![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার বন্ধু ওমর (Name”02) গতবছর ১৫ জুলাই সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ পর তার বউ এবং বাচ্চার আসার টিকেট করা ছিলো। তাদের আর আসা হয়নি। মাঝখান থেকে আমাদের বন্ধুকে কবরে শুইয়ে আসতে হয়েছে। আমি নিয়তি বিশ্বাসী মানুষ নই, এই মৃত্যুর জন্যে অংশত তার সুপারভাইসরকে দায়ী করি। ওমরের সুপারভাইসর তাঁকে আমেরিকা চলে আসলেই ফান্ড দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো। কিন্তু আসার পর নানা ওজুহাতে কখনই তার জন্যে কোন ফান্ডের ব্যবস্থা করেনি। ওমর দেশে থাকতে খুব ভালো বেতনের চাকরি করতো। হাতে বেশ কিছু টাকা নিয়েই সে এসেছিলো। কিন্তু বাংলাদেশের চাকুরিজীবির সঞ্চয় দিয়ে আসলে আমেরিকাতে চলা সম্ভব না। দেশে বউ বাচ্চা রেখে এসেছে। তাদের আনতে হবে। এখানে এসে সে পাগলের মত কাজ খুঁজে বেড়াতো। দুই বছর ফান্ড না পেয়েই বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে অনেক কস্টে চালিয়ে নিয়েছে। অবশেষে একটা চাকুরী খুঁজে পেলো। পরের সেমিস্টারে গ্রাজুয়েশন করবে মোটামুটি নিশ্চিত। ও CPT (আমেরিকাতে কাজ করার অনুমতি) নিয়ে কাজ শুরু করলো। যে সুপারভাইসর দুই বছর ধরে ওকে কোন ফান্ড দেয়নি, সে বাগড়া বাঁধিয়ে দিলো। এতদিন ধরে সে ওমরকে দিয়ে ফ্রি কাজ করাতো। সে বলল, গ্রাজুয়েশন এখন করা যাবেনা। শুধু তাই না, নিজে ইন্টারন্যাশ্নাল স্টুডেন্ট অফিসে যোগাযোগ করে ওমরের CPT বাতিল করালো। ওমর চাকরি পেয়ে নতুন বাসা ভাড়া নিয়েছিলো, বউ বাচ্চার টিকেট করেছিলো। চাকরি নিয়ে ঝামেলা হওয়াই দিশেহারা হয়ে পড়লো। এতো খরচ কোথা থেকে আসবে? দুরঘটনার আগে আমরা সবসময়ই ওকে খুব অস্থির দেখতাম। আমার কাছে মাঝে মাঝে কিছু কিছু শেয়ার করতো। তারপর একদিন সব অস্থিরতার অনেক উরধে চলে গেলো। মৃত্যুর পর ভার্সিটি তাঁকে মরণোত্তর ডিগ্রি প্রদান করলো। ওর যে ডিগ্রির জন্যে প্রয়োজনীয় সবকিছু হয়ে গিয়েছিলো, সেটাও প্রমাণিত হল। আমার বিশ্বাস, এই ডিগ্রির ব্যবস্থাও তার সুপারভাইসর করেছে কেসের ভয়ে।
কয়েকদিন আগে ওমরের সুপারভাইসরের কাছেই আরও একজন বুএটিয়ান একই ধরণের আশ্বাস পেয়ে বউসহ চলে এসেছে। আমি জানিনা তার জন্যে কি অপেক্ষা করছে। জানিনা, তারও কোনদিন ফান্ড হবে কিনা। এই খবর পেয়েই আমি এই লেখাটা লিখবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। যে ছেলেটা আজ কোন খোঁজ খবর না নিয়েই একটা প্রতিশ্রুতির উপর ভরসা করে চলে আসলো, সে কিন্তু নিউ অরলিন্সের বর্তমান বুএটিয়ান্দের সাথে একবার যোগাযোগ করলেই সব জানতে পারতো। ঝুঁকি যদি নিতেই চান, সেটাও তো জেনে বুঝে নেয়াই ভালো, তাইনা?
