নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সত্যবাক

অাবছার তৈয়বী

আবছার তৈয়বী

অাবছার তৈয়বী › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ ছিল না (দুই)

২৭ শে মার্চ, ২০১৬ ভোর ৬:০২

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’ ছিল না (দুই)
-আবছার তৈয়বী

‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্ম নিরপেক্ষতা ছিল না’ শিরোনামে লেখাটি লিখতে গিয়ে আমি স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক দলিল-পত্র এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাপূর্ব বেশ কিছু ইশতেহার, কর্মপরিকল্পনা, পুস্তিকা, ভাষণ ইত্যাদি দেখেছি। এসব ঘেঁটে আমি কোথাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র কথা পাইনি- সে কথা ১ম পর্বেই লিখেছি। কিন্তু আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত, বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণে, আওয়ামী লীগের প্রকাশনায়. মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন ঘোষণাপত্রে, স্বাধীনতার বিভিন্ন দলিল-পত্রে ঘুরে ফিরে আল্লাহর নাম এসেছে, মুক্তিযুদ্ধে সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাহায্য চাওয়া হয়েছে এবং আল্লাহর বান্দাদের মাঝে ন্যায়-বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং জনগণের মাঝে ইসলামী শিক্ষা ও নীতি-নৈতিকতা প্রচার-প্রসারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত আওয়ামীলীগের কোন নেতাই ‘ধর্ম নিরপেক্ষতা’র কথা কখনো বলেন নি; বরং ঘুরে ফিরে ইসলামের কথাই বলেছেন। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্মেলনে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনাব শামসুল হক ‘মূল দাবি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা পাঠ করেন। এতে সুস্পষ্ট করে বলা হয়, “রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর প্রতিভূ হিসেবে জনগণের ওপর ন্যস্ত থাকবে। গঠনতন্ত্র হবে নীতিতে ইসলামী, গণতান্ত্রিক ও আকারে রিপাবলিকান।” (বদরুদ্দীন ওমর, ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, পৃ. ২৪১) তাদের ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্রের ১নং ধারায় “দুনিয়ার মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন শক্তিশালী করার” কথা বলা হয়। গঠনতন্ত্রের ১০নং ধারায় বলা হয়: To disseminate true knowledge of Islam and its high morals and religious principles among the people. অর্থাৎ ‘জনগণের মধ্যে ইসলামের প্রকৃত জ্ঞান, তার উচ্চ নৈতিক শিক্ষা ও ধর্মীয় নীতিমালার বিস্তার করা’।

’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট (যার প্রধান শরীক দল ছিল আওয়ামী লীগ এবং অন্যতম শরীক দল ছিল নেজামে ইসলাম পার্টি) নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। যুক্তফ্রন্ট-এর ২১ দফা কর্মসূচির মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়: “কোরআন-সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ কোনো আইন প্রণয়ন করা হবে না এবং ইসলামী সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকদের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা হবে। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, ১ম খন্ড, ৩৭০ পৃ.)
১৯৫৫ সালের মে মাসে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর পক্ষ হতে যে সাংগঠনিক প্রচারপত্র বের হয়- তাতে ১৭ ও ১৮ নং দাবি ছিল: “১৭। মদ, গাঁজা, ভাং, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি হারাম কাজ আইন করিয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করিতে হইবে। ১৮। মুসলমানগণ যাহাতে নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি শরীয়তসম্মত কাজে অবহেলা না করেন এবং সকল শ্রেণীর নাগরিকগণের চরিত্র গঠনের জন্যে প্রচার (তাবলীগ) বিভাগ খুলিতে হইবে। হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর জন্যেও অনুরূপ ব্যবস্থা করিতে হইবে।” (ঐ, পৃ. ৪১৮-৪২০)

