![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নববর্ষের ভাবনা- (এক)
মঙ্গল শোভাযাত্রায় 'মঙ্গল' নেই
-আবছার তৈয়বী
বাংলা বর্ষবরণ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গের একটি হচ্ছে- 'মঙ্গল শোভাযাত্রা'। কিন্তু এ মঙ্গল শোভাযাত্রায় মোটেও 'মঙ্গল' নেই। তাহলে কী আছে? দলাদলি আছে। ঢলাঢলি আছে। ঢোলাঢোলি আছে। ঢুলাঢুলি আছে। দোলাদুলি আছে। হুড়োহুড়ি আছে। ঠেলাঠেলি আছে। ঘোরাঘুরি আছে। টোকাটুকি আছে। ধাক্কাধাক্কি আছে। চাপাচাপি আছে। নাচানাচি আছে। দাপাদাপি আছে। চাপাবাজি আছে। ঘেঁষাঘেষি আছে। রেষারেষি আছে। মেশামেশি আছে। রঙ-চঙ আছে। রঙ-ঢঙ আছে। ঢঙ-মশকরা আছে। রং-তামাশা আছে। হাতাহাতি আছে। হাতি আছে। ঘোড়া আছে। গাধা আছে। কুমির আছে। হাঁস আছে। মাছ আছে। সাপ আছে। পেঁচক আছে। ময়ুর আছে। কুকুর আছে। বিড়াল আছে। ইঁদুর আছে। সিংহ আছে। বাঘ আছে। ভল্লুক আছে। রাক্ষস আছে। খোক্ষস আছে। ভুত আছে। পেত্মী আছে। মুর্তি আছে। মুর্তির মুখোশ আছে। তালপাতার পাখা আছে। বাঁশরী আছে। ঢোলক আছে। একতার আছে। দোতরা আছে। দশহাতি দেবী দুর্গা আছে। কুমারী পুঁজার জলজ্যান্ত কুমারী আছে।
নেই কী? গরু, ছাগল ও মুরগি নেই। (এই তিনটি উপকারী হালাল প্রাণী কী দোষ করলো- অাল্লাহ-রাসূল মালুম)। নীতি-নৈতিকতা নেই। দেশাত্মবোধ নেই। দেশীয় সংস্কৃতির লালন নেই, পালন নেই, ধারণ নেই এবং প্রদর্শন নেই। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনাচার নেই। বাংলার কৃষক-কিষানীর সাথে একাত্মতা নেই। বাংলার কামার-কুমারের প্রতি মমত্ববোধ নেই। বাংলার জেলে-তাঁতীর কথা নেই। বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীর ন্যায্য দাবি-দাওয়ার স্লোগান নেই। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ বেকার যুবক-যুবতীর কথা নেই। দেশ ও জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ নেই। নাহ্, মঙ্গল শোভাযাত্রায় কোন 'মঙ্গল'ই নেই।
তাহলে কেন এই মঙ্গল শোভাযাত্রা? এই মঙ্গল শোভাযাত্রা- 'অমঙ্গলের জন্য'। অমঙ্গলটা কী? অমঙ্গলটা হলো- অপসংস্কৃতিকে জনমানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। অমঙ্গলটা হলো- দেশীয় সংস্কৃতিকে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করা। অমঙ্গলটা হলো- ভিনদেশী সংস্কৃতিকে দেশীয় সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়া। অমঙ্গলটা হলো- ভিনধর্মের সংস্কৃতিকে বাংলাদেশের জনমানুষের মনে পেরেক দিয়ে গেঁথে দেয়া। অমঙ্গলটা হলো- হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো। অমঙ্গলটা হলো- বাংলার সাম্য, মৈত্রী ও সংহতির গালে চপেটাঘাত করা। অমঙ্গলটা হলো- ধর্মীয় আবেগ, অনুভূতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে চিরতরে উৎখাত করা।
কে চালু করলো- মঙ্গল শোভাযাত্রা নামক এ অমঙ্গল যাত্রা? কবে থেকে শুরু হলো এ অপসংস্কৃতির সয়লাব? বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা চালু হয়- ১৯৮৬ সালে, যশোরে। ‘চারুপীঠ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান এটির আয়োজন করে। কিন্তু তখন এটির নাম ছিল- 'আনন্দ শোভাযাত্রা'। সেই শোভাযাত্রার অন্যতম আয়োজক মাহবুব জামাল শামীম উচ্চতর ডিগ্রি নিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ভর্তি হন। সাথে নিয়ে আসেন এই শোভাযাত্রার সংস্কৃতি। ছড়িয়ে দেন সহাপাঠীদের মাঝে। গ্রাম্য এ অনুষ্ঠানটি পেয়ে গেলো- জাতীয় পর্যায়ে প্রসারিত ও পল্লবিত হবার সুযোগ। তারপর ঢাকা থেকে ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সাল থেকে শুরু হয়েছিল মঙ্গল শোভাযাত্রা। সে বছরই লোকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়- এই আনন্দ শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে এই আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে প্রথম বারের মতো। শোভাযাত্রায় থাকে- বিশালকায় চারুকর্ম পাপেট, হাতি ও ঘোড়াসহ নানা প্রাণী ও দেব-দেবীর 'মুখ ও মুখোশ' এবং ব্যাঙ্গাত্মক, রঙাত্মত ও ধ্বংসাত্মক বিচিত্র সব সাজ-সজ্জা। থাকে বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য। বাংলার যুবতী মেয়েরা রাস্তায় রাস্তায় নাচে। হাটে-মাঠে নাচে। খালি পায়ে নাচে। পায়ে নূপুর পড়ে নাচে। কোমর দুলিয়ে নাচে। মাথা হেলিয়ে নাচে। পেট দেখিয়ে নাচে। বুক উঁচিয়ে নাচে। মুখ বেঁকিয়ে নাচে। পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে 'আনন্দ শোভাযাত্রা' শুরু থেকেই জনপ্রিয়তা পেয়ে যায়। তারপরের বছরও চারুকলার সামনে থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়। সে বছর 'চারুশিল্পী সংসদ' নববর্ষের সকালে চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে বর্ণাঢ্য আনন্দ মিছিল বের করে। কিন্তু শুরু থেকেই চারুকলার শোভাযাত্রাটির নাম 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' ছিল না। সংবাদপত্র থেকে যতোটা ধারণা পাওয়া যায়, ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হিসেবে নাম লাভ করে।