আমেরিকাতে আসতে হলে কয়েকটা ব্যাপার খুব মাথায় রাখতে হবে। যেমন, ১।সুপারভাইসর, ২। যে স্টেটে যাচ্ছেন, সেখানে আপনার বিসয়ের চাকরি কেমন আছে, ৩। স্কুলের র্যাঙ্ক (এইটা PhD র জন্যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে আপনি যদি একাডেমিতে ক্যারিয়ার করতে চান) ৪। আপনার ডিগ্রি STEM এর অন্তর্ভুক্ত কিনা, ইত্যাদি। যদি আপনি কোন কাজে দারুণ দক্ষ হন, বিশেষ করে যদি খুব ভালো প্রোগ্রামার হন – আপনার জন্যে আসলে আমেরিকাতে কোন কিছুই তেমন বাঁধা নয়। যদি সেটা সত্যি না হয় তবে অনেক কিছুই অনেক বড় ব্যাপার।
১। সুপারভাইসর হচ্ছে single most critical factor. একজন ভালো সুপারভাইসরের কয়েকটা গুনঃ ১। তিনি তার ছাত্রছাত্রীদের ক্যারিয়ারের ব্যাপারে সচেতন, ২। তাঁর চাকরি ম্যানেজ করে দেয়ার মত নেটওয়ার্ক এবং ইচ্ছা আছে, ৩। তার রিসার্চ এরিয়া আধুনিক এবং চাকুরীর ক্ষেত্রে তার চাহিদা আছে, ৪। তার যথেষ্ট ফান্ড আছে, ৫। আপনার কাছ থেকে তার প্রত্যাশা যৌক্তিক – অর্থাৎ তিনি এমন কিছু আশা করেননা, যা অনেক খাটুনির পরও অর্জন করা সম্ভব না, এবং ৬। ব্যবস্থাপনার দক্ষতা – যেটা আপনাকে আপনার সামর্থ্যের সরবোচ্চ অর্জনে সাহায্য করবে এবং আপনাকে কাজে অনুপ্রেরণা দিবে।
একজন সুপারভাইসর সম্পর্কে জানার কয়েকটা উপায় - তার সাথে কাজ করেছে এরকম কয়েকজনের সাথে কথা বলে, তার ল্যাব থেকে আগের শিক্ষার্থীরা কে কোথায় গিয়েছে সেটা জানার চেস্টা করা, তার ফান্ডের অবস্থা কেমন সেটাও জানার চেস্টা করা। অনেক সময় ভালো সুপারভাইসরদের ওয়েব পেইজেই এইসব অনেক তথ্য থাকে। যদি সরাসরি কাউকে না পাওয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগের বুএটিয়ান/বাংলাদেশিদের কাছ থেকেও খবর নেয়ার চেস্টা করা যায়। সব ক্ষেত্রে এইটা সম্ভব হয়না। ওমরের সুপারভাইসরের কাছে আসা ০৮ ব্যাচের ঐ ছেলের জন্যে যেটা খুবই সহজ ছিলো। সুপারভাইসর ভালো না হলে জীবন কিন্তু দোজখ হয়ে যাবে।
২। অনেক সময় এক স্টেট থেকে অন্য স্টেটের চাকরিতে আবেদন করলে ডাক পাওয়া যায়না। কারণ, আমেরিকাতে ভিন্ন স্টেট থেকে কাউকে রিক্রুট করতে রিলোকেশনের জন্যে অনেক টাকা দিতে হয়। ছোটো কোম্পানিগুলো এটা করতে চায়না। সুতরাং, যে স্টেটে যাচ্ছেন, সেখানে আপনার বিসয়ের চাহিদা কেমন, জেনে যাওয়াই ভালো। যে কয়টা চাকরির বিজ্ঞাপন থাকে তার বড়জোর ১০-২০% আমাদের মত ইন্টারন্যাশনালদের ভাইভাতে ডাকে। তাদের মধ্যে একটা অংশ আবার অন্য স্টেট থেকে ডাকেনা। তবে ২ নম্বরে লিখলেও এইটা দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না।
৩। আপনি যদি PhD করে শিক্ষকতা এবং গবেষণা করতে চান, তাহলে ইশকুলের র্যাঙ্ককে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। খারাপ র্যাঙ্কের ইশকুল থেকে PhD করে ভালো জায়গায় ফ্যাকাল্টি হওয়া প্রায় অসম্ভব। বিভিন্ন ভালো ইশকুলের ফ্যাকাল্টিদের সিভি দেখলেই এই ব্যাপারে আইডিয়া পেয়ে যাবেন। