুই না, হামাসের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা নগন্য! আমি কিছু বলবো না, আমি শুধু তাদের জন্য ইতিহাস থেকে দুটো ঘটনা হুবুহু তুলে ধরবো, তবে তার আগে একটা কথা বলে নিই। গাজার ব্যাপারটার সাথে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের তুলনা আমি করছি না, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সাথে কিছুই তুলনীয় হতে পারে না। তেমনি গাজার হত্যাকাণ্ডকে ছোট করে দেখানোও আমার উদ্দেশ্য নয়, গাজায় অবশ্যই ইজরায়লিরা ঘৃণ্য পিশাচতা চালাচ্ছে। আমি শুধু ওই মহিলার কথার জবাব দিতেই এটা তুলে ধরছি, গাজার মত একটা ব্যাপারের সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধের তুলনা করে মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করার ইচ্ছা আমার নেই।
১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার একটা অংশঃ
"নওগাঁর তাজ সিনেমা হলের নিকটবর্তী পুরনো পশু হাসপাতালটি অতিক্রম করে উত্তর দিকে কিছু দূর গেলেই দেখা যাবে, ছোট একটি মসজিদ। তার পাশেই রয়েছে একটি দালান বাড়ি। বসবাস করত এক বিহারী ব্যবসায়ী, নাম ইদ্রিস। তার বাসার ভেতর যেতেই যে কেউ চমকে উঠবেন। দেখতে পাবেন দুই ঘরের ভেতরে নির্মম হত্যার প্রমাণ চিহ্ন। একটি ঘরে অনেক দড়ি ঝুলে আছে। আর অপরটিতে রয়েছে অসংখ্য বাঙালির রক্তের ছাপ। বিহারী ব্যবসায়ীরা খানসেনাদের সহযোগিতায় যেসব বাঙালিকে ধরে এনে জবাই করতো, তাদের রক্তে তার অপবিত্র হাত রঞ্জিত করে, তা দিয়ে ঘরের জানালা রাঙিয়ে নিত, যেন আলতা দিয়ে সাজানো হয়েছে।
খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের হত্যাকা ছিল যেমন লোমহর্ষক, তেমনি নির্মম ও নিষ্ঠুর। মিলের জ্বলন্ত বয়লারের ভেতরে ফেলে কমপক্ষে ৫৬ জনকে হানাদাররা পুড়িয়ে হত্যা করে। বাঙালি শ্রমিকদের এনে বসানো হতো বয়লারের সামনে বিশ ফুট উঁচু পাকা প্রাচীরের পাশে। এরপর তাদেরকে বস্তাবন্দি করে পায়ের দিক থেকে জ্বলন্ত বয়লারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। ঢোকানো অংশ পুড়ে গেলে দেহের বাকি অংশ ও মাথা একটু একটু করে বয়লারে ঢুকিয়ে দেয়া হতো। "
আচ্ছা, উনি বলেছেন মুক্তিযোদ্ধারা রোজা নিয়ে শহীদ হন নাই, তাদের অবস্থা বেটার ছিল! কজন বাঙালি পেট পুরে খেয়ে যুদ্ধ করতো আমার জানা নেই, যাই হোক শহীদ আজাদের শেষদিনগুলোর কথা উঠে এসেছে এভাবেঃ
"১৯৭১ এর ৩০ শে আগস্ট পাকিস্তানী বাহিনী ধরে নিয়ে যায় আজাদকে তার বাসা থেকে । বাঙ্গালী দালালদের সহযোগীতায় সমস্ত শহরে রেইড দিয়ে গ্রেফতার করে আজাদ, জুয়েল, বাশার, সেকেন্দার, মনোয়ার, বদি, চঞ্চল, রুমী, সামাদ, চুল্লু, আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারক আলভী, শরীফ ইমাম, জামী, টগর, .............।
নারকীয় নির্যাতনের মধ্যে টোপ দেয়া হয় রাজস্বাক্ষী হওয়ার । সহযোগী যোদ্ধাদের নাম পরিচয় বলে দিলে মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় আজাদকে । আজাদের মা যিনি ছেলেকে কোনদিন একটি চড়ও দেননি, তিনিই বলেন, “বাবা রে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো । সহ্য করো । কারো নাম যেন বলে দিও না ।” সাধারন এক মা হয়ে ওঠেন এক অসাধারন যোদ্ধা ।
বন্দী শিবিরে মাকে আজাদ বলে পরদিন ভাত নিয়ে আসতে, দু’দিন ধরে সে ভাত খায়নি । আজাদের মা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরদিন ভাত নিয়ে যান, ছেলের দেখা পান না । আর কখনই দেখা হয় না মায়ের সঙ্গে ছেলের ।
দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৪ বছর পরে ঠিক ৩০ শে আগস্ট (১৯৭১ এর যেদিনটিতে আজাদ গ্রেফতার হয়েছিল) ১৯৮৫ তারিখে আজাদের মা মারা যান । এরমধ্যে তিনি আর কোনদিন ভাত খাননি, বিছানায় ঘুমাননি । মাটিতে চাদর পেতে ঘুমাতেন আর একবেলা রুটি খেতেন । মৃত্যুর আগে পুত্রসম ভগ্নীপুত্র জায়েদকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন তার কবরের নামফলকে যেন শুধুই লেখা থাকে “মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম - শহীদ আজাদের মা” । নিরাভরন অতি সাধারন অথচ বড় উজ্জ্বল পরিচয় একজন মুক্তিযোদ্ধার, একজন মুক্তিযোদ্ধার মায়ের ।"
উপরের অংশটুকু লিখতে গিয়ে আমার কান্না চেপে রাখতে হয়েছে, চোখ ভিজে উঠেছে। কিন্ত এখানে থামবো না, যে মানুশটার উত্তর দিতে গিয়ে এগুলো লেখা তিনি তো একজন নারী! একাত্তরের বীরঙ্গনাদের কথা তাকে যে না শোনালেই নয়, তিনি যে নিজ দেশের মুক্তিযুদ্ধের নৃসংসতার কথা কিছুই জানেন না!
"বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দলিলপত্র: অষ্টম খন্ড" থেকে রাবেয়া খাতুনের সুদীর্ঘ জবানবন্দীর কিছু অংশ হুবুহু নিচে দিলামঃ
"যে সকল বাঙালি যুবতী ওদের প্রমত্ত পাশবিকতার শিকার হতে অস্বীকার করল দেখলাম তৎৰণাৎ পাঞ্জাবী সেনারা ওদেরকে চুল ধরে টেনে এনে স্তন টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে ওদের যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে বন্দুকের নল, বেয়নেট ও ধারালো ছুরি ঢুকিয়ে দিয়ে সেই বীরঙ্গনাদের পবিত্র দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল। অনেক পশু ছোট ছোট বালিকাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করে ওদের রক্তাক্ত দেহ বাইরে এনে দুজন দু'পা দু'দিকে টেনে ধরে চড় চড়িয়ে ছিড়ে ফেলে দিল, আমি দেখলাম সেখানে বসে বসে, আর ড্রেন পরিষ্কার করছিলাম। পাঞ্জাবীরা মদ খেয়ে খেয়ে কুকুরের মতো যার যে মেয়ে ইচ্ছা তাকেই ধরে ধর্ষণ করছিল।
শুধু সাধারণ পাঞ্জাবী সেনারাই এই বীভৎস পাশবিক অত্যাচারে যোগ দেয়নি, সকল উচ্চ পদস্থ পাঞ্জাবী সামরিক অফিসাররা মদ খেয়ে হিংস্র বাঘের মতো হয়ে দুই হাত বাঘের মত নাচাতে নাচাতে সেই উলঙ্গ বালিকা, যুবতী ও বাঙালি নারীদের ওপর সারাক্ষণ পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ কাজে লিপ্ত থাকতো। কোনো মেয়ে-নারী-যুবতীকে এক মুহূর্তের জন্য অবসর দেয়া হয়নি।
হানাদারদের উপর্যুপরি ধর্ষণ ও অবিরাম অত্যাচারে বহু কচি বালিকা সেখানে রক্তাক্ত দেহে কাতরাতে কাতরাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে। পরের দিন এই সকল মেয়ের লাশ অন্য মেয়েদের সম্মুখে ছুরি দিয়ে কেটে কুচি কুচি করে বস্তার মধ্যে ভরে বাইরে ফেলে দিত। এ সকল নারী, বালিকা ও যুবতীর নির্মম পরিণতি দেখে অন্য মেয়েরা আরো ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তো এবং স্বেচ্ছায় পশুদের ইচ্ছার সম্মুখে আত্মসমর্পণ করতো।
এরপর বহু যুবতী মেয়েকে হেডকোয়ার্টারের উপর তলার বারান্দায় মোটা লোহার তারের উপর চুলের সঙ্গে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়। প্রতিদিন পাঞ্জাবীরা সেখানে যাতায়াত করতো। সেই ঝুলন্ত উলঙ্গ যুবতীদের কেউ এসে তাদের উলঙ্গ দেহের কোমরের মাংস বেটন দিয়ে উন্মক্তভাবে আঘাত করতে থাকতো, কেউ তাদের বক্ষের স্তন কেটে নিয়ে যেতো, কেউ হাসতে হাসতে তাদের যৌনপথে লাঠি ঢুকিয়ে আনন্দ উপভোগ করতো। কেউ ধারালো চাকু দিয়ে কোনো যুবতীর পাছার মাংস আস্তে আস্তে কেটে কেটে আনন্দ করতো। কেউ উঁচু চেয়ারে দাঁড়িয়ে উন্মুক্ত বক্ষ স্তন মুখ লাগিয়ে ধারাল দাঁত দিয়ে স্তনের মাংস তুলে নিয়ে আনন্দে অট্টহাসি করতো। কোনো মেয়ে এসব অত্যাচারে কোনো প্রকার চিৎকার করার চেষ্টা করলে তার যৌনিপথ দিয়ে লোহার রড ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে তৎৰণাৎ হত্যা করা হতো। প্রতিটি মেয়ের হাত বাঁধা ছিল ও পেছন দিকে শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। অনেক সময় পাঞ্জাবী সেনারা সেখানে এসে সেই ঝুলন্ত উলঙ্গ মেয়েদের এলোপাতারি বেদম প্রহার করে যেতো।"
আমার আর কিছু বলার নেই, কেবল যারা নিজ দেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি উদাসীনতা প্রকাশ করে অন্য দেশের স্বাধীনতার জন্য লাফায়, যারা ইতিহাস না জেনে আরেক দেশের হত্যাকাণ্ডকে বড় করে দেখাতে নিজ দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করতে পারে তাদের জন্য একদলা থুথু
এটুকুতেই মাথা ঘুরাচ্ছে, অথচ এরকম হাজার হাজার আত্মত্যাগে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ! আফসুস, প্রজন্ম(!) তা জানে না, বা জানতে চায় না ।
©somewhere in net ltd.