১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি এবং নানা ধরণের মুখ ও মুখোশ। ১৯৯০ এর আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের মূর্তি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীগণসহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম, মুখোশ এবং যথারীতি মূর্তি। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে-গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ সালের আনন্দ শোভাযাত্রার সম্মুখে রঙ-বেরঙয়ের পোশাক পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। বাঁশ এবং বহু বর্ণের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি। ১৯৯৩ সালে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, পেঁচা ও বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। চারুকলার সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় দিয়ে শিশু একাডেমি হয়ে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়। প্রতিটি শোভাযাত্রার মূল আর্কষণ- নানা প্রাণী ও মানুষের মূর্তি ও মুখোশ। যা চালাক ভিন সংস্কৃতির ধারক-বাহকরা শিল্পকর্ম হিসেবে চালিয়ে দেয়।
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বর্তমানে এক অপ্রতিরোধ্য গতি পেয়েছে। ধর্মীয় পণ্ডিতদের এ নিয়ে কোন কথা বলতে আমি শুনিনি। জুমার খোতবায়ও খতিবরা বয়ান রাখেন না। মন্দিরে, কেয়াংয়ে এবং গীর্জায়ও না। যারা ঈদে মিলাদুন্নলরীর (দরুদ) জুলুস বা আনন্দ-মিছিলকে নাজায়েয ও হারাম ফতোয়া দিয়ে থাকে, তারাও এই ভিনদেশী ও ভিনধর্মী 'মঙ্গল শোভাযাত্রা' দেখে মুখে কুলূপ এঁটে থাকে। না, ভুল বললাম। তারা মুচকি মুচকি হাসে। বর্তমানে এই শোভাযাত্রা প্রতিহত করার শক্তি বাংলাদেশে কারো নেই। যদি না সরকারি নিষেধাজ্ঞা বা জনসচেতনতা তৈরী করা যায়। আমি শুধু বাংলাদেশের জনগণকে অনুরোধ জানাবো- প্রিয় ভাই, বোন ও বন্ধুগণ! তোমরা ভিনদেশী ও ভিনধর্মী এই অনুষ্ঠান বর্জন করো। চিন্তা করে দেখো- ১৯৮৬ সালের আগে কি আমরা বাঙালি ছিলাম না?! চলো প্রাণভরে বাংলার ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, মাইজভাণ্ডারী গান শুনি। চলো গাই- রবীন্দ্র, নজরুল, লালন, হাছন, রমেশ, আব্বাস, আলিম ও আবদুল করিমের গান। যে গুলোতে বাঙালিত্বের গন্ধ পাওয়া যায়। যেগুলোতে বাংলার কথা আছে, বাঙালির কথা আছে। যা শুনলে ও গাইলে মনে হয়- '....একদিন বাঙালি ছিলাম রে'।
ওরে বাঙালি মুসলিম, বাঙালি হিন্দু, বাঙালি বৌদ্ধ ও বাঙালি খৃষ্টান! চলো- পহেলা বৈশাখে আমরা ফিরে যাই আমাদের গ্রামে। বিশ্বাস করো- বাংলার মেঠো পথ তোমার পদধুলির জন্য তড়পাচ্ছে। বাংলার ছায়াঢাকা মায়াঘেরা গ্রাম তোমায় স্বাগত জানাতে অপরূপ সাজে সেজেছে। বাংলার পাখ-পাখালি তোমায় পেয়ে অানন্দে মধুর সুরে গান গাইবে। যারা রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের অন্নের সংস্থান করে, চলো অন্ততঃ একদিনের জন্য হলেও তাদের পাশে দাঁড়াই। তাদের আদর-আপ্যায়নে মনে-প্রাণে বাঙালি হই। বাংলাদেশের কৃষক- কিষানী, জেলে- তাঁতী, কামার-কুমার, গাছি, কাঠুরিয়া, রাখাল ইত্যাদি পেশার জনগণের সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করি। তারাই আসল বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। তাদের সততা, সরলতা, আতিথেয়তা ও পরমত সহিষ্ণুতায় নিজেদের জীবন রাঙাই। সুস্থ বিনোদন, দেশাত্মবোধ, শিষ্টাচার, সাম্য, মৈত্রী ও সংহতির সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত হই। চলো- পদ্মা, মেঘনা, যমূনা, কর্ণফুলি, ধলেশ্বরী, সুরমা, কুশিয়ারা, করতোয়া, গোমতী, ব্রহ্মপূত্র ও বুড়িগঙ্গার পাড়ে যাই। চলো- বাংলার রূপ দেখি। বাঙালির মহত্ব দেখি। বাংলার মায়েদের মমত্ব দেখি আর বাংলাদেশকে ভালোবাসি।
তারিখ: ১২ এপ্রিল, ২০১৬ খৃ.
আবুধাবি, ইউ.এ.ই।
©somewhere in net ltd.