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, এই ক্ষেত্রে আপনার সুপারভাইসরের রেকমেন্ডেশন সবচেয়ে বেশি কাজে লাগবে। আমেরিকাতে র্যাঙ্ক ভালো মনে হচ্ছে, সেখানে রিসার্চ ভালো হয়। রিসার্চ ভালো হয় মানে হচ্ছে সেখানকার ফ্যাকাল্টিদের কোলাবরেশন ভালো, ফান্ডের অবস্থা ভালো, তাদেরকে অন্যেরা চিনে। সুতরাং তাদের রেকমেন্ডেশন অনেক শক্তিশালি হবে। একজন প্রভাবশালী সুপারভাইসর তেমন কোন কাজ না থাকলেও তার ল্যাবের ছাত্রছাত্রীদের জন্যে অনেক ভালো চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। শুধুমাত্র ভালো কাজ দিয়ে বা ভালো পাব্লিকেশন দিয়ে ভালো জায়গায় ফ্যাকাল্টি পজিশন পাওয়া প্রায় অসম্ভব। আর ভালো জায়গায় ফ্যাকাল্টি না হতে পারলে, পরবর্তী জীবনে কপালে অনেক দুঃখ আছে। কারণ আমেরিকাতে ফ্যাকাল্টি পজিশনে স্থায়ী ( tenured) হতে গেলে আপনাকে অনেক ফান্ড ম্যানেজ করতে হবে। সেটা করতে গেলে আপনাকে ভালো PhD student পেতে হবে – একার কাজে হবেনা। ইশকুল ভালো না হলে ভালো ছাত্র পাওয়ার সম্ভাবনা কম। সুতরাং আপনি মোটামুটি একটা দারিদ্রের দুষ্ট চক্রে পড়ে গেলেন।
৪। আমেরিকাতে একজন শিক্ষার্থী পাশ করার পর প্রথমে ১ বছরের কাজ করার অনুমতি পায়। একে OPT বলে। আপনার ডিগ্রি যদি STEM হয়, তবে বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী আপনি যদি একটা যোগ্য অর্থাৎ e-verified কোম্পানিতে কাজ করেন, তবে আরও ২ বছরের কাজ করার অনুমতি পাবেন। STEM ডিগ্রির মানে হচ্ছে science, technology, engineering and math degree. বুয়েটের অনেকেই অনেক প্রোগ্রামে আসেন, যেগুলো STEM না। URP এবং IPE, এই দুই বিভাগের জন্যেই এটা বেশি প্রযোজ্য। যারা STEM প্রোগ্রামে আস্লেন্না, তারা মাত্র ১ বছরের কাজের অনুমতি পাবেন। এই সময়ের মধ্যে আমেরিকাতে সেটল হওয়ার পরবর্তী ধাপ, অর্থাৎ H1B পাওয়া এখনকার বাস্তবতায় প্রায় অসম্ভব। H1B বছরে একবার দেয়া হয়, লটারির মাধ্যমে। লটারিতে টেকার সম্ভাবনা ৩৪%এর মত। আর H1B তে আপনি চাইলেই এপ্লাই করতে পারবেন্না। এটা করতে হবে আপনার কোম্পানির মাধ্যমে। সুতরাং এখানে টিকে থাকতে আপনার পরবর্তীতে PhD প্রোগ্রামে ঢুকে পড়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। আর দয়া করে PhD কে স্রেফ একটা ডিগ্রি ভাব্বেন্না। PhD করার জন্যে যে ধরণের মানসিক প্রস্তুতি বা লক্ষ্য থাকা দরকার, তা না থাকলে এটা করার কোন মানেই হয়না। আমি আবারো বলছি, কোন মানেই হয়না। কোনই মুল্য নেই।
মনে রাখবেন, ক্যারিয়ারের জন্যে জীবন নয়, জীবনের জন্যে ক্যারিয়ার। আর আমেরিকা আসাই জীবনের সার্থকতা নয়। এখানে যে পরিশ্রম করতে হয়, তা দেশে বসে করলে বুয়েটের কেউ খারাপ থাকেনা। টাকা উপার্জন, সামাজিক সম্মান কিংবা বড় পদ যদি লক্ষ্য হয় – দেশই অনেক ক্ষেত্রে ভালো। আবার আমেরিকা আপনাকে যেখানে নিয়ে যেতে পারবে, বিশেষ করে রিসার্চে যারা ক্যারিয়ার করতে চান, তাদের পক্ষে দেশে বসে তার কানাকড়িও করা সম্ভব না। সুতরাং কি করতে চান, জেনে বুঝে সিদ্ধান্ত নিন। আর হ্যাঁ, অবশ্যই তাড়াহুড়া করবেন্না। সময় নিন। এখানে যারা আছেন, তাদের সাথে যোগাযোগ করে জেনে বুঝে তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
এই লেখা আমার একান্তই ব্যক্তিগত মতামত। আমার চেয়ে অনেক অভিজ্ঞ অনেকেই এখানে আছেন। তারা আরও ভালো দিক নির্দেশনা দিতে পারেন, ত্রুটি ধরিয়ে দিতে পারেন, নতুন বিষয় নিয়ে আসতে পারেন, যা আমার না জানার কারণে কিংবা পোস্ট যতটা সম্ভব ছোট রাখার স্বার্থে এখানে আলোচনা করিনি। আমার এই দীর্ঘ লেখা যদি একজন বুএটিয়ানের জন্যেও কিছুটা উপকার বয়ে আনে, তবেই এটাকে সারথক ভাববো।
#সোহান_০২
©somewhere in net ltd.