১৯৬৬ সালে তদানিন্তন আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা পেশ করেন। পরবর্তীতে এই ৬ দফাই বাংলাদেশ আন্দোলনকে বেগবান করে। মূলতঃ বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবিত ৬ দফাই ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি। সে ৬ দফা ছিল কতিপয় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দাবি। 'মূলতঃ ৬ দফা ছিল চরম বৈষমের শিকার একটি মজলুম জনগোষ্ঠীর পক্ষে কায়েমী স্বার্থবাদী পাকিস্তানী গোঁয়াড় শাসকদের গালে একটি জবরদস্ত চপেটাঘাত'। আর সমগ্র বাঙালি জাতির পক্ষে আইনের ভেতরে থেকেই সেই চপেটাঘাতটি মেরেছিলেন বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। পাকিস্তানীরা আমাদের কীভাবে শোষন করেছিল তা এক নজরে দেখুন। অর্থনৈতিক বৈষম্যের একটি পরিসংখ্যান এখানে দেওয়া হল:
বছর প. পা. ব্যয় (কোটি) প. পা. ব্যয় (শতাংশ) পূ. পা. ব্যয় (কোটি) পূ. পা. ব্যয় (শতাংশ)
১৯৫০-৫৫ ১,১২৯ ৬৮.৩১ ৫২৪ ৩১.৬৯
১৯৫৫-৬০ ১,৬৫৫ ৭৫.৯৫ ৫২৪ ২৪.০৫
১৯৬০-৬৫ ৩,৩৫৫ ৭০.৫ ১,৪০৪ ২৯.৫০
১৯৬৫-৭০ ৫,১৯৫ ৭০.৮২ ২,১৪১ ২৯.১৮
মোট ১১,৩৩৪ ৭১.১৬ ৪,৫৯৩ ২৮.৮৪

Source: Reports of the Advisory Panels for the Fourth Five Year Plan 1970-75, Vol. I, published by the planning commission of Pakistan (quick reference: crore = 107, or 10 million)

মূলতঃ মহান মুক্তিযু্দ্ধের মূল চেতনা ছিল- ‘অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান’। (আরো চেতনা চিল যা আমরা পরবর্তীতে আলোচনা করবো) কিন্তু এই ঐতিহাসিক ৬ দফায় ধর্মনিরপেক্ষতার কথা ছিল না। বরং ১ম দফাটি ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি। ১৯৬৯ সালের আইয়ুববিরোধী ছাত্র-গণআন্দোলনে ছাত্রসমাজের ১১ দফা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উক্ত ১১ দফায় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ‘ধর্মনিরপেক্ষতার’ কথা কোথাও বলা হয়নি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পরিষ্কার ঘোষণা দেয়া হয়। যে, “কোরআন সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করা হবে না।” নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করার পর তাদের সংবিধান কমিটি (ড. কামাল হোসেন যার চেয়ারম্যান ছিলেন) কর্তৃক প্রণীত খসড়া সংবিধানের প্রস্তাবনায় তদানীন্তন “পাকিস্তানের মুসলমানদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে গড়ে তোলার” কথা স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছিল। (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র, ২য় খন্ড, সংযোজন১, পৃ. ৭৯৩)। সেই খসড়া সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে নিম্মোক্ত বিষয়গুলো সন্নিবেশিত হয়েছিল : ১) কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন পাস করা হবে না, (২) কোরআন ও ইসলামিয়াত শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে, (৩) মুসলমানদের মধ্যে ইসলামী নৈতিকতা উন্নয়নের পদক্ষেপ নেয়া হবে।” (ঐ, ২য় খ-, পৃ. ৭৯৪)।

কাজেই এ কথা স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগের জন্ম থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জনগণের সামনে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের কোনো প্রস্তাব বা কর্মসূচি পেশ করা হয়নি। বরং বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন ভাষায় জনগণকে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর কুশাসন ও আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন মূলতঃ ইসলামের বিরুদ্ধে কোনো কিছু নয়; বরং তারা ক্ষমতায় গেলে কোরআন সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন পাস করবেন না। তারা কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জনগণের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনকেও গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেবেন বলে ঘোষণা দেয়া হয়। যা বর্তমান আওয়ামীলীগ সভানেত্রী, বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটি নির্বাচনের আগেই বলে থাকেন। তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা' বলে চালিয়ে দেয়া শুধু নির্জলা মিথ্যাচারই নয়; বরং বাংলাদেশের ষোলকোটি মানুষের সাথে নির্মম এক প্রতারণা। (চলবে- ইনশাঅাল্লাহ্)।

তারিখ: ২৬ মার্চ, ২০১৬ খৃ.
আবুধাবি, ইউ.এ.ই।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.